সোমবার, মে ০১, ২০১৭

কাঁহা গেলে তোমা পাই

লিখেছেন : ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

মানুষটার যাবার এত কিসের তাড়া ছিল কে জানে। চলেই যদি যাবে তো আশার কি প্রয়োজন ছিল; আর এলোই যখন, তখন আরও কিছুদিন থাকলে কি খুব ক্ষতি হতো! খুব কি প্রয়োজন ছিল এক উদ্ভিন্নযৌবনা যুবতীকে পরিত্যাগ করে অন্যত্র মন সমর্পণের? উত্তরেরা আজ তিনবছর পরেও ধরা দেয়নি; ধরা পড়েনি সে পুরুষালিতাও। মৃদু চিনচিনানি নিয়ে নাছোড় যন্ত্রণাটা অস্তিত্ব জ্ঞাপন করে চলেছে আজও। বারে বারে জৈষ্ঠ্যের নুনজড়ানো দুপুরে হঠাৎ পাওয়া একঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ার মতোই আবেশ-বিহ্বল করে তোলে মধুময় স্মৃতিগুলো। নিজের অজান্তেই একচিলতে হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোণায়। নিজের সবটুকু পুরুষত্ব নিয়ে যেন তাকে জাপটে ধরে সে অশরীরী অস্তিত্ব; মিশে যায় অভ্যন্তরে। নিকোটিন আর ঘাম মিলেমিশে তৈরি হওয়া ঝাঁঝালো গন্ধটার অলীক স্থিতি মোহাচ্ছন্ন করে তোলে। জীবনে-যৌবনে অন্ধের মতো হাঁতড়ে ফিরছে উপলা সে পুরুষকে; তার প্রাক্তন স্বামী সলিলকে।
##

পুরুষের কাছে যা প্রথম শ্রেণির দুর্বলতা, নারীর কাছেই তাই ব্রহ্মাস্ত্র বিশেষ। বড়ো বড়ো রাজা উজিরকেও হেলায় ভূতলশায়ী করে তোলে অস্ত্র প্রয়োগে পারদর্শী রমণীরত্ন। শরীর নিয়ে কোনোদিনই রক্ষণশীল হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি উপলা। বরং উগ্র এক অহমিকা ছিল। কলেজের দিনগুলোয় প্রেমিকদের সঙ্গে চুম্বন তো ছিল নিত্য নৈমিত্তিকতা। মিলনও হয়েছে অনেকবার। শাস্ত্রই তো বলেছে: ক্ষুধা তৃষ্ণার ন্যায় রতির তৃপ্তিও আবশ্যক প্রয়োজনীয়তা। সলিলের সঙ্গেই তো দুবার মন্দারমণি ঘুরে এসেছে বিয়ের আগে। বিছানায় অনভিজ্ঞ সলিলকে রীতিমতো শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হয়েছে উপলাকে, কাম্য সুখ প্রাপ্তির উপায়গুলো।

বিশেষ করে মনে পড়ে মধুচন্দ্রিমার দিনগুলো। নিদেনপক্ষে তিন চারবার তারা মিলিত হয়েছিল সেই দশটা দিন। উদ্দাম যৌনতার সে উৎসব মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। পেগিং এর বেদনাকাতর পুরুষের অভিব্যক্তির স্মৃতি আজও সিক্ত করে তোলে। সলিলও ততদিনে পাকা খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিল। চুলের মুঠি ধরে চারপেয়ে উপলাকে রমণে বাধ্য করেছে পাশবিক নিঠুরতায়। দমবন্ধ হয়ে আসা কষ্টর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তীক্ষ্ণ চিৎকারে - ঘনীভূত হয়েছে উভয়ের যৌন পরিতৃপ্তি।

বিয়ের পর অবশ্য অভিসারে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। তার যাবতীয় শারীরিক প্রয়োজনই মিটেছে স্বামী সমীপে। ক'বছর ধরে রীতিমতো আঙুলের ডগায় নাচিয়েছে স্বামীকে। নিত্যনতুন মোড়কে নিজেকে লাস্যময়ী করে পেশ করেছে বিছানায়। এমনকি, পাছে যৌনসুখে ভাঁটা পড়ে, তাই আত্মীয়দের শত কড়া চাহনি সহ্য করেও সন্তানবতী হয়নি উপলা। বান্ধবীদের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে স্বার্থপর আর বিকৃতকামুক বিশেষণ দুটোও হজম করতে হয় প্রায়শই। কিন্তু উপলাই বা কি করতে পারে! ভগবান তো আর সবাইকে সমরূপে নির্মাণ করেননি। তার যৌন-আসক্তিময় জীবনে বস্তাপচা মনস্তত্বের কোনো দাম নেই। মানুষ যদি নিজের জীবনটা কে উপভোগই না করল তবে তার বেঁচে থেকে লাভ কি! অতীতের ক্বচিৎ উষ্ণতার স্মারক হয়ে, সারাজীবন পরের মুখের হাসিটুকু ধরে রাখতে গিয়ে প্রাণপাত করার চেয়ে যন্ত্রণার আর তো কিছু নেই এ জগতে।
##

সন্দেহটা আস্তে ধীরে দানা বাঁধছিল উপলার মনে। যে সলিল সেন্টের গন্ধ সহ্য করতে পারে না, হঠাৎ করে সে ডিও মাখতে শুরু করলে সন্দেহ হবেই। রোজ রাত সাতটার মধ্যে বাড়ি ফেরা লোকটা হঠাৎ দশটাকে নিয়ম করে তুললে সন্দেহ আরও বাড়ে বইকি। প্রভঞ্জন বেগে ধেয়ে আসা অবিশ্বাসের বিষবাষ্প গ্রাস করল উপলার তনু-মন।
নিয়ত রক্তক্ষরণে মৃতপ্রায় হয়ে উঠছিল উপলার পরাণটা। অথচ, সন্দেহ নিরসনের বিশেষ উপায় নেই। সলিলের অফিস তার অফিসের বিপরীত প্রান্তে। তাওপর আবার সেলসের কাজে সলিলকে প্রচুর ঘুরতে হয়। এমন কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই, যেখানে লুকিয়ে অপেক্ষা করলে সলিলকে অফিস থেকে ফেরার পথে হাতেনাতে ধরা যায়। প্রশ্ন করেও দেখেছে উপলা। সব উত্তর যেন সলিলের ঠোঁটস্থ। হাবভাব দেখলে মনে হয় বুঝি নাটকের সংলাপের মতো মুখস্থ বলছে।
#
- তোমার আজকাল রোজই ফিরতে দেরি হচ্ছে।
- খুব চেষ্টা করছি একটা প্রমোসনের জন্য।
#
- কাল রাতে বাড়িতে খেলে না যে বড়ো?
- বসের বাড়ি গেসলাম। বৌদি না খাইয়ে ছাড়ল না।
- গত মাসেও একদিন তুমি খেয়ে ফিরেছিলে!
- আরে সেদিন তো এক ডিস্ট্রিবিউটারের বাড়ি পার্টি ছিল। তোমায় বলেছিলাম তো। এরমধ্যে ভুলে গেলে?
#
- কদিন ধরে ডিও মাখছ দেখছি। এখন আর গা গুলোচ্ছে না বুঝি চড়া গন্ধে?
- কলকাতার রাস্তাঘাটের অবস্থা জান না? সেদিন তো বাসে একজন বলেই বসলো: দাদা কি জামা কাচা ছেড়ে দিয়েছেন?
#
বিছানাতেও আজকাল কেমন নিরাসক্ত হয়ে উঠছিল সলিল। আগের সেই উদ্দামতা দূর কল্প, সম্প্রতি সে সাপ্তাহিক মিলনেও অনীহা প্রকাশ করছে। একদিন তো বলেই ফেলল: "সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটনির পর আর শরীর চলে? একটু বিশ্রাম নিতে দাও; কাল আবার অনেক ছোটাছুটি আছে।"

মেনে নিতে পারা যাচ্ছিল না এই সলিলকে। তবে কি তার জীবনে অন্য কোনো নারীর প্রবেশ ঘটেছে! মাধুর্যময় লালিত্য নিয়ে কি কেউ আবির্ভূত হয়েছে জীবন-নাট্যমঞ্চে! ক্রমাগত বেড়ে চলা দ্বন্দ্ব আর মানসিক অশান্তির ভারে জর্জরিত উপলা একদিন সবিস্ময়ে দেখল, সলিল সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে। অথচ, বিয়ের আগে থেকে গত কয়েক বছরে কম অশান্তি হয়নি এই সিগারেট নিয়ে। সব অনুরোধ অভিমান কলহ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বজ্রনির্ঘোষে: "নেশার জিনিস ছাড়ব না।" সেই সলিলের গা থেকে নিকোটিনের গন্ধ মুছে যেতে শুরু করল! উপলা নিশ্চিত হল, কোনো এক চুম্বনবতীর অনুরোধ ছাড়া এ পরিবর্তন অকল্পনীয়।

এক লহমায় গোটা পৃথিবীটা দুলে উঠল অজানা এক ভীতি আর অনিশ্চয়তার ঘূর্ণাবর্তে। যদি সত্যি সত্যিই সলিল তাকে ছেড়ে চলে যায়! কী করবে সে তখন? চোখের সামনে একটা স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে যেতে দেখছিল উপলা। উপলব্ধি করছিল, ক্রমশ স্বামী তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও আর তাকে ছুঁতে পারা যাচ্ছে না। দুজনার মাঝে প্রাচীর হয়ে উঠেছে কোনো এক অজ্ঞাতা অন্তরালবাসীনি। অন্য কেউ তার একান্তই আপন পুরুষটাকে ভাগ করে ভোগ করছে চিন্তা করলেই সহ্যাতীত একটা যন্ত্রণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। দমবন্ধ হয়ে আসছিল সে বিপ্রতীপ পরিস্থিতির দায়ভার বহন করতে গিয়ে। আর নিতে পারছিল না উপলা। প্রতি মুহূর্তের এই আশংকাজনিত শিহরণ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে; শেষ সীমান্তে উপনীত করছে মানসিক স্থিরতা। প্রিয় বান্ধবী থেকে পাশের বাড়ির কাকিমা - সবাই ততদিনে জেনে গেছে তার কালি ঢাকা চোখের কোণ কিংবা দু মাসে তিন কেজি ওজন কমার পশ্চাদপট।

অস্বস্তিকর আড় চোখের দৃষ্টিতে রাস্তাঘাটে আজকাল সলিলকে মাপছেন চেনাপরিচিতরা। তবে সলিলের বাহাদুরিও কম নয়। যাবতীয় সাংসারিক-পারিপার্শ্বিক চাপ, স্ত্রীর তুমুল অশান্তি থেকে পা জড়িয়ে ধরে কান্না - সব আক্রমণ উপেক্ষা করে নির্লিপ্ত অসভ্যের মতো সে স্থির রয়েছে নিজ বয়ানে। সোচ্চার কণ্ঠে অস্বীকার করছে অন্যত্র মন মজানোর সত্যতা। তাজ্জবের ব্যাপার, উপলাকে পালটা প্রত্যাঘাত করার চেষ্টা সলিল কোনোদিনই করেনি। ক্রোধের পরিবর্তে করুণা জমছিল সে মনে স্ত্রীর প্রতি। শুভাকাঙ্ক্ষীরা সলিলের আক্রোশহীন স্বামীত্বকে চিহ্নিত করছিল অপরাধবোধে ভোগা আত্মগ্লানি রূপে।

যাবতীয় উদ্বেগ আর আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে একদিন হঠাৎ সলিল নিরুদ্দেশ হল। আত্মীয়স্বজন থেকে পুলিশ - সবার সব অনুসন্ধানকে ব্যর্থ করে কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিশে গেল মানুষটা। অসমাপ্তই রয়ে গেল তার জীবনের সালতামামি। এক ফোঁটা চোখের জলও কেউ সেদিন দেখেনি দুঃখে নিথর হয়ে যাওয়া উপলার চোখে। বেদনার তীব্র দহন যেন শুষে নিয়েছিল তার সব অশ্রুকে। সকলেই একবাক্যে মেনে নিল চরিত্রহীন সলিলের নিষ্ঠুর পাশবিকতার বিবরণ। অতি উৎসাহী কেউ কেউ সেই পর্দানসীন বিবির খোঁজ নেবারও চেষ্টা চালিয়েছিলেন। দুঃখের কথা, তার পরিচয়ও উদ্ধার করা যায়নি।
#

যদিও আজকাল কলকাতার নতুন ফ্ল্যাটে অধিকাংশ সময় কাটে, তবু মুর্শিদাবাদের বাড়িটা এখনও বিক্রি হয়নি। প্রায়শই সপ্তাহান্তের কটা দিন কাটিয়ে যায় উপলা তার স্বামীর ভিটেতে। প্রস্তরীভূত উপলা সমাজের চোখে চিরদুখিনি সতীর সন্মাননা লাভ করেছে।
#

নিঝুম রাতে মহানগরের বৃষ্টিস্নাত পথ ধরে এগিয়ে চলেছে উপলার সিডান। অনুচ্চগ্রামে বাজছে নিধুবাবুর গান:

     তুমি বুঝি জান না হে প্রাণ, বেঁধেছি প্রেমের ডোরে।
     কেমনে ছাড়াবে তুমি, আশা আশা ধরে আপন জোরে
     হৃদয় মন্দিরে রাখি, রক্ষক করেছি আঁখি।

একরাশ ক্ষিদেতে জ্বলছে সে। যে করে হোক সন্ধান পেতে হবে সলিলের। নয়তো সে বাঁচবে কেমন করে! বড়ো প্রয়োজন তার সে পুরুষটাকে। বড়ো বেশি ভালোবাসার আর ভালোলাগার বস্তু যে সেই পেশীবহুল নির্মেদ শরীরটা। পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা যে না পাওয়ার চেয়ে বহুগুণ বেশি ক্ষতবিক্ষত করে মনটাকে।

অব্যক্ত মন্ত্রণা বুকে বয়ে নিয়ে চলে উপলার পুরুষ থেকে পুরুষান্তরে গমন। খুঁজে ফেরা সেই তীব্র যৌনাকাঙ্ক্ষার তাড়স জাগানো গন্ধটার অস্তিত্ব। যতবার মনে হয় এই তো পেয়েছি, ততবারই রমণশেষে অপেক্ষা করে একরাশ হতাশা। পাশে শুয়ে থাকা পুরুষ শরীরকে হঠাৎই বড়ো ঘেন্না করে ওঠে। ধিক্কার জাগে নিজের ওপরে। এ কী করল সে! একথা যদি জানাজানি হয়ে যায় তবে সলিলের সামনে মুখ দেখাবে কি করে? পত্নীনিষ্ঠ সে সত্ত্বা যদি মানিয়ে নিতে না পারে স্ত্রীর এমনবিধ আচরণ! যদি ভুল বোঝে? যদি ভাবে সলিলের খোঁজে নয়, রতি তৃপ্তির সন্ধানে উপলার এ অভিসার! তখন তো আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো গতি থাকবে না উপলার। সে কষ্ট সইতে পারবে না সে। তারচেয়ে বরং সহজ পন্থায় সে কষ্ট দূর করাই বাঞ্ছনীয়। কান্নায় ভেঙে পড়া উপলার হাত খুঁজে নেয় ঈপ্সিত আয়ুধ। চিরতরে চুপ করে যায় আরও একটু প্রাণ। উদভ্রান্তের মতো সলিলকে হাঁতড়ে ফিরছে উপলা তার মনের গভীর গহন কোণে।
#

পুনশ্চ: চ্যার্টার্জিদের ড্রইং রুমে প্রথম প্রথম তুমুল বাগ্-বিতণ্ডা হলেও মাসখানেকের মধ্যেই থিতিয়ে গেছে অন্তর্ধান রহস্যালোচনা। সদর শহরের অনাথ আশ্রমের বাচ্চা গুলো পরপর কয়েকটা রবিবার অপেক্ষার পর ভুলে গেছে‌ তাদের চকলেট-কাকুকে। স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে আছে শুধু একটা ভ্যালিয়ামের পাতা, কোনো এক নাম না জানা ভাগাড়ে। অতন্দ্র অথচ নীরব প্রহরায় সদাজাগ্রত রয়েছে বাড়ির সেপটিক ট্যাঙ্ক।
 

কোন মন্তব্য নেই: