সোমবার, নভেম্বর ০৪, ২০১৩

অথসূর্যকথা : অনেক জানা,অনেক অজানাও

         লিখেছেন : সবজাণ্তা গোঁসাই
সূর্য : ব্যাস প্রায় ১৩ লক্ষ ৯২ হাজার কিলোমিটার
সৌরজগতের কেন্দ্রের খুব কাছে অবস্থিত তারাটির নাম। প্রায় আদর্শ গোলক আকৃতির এই তারা প্রধানত প্লাজমা তথা আয়নিত পদার্থ দিয়ে গঠিত যার মধ্যে জড়িয়ে আছে চৌম্বক ক্ষেত্র। এর ব্যাস প্রায় ১৩ লক্ষ ৯২ হাজার কিলোমিটার যা পৃথিবীর ব্যাসের ১০৯ গুণ, ভর প্রায় ২×১০৩০ কিলোগ্রাম তথা পৃথিবীর ভরের ৩ লক্ষ ৩০ হাজার গুণ। এই ভর সৌরজগতের মোট ভরের শতকরা ৯৯.৮৬ ভাগ। সূর্যের প্রধান গাঠনিক উপাদান হাইড্রোজেন, আসলে মোট ভরের তিন চতুর্থাংশই হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেনের পরেই সবচেয়ে প্রাচুর্য্যময় মৌল হিলিয়াম। হিলিয়ামের চেয়ে ভারী মৌল সূর্যের মাত্র ১.৬৯% ভরের জন্য দায়ী, তারপরও এদের সম্মিলিত ভর পৃথিবীর ভরের ৫,৬২৮ গুণ। এই ভারী মৌলগুলোর মধ্যে রয়েছে অক্সিজেন, কার্বন, নিয়ন, লোহা ইত্যাদি।

তারার শ্রেণীবিন্যাস করার একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে যা অনুসারে সূর্য জিটুভি (G2V) শ্রেণীর মধ্যে পড়ে। অনেক সময় একে হলদে বামন ডাকা হয় কারণ তার তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি বর্ণালীর হলুদ-সবুজ অংশে। সূর্যের রঙ সাদা হলেও ভূপৃষ্ঠ থেকে একে হলুদ দেখাতে পারে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নীল আলোর বিচ্ছুরণের কারণে। বর্ণালী ধরন "জিটু" বলে দেয় সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা আনুমানিক ৫৭৭৮ কেলভিন বা ৫৫০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর "ভি" দিয়ে বোঝায় আকাশগঙ্গার অধিকাংশ তারার মত সূর্যও একটি প্রধান ধারার তারা অর্থাৎ সে কেন্দ্রভাগে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে অবিরাম হাইড্রোজেন পুড়িয়ে হিলিয়াম উৎপাদন করে যাচ্ছে। কেন্দ্রে সূর্য প্রতি সেকেন্ডে ৬২ কোটি মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পোড়ায়। আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যকে অনুজ্জ্বল ও বেশ তাৎপর্যহীন একটি তারা মনে করলেও বর্তমানে জানা গেছে আকাশগঙ্গার শতকরা ৮৫ ভাগ তারার চেয়ে সূর্যের উজ্জ্বলতা বেশি, প্রকৃতপক্ষে আকাশগঙ্গার অধিকাংশ তারাই লোহিত বামন। সূর্যের পরম মান +৪.৮৩; কিন্তু পৃথিবীর খুব কাছে হওয়ার কারণে আকাশে একে অন্য যেকোন বস্তুর চেয়ে অনেক উজ্জ্বল দেখায়, তাই আপাত মান অনেক কম, -২৬.৭৪। সূর্যের করোনা অবিরত মহাশূন্যে প্রসারিত হতে থাকে যে কারণে সৌরঝড়ের জন্ম হয়। সৌরঝড় মূলত আয়নিত কণার ধারা যা হেলিওপজ তথা প্রায় ১০০ নভো-একক (সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্বের ১০০ গুণ) পর্যন্ত ধেয়ে যায়। সৌরঝড়ের মাধ্যমে আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমে সৃষ্ট হেলিওস্ফিয়ার বা সৌরমণ্ডল সৌরজগতের বৃহত্তম অবিচ্ছিন্ন কাঠামো।
সূর্য বর্তমানে স্থানীয় বুদবুদ অঞ্চলের স্থানীয় আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘের মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করছে যা আকাশগঙ্গার কালপুরুষ বাহুর ভেতরের দিকে অবস্থিত। পৃথিবী থেকে ১৭ আলোকবর্ষ দূরত্বের মাঝে তথা সবচেয়ে নিকটবর্তী ৫০টি তারার (সবচেয়ে নিকটবর্তী তারা প্রক্সিমা সেন্টরি ৪.২ আলোকবর্ষ দূরে) মধ্যে সূর্য ভরের দিক দিয়ে চতুর্থ। সূর্য আমাদের ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে আনুমানিক ২৪ - ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এবং কেন্দ্রের চারদিকে ২২.৫ থেকে ২৫ কোটি বছরে একবার ঘুরে আসে। ছায়াপথীয় উত্তর মেরু থেকে দেখলে সূর্যের এই আবর্তন ঘড়ির কাঁটার দিকে। আমাদের ছায়াপথ যেহেতু মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের (পটবিকিরণ) সাপেক্ষে হ্রদসর্প মণ্ডলের দিকে সেকেন্ডে ৫৫০ কিলোমিটার বেগে ধাবিত হচ্ছে সেহেতু পটবিকিরণের সাপেক্ষে সূর্যের বেগ কাংস্য বা সিংহ মণ্ডলের দিকে সেকেন্ডে প্রায় ৩৭০ কিলোমিটার।
সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড সময় নেয়
পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব আনুমানিক ১৪.৯৬ কোটি কিলোমিটার যাকে ১ নভো-একক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে পৃথিবীর কক্ষপথ যেহেতু উপবৃত্তাকার সেহেতু সূর্য থেকে তার দূরত্ব পরিবর্তিত হয়, জানুয়ারি মাসে সে সূর্যের সবচেয়ে কাছে (অনুসূর) আসে এবং জুলাইয়ে সবচেয়ে দূরে (অপসূর) সরে যায়। যাহোক, গড় দূরত্বে সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড সময় নেয়। এই সূর্যালোকের শক্তি পৃথিবীর প্রায় সকল জীবকে বাঁচিয়ে রাখে। উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় এই আলো থেকে খাদ্য উৎপাদন করে এবং প্রাণীরা খাদ্যের জন্য এসব উদ্ভিদ বা অন্য প্রাণীর উপর নির্ভর করে। পাশাপাশি জলবায়ু এবং আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণেও সূর্যালোক প্রধান ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর উপর সূর্যের বিশাল প্রভাব সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষ অনুধাবন করে আসছে। অনেক সংস্কৃতিতে সূর্যকে তাই দেবতা মনে করা হতো। তবে সূর্যের প্রকৃত কাঠামো সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণা গড়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছে। উনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত বিজ্ঞানীরাও সূর্যের গাঠনিক উপাদান এবং শক্তির উৎস সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতেন না। এখনও সূর্য নিয়ে গবেষণা চলছে কারণ তার কিছু ব্যবহর এখনও পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায়নি।
সূর্য একটি জি-ধরনের প্রধান ধারার তারা যার ভর সৌর জগতের মোট ভরের শতকরা ৯৯.৮৬৩২ ভাগ। এর গঠন প্রায় নিখুঁত গোলকের মত, কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর দিকে কমলালেবুর মত একটু চাপা। এই কমলাকৃতির পরিমাণ প্রতি ৯০ লক্ষ ভাগে এক ভাগ। অর্থাৎ সূর্যের মেরু অঞ্চলীয় ব্যস বিষুবীয় ব্যসের চেয়ে মাত্র ১০ কিলোমিটার কম। যেহেতু সূর্য প্লাজমা তথা আয়নিত গ্যাস দিয়ে গঠিত, সেহেতু এটি বিষুবীয় অঞ্চলে মেরু অঞ্চলের চেয়ে বেশি বেগে ঘোরে। এই পরিবর্তনশীল বেগকে বলা হয় ব্যবকলনীয় বেগ। এ ধরণের বেগের কারণ, সূর্যের মধ্যকার পরিচলন এবং কেন্দ্রের চেয়ে পৃষ্ঠের দিকে তাপমাত্রার ঢাল বেশি বাঁকা হওয়ায় ভরের স্থানান্তর। ভূ-কক্ষের উত্তর মেরু থেকে দেখলে সূর্যের যে বামাবর্তী কৌণিক ভরবেগ পর্যবেক্ষণ করা যায় তার কিছু অংশ এই ভর স্থানান্তরের কারণে পুনর্বন্টিত হয়। অর্থাৎ এক স্থানের ভরবেগ কমে গিয়ে অন্য স্থানে বেড়ে যায়। এই প্রকৃত ঘূর্ণন বেগের মান হচ্ছে বিষুবীয় অঞ্চলে ২৫.৫ দিন এবং মেরু অঞ্চলে ৩৩.৫ দিন। তবে পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্যের অবস্থান প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকায় আমরা এই আবর্তন বেগের মান পাই ২৮ পার্থিব দিন। দেখা যাচ্ছে, সূর্যের নিজ কক্ষের চারদিকে আবর্তন বেগ খুবই কম, এই ঘূর্ণন বেগ থেকে যে কেন্দ্রাতিগ বলের সৃষ্টি হয় তা সূর্যের পৃষ্ঠ অভিকর্ষের তুলনায় ১৮০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। গ্রহগুলোর জোয়ার বলও এ তুলনায় এত নগণ্য যে তারা সূর্যের আকার-আকৃতির কোন পরিবর্তন করতে পারে না।
সূর্য একটি পপুলেশন ১ তারা, অর্থাৎ এতে ভারী মৌলিক পদার্থের পরিমাণ বেশি। তারাটির উৎপত্তির পেছনে খুব সম্ভবত আশপাশের এক বা একাধিক অতিনবতারা বিস্ফোরণের ভূমিকা রয়েছে। উল্লেখ্য অতিনবতারা বিস্ফোরণ বিশাল গ্যাসীয় মেঘকে সংকুচিত করার মাধ্যমে নতুন তারা সৃষ্টির সূচনা ঘটাতে পারে। সৌরজগতে সাধারণ পপুলেশন ২ তারার (যাদের মধ্যে ভারী পদার্থ কম থাকে) চেয়ে বেশি ভারী মৌল দেখা যায়। যেমন, ইউরেনিয়াম এবং স্বর্ণ। এই ভারী মৌলগুলো সম্ভবত অতিনবতারা বিস্ফোরণের সময় তাপহারী বিক্রিয়ার মাধ্যমে, অথবা কোন বৃহৎ দ্বিতীয় প্রজন্ম তারার অভ্যন্তরে নিউট্রন শোষণ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়েছিল।
পার্থিব গ্রহগুলোর মত সূর্যের কোন নির্দিষ্ট পৃষ্ঠসীমা নেই এবং এর গ্যাসের ঘনত্ব ব্যসার্ধ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে সূচকীয় হারে হ্রাস পায়। তথাপি এর প্রায় সুনির্দিষ্ট একটি অভ্যন্তরীন গঠন রয়েছে যা নিচে বর্ণনা করা হবে। সূর্যের ব্যসার্ধ্য নির্ণয় করা হয় কেন্দ্র থেকে আলোকমণ্ডলের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। আলোকমণ্ডল সূর্যের এমন একটি অঞ্চল যার বাইরে গ্যাস এত পাতলা হয়ে যায় যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিকিরণ নিঃসরণ করতে পারে না। এজন্যই দৃশ্যমান আলোয় আমরা সাধারণত সূর্যের আলোকমণ্ডলই দেখি।
সূর্যের অভ্যন্তরভাগ সরাসরি দেখা যায় না, সূর্য তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণের প্রতি অনচ্ছ। কিন্তু সৌরকম্পনবিদ্যা-র মাধ্যমে অভ্যন্তরভাগ সম্পর্কে ধারণা লাভ সম্ভব, ঠিক ভূকম্পনবিদ্যার মত। ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট তরঙ্গের মাধ্যমে যেমন পৃথিবীর অভ্যন্তরীন গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ঠিক তেমনি সূর্যের অভ্যন্তরভাগ দিয়ে চলমান অব-শাব্দিক চাপ তরঙ্গের মাধ্যমে সূর্যের অভ্যন্তরীন গঠনও জানা সম্ভব। এছাড়া কম্পিউটার সিম্যুলেশনের মাধ্যমেও সূর্যের অদেখা ভুবন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়।
সূর্যের কেন্দ্র থেকে শুরু করে মোট ব্যসার্ধ্যের শতকরা ২০-২৫ ভাগ পর্যন্ত যে অঞ্চলটি রয়েছে তার নাম কোর বা কেন্দ্রভাগ। এই অঞ্চলের ঘনত্ব ১৫০ গ্রাম/ঘনসেন্টিমিটার (পানির ঘনত্বের ১৫০ গুণ) এবং তাপমাত্রা প্রায় ১ কোটি ৩৬ লক্ষ কেলভিন। অথচ সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্র ৫৮০০ ডিগ্রি কেলভিন। সোহো মহাকাশ মিশন থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সূর্যের কেন্দ্রভাগে ঘূর্ণন বেগ বিকিরণ অঞ্চলের অন্যান্য স্থানের তুলনায় বেশি। এই অঞ্চলে প্রোটন প্রোটন শিকলের মাধ্যমে হাইড্রোজেন সংযোজনের (ফিউশন) মাধ্যমে হিলিয়াম তৈরি হয়। এটিই সূর্যের শক্তির প্রধান উৎস। সূর্যে উৎপাদিত মোট হিলিয়ামের শতকরা মাত্র ২ ভাগ সিএনও চক্র থেকে আসে।
কেন্দ্রভাগে সূর্যের মোট শক্তির প্রায় পুরোটাই উৎপাদিত হয়। ব্যসার্ধ্যের ২৪% এর মধ্যে ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে সূর্যের মোট শক্তির শতকরা ৯৯ ভাগ উৎপাদিত হয়, ৩০% এর পর আর কোন ফিউশন বিক্রিয়া দেখাই যায় না। সুতরাং সূর্যের বাকি অংশ কেন্দ্রভাগের শক্তি দিয়েই চলে, কেন্দ্রভাগ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শক্তি বাইরের স্তরগুলোর দিকে প্রবাহিত হয়। অনেকগুলো স্তর ভেদ করে অবশেষে এই শক্তি আলোকমণ্ডলে পৌঁছায়, এরপর পদার্থ কণার গতিশক্তি বা সূর্যালোক হিসেবে মহাশূন্যে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতি সেকেন্ডে ৯.২×১০৩৭ টি প্রোটন-প্রোটন শিকল বিক্রিয়া ঘটে। প্রতিটি বিক্রিয়ায় যেহেতু ৪টি হাইড্রোজেন মিলে একটি হিলিয়াম তৈরি হয় সেহেতু বলা যায়, প্রতি সেকেন্ডে সূর্য ৩.৭×১০৩৮ টি প্রোটনকে (প্রায় ৬.২×১০১১ কিলোগ্রাম) আলফা কণা তথা হিলিয়াম কেন্দ্রিনে রূপান্তরিত করে। সূর্যে মোট মুক্ত প্রোটনের সংখ্যা প্রায় ৮.৯×১০৫৬ টি। হাইড্রোজেনের সংযোজন বিক্রিয়ার মাধ্যমে সংযোজিত ভরের শতকরা ০.৭ ভাগ শক্তিতে পরিণত হয়। হিসাব করলে দেখা যায় ভর-শক্তি রূপান্তরের মাধ্যমে সূর্যে প্রতি সেকেন্ডে ৪২ লক্ষ মেট্রিক টন শক্তি বিমুক্ত হয়। ভর ধ্বংস হয় না বরং এই ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয় যা বিকিরণ হিসেবে মহাশূন্য ছড়িয়ে পড়ে। আইনস্টাইনের ভর-শক্তি সমতুল্যতা দিয়ে এটি ব্যাখ্যা করা যায়।
তবে কেন্দ্রেভাগের সব স্থানে একই হারে বিক্রিয়াটি ঘটে না। কেন্দ্র থেকে দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে এটি পরিবর্তিত হয়। তাত্ত্বিক মডেল থেকে দেখা যায় সূর্যের কেন্দ্রে শক্তি উৎপাদনের পরিমাণ প্রতি ঘন মিটারে ২৭৬.৫ ওয়াট। পরিমাণটি কিন্তু মোটেই বেশি নয়। এই সংখ্যা পারমাণবিক বোমার বদলে আমাদেরকে সরীসৃপদের বিপাক ক্রিয়া ব্যবহৃত শক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। সূর্যের প্রতি একক আয়তনে উৎপাদিত সর্বোচ্চ শক্তিকে খাদ্যশস্যের বর্ধনে ব্যবহৃত সারের ব্যয়িত শক্তির সাথে তুলনা করা হয়েছে। সূর্য থেকে যে আমরা এত শক্তি পাই তার কারণ এই নয় যে, এই গ্যাসপিণ্ডের প্রতি একক আয়তনে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপাদিত হয়, বরং এইজন্যে যে সূর্যের আয়তন অনেক বেশি। একক আয়তনে শক্তির পরিমাণ অনেক কম হলেও সমগ্র আয়তনে সংখ্যাটি অনেক বড় হয়ে যায়।
কেন্দ্রভাগের সংযোজন বিক্রিয়া একটি আত্ম-সংশোধনযোগ্য সাম্যাবস্থায় আছে। বিক্রিয়ার হার যদি একটু বেড়ে যায় তাহলে কেন্দ্রভাগ উত্তপ্ত হয়ে সম্প্রসারিত হতে শুরু করে, এতে গ্যাসের ঘনত্ব কমে যায়, বিক্রিয়া হারও কমে যায়। আবার বিক্রিয়ার হার স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে কেন্দ্রভাগ সামান্য সংকুচিত হয়ে গ্যাসের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে বিক্রিয়ার হার আবার বেড়ে যায়। এভাবেই সাম্যাবস্থা রক্ষিত হয়।
বিক্রিয়া যেসব উচ্চ শক্তির গামা রশ্মি উৎপন্ন হয় তারা বিকিরিত হওয়ার মাত্র কয়েক মিলিমিটারের মধ্যেই সৌর প্লাজমা দ্বারা আবার শোষিত হয়, এরপর সামান্য নিম্ন শক্তিতে আবার বিকিরিত হয়। এভাবে বিকিরিণ-শোষণের খেলা চলতেই থাকে। এজন্যই সূর্যের কেন্দ্র থেকে পৃষ্ঠে শক্তি পৌঁছুতো অনেক সময় লাগে। কেন্দ্র থেকে পৃষ্ঠে ফোটনের আসতে প্রায় ১০,০০০ থেকে ১৭০,০০০ বছর লাগে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
পৃষ্ঠমুখী যাত্রার পথে ফোটন পরিচলন অঞ্চল পার হয়ে শেষে আলোকমণ্ডলে পৌঁছায়, এই স্তর পেরোলেই অবারিত মহাশূন্য, যাতে দৃশ্যমান আলো হিসেবে ফোটনগুলো ছড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতিটি গামা রশ্মি সূর্য থেকে পালানোর পূর্বে কয়েক মিলিয়ন দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ফোটনে রূপান্তরিত হয়। সংযোজন বিক্রিয়া গামা রশ্মির পাশাপাশি নিউট্রিনো-ও উৎপন্ন হয়, কিন্তু গামা রশ্মির মত তারা পদার্থের সাথে এত মিথস্ক্রিয়া করে না, আসলে মিথস্ক্রিয়া করে না বললেই চলে। সুতরাং উৎপাদিত নিউট্রিনোর প্রায় সবগুলোই তৎক্ষণাৎ সূর্য থেকে পালাতে সক্ষম হয়। অনেক বছর ধরে সূর্য থেকে যে পরিমাণ নিউট্রিনো পাওয়ার কথা তার চেয়ে প্রায় ৩ গুণ কম পাওয়া যাচ্ছিল। এই সমস্যার নাম দেয়া হয়েছিল সৌর নিউট্রিনো সমস্যা। কিন্তু ২০০১ সালে নিউট্রিনো স্পন্দন আবিষ্কৃত হওয়ার পর এর সমাধান হয়েছে। আসলে সূর্য থেকে অনেক নিউট্রিনো আসে, কিন্তু পৃথিবীতে দুরবিনের মাধ্যমে আমরা মাত্র ৩ ভাগের ২ ভাগ নিউট্রিনো সনাক্ত করতে পারি, কারণ পৃথিবীতে আসতে আসতে নিউট্রিনোগুলো স্বাদ পাল্টায়।
সূর্যের ভরের শতকরা ৭৪ ভাগই হাইড্রোজেন, বাকি অংশের মধ্যে ২৫% হিলিয়াম এবং এছাড়াও রয়েছে উচ্চ ভরসম্পন্ন কিছু বিরল মৌলিক পদার্থ। সূর্যের নাক্ষত্রিক শ্রেণীবিন্যাস অনুসারে এর শ্রেণী হচ্ছে জি২ভি (G2V)। "জি২" দ্বারা বোঝায় এর পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা ৫,৫০০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি  K দ্বারা বোঝায় এর বর্ণ সাদা, অবশ্য পৃথিবীর পরিবেশে বিচ্ছুরণের কারণে এর বর্ণ হলুদ দেখায়। এর বর্ণালি রেখা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় তাতে আয়নিত ও নিষ্ক্রীয় উভয় ধরনের ধাতুর বর্ণালি রয়েছে, এছাড়াও রয়েছে খুব দূর্বল হাইড্রোজেন রেখা। V-বর্ণটি দ্বারা বোঝায়, অন্যান্য অধিকাংশ তারার মতই সূর্য একটি প্রধান ধারার তারা। অর্থাৎ সূর্য তার প্রয়োজনীয় শক্তি হাইড্রোজেন কেন্দ্রীনকে কেন্দ্রীন সংযোজন প্রক্রিয়ায় হিলিয়াম কেন্দ্রীনে পরিণত করার মাধ্যমে উৎপাদন করে। এছাড়া প্রধান ধারার তারায় hydrostatic balance লক্ষ্য করা যায়, তথা এরা সম্প্রসারিত বা সংকুচিত হয়না। আমাদের ছায়াপথে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি G2 শ্রেণীর তারা রয়েছে। সূর্যের সমগ্র আকারের লগারিদমভিত্তিক বিন্য্যাসের কারণে এই ছায়াপথের ৮৫% তারার চেয়ে এর উজ্জ্বলতা বেশি। অবশ্য আমাদের আকাশগঙ্গার অনেকগুলো তারাই লাল বামন পর্যায়ে রয়েছে।
সূর্যের অবস্থান আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে "২৫,০০০ - ২৮,০০০ আলোক বর্ষ", আর এই দূরত্বে থেকেই এটি অবিরত ছায়াপথের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছে। একবার কেন্দ্রের চারদিক দিয়ে সমগ্র পথ ঘুরে আসতে সূর্যের সময় লাগে "২২৫ - ২৫০ মিলিয়ন বছর"। এর কক্ষপথীয় দ্রুতি ২১৭ কিমি/সে; এ থেকে দেখা যায় সূর্য ১,৪০০ বছরে এক আলোক বর্ষ দূরত্ব এবং ৮ দিনে এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক (AU) দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে।
সূর্য একটি তৃতীয় প্রজন্মের তারা, কাছাকাছি কোন একটি অতি নব তারা থেকে উদ্ভূত অভিঘাত তরঙ্গ এর উৎপত্তিতে একটি চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। পুরো সৌর জগতে স্বর্ণ বা ইউরেনিয়ামের মত ভারী মৌলসমূহের প্রাচুর্য লক্ষ্য করে চালিকাশক্তি হিসেবে এই ঘটনাটি প্রস্তাব করা হয়েছে। খুব সম্ভবত একটি অতি নব তারার বিবর্তনের সময় ক্রিয়াশীল endergonic কেন্দ্রীন বিক্রিয়া অথবা দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বৃহৎ তারার অভ্যন্তরে নিউট্রন শোষণের ফলে উদ্ভূত ট্রান্সম্যুটেশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে এই মৌলসমূহ সৃষ্টি হয়েছে।
পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের সকল শক্তির মূল উৎস সূর্য। সৌর ধ্রুবক নামে একটি পদের ব্যবহারই এই উৎসের প্রয়োজনীয়তার দিকে ইঙ্গিত করে। সূর্যের দিকে সরাসরি মুখ করে থাকা পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রতি একক ক্ষেত্রফলের উপর সূর্য প্রদত্ত শক্তির পরিমাণকে সৌর ধ্রুবক বলে। এর আপাত মান হচ্ছে ১,৩৭০ ওয়াট/বর্গমিটার। এই মানটি সূর্য থেকে এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক দূরত্বে অবস্থানকারী যে কোন বস্তুর পৃষ্ঠের জন্য প্রযোজ্য। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বকেই এক জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক দূরত্ব বলা হয়। পৃথিবীতে এতোটা শক্তি পৌঁছালেও তার পুরোটা পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছে না। যখন আবহাওয়া সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকে এবং সূর্য সর্বোচ্চ বিন্দুতে (zenith) থাকে তখন ভূ-পৃষ্ঠে সরাসরি পতিত সৌর শক্তির পরিমাণ হয় প্রায় ১,০০০ ওয়াট/বর্গমিটার। এই শক্তিকে কাজে লাগানোর অনেকগুলো প্রাকুতিক ও কৃত্রিম উপায় আছে। উদ্ভিদ এই শক্তি ব্যবহার করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চালু রাখে যা থেকে প্রাপ্ত শক্তি তারা রাসায়নিক শক্তিতে (অক্সিজেন ও স্বল্প পরিমাণ কার্বন যৌগ) পরিণত করে। আবার কৃত্রিমভাবে সৌর শক্তির মাধ্যমে সরাসরি উত্তপ্ত করে বা সৌর কোষ জাতীয় বৈদ্যুতিক পরিবর্তক মাধ্যমে সৌর শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা হয় যা আমাদের অনেক কাজে লাগে। পেট্রোলিয়াম সহ অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানীতে যে শক্তি নিহিত থাকে তা-ও উদ্ভিদ সৌর শক্তি থেকে লাভ করেছিল। সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত শক্তিই নানাভাবে পরিবর্তীত হয় এ ধরনের জ্বালানীর দাহিকাশক্তির যোগান দেয়।
সূর্যের আলোর কিছু চমৎকার জীববৈজ্ঞানিক ধর্মও রয়েছে। সৌর আলোর লুমেন ও ওয়াটের মধ্যে যে অনুপাত তা ভাল মানের প্রতিপ্রভ আলোর সাথে তুলনীয়। এর মাধ্যমে বোঝা যায় সূর্য যে আলো দেয় তা তার উত্তপ্ত করার ক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং প্রদত্ত এই আলোর পরিমাণ বিপুল। এ থেকেই গ্রীষ্মকালে গৃহাভ্যন্তরের আলোকসজ্জার জন্য সূর্যের আলোর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়। কারণ এটি যত না উত্তপ্ত করে তার চেয়ে বেশি আলোকিত করে, আর গ্রীষ্মকালে উত্তাপ কমানো প্রয়োজন। অবশ্য সূর্যের আলোও কিছু উত্তাপ ছড়ায়। কিন্তু বৈদ্যুতিক বাতি একদিকে বেশি উত্তাপ তো ছড়ায়ই, আবার বিদ্যুৎও ব্যবহার করে। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির কিছু প্রতিষেধক গুণ রয়েছে যা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্তকরণে কাজে লাগে। সূর্যের আলোতে ভিটামিন ডি তৈরি করে যা মানব শরীরের জন্য উপকারী।
সূর্য যখন দেবতার রূপকে
সূর্য (সংস্কৃত : सूर्य, Sūrya, "সর্বোচ্চ আলোক") হিন্দুধর্মের প্রধান সৌরদেবতা। তিনি আদিত্যগণের অন্যতম এবং কশ্যপ ও তাঁর অন্যতমা পত্নী অদিতির পুত্র। কোনো কোনো মতে তিনি ইন্দ্রের পুত্র। সূর্যের কেশ ও বাহুর সোনার। তিনি সপ্তাশ্ববাহিত রথে আকাশপথে পরিভ্রমণ করেন। তাঁর রথের ঘোড়াগুলি সাতটি পৃথক পৃথক রঙের, যা রঙধনুর সাত রঙের প্রতীক। তিনি রবিবারের অধিপতি।


হিন্দু ধর্মীয় সাহিত্যে সূর্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কারণ তিনিই একমাত্র দেবতা যাঁকে মানুষ প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করতে পারেন। এছাড়াও, শৈব ও বৈষ্ণবেরা সূর্যকে যথাক্রমে শিব ও বিষ্ণুর রূপভেদ মনে করেন। উদাহরণস্বরূপ, বৈষ্ণবেরা সূর্যকে সূর্যনারায়ণ বলে থাকেন। শৈব ধর্মতত্ত্বে, শিবের অষ্টমূর্তি রূপের অন্যতম হলেন সূর্য।
সূর্যের অন্যান্য নামগুলি হল বিবস্বান, রবি (অর্থাৎ, "আগুনপাখি"), আদিত্য (অর্থাৎ, "অদিতির পুত্র"), পূষা ("শ্রেষ্ঠ পাপনাশক"), দিবাকর ("দিনের স্রষ্টা"), সবিতৃ ("উজ্জ্বলকারী"), অর্ক ("রশ্মি"), মিত্র ("বন্ধু"), ভানু ("আলোক") ভাস্কর ("আলোকনির্মাতা"), গ্রহপতি ইত্যাদি।
সূর্য ও সূর্যদেব
হিন্দু ধর্মের পৌরানিক কাহিনীতে (পুরান) সূর্য দেবতার পরিচয় পাওয়া যায়। পুরান মতে সূর্য হিন্দু ধর্মের অন্যতম পৌরানিক দেবতা। সংস্কৃত surya শব্দ থেকে এর উৎপত্তি যার অর্থ দাড়ায় সর্বোচ্চ আলোক অর্থাৎ আলোক প্রদানকারি দেবতা। তিনি কশ্যপ ও অদিতির পূত্র (তবে এটি নিয়ে বিতর্ক আছে) যার চারজন সঙ্গিনী- সরন্যু, রাজ্ঞী, ছায়া এবং প্রভা। সূর্য দেব তার সপ্তহর্ষী রথে করে প্রত্যেহ আকাশ দিয়ে ছুটে বেড়ান এবং সাঝে স্বর্গে ফিরে আসেন যার ফলশ্রুতিতে পৃথিবীতে দিন রাত্র হয়।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থে সূর্যদেব কে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়ে থাকে তিনিই একমাত্র দেবতা যিনি প্রত্যেহ দৃষ্টিগোচর হন। আদিত্য দেবগনের মধ্যে সূর্য অন্যতম। তিনি রবিবারের অধিকর্তা। বিষ্ণুভক্তগন সূর্যকে নারায়নের অপর রুপ বলে মানেন তাই তার আরেক নাম সূর্যনারায়ন। অপরদিকে শৈব ধর্মত্বত্তে তাকে শিবের স্বরুপ বলা হয়েছে যার আট নাম- বিবস্থান, রবি, পুষা, আদিত্য, দিবাকর, সবিতৃ, ভানু, অর্ক, গ্রহপতি ও ভাস্কর।

এ থেকে একটা ধারনা করা যায় যে এটি আর যা হোক কোন ভাবেই ৭ঘোড়ায় টানা রথ নয়। দিন রাতের হিসাব যে আহ্নিক গতির কারনে হয় তা বহু আগেই প্রমানিত। পৌরানিক ভাষ্যমতে সূর্যের পৃথিবী ব্যাপি ছুটে ছুটে দিন রাত বানানোর কোন প্রমানযোগ্য তথ্য আজও পাওয়া যায়নি। এছাড়া তিনি শিব নাকি নারায়নের প্রতিমূর্তি, কশ্যপমুনি নাকি ইন্দ্রের পূত্র তা নিয়ে শাস্ত্রেই যথেষ্ট সংশয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে সূর্যকে একটি নক্ষত্র ছাড়া দেবতা ভাবাটা যে কত বড় বোকামি তা তথ্যাদি সমূহ পর্যবেক্ষন করলেই বোঝা যায়। আর যাই হোক ৫০০০ ডিগ্রি তাপে কি কেউ নিজেকে সপে দিতে চাইবে?
পিএইচ১ নামে ৪ সূর্য বিশিষ্ট নতুন গ্রহের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা
বিজ্ঞানীরা আরো একটি গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন। নতুন এ গ্রহের আকাশে চারটি সূর্য রয়েছে বলে জানিয়েছেন আমেরিকার নেভাদা অঙ্গরাজ্যের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল জ্যোতির্বিদ। চার সূর্য বিশিষ্ট এ ধরনের গ্রহের এই প্রথম সন্ধান পাওয়া গেল।
পৃথিবী থেকে গ্রহটির অবস্থান হচ্ছে পাঁচ হাজার আলোক-বর্ষ দূরে। গ্রহ অনুসন্ধানকারীদের সম্মানার্থে বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন পিএইচ১।
নতুন গ্রহ পিএইচ১ দুটি সূর্যকে কেন্দ্র করে নিজ কক্ষপথে আবর্তিত হচ্ছে। এ ছাড়া কিছু দূরত্বে রয়েছে আরো দু'টি নক্ষত্র। পিএইচ থেকে এ দু'টি নক্ষত্রের দূরত্ব পৃথিবী ও সূর্যের দূরত্বের চেয়ে অন্তত এক হাজার গুণ বেশি।
গতকাল (সোমবার) নেভাদার ডিভিশন ফর প্লানেটারি সায়েন্স অব দ্য আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির বার্ষিক বৈঠকে এ বিষয়ে গবেষণাপত্র জমা উপস্থাপন করা হয়।

এর আগে, এ ধরনের কোনো গ্রহ আবিষ্কৃত হয়নি যার আকাশে চারটি সূর্য আছে। এর আগে ছয়টি গ্রহ পাওয়া গেছে যাদের আকাশে আছে দু'টি করে সূর্য। মার্কিন বিজ্ঞানী কিয়ান জেক এবং রবার্ট গ্যাগলিয়ানো সর্বপ্রথম পিএইচ১-এর সন্ধান পান। পরে তাদের এ দাবিকে সমর্থন করেন হাওয়াইয়ে কর্মরত একদল ব্রিটিশ ও মার্কিন গবেষক।
পৃথিবীর চেয়ে ৬.২ গুণ বড় ব্যাসার্ধ রয়েছে নতুন এ গ্রহের আর নেপচুনের চেয়ে সামান্য বড় পিএইচ১। এর গঠন প্রক্রিয়া এবং জলবায়ুর ক্ষেত্রে এ গ্রহ কি ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে এখন তা খুঁজে দেখবেন বিজ্ঞানীরা।
সূর্য ঘোরে নাকি পৃথিবী ঘোরে ?
প্রায় দুশকেরও বেশীকাল ধরে ইসলামি জগতে ইসলামি বিজ্ঞানী নামক কতিপয় বিরাট দিকপালের পদচারনা লক্ষ্য করা যায়, যেমন -ডা, জাকির নায়েক, হারুন ইয়াহিয়া এসব যারা প্রানান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন কুরানের মধ্যে বিজ্ঞান আবিস্কারের মহতী প্রচেষ্টায়। এটা খুব ভাল একটা উদ্যোগ। যদি দেখা যায় যে বিজ্ঞানের মৌলিক সূত্রগুলির খোজ কুরানে পাওয়া যায় তাহলে কুরান যে আল্লাহর বানী তাতে কারো কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। মূলত: এ লক্ষ্যকে উদ্দেশ্য করেই এ উদ্যোগ। সুতরাং আমিও যার পর নাই পুলকিত হয়ে তাদের এসব আবিস্কারের কিছু কিছু নিজেই স্বপ্রণোদিত হয়ে কিতাব থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে লাগলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল মানুষের কথা সহজে বিশ্বাস করতে নেই , যেগুলোকে পরখ করে দেখার সুযোগ আছে সেটা পরখ করে দেখে তারপর সে ব্যপারে নিশ্চিত হওয়াই হলো বুদ্ধিমানের কাজ। তাই আমি সূর্য ঘোরে নাকি পৃথিবী ঘোরে এ বিষয়টা পরখ করতে লেগে গেলাম । এ বিষয়ে ড, জাকির নায়েকের উল্লেখিত একটা আয়াত , যেমন-
সূর্য তার নির্দিষ্ট কক্ষে আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ, আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ। সূরা ইয়াসিন-৩৬:৩৮
সূর্য ঘোরে ? আমি তো হতবাক। কিন্তু পরে জানা গেল সূর্য আসলেই ঘোরে। সাম্প্রতিক কালে জানা গেছে যে - সূর্য তার ছায়াপথকে কেন্দ্র করে ঘোরে ও একপাক ঘুরে আসতে সময় নেয় প্রায় ২০ কোটি বছর। সুতরাং জাকির নায়েকের বক্তব্য মতে সেই চৌদ্দশত বছর আগে এটা কারও জানা ছিল না অথচ কুরানের মধ্যে আছে , তাই কুরান আল্লাহর বানী না হয়ে যায় না। আসলেই দারুন রোমাঞ্চকর আবিস্কার বলা বাহুল্য। তখন আমি উক্ত আয়াত সম্পর্কিত কোন হাদিস আছে কি না তা খুজতে থাকলাম একই সাথে তাফসির খুজতে থাকলাম। আর তখন পাওয়া গেল নিচের হাদিস-
আবু দার থেকে বর্নিতঃ আল্লার রসুল একদিন সূর্যাস্তের সময় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- তুমি কি জান অস্ত যাওয়ার পর সূর্য কোথায় যায় ? আমি উত্তর দিলাম- আল্লাহ আর তার রসুল ভাল জানেন। তখন আল্লাহর রসুল বললেন- এটা চলতে থাকে যতক্ষন না আল্লাহর সিংহাসনের নীচে পৌছে। সেখানে সে সিজদা দেয় আর আল্লাহর কাছে পূনরায় উদিত হওয়ার অনুমতি চায়। যতক্ষন অনুমতি না দেয়া হয় ততক্ষন সে সেজদা দিতেই থাকে। পরে তাকে যেখানে সে উদিত হয়েছিল সেখানে ফিরে গিয়ে পূনরায় উদিত হওয়ার জন্য অনুমতি দেয়া হয়। আর এটাই আল্লাহর বানী -সূর্য তার নির্দিষ্ট কক্ষে আবর্তন করে- (কুরান ৩৬:৩৮) এর অর্থ।এটা বুখারী শরিফ, খন্ড-৪. বই-৫৪, হাদিস নং- ৪২১
এ কি ? এটা কি বলল ? সূর্য সারাদিন আকাশে পরিভ্রমন করে যখন অস্ত যায় তখন আল্লাহর আরশের নীচে গিয়ে সিজদা দিতে থাকে? আমি তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। এ কি ব্যখ্যা ? আর এটাই হলো কুরানের ৩৬:৩৮ আয়াতের আসল অর্থ যা স্বয়ং নবিজী বলে গেছেন। অথচ আমরা জানি সূর্য বাস্তবে কখনো অস্ত যায় না, বাংলাদেশে যখন রাত তখন আমেরিকার আকাশে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে সূর্য। পৃথিবী নিজ অক্ষে লটিমের মত পাক খায় বলেই আমাদের কাছে সূর্য একবার উদিত হয় আর দিন শেষে অস্ত যায় বলে মনে হয়। অথচ আল্লাহর নবী বলছেন এটা নাকি ভুল। তিনি বলছেন রাতের বেলা আসলে সূর্য আল্লাহর আরশে গিয়ে সিজদায় পতিত হয় ও পুনরায় উদিত হওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থণা করতে থাকে। হুবহু একই ব্যখ্যা নানা হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কুরানের সবচাইতে বিখ্যাত তাফসিরকার ইবনে কাসিরও দিয়ে গেছেন , যেমন-
আবু যার ( রা) রসুলুল্লাহ (সা)কে এ আয়াতের ( ৩৬:৩৮) অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন -সূর্যের গন্তব্য স্থল আরশের নীচে রয়েছে। পৃষ্ঠা নং-১৩৭, ১৬শ খন্ড, তাফসির ইবনে কাসির, অনুবাদ: ড, মুজিবুর রহমান, প্রাক্তন অধ্যাপক ও সভাপতি , ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
এখন আমার প্রশ্ন হলো - ডা, জাকির নায়েক বেশী ইসলাম জানেন নাকি আমাদের নবিজী বা ইবনে কাসির বেশী ইসলাম জানতেন ? কার ব্যখ্যা আমরা গ্রহন করব ?
এখানে উল্লেখ্য , কুরান বা হাদিসের কোথাও কিন্তু বলা নেই যে পৃথিবী ঘোরে , বা এর কোনই ইঙ্গিত কোথাও নেই। অথচ সেটা বললেই হতো মহা আশ্চর্য ঘটনা। কারন সেই ৭ম শতাব্দি বা তারও হাজার হাজার বছর আগে থেকে জ্ঞানী মূর্খ , উন্মাদ পাগল, শিশু বৃদ্ধ যে কেউই কিন্তু সাদা চোখেই দেখত যে সূর্য প্রতিদিন পূব দিকে উদিত হয়ে সারা দিন পরিভ্রমন করে সন্ধ্যার কিছু আগে পশ্চিম আকাশে অস্ত যায়। আর তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হতো - বলতো সূর্য সারা দিন কি করে ? অতি সহজেই তারা উত্তর দিত - সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়ে সারা দিন তার নিজ অক্ষে পরিভ্রমন করে পশ্চিমে অস্ত যায়। হুবহু একথাটাই কিন্তু কুরানে লেখা। এর মধ্যে নতুনত্ব কোথায় ? কুরান খুব সুন্দর ও পরিস্কার ভাবে বলতে পারল যে সূর্য ঘোরে , অন্য আয়াতে আছে চাঁদ ঘোরে , একটিবার পরিস্কার করে বলতে পারল না যে পৃথিবী ঘোরে? সেই কালের মূর্খ আরবরা হয়ত এটার অর্থ বুঝত না , কিন্তু তাতে কি ? আল্লাহর সবগুলো বানীর সব অর্থ তারা যে বুঝবে না এমন কথা তো খোদ কুরানেও বলা আছে। যেমন -
তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে, তারা অনুসরণ করে ফিৎনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশে তন্মধ্যেকার রূপকগুলোর। আর সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। সূরা আল ইমরান - ৩: ০৭
সুতরাং পৃথিবী ঘোরার কথা পরিস্কার ভাবে বলে দিলে তা সেই ৭ম শতাব্দির আরবরা বুঝত না ঠিকই কিন্তু বর্তমানে আমরা সেগুলোর অর্থ বুঝতে পারে বাস্তবে তার সত্যতা দর্শন করলে কুরানকে সত্যি সত্যি আল্লাহর বানী হিসাবে প্রমান পেতাম। তাহলে কতই না সুন্দর হতো , তাই নয় কি ? কিন্তু সেই কালের মহাজ্ঞানীরাও জানত না যে সূর্য নয় বরং পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর ঘোরে যে কারনে দিন রাত হয় এবং তাছাড়া খোদ সূর্যের চারপাশে ৩৬৫ দিনে একবার করে প্রদক্ষিন করে আসে। সুতরাং সূর্য নয় বরাং পৃথিবী ঘোরার কথা যদি কুরান হাদিসে কোথাও বলা থাকত তাহলেই সেটা হতো মহা বিস্ময়কর ব্যপার। তাই নয় কি ?
মহাবিভ্রমে পড়ে গেছি কোনটা সত্য- সূর্য ঘোরে নাকি পৃথিবী ঘোরে ? কুরান ও হাদিসের কথা সত্য, নাকি বিজ্ঞানীদের কথা সত্য ?
অন্ধকার দূর করবে কৃত্রিম সূর্য
নরওয়ে তে বানান হবে এই কৃত্রিম সূর্য । সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত নরওয়ের রুজকান শহরে সূর্যের আলো ঢুকতে পারে না তার আশেপাশের পাহাড়ের কারনে । প্রায় পুরো শীতকাল কাটে অন্ধকারে তাঁদের ।
কি করা যায় ? পাহাড় কেটে ফেলতে হবে !! না, তারা বের করেছে আরও অভিনব উপায়, কেননা বানিয়ে ফেলা যাক আরেকটি সূর্য ???!!!
The Mirror Project নামে এই প্রোজেক্ট এ ব্যাবহার করা হবে ৩টি আয়তক্ষেত্রাকার বিরাট আয়না । পাহাড়ের দুপাশে স্থাপনকরা এই আয়নাগুলোতে প্রতিফলিত হবে সূর্যের আলো যা শহরের কেন্দ্রস্থলে মিলিত হয়ে বানাবে কৃত্রিম সূর্য । আর তাতে আলকিত হবে পুরো শহর ।
৩২৮-বর্গ ফুটের এই আয়নাগুলো সোলার প্যানেলের ফ্রেমে পাওয়া যায় যা কিনা কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয় । একটি সৌর শক্তি দ্বারা পরিচালিত সেন্সর দ্বারা সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং তা ব্যাবহার করে আয়নাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে যাতে অধিক সূর্য রশ্মি সে শহরের দিকে ঠেলে দিতে পারে ।
শহরটি এর জন্য $835,000 খরচ করছে । হেলিকপ্টারের সাহায্যে কিছুদিন আগে আয়নগুলো স্থাপন করা হয়েছে । সেপ্টেম্বর এর প্রথমদিকে প্রোজেক্টটির প্রথম পরীক্ষা করা হবে ।
হিসাব অনুযায়ী ২০০০-বর্গ ফুট ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট সূর্যটি শহরকে আলোকিত করবে ।
মিশরের পৌরাণিক কাহিনীঃ মিস্ট্রেস অব দি গড এবং সূর্যদেবের গোপন নাম
মিশরের সূর্যদেবতা
যে মুখ নিয়ত পালায়......।। আকাশের দেবী নাট আকাশের দেবী চার সন্তানের জন্ম দিলেন। অসিরিস আইসিস নেপথাইস এবং সেথ। দুই পুত্র দুই কন্যা। তন্মধ্যে অসিরিস ও আইসিসের বিয়ে হল। অসিরিস মিশরের ফারাও হলেন। চলতে থাকল রাজ্য শাসন।সুখে শান্তিতে দিন যায়।রাত আসে। সন্তানের মধ্যে সবাই ভালো হলে কি আর গল্প জমে? ছবিতে ভিলেনের দরকার আছে।(কার্ল মার্ক্স নাকী বলেছিলেন, শয়তান ছাড়া ইশ্বরের করার কিছুই থাকে না।সত্য মিথ্যা জানি না।শোনা কথা) যাইহোক, এই কাহিনীর ভিলেন সেথ। সে রাজা হতে চাইল। আপন ভাই অসিরিস কে মেরে বাক্স বন্দি করে ভাসিয়ে দিল নদীতে। সেথ রাজ্যে সিংহাসন দখল করে হল নতুন ফারাও। আর আইসিস তার ভাই এবং স্বামী জনাব অসিরিস কে খোঁজে বের করতে বের হলেন। কিছু ঘোরাঘোরির পর আইসিস তার স্বামীর মৃতদেহ পেলেন বাক্সবন্দি অবস্থায়।কাঠের বাক্স। আইসিস বাক্স থেকে মৃতদেহ নিয়ে এলেন মিশরে।তার উদ্দেশ্য মিশরেই কবর দেয়া। এই কথা কানে গেল সেথ এর। সে ভীষণ রাগান্বিত হয়ে অসিরিসের মৃতদেহ কেড়ে নিল।অসিরিসের প্রতি তার ক্ষোভ ব্যাপক। মৃতদেহ কয়েক টুকরো করে ছড়িয়ে দিল সমস্ত মিশরে। অসিরিস আইসিস ও তার বোন নেপথাইস এহেন অবস্থায় পক্ষীরূপ ধারণ করলেন।উড়ে উড়ে খুঁজতে লাগলেন অসিরিসের মৃতদেহ। টুকরা গুলো তারা খুঁজে পেয়েছিলেন(পেনিস বাদে)। আইসিস তার ম্যাজিক্যাল পাওয়ার দিয়ে অসিরিস কে আবার জীবন ও দিয়েছিলেন। এরপর থেকে অসিরিস মৃতদের শাসন করতে লাগলেন। আইসিস এক পুত্র সন্তানের জন্ম হল এর নয় মাস পরে। তার নাম রাখা হল হোরাস। ভিলেন চাচা সেথ এর ভয়ে মা আইসিস হোরাস কে বড় না হওয়া পর্যন্ত লুকিয়ে রেখেছিলেন। হোরাস এতটুকু হল পোস্টের ভুমিকা।এবার আসল কথায় আসা যাক সূর্যদেবের নাম প্রসঙ্গে।সূর্যদেবের নাম ছিল অসংখ্য।কিন্তু কথিত ছিল তার একটি গোপন নাম আছে। যেই নাম শুধু তিনি ই জানেন। এই নামেই রয়েছে অনেক শক্তি, ক্ষমতা। কেউ যদি এই নাম জানতে পারে তাহলে প্রধান সব দেবতার সাথে সূর্যদেবের পাশে বসার অধিকার সে পাবে। রি আইসিস এই কাহিনী শোনে মনে করলেন সূর্যদেবের গোপন নাম জানতে হবে।তিনি সে চেষ্টা নিলেন।আইসিস বৃদ্ধ সূর্যদেবের থুতু র কিছু অংশের সাথে মাটি মিশিয়ে তার যাদিবিদ্যার সাহায্যে এক সাপ তৈরী করলেন।একেবারে মারাত্বক সর্প। সূর্যদেব রি প্রতিদিন বাইরে একটু হাটাহাটি করতেন।প্রতিদিনের অভ্যাস মত একদিন বের হয়েছিলেন। আইসিস এর তৈরী মারাত্বক সর্প এসে তাকে সময় সুযোগ বুঝে কামড়ে দিল। সূর্যদেব প্রথমে ভেবেছিলেন এ আর এমন কি! সাপটা বেগোরে মারা পড়বে। কিন্তু তিনি জানতেন না তার থুতুর কিছু অংশ দিয়ে তৈরী বলে সাপটা তার মতই বিষাক্ত। কিছুক্ষণ পড়ে সূর্যদেবের সারা শরীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ল। চিকিৎসকরা এসে কিছু করতে পারলেন না। বড় বড় দেবতা রা হতাশ চোখে সূর্যদেবের ছট ফটানি দেখতে লাগলেন। আইসিস এর নামডাক ছিল চিকিৎসক হিশেবে।সবাই তাকে ডাকার পরামর্শ দিলেও সূর্যদেব রাজি হচ্ছিলেন না। কারণ তার ধারণা ছিল আইসিস আসলেই তার গোপন নাম জানতে চাইবে। অবশেষে অবস্থা চরম খারাপ হলে আইসিস কে ডাকা হল।সূর্যদেব আইসিস কে গোপন নাম বলার আগে শপথ করিয়ে নিলেন, কাউকে যেন না বলে।বিশেষ করে তার বীর পুত্র হোরাস কে। আইসিস এর যাদুবিদ্যায় কাজ হল। সূর্যদেব সুস্থ হলেন।আর দেবী আইসিসকে সুর্যদেব রি তার গোপন নামটা বললেন প্রতিজ্ঞামত।এজন্য আইসিসকে বলা হয় মিস্ট্রেস অব দি গডস। আইসিসঃমিস্ট্রেস অব দি গডস।
সূর্য এবং সূর্যবংশ
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে–  দেবতা বিশেষ। হিন্দু ধর্মে সূর্য দেবতা- পাঁচটি ভিন্ন নামে প্রশংসিত হয়েছেন। এঁর মায়ের নাম অদিতি এবং পিতা কশ্যপ। অদিতির পুত্র বলে এর অন্য নাম– আদিত্য। স্বর্ভানু বা রাহু একে গ্রাস করে, এবং ইনি আবার মুক্ত হন। এঁর মুখ হলো আলোকময় আকাশ। সূর্যমণ্ডল এঁর চোখ, সূবর্ণময় হাত। ইনি সর্বদর্শী, বিশ্বভুবনের চর। সাত ঘোড়ার রথে ইনি আকাশপথে বিশ্বপর্যটন করেন। সূর্যের রথের সারথি ছিলেন অরুণ। তাঁর চলার পথ পরিস্কার করে দেন বরুণ দেবতা। ইনি স্থাবর ও জঙ্গম তথা সকল জীবের প্রাণস্বরূপ। এঁর হাতে পদ্ম থাকে।

বিশ্বকর্মা কন্যা সংজ্ঞার সাথে সূর্যের বিবাহ হয়। সূর্য সংজ্ঞার সাথে মিলিত হয়ে তিনটি সন্তান উৎপন্ন করেন। এদের নাম রাখা হয় মনু, যম ও যমুনা। সংজ্ঞা সূর্যের প্রখর দ্যুতি ও তেজ সহ্য করতে না পেরে নিজের মতো করে ছায়াকে সৃষ্টি করেন। এই ছায়াকে সূর্যের কাছে পাঠিয়ে ইনি উত্তরকুরুবর্ষে অবস্থান করতে থাকেন। সূর্য পরে ছায়ার সাথে মিলিত হয়ে তিনটি সন্তান উৎপন্ন করেন। এদের নাম রাখা হয় সার্বনি মনু, শনি ও তপতী। পরে সূর্য সংজ্ঞার কৌশল বুঝতে পেরে উত্তরকুরুতে অশ্বরূপ ধারণ করে সংজ্ঞার সাথে মিলিত হন। এই মিলনের ফলে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের জন্ম হয়। এরপর সূর্য সংজ্ঞাকে ফিরিয়ে আনেন। সংজ্ঞার উপযোগী করার জন্য বিশ্বকর্মা সূর্যকে আটটি ভাগে ভাগ করেন। এই আটটি ভাগ পৃথিবীতে পতিত হলে– বিশ্বকর্মা এগুলি দিয়ে বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিবের ত্রিশূল, কুবেরের অস্ত্র, কার্তিকেয়ের তরবারি ও অন্যান্য দেবতাদের অস্ত্র নির্মাণ করে দেন।
    অন্যত্র কথিত আছে– সূর্যপত্নী সংজ্ঞা সূর্যের তাপ সহ্য করতে অসমর্থ হলে, বিশ্বকর্মা সূর্যকে মোট ১২টি ভাগে ভাগ করেন। সেই ১২টি অংশ ভিন্ন ভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন মাসে উদিত হয়। এগুলি হলো–
                           বৈশাখ মাসের অংশের নাম– তপন   
                            জ্যৈষ্ঠ মাসের অংশের নাম– ইন্দ্র
                            আষাঢ় মাসের অংশের নাম– রবি
                            শ্রাবণ মাসের অংশের নাম– গভস্তি
                            ভাদ্র মাসের অংশের নাম– যম
                            আশ্বিন মাসের অংশের নাম– হিরণ্যরেতাঃ
                            কার্তিক মাসের অংশের নাম– দিবাকর
                            অগ্রহায়ণ মাসের অংশের নাম– চিত্র/মিত্র
                            পৌষ মাসের অংশের নাম– বিষ্ণু
                            মাঘ মাসের অংশের নাম– অরুণ
                            ফাল্গুন মাসের অংশের নাম– সূর্য
                            চৈত্র মাসের অংশের নাম– বেদজ্ঞ

মহাভারতে বর্ণিত আছে– কুন্তী দেবী দুর্বাসার কাছ থেকে বর পেয়ে সূর্যকে আবাহন করলে, সূর্য কুন্তীর সাথে মিলিত হন। এই মিলনের ফলে কর্ণ নামক মহাবীরের জন্ম হয়। আবার রামায়ণের মতে– সূর্যের বীর্য ঋক্ষরজার গ্রীবায় পতিত হলে সুগ্রীবের জন্ম হয়। সূর্য পুত্র বৈবস্বত মনু ইক্ষ্বাকুরের পিতা ছিলেন। সেই থেকে পৃথিবীতে সূর্য বংশের সূচনা হয়।    
বিন্ধ্যপর্বতের সাথে সূর্যের বাক-বিতণ্ডার ফলে, পৃথিবী ধ্বংসের উপক্রম হয়। পরে অগস্ত্য মুনি এই সংকট থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেন।    
সূর্যের বিভিন্ন নাম ও তার সংজ্ঞা: মহাদেব দক্ষের যজ্ঞ নষ্ট করার সময়- সূর্য বাধা দিতে এলে বীরভদ্র এর দাঁত বিনষ্ট করেছিলেন। সেই কারণে দন্তহীন অর্থে- অজম্ভ, অদন্ত ।
অদিতির পুত্র অর্থে- অদিতিজ, অদিতিতনয়, অদিতিনন্দন, অদিতিপুত্র, অদিতিসূত, আদিত্য।
সূর্যের সারথি ছিলেন অরুণ। এই অর্থে- অরুণসারথি।
পদ্মফুল হাতে ধারণ করেন, এই অর্থে- অব্জিনীনাথ, অব্জিনীপতি।
এই কারণে ইনি অযুগসপ্তি, অযুগ্মবাহ নামে অভিহিত হয়ে থাকেন।
সূর্যধর্মা : হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে- ত্রিগর্ত দেশের বড় রাজকুমার ছিলেন। যুধিষ্ঠির অশ্বমেধযজ্ঞ আরম্ভ করলে, অর্জুনের উপর এই অশ্ব রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এঁর আদেশে এঁর ছোটভাই কেতুধর্মা এই অশ্ব আটক করেন। এই অশ্ব নিয়ে অর্জুনের সাথে যুদ্ধ হলে, উভয়ই অর্জুনের কাছে পরাজিত ও নিহত হন।
সূর্যবংশ : সূর্য পুত্র বৈবস্বত মনু ইক্ষ্বাকুরের পিতা ছিলেন। সেই থেকে পৃথিবীতে সূর্য বংশের সূচনা হয়। রামসহ বহু বীর এই বংশে জন্মগ্রহণ করেছিল। এই বংশধারার দুটি শাখা ছিল। এর একটি ধারা ইক্ষ্বাকুর থেকে অযোধ্যায় স্থাপিত হয়েছিল। অপর ধারাটি ইক্ষ্বাকুর পুত্র নিমির থেকে মিথিলায় স্থাপিত হয়েছিল। 
সূর্যপ্রণাম :সকালে উঠে সূর্যকে প্রণাম করতে হয়
সকালে উঠে সূর্যকে প্রণাম করুন এই মন্ত্রে: . ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্। ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহষ্মি দিবাকরম্॥
.গোবিন্দ প্রণাম মন্ত্র : ওম ব্রহ্মাণ্ড দেবায় গোব্রাহ্মণ হিতায় চঃ জগদ্ধিতায় শ্রীকৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমঃ॥
.তুলসী প্রণাম মন্ত্র : বৃন্দায়ৈ তুলসী দৈব্যে প্রিয়াঐ কেশবস্য চঃ কৃষ্ণভক্তিপদে দেবী সত্যবত্যৈ নমঃ নমঃ॥
.গুরু প্রণাম মন্ত্র : অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচারম্। তত্পকদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ॥
দুর্গা প্রণাম মন্ত্র : সর্বমঙ্গল-মঙ্গল্যে শিবে সর্বথসাধিকে। শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণী নমোহস্তুতে॥
.অশ্বত্থ বৃক্ষের মাঝে রয়েছেন স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু। তাই বৃক্ষমূলে জল দিয়ে এই মন্ত্র পাঠ করতে হয় : ওঁ অশ্বত্থ বৃক্ষরূপোহসি মহাদেবেতি বিশ্রুতঃ। বিষ্ণুরপধরোহসি ত্বং পুণ্যবৃক্ষ নমোহস্ত্ত তে॥
.বিশ্বকর্মা প্রণাম মন্ত্র : দেবশিল্পিন্ মহাভাগ দেবানাং কার্যসাধক। বিশ্বকর্মন্নমস্তুভ্যং সর্বাভীষ্টফলপ্রদ॥
সূর্য যখন একটি ইতিহাস, একজন বিপ্লবী
সূর্য সেন বা সূর্যকুমার সেন,ডাকনাম কালু,যিনি মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত। ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। পূর্ববঙ্গে জন্ম নেয়া এই বাঙালি বিপ্লবী তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং নিজ জীবন বলীদান করেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন

কলকাতা মেট্রো সূর্য সেনের স্মরণে বাঁশদ্রোণী মেট্রো স্টেশনটির নামকরণ করেছে "মাস্টারদা সূর্য সেন মেট্রো স্টেশন"। এছাড়া তাঁর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়।
সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় অর্থনৈতিক ভাবে অস্বচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজমনি সেন এবং মাতার নাম শশী বালা সেন। রাজমনি সেনের দুই ছেলে আর চার মেয়ে। সূর্য সেন তাঁদের পরিবারের চতুর্থ সন্তান। দুই ছেলের নাম সূর্য ও কমল। চার মেয়ের নাম বরদাসুন্দরী, সাবিত্রী, ভানুমতী ও প্রমিলা। শৈশবে পিতা মাতাকে হারানো সূর্য সেন কাকা গৌরমনি সেনের কাছে মানুষ হয়েছেন। সূর্য সেন ছেলেবেলা থেকেই খুব মনোযোগী ভাল ছাত্র ছিলেন এবং ধর্মভাবাপন্ন গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন।
তাঁর প্রথম স্কুল ছিল দয়াময়ী উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে তিনি নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি ন্যাশনাল হাই স্কুলে ভর্তি হন। সূর্য সেন ১৯১২ সালে চট্টগ্রামের নন্দনকাননে অবস্থিত হরিশদত্তের ন্যাশনাল স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজে এফ. এ.-তে ভর্তি হন। সে সময় আই.এ বা বর্তমানের এইচএসসি পরীক্ষার পরিবর্তে ফার্স্ট আর্টস বা এফ. এ. পরীক্ষার নিয়ম ছিল। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এফ. এ. পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করে তিনি একই কলেজে বিএ-তে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু তৃতীয় বর্ষের কোন এক সাময়িক পরীক্ষায় ভুলক্রমে টেবিলে পাঠ্যবই রাখার কারণে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বিতাড়িত হন। ফলে, তাঁকে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বিএ পড়তে যেতে হয়। ১৯১৮ সালে তিনি বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন এবং চট্টগ্রামে ফিরে এসে ব্রাহ্ম সমাজের প্রধান আচার্য্য হরিশ দত্তের জাতীয় স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি দেওয়ানবাজারে বিশিষ্ট উকিল অন্নদা চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত অধুনালুপ্ত 'উমাতারা উচচ ইংরেজি বিদ্যালয়ে' অংকের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এসময় বিপ্লবী দলের সাথে তাঁর সম্পর্ক গভীরতর হয়ে ওঠে এবং শিক্ষকতা করার কারণে তিনি 'মাস্টারদা' হিসেবে পরিচিত হন।
বিপ্লবী ভাবধারায় দীক্ষিত সূর্য সেন দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকে একমাত্র তপস্যা হিসেবে নিয়েছিলেন। তাই তিনি বিবাহ-বিরোধী ছিলেন। কিন্তু বিএ পাশ করে চট্টগ্রামে আসার পর থেকেই তাঁর বিবাহের কথাবার্তা অভিভাবকরা তোলেন। অবশেষে তাঁর বড়ভাই শিক্ষক চন্দ্রনাথ সেন (সহোদর নয়) ও অন্যান্য আত্মীয়দের বিশেষ অনুরোধে ১৯১৯ সালে তিনি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ার নগেন্দ্রনাথ দত্তের ষোল বছরের কন্যা পুষ্প দত্তকে বিয়ে করেন। আত্মীয়-স্বজনের চাপে বিয়ে করলেও মাস্টারদার মনে এ ধারণা বলবৎ ছিল যে, বিবাহিত জীবন তাকে কর্তব্যভ্রষ্ট করবে, আদর্শচ্যুত করবে। তার ফলে স্ত্রীর সংগে একদিন তিনি কথা পর্যন্ত বলেন নি। বিবাহের তৃতীয় দিনে হিন্দুদের মধ্যে যে ফুলশয্যার প্রথা প্রচলিত আছে, সেদিন তিনি তাঁর বৌদিকে বলেন, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন স্ত্রীর সংগে সহবাসে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। তাই তিনি সেদিনই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে আসেন এবং তারপর স্ত্রীর সাথে আর কোনদিন দেখা করেননি।
১৯২৬ সালে সূর্য সেন পলাতক অবস্থায় কোলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রীটের এক মেসে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সেখান থেকে তাঁকে বোম্বাইয়ের (মুম্বাই) রত্নগিরি জেলে পাঠানো হয়। মাস্টারদা যখন রত্নগিরি জেলে আটক, তখন তাঁর স্ত্রীর কঠিন টাইফয়েড রোগ হয়। দেওয়ানবাজারের যে বাসা থেকে মাস্টারদা পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর স্ত্রী সেখানে তখন মৃত্যুশয্যায় ছিলেন। বহু দরখাস্তের পর মাস্টারদাকে যখন পুলিশ পাহারায় রত্নগিরি জেল থেকে ছুটিতে চট্টগ্রাম আনা হয় মূমুর্ষু স্ত্রীকে দেখার জন্য, তাঁর স্ত্রীর আয়ু তখন সম্পূর্ণ নিঃশেষিত। সূর্য সেনের স্ত্রী বিপ্লবী কাজ-কর্মে তাঁকে নেয়ার জন্য মাঝে মাঝে বয়োকনিষ্ঠ সহকর্মীদের কাছে অনু্যোগ করতেন। স্বামীর কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা পুষ্প দত্ত এ জীবনে আর এ বিপ্লবী নেতার দেহ-মনের সান্নিধ্যে যেতে পারেন নি।
ভিত্তি প্রস্তর এর নিম্নাংশঃ এটি ১৯৭৫ সনের ১৮ ই এপ্রিল বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থা ও সূর্য সেন স্মারক প্রতিমূর্তি কমিটি কলকাতা কর্তৃক স্থাপিত হয়। প্রস্তরটির এক পাশে ওই সময়ের আন্দোলনে নিহত সকল বিপ্লবীদের নাম মার্বেল পাথরে খোদাই করা আছে। মুর্তিটি সবসময় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
ভারতে ইংরেজ শাসনবিরোধী অরবিন্দ ঘোষ ১৮৯৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে দেশে ফিরে বরোদা কলেজে সহকারী অধ্যক্ষের পদে যোগদান করেন। এ সময় তিনি মহারাষ্টের গুপ্ত বিপ্লবী সমিতির নেতা দামোদর হরি চাপেকার এবং রামকৃষ্ণ হরি চাপেকারের সংস্পর্শে এসে বিপ্লবে অনুপ্রানিত হলেন। তাঁর এবং তরুণ ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রের তৎপরতায় কলকাতার আপার সার্কুলার রোডের একটি বাড়িতে বাংলার প্রথম গোপন বিপ্লবীদল “অনুশীলন” সমিতি গঠন করা হয়। ১৮৯৯-১৯০১ সালে গঠিত এই সমিতির সভাপতি ছিলেন প্রমথনাথ মিত্র এবং কোষাধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ দলে পরে যুক্ত হলেন বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী, যোগেন্দ্র বিদ্যাভূষন প্রমুখ। অনুশীলন সমিতির সদস্যদের লাঠি খেলা, অসি খেলা, ছোরা খেলা, কুস্তি, মুস্টিযুদ্ধ ইত্যাদি শিক্ষা দেয়া হত। অরবিন্দ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখের চাঁদাতে এই সমিতি চলত। লাঠি খেলা, অসি খেলা, ছোরা খেলায় তৃপ্ত থাকতে অস্বীকার জানিয়ে বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী “অনুশীলন সমিতি” থেকে আলাদা হয়ে “যুগান্তর” দল গঠন করে। “অনুশীলন” সমিতি এবং “যুগান্তর” এ দুই দলের শাখা পূর্ব বাংলায় গড়ে উঠে। পুলিন দাসকে ঢাকা অনুশীলন সমিতির অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়। এর সাথে আরো যুক্ত ছিলেন প্রতুল গাঙ্গুলী, কেদারেশ্বর সেন, রবি সেন প্রমুখ পশ্চিম বাংলার মানিকতলায় বিপ্লবীদের বোমার কারখানা আবিস্কারের পর অরবিন্দ ঘোষ সহ অনেক বিপ্লবীদের আলিপুর বোমা মামলায় জড়ানো হয়। ১৯০৭ সালে ঐ মামলার পলাতক কিছু আসামী গোপনে পালিয়ে চট্টগ্রাম আসেন। এসময় তাদের আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে চট্টগ্রামে প্রথম বিপ্লবী সংগঠনের জন্ম হয়। যামিনী সেন, মণীন্দ্র সেন আর অম্বিকা চক্রবর্তী প্রমুখ ছিলেন এই সংগঠনের সদস্য। এই বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যরা কলকাতা থেকে গোপনভাবে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা এবং ইস্তেহার চট্টগ্রামে বিলি করতেন। সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য অস্ত্র এবং বিস্ফোরক তাদের হাতে ছিল না
১৯১৬ সালে বহররমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে সূর্য সেন সরাসরি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হন। বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি এই কলেজ়ে তিনি অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে আসেন। তিনি যুগান্তর দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। সূর্য সেনকে তিনি বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। সূর্য সেন ১৯১৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করে চট্টগ্রামে এসে গোপনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন। ৪৯নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের নগেন্দ্রনাথ সেন ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে এসে সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী ও চারুবিকাশ দত্তের সাথে দেখা করেন। সূর্য সেন এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী অম্বিকা চক্রবর্তী একই থানার পাশাপাশি গ্রামের ছাত্র হিসেবে ছোটবেলা থেকেই পরস্পরের কাছে পরিচিত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) শেষের দিকে অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে গোপন বিপ্লবী দল গঠন করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, শুরুতে চট্টগ্রামের বিপ্লবী দল একটিই ছিল। তারা বাংলার প্রধান দু'টি বিপ্লবী দল "যুগান্তর" এবং "অনুশীলন"- কোনটির সাথে একেবারে না মিশে গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। বিপ্লবী নেতা সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী তখন চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানবাজার দেওয়ানজী পুকুরপারে 'সাম্য আশ্রম' প্রতিষ্ঠা করে ওখানে থাকেন। সেখানে গোপনে বিপ্লবীরা জমায়েত হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের অন্যতম নেতা চারুবিকাশ দত্ত তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে "অনুশীলন" দলের সাথে যুক্ত হয়ে যান। এভাবে চট্টগ্রামেও বাংলার অন্যান্য জেলার মত দু'টি বিপ্লবী দল গড়ে ওঠে। দুই দলে বিভক্ত হওয়ার পর চট্টগ্রামে যে বিপ্লবী দলটি নিজস্ব স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে কংগ্রেসের প্রকাশ্য আন্দোলনে কোলকাতার "যূগান্তর" দলের সঙ্গে সহযোগিতা করত, সে দলের সাংগঠনিক কমিটি ছিল নিম্নরূপ- সভাপতি- সূর্য সেন; সহসভাপতি- অম্বিকা চক্রবর্তী; শহর সংগঠনের দায়িত্বে- গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিংহ; গ্রামের সংগঠনের দায়িত্বে- নির্মল সেন। এছাড়া লোকনাথ বলকে ছাত্র আন্দোলন ও ব্যায়ামাগার গঠন প্রভৃতি কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। অনুরূপ সেন বিপ্লবীদলের সংবিধান লিখলেন এবং তাঁকে ও নগেন্দ্রনাথ সেনকে কলকাতার অন্য দলগুলোর সাথে যোগাযোগ এবং অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৯২০ সালে গান্ধীজী- কর্তৃক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে অনেক বিপ্লবী এই আন্দোলনে যোগ দেন। গান্ধীজীর অনুরোধে বিপ্লবীরা তাদের কর্মসূচি এক বছরের জন্য বন্ধ রাখেন। সূর্য সেন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিলেন। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্র ও বিপ্লবী অনন্ত সিংহ ছাত্র ধর্মঘট পরিচালনা করার জন্য স্কুল থেকে বহিস্কৃত হন। মহাত্মা গান্ধী ১৯২২ সালে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করলে বিপ্লবী দলগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠে। তখন চট্টগ্রাম কোর্টের ট্রেজারী থেকে পাহাড়তলীতে অবস্থিত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন নিয়ে যাওয়া হতো। ১৯২৩-এর ১৩ ডিসেম্বর টাইগার পাস এর মোড়ে সূর্য সেনের গুপ্ত সমিতির সদস্যরা প্রকাশ্য দিবালোকে বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭,০০০ টাকার বস্তা ছিনতাই করে। ছিনতাইয়ের প্রায় দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠক চলাকালীন অবস্থায় পুলিশ খবর পেয়ে বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দিলে পুলিশের সাথে বিপ্লবীদের খন্ড যুদ্ধ হয় যা "নাগরখানা পাহাড় খন্ডযুদ্ধ" নামে পরিচিত। যুদ্ধের পর গ্রেফতার হন সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। রেলওয়ে ডাকাতি মামলা শুরু হয় সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তীকে নিয়ে। অনন্ত সিং আর গণেশ ঘোষের নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়। কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এই মামলায় আসামি পক্ষের আইনজীবি ছিলেন। সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী এ মামলা থেকে ছাড়া পেয়ে যান। গ্রেফতার করার পর বিপ্লবীদের উপর নির্যাতনের কারনে কলকাতা পুলিশ কমিশনার টেগার্টকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে বিপ্লবীরা। এই পরিকল্পনার কথা পুলিশ আগে থেকেই জানতে পারে। এ কারনে ২৫ অক্টোবর ১৯২৪ সালে গ্রেফতার হন গণেশ ঘোষ, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং সহ আরো কয়েকজন। পুলিশকে বার বার ফাঁকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯২৬ সালের ৮ অক্টোবর সূর্য সেন কলকাতার ওয়েলিংটন স্ট্রীটে গ্রেফতার হন। বন্দী হবার পর তাঁকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। পরে বোম্বের রত্নগিরি জেলে পাঠানো হয়, সেখান থেকে বেলগাঁও জেলে। ১৯২৭ সালে নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং মুক্তি পান। আর ১৯২৮ সালের শেষভাগে সূর্য সেন ও গণেশ ঘোষ জেল থেকে ছাড়া পান।
বিপ্লবী সংগঠনে মেয়েদের সদস্য করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিপ্লবীদের প্রতি মা, নিজের বোন এবং অন্যান্য নিকট আত্নীয় ছাড়া অন্য মেয়েদের সাথে মেলামেশা না করার নির্দেশ ছিলো মাষ্টার’দা সূর্য সেনের। পরে তিনি এই নির্দেশ শিথিল করেন। এতে পরবর্তীতে কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বিপ্লবী সংগঠনে যোগ দেন।
১৯২৮ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাসে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বার্ষিক অধিবেশন হয়। ঐ অধিবেশনে চট্টগ্রাম থেকে যে প্রতিনিধিরা ছিলেন তাঁরা হলেন সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং, নির্মল সেন, লোকনাথ বল, তারকেশ্বর দস্তিদার প্রমুখ। সেখানে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের সাথে সূর্য সেনের সাথে বৈঠক হয়। ১৯২৯ সালে মহিমচন্দ্র দাস এবং বিপ্লবী সূর্য সেন যথাক্রমে চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঐ বছর বিপ্লবী নেতাদের উপর পুলিশের পাহারা আরো জোরদার করার জন্য কলকাতার কেন্দ্রীয় অফিস থেকে নির্দেশ আসে। ১১ জন গোয়েন্দা এবং চব্বিশজন পুলিশ নিয়োগ করা হলো ছয়জন বিপ্লবী নেতার জন্য। ১৯৩০ সালের শুরু থেকেই আসকার খাঁর দিঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত কংগ্রেস অফিসে সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী ভবিষ্যৎ এর সশস্ত্র বিপ্লবের রুপরেখা নিয়ে বিভিন্ন নেতা কর্মীদের সাথে আলোচনা করতেন। এসব আলোচনার পর ঠিক করা হয় শুধু শহর না, বরং বিভিন্ন গ্রাম এবং কক্সবাজার থেকেও বিপ্লবীদের নেয়া হবে। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেদের দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় “ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চিটাগাং ব্রাঞ্চ”।  বাংলায় “ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনী, চট্টগ্রাম শাখা”।। আইরিশ বিপ্লবের ধাঁচে একটা পরিকল্পনা তৈরি করা হয় যার মূল কর্মসূচী ছিল : না করা।
পরিকল্পনা অনুসারে কাজের জন্য কয়েকটা দল গঠন করা হয়। সূর্য সেনের দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৫ জন, অম্বিকা চক্রবর্তীর ১৫ জন, অনন্ত সিং এবং গণেশ ঘোষের ২২ জন, নির্মল সেনের ৬ জন। এই দলগুলোর মধ্যে আবার উপদল ছিল। ইতোমধ্যেই চলছিলো অস্ত্র সংগ্রহ এবং বোমা তৈরির কাজ।
১৮ এপ্রিল ১৯৩০, শুক্রবার রাত ৮টা বিদ্রোহের দিন হিসাবে ঠিক হয়। পরে তা দশটা করা হয়। চারটা বাড়ি হতে চারটা দল আক্রমণের জন্য বের হয়। সে রাতেই ধুম রেলস্টেশনে একটা মালবহনকারী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে উল্টে যায়। একদল বিপ্লবী আগে থেকেই রেল লাইনের ফিসপ্লেট খুলে নেয়। এর ফলে চট্টগ্রাম সমগ্র বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্য একটি দল চট্টগ্রামের নন্দনকাননে টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ অফিস আক্রমণ করে। হাতুড়ি দিয়ে তারা সব যন্ত্রপাতি ভেঙ্গে দেয় এবং পেট্রোল ঢেলে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আরেকটি দল পাহাড়তলীতে অবস্থিত চট্টগ্রাম রেলওয়ে অস্ত্রাগার দখল করে নেয়। উন্নতমানের রিভলবার ও রাইফেল গাড়ীতে নিয়ে অস্ত্রাগারটি পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানো হয়। তবে সেখানে কোনো গুলি পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবীরা দামপাড়ায় পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক দখল করে নেয়। এই আক্রমনে অংশ নেয়া বিপ্লবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে সূর্য সেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সূর্য সেন অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষনা দেন। তিনি তার ঘোষনায় বলেন :
"The great task of revolution in India has fallen on the Indian Republican Army. We in Chittagong have the honour to achieve this patriotic task of revolution for fulfilling the aspiration and urge of our nation. It is a matter of great glory that today our forces have seized the strongholds of Government in Chittagong…The oppressive foreign Government has closed to exist. The National Flag is flying high. It is our duty to defend it with our life and blood".
চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরুপে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল চারদিন। কিন্তু এরমধ্যে বিপ্লবীদের খাদ্যসংকট দেখা দিল এবং সূর্য সেন সহ অন্যদের কচি আম, তেঁতুল পাতা, কাঁচা তরমুজ এবং তরমুজের খোসা খেয়ে কাটাতে হয়। সূর্য সেন সহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার ৫০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষনা করে। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে (চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পাহাড়) অবস্থান করছিল সে সময় সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাঁদের আক্রমণ করে। দুই ঘন্টার প্রচন্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন নিহত হয়।
জালালাবাদ যুদ্ধের পর বিপ্লবী নেতাদের ধরার জন্য রেলস্টেশন, স্টীমারঘাট হতে শুরু করে সব স্থানে অভিযান চলছিলো। বিপ্লবীরা তখন বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে আত্মগোপন করে ছিলো। সূর্য সেন ১৬ জন বিপ্লবীকে নিয়ে ২৪ এপ্রিল রাতে নিজ বাড়িতে আসেন। এর মধ্যে অনন্ত সিং পুলিশের কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দেন এবং কয়েকজনকে পুলিশ আটক করে এবং এদের বিরুদ্ধে অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলা শুরু হয়। এ মামলা শুরু হওয়ার পর অসুস্থ অম্বিকা চক্রবর্তী পটিয়া থানার চক্রশালা গ্রামে গ্রেপ্তার হন। অম্বিকা চক্রবর্তী এবং সেসময় গ্রেপ্তার হওয়া অন্য বিপ্লবীদের নিয়ে দ্বিতীয় অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলা শুরু হয়। প্রায় ১৯ মাস বিচারের পর ১৯৩২ সালের ১লা মার্চ অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলার রায়ে অনন্ত সিং, লোকনাথ বল এবং গনেশ ঘোষসহ ১২ জনকে দ্বীপান্তর বাসের আদেশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে অপর মামলায় অম্বিকা চক্রবর্তীর প্রাণদন্ডের আদেশ হয় পরে হাইকোর্টে আপিলের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। এ রায়ের পর সূর্য সেনকে ধরার জন্য পটিয়া এবং গোমদন্ডীতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়। সরকার ৫০০০ টাকার পরিবর্তে ১০,০০০ পুরস্কার ঘোষনা করে। ১৯৩২ সালের ১৩ জুন রাত ৯টায় পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী চক্রবর্তীর বাড়িতে তাঁকে ধরার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ক্যামেরনকে গুলি করে সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন কিন্তু নির্মল সেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলের (চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের দিন) অন্যতম একটি পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ কিন্তু গুড ফ্রাইডে থাকায় সেদিন ঐ ক্লাবে কেউ ছিল না। মাস্টার’দা সূর্য সেন স্থির করেন ২৩ সেপ্টেম্বর (১৯৩২ সাল) ইউরোপীয় ক্লাবে প্রীতিলতার নেতৃত্বে হামলা করা হবে। এ প্রসজ্ঞে মাস্টার’দা লিখেছেন
"বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ, কালারপোল পর্যন্ত এদের দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেছে। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগৎ জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পেছনে নেই”।২৩ সেপ্টেম্বর রাতে প্রীতিলতা সূর্য সেন-এর নির্দেশে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। হামলায় ৫৩ জন ইংরেজ হতাহত হয়েছিল। গুলিতে আহত প্রীতিলতা দৈহিকভাবে অত্যাচারিত হওয়ার চাইতে থেকে স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিলেন। তিনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
ইংরেজ প্রশাসন সূর্য সেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরার জন্য সর্বাত্নক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। সূর্য সেন গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলেন। ১৯৩৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী রাতে সেখানে এক বৈঠকে ছিলেন কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত, ব্রজেন সেন আর সুশীল দাসগুপ্ত। ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্র সেন সূর্য সেনের উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয়। রাত প্রায় ১০টার দিকে পুলিশ আর সেনাবাহিনী ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িটি ঘিরে ফেলে। রাতের অন্ধকারে গুলি বিনিময় করে কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত আর সুশীল দাসগুপ্ত পালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু রাত ২টার দিকে অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন।তারপর ঐ বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ সূর্য সেনের নিজের হাতে লেখা অর্ধসমাপ্ত আত্মজীবনীর খাতা উদ্ধার করে। সেই খাতার উপর লেখা ছিল “বিজয়া”। বিচারের সময় “বিজয়াতে” লেখা তাঁর কথাগুলো বিপ্লব এবং প্রশাশনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রমান হিসাবে অনেকবার ব্যবহার করা হয়। ১৭ই ফেব্রুয়ারী রাতে সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেনকে প্রথমে জেলা গোয়েন্দা সদর দপ্তরে, পরে কোর্ট হয়ে চট্টগ্রাম জেলে নেয়া হয়। সূর্য সেন গ্রেপ্তার হবার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল “চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন সম্পর্কে ফেরারী সূর্য সেনকে গত রাতে পটিয়া হইতে ৫ মাইল দূরে গৈরলা নামক স্থানে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে। সূর্য সেনকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মামলায় প্রধান আসামি বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। গত ১৯৩০ সাল হইতে সূর্য সেন পলাতক ছিলেন এবং তাঁহাকে ধরাইয়া দিবার জন্য গভর্নমেন্ট দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষনা করিয়াছিলেন”। ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বেঙ্গল চিফ সেক্রেটারী কর্তৃক লন্ডনে ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে কাছে পাঠানো রিপোর্টে লেখা হয়
“The outstanding event of the fortnight is the arrest on 17 February of Surjya Sen of Chittagong Armoury Raid notoriety, who, as the leader and brain of absconders, has been giving constant anxiety over the last three years. It was unfortunate that when Surjya Sen and his companion were arrested, 4 others made good their escape…But luck enters very largely into these night operations and it certainly was a great stroke of luck that Surjya Sen was secured”।
সূর্য সেন গ্রেফতার হবার পর তারকেশ্বর দস্তিদার দলের নেতৃত্ব গ্রহন করেন। কিন্তু ১৯৩০ সালের ১৮ই মে আনোয়ারা থানার গহিরা গ্রামে পুলিশ আর মিলিটারীর সাথে সংঘর্ষের পর তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্ত গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে বিপ্লবীরা জেল থেকে সূর্য সেনকে মুক্ত করার জ়ন্য কয়েকবার চেষ্টা চালায়। প্রতিবারই তাদের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়।
সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তকে বিচারের জন্য ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ট্রাইব্যুনালের কমিশনাররা ছিলেনঃ বাখরগঞ্জের দায়রা জজ ডব্লিউ ম্যাকসার্পি, সিলেটের অতিরিক্ত দায়রা জজ রজনী ঘোষ এবং চট্টগ্রামের দায়রা জজ খোন্দকার আলী তোয়েব। ১৫ জুন ১৯৩৩ এ শুরু হওয়া এ মামলায় কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়। আগ্নেয়াস্ত্র বহন করা ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগের প্রত্যক্ষ প্রমান উপস্থাপন করা যায়নি। ১৪ আগষ্ট ১৯৩৩ সালে এই মামলার রায় ঘোষনা করা হয়। পরদিন আনন্দবাজার পত্রিকার খবর ছিলঃ “চট্টগ্রাম ১৪ই আগষ্ট—অদ্য দ্বিপ্রহর ১২ ঘটিকার সময় স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল হইতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মামলার রায় প্রদত্ত হয়। ট্রাইব্যুনাল সূর্য সেনকে ১২১ ধারা অনুসারে দোষী সাব্যস্ত করিয়া প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেন। ওই একই ধারায় তারকেশ্বর দস্তিদারের প্রতিও প্রাণদন্ডের আদেশ প্রদত্ত হয়। কুমারী কল্পনা দত্তকে ভারতীয় দন্ডবিধির ১২১ ধারা অনুসারে দোষী সাব্যস্ত করিয়া তাঁহার প্রতি যাবজ্জীবন দন্ডাদেশ প্রদান করা হয়। আদালত প্রাঙ্গনের চারিদিকে পুলিশের বিশেষ বন্দোবস্ত করা হইয়াছিল। রায় প্রদত্ত হইবার পুর্বে সেনাদল কিছুকাল শহরে কুচকাওয়াজ করে। আসামীরা শান্তচিত্তে দন্ডাদেশ গ্রহণ করে এবং তৎক্ষণাৎ আদালত হইতে স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁহারা বিপ্লবাত্নক ধ্বনি করিতে করিতে আদালত গৃহ ত্যাগ করে। ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট রায়ের উপসংহারীয় অংশ পাঠ করেন। ১৫০ খানা টাইপ করা কাগজে প্রদত্ত হইয়াছে।”  মামলার রায় প্রদানের পর তিনজন বিপ্লবীর পক্ষে কলকাতা হাইকোর্টে আপিলের আবেদন করা হয়। ১৪ নভেম্বর ১৯৩৩ সালে হাইকোর্ট প্রদত্ত রায়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের দেয়া দন্ড বহাল রাখে।
এইখানেই মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসি হয়েছিল
কনডেম্‌ড সেলে সূর্য সেনকে কড়া পাহারায় নির্জন কুঠুরীতে রাখা হত। একজন কয়েদি মেথর সূর্য সেনের লেখা চিঠি ময়লার টুকরিতে নিয়ে জেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বন্দী বিপ্লবীদের দিয়ে আসতো। মৃত্যুর আগে জেলে আটক বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে’র কাছে সূর্য সেন পেন্সিলে লেখা একটি বার্তা পাঠান। সে বার্তায় তিনি লেখেন “আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা”। তিনি স্মরণ করেন তাঁর স্বপ্নের কথা--স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন যার জন্য জীবনভর উৎসাহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মত তিনি ছুটেছেন। তাঁর ভাষায় “ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো”। তিনি সংগঠনে বিভেদ না আসার জন্য একান্তভাবে আবেদন করেন । শেষ দিনগুলোতে জেলে থাকার সময় তাঁর একদিন গান শোনার খুব ইচ্ছা হল। সেই সময় জেলের অন্য এক সেলে ছিলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। রাত ১১টা/১২টার দিকে কল্পনা দত্ত তাঁকে চিৎকার করে বলেন “এই বিনোদ, এই বিনোদ, দরজার কাছে আয়। মাষ্টারদা গান শুনতে চেয়েছেন”। বিনোদ বিহারী গান জানতেন না। তবুও সূর্য সেনের জন্য রবিঠাকুরের “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে” গানটা গেয়ে শোনালেন। ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারী মধ্যরাতে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসী কার্যকর হবার কথা উল্লেখ করা হয়। সূর্য সেন কে এবং তারকেশ্বর দস্তিদারকে ব্রিটিশ সেনারা নির্মম ভাবে অত্যাচার করে। ব্রিটিশরা হাতুরী দিয়ে তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দেয় এবং তাঁর হাড় ও ভেঙ্গে দেয়। হাতুরী দিয়ে নির্মম ভাবে পিটিয়ে অত্যাচার করা হয়। এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের লাশ আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানো হয়নি। ফাঁসীর পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টীমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহ দুটোকে ব্রিটিশ ক্রুজার “The Renown” এ তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়।


কৃতজ্ঞতা : গুগল সার্চ ইঞ্জিন, উইকিপিডিয়া।

কোন মন্তব্য নেই: