লিখেছেন : পাপ্পন দাস
ভারতের
সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে যে ভারত একটি ধর্মননিরপেক্ষ রাষ্ট্র।তার মানে ধরে
নেওয়া যায় যে দেশের সংবিধানই বলে দিচ্ছে, ভারতে ধর্মান্ধদের কোনও স্থান
নেই।কিন্তু বর্তমান ভারতের কিছু রাজনৈতিক গতিবিধির দিকে চোখ রাখলে কোনও
কিছুই আর গোপন থাকে না।বোঝা যায় যে আজকাল অনেকে ইচ্ছে করেই দেশের এই সুন্দর
মহিমা,যাকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে আখ্যায়িত করেছি,তাকে আহত করছেন।
প্রথমেই ধরে নেওয়া যাক গো-মাংস প্রসঙ্গ।আজকাল মনে হচ্ছে এই গো-মাংস
জিনিসটি যতটা না মাংস,তার চেয়ে ঢের বেশি বিতর্কিত।এই জিনিসটি যেন হয়ে গেছে
আজকাল বিতর্কের অন্য একটি নাম।বস্তুত আজ সারা ভারতে এ ধরণের চরম বিতর্কিত
জিনিস আর দু-টি আছে বলে আমার মনে হয় না।আজকাল এই গো-মাংস বিষয়টি এমনভাবে
চর্চিত যে মনে হচ্ছে দেশে বুঝি আর কোনো ইস্যুই নেই।
সেদিন ফেসবুকে পূর্ব বাংলার আমার এক বন্ধু এই ব্যাপারে লিখেছে,' ভারত
ক্রমশ একটি "গরুর দেশ" হতে চলেছে। গরু এবং ভারত যেন এখন সমার্থক। ওরা মাকে
ধর্ষণ করে গরুকে মা ডাকে। আবার সেই গরু নামক মাকে পূজা করতে মানুষকে হত্যা
করে। যেখানে প্রতিদিন ভারতের কোথাও না কোথাও কোনও নারী ধর্ষিত হয় সেখানে
গরুকে মা ভেবে পূজা করা ও তাকে বাঁচাতে মানুষকে হত্যা করা প্রমাণ করে ভারত
মানুষের দেশ থেকে "গরুর দেশ" দেশ হতে চলছে। হিন্দুত্ব বেঁচে থাক, গরুও
বেঁচে থাক, শুধু মানুষ নিপাত যাক।'
সে কিন্তু ভুল
কিছু লিখেনি।দেশের বাইরে বসে একজন লোক যদি এই ব্যাপারটাকে এত সুন্দর করে
উপলব্ধি করতে পারেন,তাহলে দেশে বসে কেন আমরা ব্যাপারটাকে তোল দিতে চাইছি
না।এই যেমন সেদিন,আমাদের রাজ্যের যোরহাট জেলায় গরুর মাংস রাখার অভিযোগে তিন
জনকে গ্রেফতার করা হয়।তাছাড়া এদের মধ্যে একটি নাবালকও রয়েছে।আর এই
গ্রেফতারের ঘটনা জনসম্মুখে আসার পর সারা এলাকা জুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের
সৃষ্টি হয়েছে।কিন্তু যাদের ধরা হয়েছে এরা সবাই মুসলিম সম্প্রদায়ের।আর তাইতো
প্রশ্ন উঠছে,আমরা কি আজকাল মানুষের বাড়ির ফ্রিজের দিকেও চোখ রাখতে উদ্যত?
গটনাটি যোরহাটের ভোগদৈ পুলিশ ফাঁড়ির গোঁহাইটেকলা গ্রামের।অভিযোগ
ছিল,একজন নাবালক সহ তিন জন মুসলিম নির্মাণ শ্রমিক তাদের কাছে প্রায় আধ কেজি
ওজনের গো-মাংস রেখেছেন।তারা একটি ভবন নির্মাণের কাজে যুক্ত,আর সেখানে বসেই
তারা গরুর মাংসগুলো ভক্ষণ করেন।ঘটনার খবর পেয়ে এম বোরা নামের এক ব্যক্তি
পুলিশ ফাঁড়িতে এজহার দায়ের করেন।পুলিশ এসে গরুর মাংস বাজেয়াপ্ত করে,এবং
তাদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়।যোরহাট পুলিশের কাছে এই ব্যাপারে জানতে
চাওয়া হলে তারা জানায়,ধৃত তিন নির্মাণ কর্মীকেই পুলিশি হেফাজতে রাখা
হয়েছে।এদের মধ্যে একজন ধুবড়ির।তার নাম শাহজাহান হক।আরেকজন কোকড়াঝাড়
জেলার।তার নাম আছুর রহমান।আর তৃতীয়জনের নাম জানা যায়নি।
এখানে উল্লেখ্য যে কিছুদিন আগেও গো-মাংস পাচার নিয়ে একটা ঘটনা
ঘটেছে।রাজস্থানের আলোয়ারে গো-পাচারের সময় মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু লোককে
হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোক পাকড়াও করেন।তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকদের
উপর অত্যাচার করেন।এবং এতে একজন লোক প্রাণ হারান,এবং কিছু লোক আহত হন।
এদিকে যোরহাটের ঘটনা নিয়ে বিজেপির তরফ থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা
হয়েছে।তারা জানিয়েছে,খুব তাড়াতাড়ি তারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব রাজ্যে
ক্ষমতায় ফিরছে।আর ক্ষমতায় এলে তারা গো-হত্যার ওপর কোনও ধরণের নিষেধাজ্ঞা
আরোপ করবে না।কিন্তু সেদিনের এই শ্রমিকদের গ্রেফতারের পর এলাকার পুলিশ
সুপারের বক্তব্য বিজেপির তরফ থেকে প্রকাশিত বিবৃতির সঙ্গে কোনওভাবেই মিল
খাচ্ছে না।তিনি জানান,'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার জন্যই ওই তিন নির্মাণ
শ্রমিক প্রকাশ্যে গরুর মাংস নিয়ে এসেছিল।১৯৫০ সালের অসম পশু সুরক্ষা আইনে
রাজ্যে গো-হত্যা নিষিদ্ধ।' তবে জেলার পশুপালন দফতরের কর্মীদের এই ব্যাপারে
প্রশ্ন করা হলে তারা জানান,এই মাংস গো মাংস কি-না,তা পরীক্ষার জন্য
ল্যাবটরিতে পাঠানো হয়েছে।
নিবন্ধের প্রথমেই
লিখেছি যে,ধর্মনিরপেক্ষতার মহিমাকে আজকাল খুব জোর আঘাত করা হচ্ছে।তার
আরেকটা প্রমাণ হল উত্তরপ্রদেশের নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের
সাম্প্রতিক একটা ভাষ্য।সেদিন আবার তিনি ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার
তার ভাবনাকে উস্কে দেন।তিনি বলেন,'হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণাতে কোনও ভুল
নেই।সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ইতিমধ্যে হিন্দুত্ব সম্পর্কে
পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়েছে।সুপ্রিম কোর্ট বলেছে,হিন্দুত্ব কোনও সম্প্রদায়
বিশেষের উপাসনা পদ্ধতি নয়।এটা হচ্ছে জীবন পদ্ধতি।আর যদি দেশকে হিন্দু
রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্যোগে জনগণের উন্নত জীবনযাপন ও দেশের স্বার্থ
সুরক্ষিত হয়,তা-হলে হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা গ্রহণে কারও কোনও সমস্যা থাকা
উচিত নয়।'
যোগী আদিত্যনাথের এই বক্তব্য নিয়ে
রাজনৈতিক মহলে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে।আর এই বিষয় নিয়ে বিতর্ক হওয়াই
স্বাভাবিক।কিন্তু শাসক দল বিজেপি আদিত্যনাথের বক্তব্যের সমর্থন করছে।দলের
সাধারণ সম্পাদক বিজয় বাহাদুর পাঠক এই ব্যাপারে বলেন যে,আমাদের
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে অন্যায়ের কিছু নেই।হিন্দু ধর্ম সবসময় শান্তির কথা
বলে আসছে,আর আমাদের মুখ্যমন্ত্রীও শান্তির কথা বলছেন।বস্তুত মেকি
ধর্মনিরপেক্ষতা আমরা অনেক দেখেছি,এবং আজও দেখে আসছি।
এদিকে সেদিন দুরদর্শনকে দেওয়া সাক্ষাতকারে যোগী আদিত্যনাথ আরও অনেক
বিষয়ে মুখ খুলেন।সন্ন্যাসী হয়ে কিভাবে তিনি রাজনীতিতে এলেন,এই ব্যাপারে
প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,'যোগীরা যদি রাজনীতিতে আসে,তাতে ক্ষতি কী?আমি তো
এতে ক্ষতির কিচ্ছু দেখছি না।আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও কি একজন
যোগীর চেয়ে কোনও অংশেও কম?দেশের প্রতি যোগীদের অবদান অপরিসীম।তাছাড়া
রাজনীতি যোগীদের জন্য,এটা ভোগীদের জন্য নয়।
এবার
আসি মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু নেতার প্রসঙ্গে।আজম খান,আসাদ উদ্দিন
ওয়েসি--এরা প্রত্যেকেই নিজেদেরকে মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি মনে করেন।আর তারা
মাঝে মাঝে এমন কিছু কথা বলে থাকেন,যা অনায়াসেই ধর্মনিরপেক্ষতার টুঁটি চেপে
ধরে।তাদের বক্তব্য ধর্মনিরপেক্ষতার গলা টিপে দেয়।তাদের ভাষা আমাদের
আশেপাশের সার্বিক পরিস্থিতিকে সুন্দর করা তো দূর,এতে বিতর্ক আরও সুন্দর পথ
পেয়ে যায়।
আর তাইতো বলতে বাধ্য হচ্ছি ভারতের
বর্তমান পরিস্থিতি অন্ধকারের পথ ধরে চলছে।আর সত্যি সত্যিই হিন্দু-মুসলমান
সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক ঐতিহ্য, যা নিয়ে আমরা খুব গর্ব করে থাকি,তা কিন্তু
আজ প্রত্যাহ্বানের মুখে।আর এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।এর দেশে দেশকে বাঁচাতে
হলে আমাদের সবার মাঠে নামতে হবে,ধর্মনিরপেক্ষতার শত্রুদের পথ আগলে দাঁড়াতে
হবে।এবং এতেই হয়ত দেশ আবার নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন