শুক্রবার, এপ্রিল ১৪, ২০১৭

মুণ্ডচ্ছেদের রাজনীতি আজ তুঙ্গে

লিখেছেন :  পাপ্পন দাস

মুণ্ডচ্ছেদের রাজনীতি প্রসঙ্গে সেদিন ফেসবুকে একটা স্টেটাস আপডেট করি।লিখেছিলাম,'বিজেপির এক যুব নেতা বলেছেন,
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শয়তান,এবং তাই তাঁর মাথার দাম ১১ লক্ষ টাকা।অবশ্য সংসদের উভয় সদনে যখন এই বিষয়টা তোলে ধরা হয়,তখন সবাই এর নিন্দা করেন।বিজেপির তরফ থেকে তো বলেই দেওয়া হয়েছে,চাইলে অভিযুক্ত সেই নেতার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
     এবার নয়া সংযোজন হলেন টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম 'নূর রহমান বরকতি'।যিনি বিজেপির সেই নেতা যোগেশের মাথার দাম ২২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করলেন।তিনি বললেন,যে লোকটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথার দাম ধার্য করেছে,তার মাথা কেটে আনলে আমি ২২ লক্ষ টাকা দেবো।ভালো,খুব ভালো,খুব খুব ভালো।হুমকির পাল্টা হুমকি তো একেই বলে।মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার
(ইমাম) বোনের মতো।তাই তাঁর(মমতা) মাথার দাম যে ধার্য করেছে,তার (যোগেশ) মাথার দাম ধার্য করা যেতেই পারে।
     কোনটা ঠিক,কোনটা বেঠিক, তা আমার জানা নেই।আদতে কী দু'টাই বেঠিক,তাও আমি বলতে পারছি না।জ্ঞানীজনেরা এই ব্যাপারে নিজেদের মত দেবেন।কিন্তু আমার বক্তব্য হল,যোগেশ যা বলেছেন,তা অন্যায়।এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত,এবং তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।আর আমি যতটুকু দেখতে পাচ্ছি,সবাই এর প্রতিবাদ করছেন।কেউ কেউ এর প্রতিবাদস্বরূপ কোনো কবিতা লিখেছেন কি না,তা আমার জানা নেই।তবে চাইলে লিখতেই পারেন।কিন্তু ইমামের বক্তব্যের প্রতিবাদ কেন কেউ করছেন না।ইমাম কী সঠিক কথা বলেছেন?তাছাড়া এসব ইসলামের ধ্বজাধারী ইমামরা তো প্রায়ই ফতোয়া টতোয়া জারি করে থাকেন।এদের বিরুদ্ধে কেন কেউ মাঠে নামেন না?কেন কড়া ভাষার এদের নিন্দা করেন না?কেন এদের প্রতিবাদস্বরূপ দু-চারটে কবিতা বেরিয়ে আসে না?'
    প্রবান্ধিক অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় দুটি লিংক শেয়ার করেন।যার মাধ্যমে আমার কিছু ভুলভ্রান্তি দূর হয়।
    মহম্মদ জিম নায়াজ লেখেন,'পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা ব্যানার্জীর মাথার দাম ১১লাখ টাকা ধার্য করেছেন বিজেপির যুবমোর্চা নেতা। পাল্টা, টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বরকতী, সেই বিজেপির যুবমোর্চা নেতার মাথার দাম দ্বিগুণ অর্থাৎ ২২লাখ টাকা ধার্য করেছেন।তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়াল? মমতার মাথার দাম ধার্যকারী যুবমোর্চা নেতা যদি শয়তান হয়ে থাকেন, সেই একইযুক্তিতে বরকতী প্রমাণ করলেন- তিনি দ্বিগুণ শয়তান।
   গতকাল, একটি লাইভ টিভি ডিবেটে এই শয়তান বরকতী নাকি এক বিজেপি নেতাকে 'বানচোদ' বলে খিস্তি দিয়েছেন। একজন বেতনভুক ইমাম হয়েও তিনি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে ওপেন লাইভ টিভি ডিবেটে খিস্তি করছেন, ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফতোয়া দিয়ে যাচ্ছেন। এতকিছুর পরেও মুসলিমরা চুপ! মুসলিমরা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বরকতীকে টিপু সুলতান মসজিদ থেকে বের করতে পারছেন না! খারিজ করতে পারছেন না, তার ইমাম পদ।
  শুনলাম, পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত কানাডার নাগরিক আর এস এস-এর পোষ্টার বয় তারেক ফাতাহকে ভারত থেকে বিতাড়নের জন্য ইমাম বরকতী নাকি ধর্মতলায় সভার ডাক দিয়েছেন। বাংলার বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে তারেক ফাতাহ কি কোনও প্রাসঙ্গিক ব্যক্তি! তাকে বিতাড়নের জন্য ধর্মতলায় সভার ডাক! অহেতুক তাকে ফুটেজ দেওয়ার অর্থ কি?বলি, বরকতীর ডাকা সভা মুসলিমরা বয়কট না করে বরং দলে দলে যোগদান করুন। তবে হ্যাঁ, প্রত্যেকে ব্যাগে ছেঁড়া জুতো নিয়ে যেতে ভুলবেন না। বাংলার বুকে তারেক ফাতাহ-র মত একজন অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তিকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য বরকতী যে সভার ডাক দিয়েছেন, সেই সভার মঞ্চে বরকতীকে লক্ষ্য করে ছেঁড়া জুতো ছুড়ে মারুন। সুযোগ পেলে মঞ্চে উঠে বরকতীকে জুতো পেটা করুন। প্রতিদানে টাকা না মিললেও অসংখ্য মুসলিমের দোয়া মিলবে নিশ্চিত।'
     তার সেই স্টেটাসের পক্ষে এবং বিপক্ষে প্রচুর মত আসে। এ দেশে পাগলের সংখ্যা বাড়ছে,না অরাজকতা কায়েম হচ্ছে,এ নিয়ে স্বাভাবিক কারণে সাধারণ মানুষের মনে দুশ্চিন্তার শেষ নেই।আর দুশ্চিন্তা হওয়াই স্বাভাবিক।প্রতিদিনই এমন কিছু পাগল জন্ম নিচ্ছেন,যাদের হাত ধরে সারা দেশে একটা বিশ্রী বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে।মনে হচ্ছে আর খুব বেশিদিন নেই এ দেশে অরাজকতা কায়েম হতে।বস্তুত গুটি গুটি পায়ে তা হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে।আর এমন কিছু সাধারণ মানুষ আছেন যারা এর স্বপক্ষে যুক্তিও তুলে ধরছেন।কেউ কেউ বলছেন, খুনের হুমকি এটা চরম ধিক্কারজনক এটা একবাক্যে মেনে নিতে হয়।কিন্তু যারা বঙ্গ থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত প্রতিবাদে গলা ফাটাচ্ছেন এরা পক্ষপাতিত্ব শয়তান। এই জেহাদি ইমাম বকরতি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিরুদ্ধে ফঁতোয়া দেয়, চুল দাড়ি কামিয়ে মুখে চুনকালি মাখিয়ে মাথা নিয়ে আসলে ২৫লক্ষ টাকা দেবে, বঙ্গ বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষকে যখন পাথর ছোঁড়ার নিদান দেয়, তখন কেন বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদীরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন?
      এদিকে, আমরা যে পাগলের দেশে বসবাস করছি তার প্রমাণ হল,মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন তাঁর মুণ্ডচ্ছেদের হুমকি দানকারীকে 'পাগল' বলে আখ্যায়িত করেন,তখন একে আমরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে রাজি নই।কেন তিনি এরকম বলেছেন,তিনি এরকম বলতে পারেন না,তাঁর এরকম বলাটা গুরুতর অন্যায়--এরকম বাক্যবাণে তাঁকে জর্জরিত করি।আর এই যে মুণ্ডচ্ছেদের রাজনীতি,
তা কিন্তু নতুন কিছু নয়,ভারতে এরকম আগেও প্রচুর ঘোষণা হয়েছে,এ নিয়ে প্রচুর রাজনীতি হয়েছে।কিন্তু আজকাল যেন তা এক অন্য মাত্রা পেয়েছে।কিছুদিন ধরেই একটি রাজনৈতিক শিবির থেকে অকাতরে বিভিন্ন রাজনীতিকের মুণ্ডচ্ছেদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।তারা এসব হুমকি দিতে মোটেও ভয় পাচ্ছেন না।যে কোনও প্রশ্নে মতভেদ হল,আর তারপরই এ ধরণের একটা হুমকি দেওয়া হল।তাও আবার প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে।আসলে আজকাল এ ধরণের হুমকি জলভাতে পরিণত হয়েছে।আর এ বিষয়ে প্রশাসন কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে,তাও কিন্তু আমাদের কাছে পরিস্কার নয়।কেরলের মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নের কথাই বলুন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলুন,তসলিমা নাসরিনের কথা বলুন,
তারেক ফাতাহর কথা বলুন,কিংবা রামমন্দিরের বিরোধিতা-
কারীদের কথাই বলুন---বার বারই কিন্তু মুণ্ডচ্ছেদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।কখনও তা আসছে গেরুয়া শিবিরের কোনও মহল থেকে,
কখনও আসছে অন্য কোনও মহল থেকে।আর তাইতো অনেকেই প্রশ্ন করছেন,আমাদের এই সুন্দর দেশ এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিভাবে আয়ত্ত করল?এ নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে উদ্বেগের শেষ নেই।আমারও বার বার প্রশ্ন করতে মন চায়,এই যে মুণ্ডচ্ছেদের হুমকিদাতারা,তারা এমন সাহসই বা কোথা থেকে জোগাড় করেন? যারা ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি করেন,বার বার যারা নৈতিকতার কথা বলে থাকেন,যারা চিৎকার করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইর কথা বলে থাকেন,কিভাবে তারা এত পাশবিক হন?আর এই প্রশ্ন কিন্তু শুধুমাত্র আমার নয়,শান্তি এবং মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী সারা দেশবাসীর।সবাই আমরা এর উত্তরের প্রতিক্ষায় বসে আছি।

কোন মন্তব্য নেই: