রবিবার, ফেব্রুয়ারী ০২, ২০১৪

যৌনকর্মী, যৌনপেশা, যৌনপল্লি এবং এই অন্ধকারময় জগৎটির নির্মূলকরণের প্যাঁচ-পয়জার


            লিখেছেন : অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেশ্যাবৃত্তি হল স্বামী বা বন্ধুকে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে নগদ অর্থ বা অন্য কোনো কিছুর বিনিময়ে বাছবিচারহীনভাবে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া। তসলিমা নাসরিন এই পেশা সম্বন্ধে বলেন, “এটাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশা বলে লোককে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা হয় বটে, আসলে এটা কিন্তু প্রাচীনতম পেশা নয়, এটা বরং মেয়েদের বিরুদ্ধে 'পৃথিবীর প্রাচীনতম নির্যাতন'“। এই পণ্য-দুনিয়ায় পণ্য হওয়ার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামের মাধ্যমে বিপ্লব-বিদ্রোহ যেমন জারি করা আছে, তেমনই তার চতুর্গুণ শক্তিতে মানুষ, বিশেষ করে নারী-মানুষকে পণ্য করার নেটওয়ার্কসমূহের জোয়ার প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। আর এই সুনামির মূল প্রতিপাদ্য যৌন-বাণিজ্য ও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মুনাফা। বাৎসায়ন রচিত  “কামসূত্র”-এ বৈশিকাখ্যং অধ্যায়ে বলা হয়েছে, “রুচি হইতে যে পুরুষগ্রহণপ্রবৃত্তি তা স্বাভাবিক আর অর্থার্জনার্থ যে প্রবৃত্তি তা কৃত্রিম”। বাৎসায়ন উল্লিখিত “অর্থার্জনার্থ” এই কৃত্রিম প্রবৃত্তিই নিন্দার্হ। এই বেশ্যাপ্রবৃত্তিই বর্তমান বিশ্বে এক নম্বরের বাণিজ্য-বিষয়, অনেক দেশের রাজকোশের অর্থের বেশ্যাপ্রবৃত্তিই প্রধান উৎস। তবুও বিভিন্ন কারণে সেকালে যৌনব্যাবসাকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছিলেন কৌটিল্য। অবৈধ নারীসংসর্গ বোঝাতে তিনি ‘বাহ্যবিহার’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই ‘বাহ্যবিহার’-এর পক্ষে বা বিপক্ষে স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি কৌটিল্য। বাৎসায়ন বলেছেন, গণিকা অথবা বিধবাদের সঙ্গে দেহসম্ভোগ সমর্থন করা হয়
না, আবার নিষিদ্ধও নয়। সমাজবিদ লেকির মতে, গণিকাবৃত্তি হল সমাজের মাত্রাতিরিক্ত যৌনকামনা বেরিয়ে যাওয়ার একটি সেফটি-ভালভ। সেকি মনে করেন, নিজে মূর্তিমতী পাপীষ্ঠা হলেও পরিণামে পুণ্যের অধিকারিণী এই গণিকা। এরা না থাকলে সংখ্যাহীন সুখী পরিবারের প্রশ্নাতীত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যেত। তাহলে কি চিরটাকাল সমাজের বিষ-ক্লেদ কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠী হয়ে থেকে যাবে গণিকাশ্রেণি ! নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন একটি ব্লগে লিখতে গিয়ে বলেছেন – “ক্রীতদাসপ্রথার সঙ্গে পতিতা প্রথার মূলত কোনো পার্থক্য নেই। ক্রীতদাসরা যখন তুলো ক্ষেতে চাষের কাজ করত, দাসমালিকরা প্রায়ই সশরীরে উপস্থিত হয়ে কিছু ক্রীতদাসীকে যৌনকর্মের জন্য তুলে নিয়ে যেত। ত্বক যাদের একটু কম কালো, সাধারণত তাদেরকেই পছন্দ করত। বাজারে নিয়ে যৌন-ব্যাবসার জন্য ভাড়া খাটাত, নয়তো সরাসরি পতিতালয়েই তাদের নগদ টাকায় বিক্রি করে দিত। আঠারো-উনিশ শতকে যে প্রথাটিকে বলা হত  ক্রীতদাস প্রথা, বিংশ-একবিংশ শতকে সেই প্রথাকে বলা হচ্ছে পতিতা প্রথা”।
অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রির ইতিহাস সুপ্রাচীন। ওয়েবস্টার অভিধান মতে, সুমেরিয়ানদের মধ্যেই প্রথম পবিত্র পতিতার দেখা মেলে। প্রাচীন গ্রন্থাদিসূত্রে, যেমন ইতিহাসের জনক হিসেবে খ্যাত হিরোডেটাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৪-খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০/২০)-এর লেখায় এই পবিত্র পতিতাবৃত্তির বহু নমুনা পাওয়া যায়, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হতো এবং সেবাশুশ্রূষার নমুনা হিসেবে একজন বিদেশীর সাথে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হতো। একই ধরনের পতিতাবৃত্তির চর্চা হতো সাইপ্রাস এবং করিন্থেও। এটি বিস্তৃত হয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ এটি ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলোতেও সংক্রমিত হয়, যেমন সিসিলি, ক্রটন, রোসানো ভাগলিও, সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহরে। এক্ষেত্রে অনুমান করা হয় এশিয়া মাইনর, লাইদিয়া, সিরিয়া ও এট্রাকসনের নামও। ইসরায়েলে এটি একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল, যদিও কয়েকজন প্রফেট, যেমন ইজাকেইল, এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সমাজে পতিতারা ছিল স্বাধীন এবং তারা বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করা ও কর দেবার ব্যাপারে আদিষ্ট ছিল। গ্রিক হেটায়েরার মতো জাপানে ছিল জেইসার।
কৌটিল্যের “অর্থশাস্ত্র” থেকে পতিতা ও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষীয় চিত্র পাওয়া যায়। কী বলছে অর্থশাস্ত্র ? অর্থশাস্ত্র বলছে দেহব্যাবসা একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা। পুরোপুরি ঘৃণিত বা গোপনীয় নয়। কৌটিল্যের সময় দেহব্যাবসা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয় বলে জানা যায়, যে শিল্পের নাম ছিল বৈশিক কলা। বিশেষজ্ঞরা এ শিল্পের চর্চা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন। অর্থশাস্ত্রে, এমনকি গণিকাধ্যক্ষেরও উল্লেখ আছে। তাঁর কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গণিকাদের সংগঠিত ও দেখভাল করা।
পাশ্চাত্য সভ্যতার জতুগৃহ প্রাচীন গ্রিকের এথেনাইয়ের কবি সোলোন , যিনি তৎকালীন গ্রিকের সাতজন জ্ঞানী লোকের একজন হিসেবে গণ্য হতেন, খ্রিষ্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম পতিতালয় স্থাপন করেন। এই পতিতালয়ের উপার্জন দিয়ে আফ্রোদিতিকে নিবেদন করে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। মধ্যযুগে ইউরোপে ব্যাপকভাবে পতিতাবৃত্তি ছড়িয়ে পড়ে এবং পৌরসভার মাধ্যমে পতিতালয়সমূহ পরিচালিত হতে থাকে।প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ ও কূটনীতিক মেগান্থিনিস এক ধরনের পরিদর্শকের কথা বলেছেন, যারা রাজ্যের সকল কার্যক্রমের ওপর গণিকাদের সহায়তায় নজর রাখতেন এবং রাজার কাছে গোপন রিপোর্ট দিতেন।
ঋগ্বেদ এবং জাতকেও এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন পণ্ডিতরা। মহাভারতেও গণিকাদের বর্ণময় জীবন ও রাজকীয় জাকজমকের বর্ণনা আছে। রামায়ণে দেখা যায়, রাম ভরতকে জিজ্ঞাসা করছেন যে তিনি গণিকা, ঘোড়া ও হাতির ব্যাপারে সন্তুষ্ট কি না। জৈন লেখক হেমচন্দ্রের লেখায় একটি কিংবদন্তীর উল্লেখ আছে যে, রাজা নন্দ গণিকার গর্ভজাত এক নাপিতের সন্তান। বৌদ্ধ গ্রন্থগুলোতে বিখ্যাত গণিকা অম্বাপালী, সালাবতী, সামা, সুলমা ছাড়াও এমন অনেকের কথা বলা আছে, যারা বুদ্ধি ও শিল্পীত দক্ষতার গুণে সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
প্রাচীন যুগে রাজকোষ থেকে বেতন ছাড়াও গণিকারা অলংকার, স্বর্ণমুদ্রা, পোশাক-আশাক, নানারকম মূল্যবান উপঢৌকন, সম্পত্তি লাভ করতেন। অবশ্য কোনো গণিকার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর সঙ্গে বা তাঁর অবিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে বলপূর্বক দেহসম্ভোগের চেষ্টা করলে সর্বোচ্চ আর্থিক সাজা হত। তবে সেযুগের বেশ্যাবৃত্তি এযুগে আর শিল্পের পর্যায়ে নেই। তবে নারীর রূপ, যৌবন ও শরীরের বাণিজ্যিক ব্যবহার, যেমন পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট তৈরি করা, পর্নোগ্রাফি সিডি তৈরি করা , অর্ধনগ্ন ফ্যাশন শো, যৌনসঙ্গম সংবলিত চলচ্চিত্র নির্মাণ, পর্নো ম্যাগাজিন প্রকাশ, বিজ্ঞাপনচিত্রে  অশ্লীল  নারীর মডেল ব্যবহার ইত্যাদি মাধ্যমে নারীর নারীত্ব প্রতিনিয়ত অপমানিত হচ্ছে। সরাসরি দেহব্যাবসার মাধ্যমে  বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা করা হচ্ছে। পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে যারা যৌনসঙ্গম করে তারাও আর-এক ধরনের বেশ্যামি করে থাকে।এ ধরনের বেশ্যামি ভারত-বাংলাদেশসহ প্রায় সব দেশেই নির্মাণ হয়ে থাকে।
কথা হচ্ছিল বেশ্যাবৃত্তির বিষয়ে। বিশ্বের অনেক দেশ, যাদের প্রধান আয় পর্যটন শিল্পনির্ভর, সেসব দেশে এখনও সরকারি তত্ত্বাবধানেই দেহব্যাবসা পরিচালিত হয়। এমনকি বাংলাদেশ রাষ্ট্রও এখনো এ প্রথাকে অনুমোদন করে যাচ্ছে পতিতাবৃত্তিতে আগ্রহী যে-কোনো আঠারো বছর বয়সোত্তীর্ণ নারীকে দেহব্যবসা চালাবার জন্য লাইসেন্স দিয়ে, সারাদেশে ১৪টি পতিতালয় পরিচালনা করে এবং সেখান থেকে রেভিনিউ গ্রহণ করে।
গণিকাধর্ষণ সভ্য সমাজের আদালতে বড়ো কোনো অপরাধ হিসেবেই গণ্য হয় না। আসামিপক্ষের আইনজীবী যদি এটি প্রমাণ করতে পারেন, তবে আসামির কোনো শাস্তি হয় না অথবা শাস্তি হলেও তা হয় নামমাত্র।বলা হয়, ধর্ষিতা ধর্ষককে প্রলুব্ধ করেছেন। তাই তাঁকে ১০১ দোররা মারা হয়, মাথা মুড়িয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয় কিংবা মাটিতে পুঁতে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা হয়। যারা এসব ফতোয়ায় কাজির দায়িত্ব পালন করেন, তাঁরা অবশ্যই হন পুরুষ, এবং তাঁরা সেরকম পুরুষ, খোঁজ নিলে যাঁদের বিবাহ-বহির্ভূত যৌনসঙ্গের একাধিক ঘটনার প্রমাণ মিলবে।
ইন্টার প্রেস সার্ভিস (৮ এপ্রিল ১৯৯৮) সূত্রে জানা যায়, পাচারকৃত এই দু’লক্ষ নারীর সবাই ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে যৌনকাজে ব্যবহৃত হচ্ছেন। একটি বিদেশী সংস্থার বাংলাদেশ সম্পর্কিত কান্ট্রি নেরেটিভ পেপারের ভাষ্য অনুযায়ী, বৈধভাবে যেসব নারী গৃহপরিচারিকা হিসাবে কাজ করার জন্য কাতার, বাহরিন, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে যান, প্রায়শই তাঁদেরও অনিচ্ছাকৃত যৌনদাসত্বকে মেনে নিতে হয়। ইন্টার প্রেস সার্ভিস মনে করে, বার্মিজ মেয়েদের পাচারের রুট হিসেবেও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে খ্যাতি পেয়েছে।
সর্বত্র যৌনপল্লি না-থাকায় কলকাতাসহ সারা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের পার্কে-উদ্যানে-রাস্তার পাশে-বড়ো বড়ো ইমারতের দেয়াল ঘেঁষে, নির্মাণাধীন ভবনের নীচে, নদীতীরে, রেল ও বাস স্টেশনে রাত্রিবেলা শরীর কেনাবেচার কী জমজমাট হাট বসে একটু খবর লাগিয়ে দেখুন! তা ছাড়া ক-জন জানেন জানি না যে শত শত আবাসিক হোটেলের সবকটিই এখন একেকটি যৌনপল্লি, গৃহস্থ-গৃহগুলিও বাদ নয়। যৌন-পরিসেবা গ্রাহকদের জন্য আবাসিক হোটেল বেশ্যালয়ের চেয়ে অনেক বেশি সহজগম্য, এর গায়ের সঙ্গে বেশ্যা বা বেশ্যালয় নামটি সাঁটা নেই বলে, একেই বলে লেবেলহীন উদ্দাম যৌনতা।সে কারণে বেশ্যালয় ও রাস্তাঘাটের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ খরচ করেও যৌন-পরিসেবা ক্রয়-বিক্রয় জারি আছে। পুলিশ রেইডে ধরা পড়া যৌনকর্মী ও ক্রেতা-গ্রাহকের সংখ্যার দিকে তাকালেই অনুমান করা যায়। আর ফ্লাটবাড়ির আশ্রয়ে পরিচালিত হওয়া যৌনব্যাবসার চিত্রটি আমাদের কাছে আড়ালেই থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে, থেকে যাবে। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে অভিযোগ না-উঠলে কিংবা ওসব স্পটে কেউ খুন না-হলে সাধারণত সেগুলো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এবং গণমাধ্যমের আড়ালেই থাকে। উল্লেখ্য, এসব স্পটের গ্রাহকরা প্রায়শই হন উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তেরা।এখানে যেসব মেয়েরা দেহব্যাবসা করে তারা কেউ স্কুল-কলেজে ছাত্রী, কেউ গৃহবধু।পড়াশোনার খরচ বা অন্যান্য বিলাস মেটানোর জন্য আসে ছাত্রীরা এবং গৃহবধুরা আসেন বাড়তি রোজগারের জন্য। এরা কেউ কেউ এসকটের তত্ত্বাবধানে কাজ করে, আবার কেউ কেউ স্বাধীনভাবে কাজ করে।যারা স্বাধীনভাবে কাজ করে তাদের এজেন্ট বা আড়কাঠি নেই, এরা নিজেদের শিকার বা গ্রাহক নিজেরাই সংগ্রহ করে নেন।ছুৎমার্গকে সরিয়ে দিয়ে সমাজে এদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে মুক্ত অর্থনীতির বাজারে।যৌন-বাজারে আবার আর-এক শ্রেণির আবির্ভাব হয়েছে, এরা ব্যক্তিগত যৌন-অতৃপ্ততা থেকে অন্য পুরুষের কাছে শরীর সমর্পণ করে। এরা মূলত বিবাহিত মহিলা, এরা নিজেদের পছন্দমতো যৌনসঙ্গী খুঁজে নেন, যে পুরুষ এই নারীকে শরীরী-সুখে তৃপ্ত করতে পারবে সে পাবে পর্যাপ্ত অর্থমূল্য।এই ধরনের পুরুষ বা পুরুষবেশ্যাদের “জিগোলো” বলা হয়ে থাকে।এই বাজারে পুরুষক্রেতারা যেমন তার বয়সের থেকে তুলনামূলক অনেক কম বয়সি মেয়েদের পছন্দ করে, তেমনই নারীক্রেতারাও তার বয়সের থেকে তুলনামূলক কম বয়সি ছেলেদেরকে যৌনসঙ্গী হিসাবে বেশি পছন্দ করে। এখানে নারী ক্রেতা, পুরুষ পরিসেবাদাতা। আপাতত এরা সংখ্যায় অল্প হলেও এ ব্যাপারটা নারী-ক্ষমতায়নেরই ইঙ্গিত দেয়।
অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এর এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ৪৯.১০ শতাংশ যৌনকর্মী এ পেশায় এসেছেন সীমাহীন দারিদ্র্যের নিষ্পেষণের কারণে, ২১.৫৬ শতাংশ এসেছেন পারিবারিক ডামাডোলের শিকার হয়ে, ১৫.৫৬ শতাংশ অন্য জীবিকার মিথ্যা আশার হাতছানিতে, ৮.৬৭ শতাংশ জেনেশুনে স্বেচ্ছায় এসেছেন এবং বলপূর্বক ধরে এনে এ ব্যাবসায় লাগানো হয়েছে ০.৪৪ শতাংশকে। যারা মনে করেন যৌনকর্মীরা কেবল বংশপরম্পরায়ই এ পেশায় আসে, তাদের জন্য এই তথ্যটি দেওয়া যায় যে কলকাতার মোট যৌনকর্মীর মধ্যে সে হার মাত্র ৪.৬৭ শতাংশ। পাশাপাশি কৌতূহলী পাঠকদের জন্য এখানে আরেকটি চিত্র তুলে ধরা যায়, যে-চিত্রটি ধারণা দেবে যে এদের এ পেশায় আসার মাধ্যম কারা। এসব যৌনকর্মীর ৬০.৬৭ শতাংশই এ পেশায় এসেছেন বন্ধু ও প্রেমিকের প্রতারণার শিকার হওয়ার মাধ্যমে, ৭.১১ শতাংশ দালালদের মাধ্যমে, ৭.৩৩ শতাংশ দালালদের দ্বারা বিক্রিত হয়ে, ৪ শতাংশ আত্মীয়দের মাধ্যমে, ২.২২ শতাংশ আত্মীয়দের দ্বারা বিক্রিত হয়ে এবং নিরুপায় হয়ে নিজেরাই এ পেশায় আত্মসমর্পণ করেছে ১৮.৬৭ শতাংশ। এইসব যৌনকর্মীদের ক্রেতা কারা ? সবাই, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। এক আলাপে জানা গেছে, রাজনীতিক-নেতা, অভিনেতা, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশেষ বাহিনী, কোনো টক শোয়ে যৌনকর্মের বিরুদ্ধে লম্বা লম্বা লেকচার মারা ব্যক্তিত্ব, উর্দি-পরিহিত পুলিশসহ সমাজের কথিত অভিজাত থেকে নিচুতলার সব শ্রেণির মানুষই এখানকার নিত্য অতিথি, খরিদ্দার, বাঁধা-বাবু।যৌন-ব্যাবসায় জড়িত এমন অনেক মেয়েও পতিতা প্রথার পক্ষে কথা বলছেন। তারা বলছেন, 'অন্য যে-কোনো শ্রমের মতো বেশ্যাবৃত্তিও শ্রম'। আরও এক ধাপ এগিয়ে কেউ কেউ বলছেন, এই শ্রম নাকি সমাজে মেয়েদের ক্ষমতায়নে সাহায্য করছে।
কলগার্ল হিসাবে যারা কাজ করে এবং ম্যাডামের ভূমিকায় যারা, তাদের অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে রাস্তার যৌনকর্মীদের চেয়ে আলাদা। তাই তামাম যৌনকর্মীদের উঁচু শ্রেণি, মাঝারি শ্রেণি, আর নিচু শ্রেণিতে ভাগ করার একটা প্রবণতা দেখা দেয়।
অবশ্য যেসব মেয়ে-মহিলারা নিজেদের অপরিমেয় চাহিদা (অতৃপ্ত শরীর অথবা অপর্যাপ্ত অর্থ) মেটাতে সমাজের আড়ালে থেকে সমাজকে আড়াল করে যৌনক্রীড়ায় লিপ্ত হন তারা নিশ্চয় এই পরিসংখ্যানে নেই, থাকার কথাও নয়। সার্ভে-সমীক্ষায় তারা অন্তরালেই থেকে যাবে, ধরা পড়ে না। সেটাই স্বাভাবিক। যদি কোনোদিন যৌনপেশা মর্যাদাকর হিসাবে স্বীকৃতি পায় সমাজ ও আইন থেকে, তখনই দিনের আলোর মতো প্রকাশ্যে এসে পড়বে মেয়ে-মহিলা কতজনই-বা সমীক্ষার ভিতরে, কতজনই-বা সমীক্ষার বাইরে ! তখনই বোঝা যাবে আমরা যে সমাজের উচ্ছেদ চাইছি, সেই সমাজের শিকড় কতদূর পর্যন্ত সেঁধিয়ে আছে।
এরপরও আছে সেক্স-ট্যুরিজম তথা যৌন-পর্যটন। ভাবা যায়, সেক্স-ট্যুরিজম তথা যৌন-পর্যটন অনেক রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস ! সেক্স-ট্যুরিজম বা যৌন-পর্যটন হল তাই, যা অর্থের বিনিময়ে যৌন-সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে কোনো বিশেষ স্থানে ভ্রমণ করা। পর্যটন খাতের কাঠামো ও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে গন্তব্যস্থানের বসবাসস্থলে পর্যটক কর্তৃক বাণিজ্যিকভাবে যৌন-সম্পর্ক স্থাপনকেই সেক্স-ট্যুরিজম বা যৌন-পর্যটন বলে।যৌন-পর্যটকদের জন্য কখনো-কখনো গন্তব্যদেশে স্বল্পমূল্যে যৌন-পরিসেবা পাওয়ার আকর্ষণ থাকে। এমনকি সেসব দেশের থাকে যৌন-সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে আইনগত শৈথিল্য এবং শিশু-যৌনকর্মী পাওয়ার আকর্ষণও। যৌন-পর্যটনের জন্য পর্যটকদের প্রথম বাছাই দেশগুলি হল থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, ডোমিনিকান রিপাবলিক, কোস্টারিকা, কিউবা, জার্মানি, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, নেদারল্যান্ডস এবং কম্বোডিয়া। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া, হাঙ্গেরি, ইউক্রেন, পোলান্ড এবং চেক রিপাবলিকের নামও ওই তালিকায় সংযুক্ত হয়েছে। নির্দিষ্ট কোনো দেশের কেবল এক বা একাধিক নির্দিষ্ট স্থানই কেবল যৌন-পর্যটকদের গন্তব্য হয়। যেমন নেদারল্যান্ডের আমস্টারডাম, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, পাট্টায়া ও পুকেট। আমেরিকায় যেহেতু নেভাদা ছাড়া অন্য সব এলাকায় পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ বা অবৈধ, তাই ওখানকার স্থানীয় শরীরপ্রেমীরা নেভাদায় যৌন-পর্যটনে যায়।
পর্যটকের অধিকাংশেরই ঝোঁক থাকে শিশু-যৌনতার প্রতি, যদিও অধিকাংশ দেশেই শিশুদের যৌন-কাজে ব্যবহার করা আইনসম্মত নয়। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা যৌন-পর্যটন এবং শিশু যৌন-পর্যটনকে আলাদা করে দেখে থাকেন। তাদের মতে, যেসব পর্যটক শিশুদেরকে যৌন-কাজে ব্যবহার করে তাঁরা “কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড” এবং “অপশনাল প্রোটোকল অন দ্য সেল অব চিলড্রেন”, “চাইল্ড প্রস্টিটিউশন অ্যান্ড চাইল্ড পর্নোগ্রাফি” লঙ্ঘন করে। ব্যতিক্রম সিঙ্গাপুর, সিঙ্গাপুরের এরকম কোনো আইন নেই বলে তারা বিশ্বের সমালোচকদের কছে নিন্দিত হয়ে আছে। ইন্দোনেশিয়ায়ও প্রচুর পরিমাণে কমবয়েসি শিশুদের যৌন-কাজে ব্যবহার করা হয়। ইউনিসেফের তত্ত্বাবধানে হওয়া সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় আফ্রিকার দরিদ্র দেশ কেনিয়ায় শিশু পতিতাবৃত্তির এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশটির উপকূলীয় এলাকায় যৌন-পর্যটন চালু থাকায় সেখানকার অজস্র শিশু যৌন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার মেয়েশিশু দেশটির মালিন্দি, মোম্বাসা, কালিফি এবং দিয়ানি উপকূলীয় এলাকায় বাস করে, যারা অর্থের বিনিময়ে যৌন-কর্ম করে থাকে। এছাড়াও ২ থেকে ৩ হাজার শিশু ছেলেমেয়ে অর্থের বিনিময়ে সর্বক্ষণের যৌন-পরিসেবা দিয়ে থাকে।কেনিয়ার সৈকতে শিশু যৌন-পর্যটনে আগতদের ১৮ শতাংশ ইতালিয়ান, ১৪ শতাংশ জার্মান এবং ১২ শতাংশ সুইস। এরপরেই আছেন উগান্ডান, তাঞ্জানিয়ান, ব্রিটিশ এবং সৌদি আরবীয়রা।
মেয়েরা কেন পতিতাবৃত্তির মতো নিকৃষ্ট পেশা বেছে নিচ্ছেন বা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন ? (১) দারিদ্র্যতা আমাদের সমাজের অন্যতম প্রধান কারণ। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে অনেক মহিলা ইচ্ছায় কী অনিচ্ছায় পতিতালয়ের মতো এহেন অমানবিক তথা অনৈতিক পেশায় জড়িয়ে পড়ে। গ্রামের দরিদ্র মেয়েরা শহরে এসে বেশ্যালয়ের আশ্রয় নেয়। গ্রামীণ সমাজের দারিদ্র্য দশাই মহিলাদের একটি অংশকে নগরে ঠেলে দিচ্ছে, যারা স্বেচ্ছায় অথবা দালালের খপ্পরে পড়ে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে। (২) অনেকে আবার জরায়ুর স্বাধীনতার জন্য পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে। তারা একই স্বামীর সঙ্গে সারাজীবন বসবাস করতে নারাজ। তা ছাড়া সাংসারিক ঝামেলা, সন্তান-সন্তুতি লালনপালন ইত্যাদি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করেন।(৩)  অনেক দুশ্চরিত্র মেয়েরা এটাকে পেশা হিসাবে বেছে নেন। কারণ এখানে অফুরন্ত শারীরিক আনন্দ ও বিপুল অর্থ দুটোই একসাথে পাওয়া যায় -- যা অন্য কোনো পেশায় প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করে জীবনকে অন্যরকমভাবে উপভোগ করার স্বাদও এ পেশায় পাওয়া যায়।(৪) স্বামী-স্ত্রীর পৃথক বা বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে অনেক নারী এ পেশায় এসে স্বামীদের বুঝিয়ে দেয় তোমাদেরকে ছাড়াও আমরা জীবনযাপন করতে পারি।তবে এরা কিন্তু তথাকথিত ওই প্রান্তিক পাড়াগুলিতে গিয়ে বাসা বাঁধে না, উড়ে উড়ে সাধ এবং স্বাদ মিটিয়ে নেন।(৫)  অনেক নারী প্রেমিকের সঙ্গে নিয়মিত সহবাসের পর প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এই পথে পা বাড়ায়। জীবনে বিয়ে না করার পরিকল্পনা করে।(৬)  অবিবাহিত নারীরা কেউ অদম্য যৌন-চাহিদা, কেউ মাত্রহীন অর্থ-চাহিদা, কেউ উভয় চাহিদা মেটানোর জন্য এ পেশায় আসেন।(৭)  এই পেশায় আসার জন্য ধর্ষণকেও দায়ী করা যায়। অনেক ধর্ষিতা নারী আছে যারা সমাজে স্থান পায় না। ধর্ষিতা হওয়ার কারণে যখন বিয়ে হয় না, সমাজ প্রত্যাখ্যান করে তখন তারা বাধ্য হয়ে বেশ্যালয়ে নাম লিখিয়ে ফেলেন।(৮)  দালালের খপ্পরে পড়ে অনেক মেয়েরা এই পেশায় চলে আসেন। প্রথমে তারা বুঝতে পারে না, কিন্তু যখন বুঝতে পারে তখন ইচ্ছে করলেও এই দুনিয়া থেকে মূলস্রোতে ফিরে আসতে পারে না। সাধারণত গ্রামের সহজ-সরল মেয়েদেরকে শহরে চাকরি বা কাজ দেওয়ার নাম করে ফুসলিয়ে এনে পতিতালয়ে তাদেরকে ভাড়া খাটায় বা বিক্রি করে দেয়।(৯)  এটি একটি লাভজনক ব্যাবসা, কানা পয়সা পুঁজি লাগে না। পুঁজিবিহীন ব্যাবসা করতে যেসব মহিলা আগ্রহী, সমাজকে তোয়াক্কা করে না যেসব মহিলা, তারা যুক্ত হয়ে পড়ে। আমাদের সমাজে এক শ্রেণির নারী জীবনের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে বেশ্যালয়কে পেশা হিসাবে বেছে নেয়। (১০)  এই পেশায় আসার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রির প্রয়োজন পড়ে না। সাধারণত চলনসই রূপ, ঢলঢল যৌবন থাকলেই চলে। তা ছাড়া বর্তমানে চাকরি নামক সোনার হরিণের পিছনে ঘোরাঘুরি না করে এই পেশায় আসা সহজ। (১১) জন্মগত কারণে অনেক নারী বেশ্যালয়ে নাম লেখাতে বাধ্য থাকেন। সাধারণত পতিতার মেয়েই পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করে। (১২) সামাজিকভাবে বহুগামিতা বেড়ে যাওয়ায় এই ব্যাবসা দিনদিনই লাভজনক হয়ে যাচ্ছে ।
এছাড়াও আরও  অনেক কারণ আছে যার জন্য একজন নারী এই পেশায় আসতে পারে। আর নারী এ পেশায় আসার ফলে পুরুষরা খরিদ্দার হয়ে তাদের কাছে যায়। কারণ নারী সে যে স্তরেরই হোক-না-কেন ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো প্রাপ্তি ছাড়া সে কখনোই শারীরিক সম্পর্ক করে না।এই ব্যাপারটাই নারীকে বেশি সর্বনাশ করেছে।
পরিশেষে, বেশ্যাবৃত্তির মতো একটি নিকৃষ্ট পেশা আমাদের সমাজে আজ গেড়ে বসেছে। এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে কত নারী যে তাদের জীবনে ধ্বংস ডেকে এনেছে, কত পুরুষ যে বেশ্যালয়ে গমন করে সহায় সম্বল হারিয়েছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে কত নারী-পুরুষ। যুবসমাজের অধঃপতন হয় এই বেশ্যালয়ে। যখন বেশ্যালয়ে গিয়ে মস্তি করার রেস্ত থাকে না, তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ মেয়েদের ঘাড়ের উপর। বেশ্যালয়ে গমন করে অনেক নারী-পুরুষ এইডস এর মতো ভয়াবহ মারণব্যাধি ডেকে আনছেন। এক শ্রেণির অর্থলিপ্সু পুরুষ এবং মহিলা নারীদের নিয়ে বেশ্যালয় তৈরি করে লক্ষ লক্ষ ডলার রোজগার করছে। আমাদের সমাজে দিন দিন বেশ্যালয় বা পতিতালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ প্রশাসন এ ব্যাপারে নীরব।শান্তিপ্রিয় নাগরিকগণ পতিতাবৃত্তি বা পতিতালয় উৎখাত করতে কোনো আন্দোলন করতে পছন্দ করছেন না। তাই সেই সুযোগে নারীদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, যুবকদের ধ্বংস করার জন্য এ ব্যাবসা করছে শরীর-ব্যবসায়ীগণ। খরিদ্দার হারায় সম্পদ, অর্থ ও পারিবারিক শান্তি। পতিতাবৃত্তি খরিদ্দার ও নারীর উভয়ে নৈতিক অধঃপতন ঘটায়। উভয়ে স্বাভাবিক ও সাধারণ যৌন আনন্দ লাভে হয় বঞ্চিত। বস্তুত বেশ্যাবৃত্তি যৌন-বিকৃতিরই নামান্তর। বেশ্যাবৃত্তির কারণে উভয়ের উত্তরসুরীদের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়। সমাজের সবাই এই পেশাকে খারাপ চোখে দেখে বটে। এই ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে সামাজিক তথা অপরাধমূলক আচরণও দেখা যায়। মাদকাসক্তি, মাতলামি, জুয়াখেলা, ব্লুফ্লিম, ধর্ষণ, ইভ টিজিং ইত্যাদি অপরাধ করতে থাকে তারা।
যৌনকর্মীদের এবং যৌনপেশাকে  নির্মূল করা-না-করার প্রশ্নে, পুনর্বাসন প্রশ্নে, নৈতিকতা প্রশ্নে, ধর্মীয় প্রশ্নে, অধিকারের প্রশ্নে নানারকম তর্ক-বিতর্ক আমরা  শুনে থাকি। অর্থশাস্ত্র মতে, বাজারে যদি কোনো পণ্যের চাহিদা থাকে তাহলে সে পণ্যের উৎপাদন রহিত করা যায় না। প্রকাশ্যে না-হলেও গোপনে তার উৎপাদন চলতেই থাকে। যৌনপণ্যের বাজারচাহিদা কমানো না-গেলে চিহ্নিত “রেড লাইট এরিয়া”-গুলিকে তছনছ করে দিলেও অন্য কোনো ছদ্ম-আবরণে এ ব্যাবসা চলতেই থাকবে। তাতে মাত্র একদল যাবে, একদল আসবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।
কিন্তু লক্ষণীয় যে বেশ্যাবৃত্তি টিকিয়ে রাখার পক্ষে দেওয়া সর্বকালের সকল মতই হল পুরুষদের। কারণ এ প্রথার ভোক্তা পুরুষরাই। প্রত্যক্ষভাবে নারীনেত্রীদের বেশ্যাবৃত্তির পক্ষে  সাধারণত মত দিতে দেখা যায় না। নারীরা এ ক্ষেত্রে দ্বিধাবিভক্ত -- এক ভাগের নেত্রীরা বেশ্যাবৃত্তিকে সম্পূর্ণভাবে যৌন-নির্যাতন বা ধর্ষণ হিসাবে দেখেন। তাঁরাই চান এ ব্যবস্থা চিরতরে বন্ধ হোক। এ সকল নারীনেত্রীদের প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালে সুইডেনে একটি আইনও তৈরি হয়ে গেল। সেখানে বলা হল -- যৌনতা বিক্রি কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু যৌনতা ক্রয় অবশ্যই অপরাধ। এই আইন যৌনসেবা ক্রয়ে ভোক্তাদের নিরুৎসাহিত করবে । আর ক্রেতা যখন থাকবে না তখন এটি আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাবে। অন্য পক্ষের নারীগণ মনে করেন -- পতিতাদের অধিকার, নিজস্ব ইচ্ছা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে দেখেন। তাঁরা পতিতাদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, যথার্থে  পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না-করে পতিতালয় উচ্ছেদের বিরোধিতা করেন এবং এই পেশাকে কর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বলেন। দেহব্যবসায়ে নিয়োজিতদের পতিতা, বেশ্যা, গণিকা, খারাপ মেয়েছেলে ইত্যাদি না-বলে যৌনকর্মী এবং তাদের কর্মকে যৌনকর্ম বলার পক্ষে পৃথিবীব্যাপী তাদের আন্দোলনও জারি করা আছে।এরা জার্মানিতে আইন সংস্কারের জন্য চেষ্টা করার ফলে গত ২০০২ সালে সে দেশে যৌনকর্ম একটি নিয়মিত পেশা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়াও ওই আইনে যৌনকর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারও অন্তর্ভুক্ত করেছে। সারা পৃথিবীতেই এই দাবিতে আন্দোলন সচল আছে। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি এবং বাংলাদেশের দুর্জয় নারী সংঘও এরকম দাবিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে চলেছেন।প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সারা পৃথিবীতে যে বিপুল পরিমাণ নারী এই পেশার সঙ্গে  স্বেছায় যুক্ত হয়েছেন বা পাকেচক্রে শরীরের ব্যাবসায় যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁরা যেভাবেই হোক তাঁদের শ্রমই বিক্রি করছেন বা কিনছেন। এক দিনের বা এক মাসের নোটিসে এদের এ পেশা থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার পৌর-কর্তৃপক্ষ ১৯৯২ সালে শহরের যৌন-বিনোদন কেন্দ্রগুলি ভেঙে দেওয়ার পর সেখানকার যৌনকর্মীরা সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর থেকে ওদেশে বিভিন্ন ধরনের যৌনরোগ ও এইচআইভির সংক্রমণ অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়।
তসলিমা নাসরিন বেশ্যাবৃত্তিকে বৈধতা দেওয়ার বিরুদ্ধে। বলেছেন – “পতিতাপ্রথাকে বৈধ করা মানে নারী নির্যাতনকে বৈধ করা। যে রাষ্ট্রে পতিতা প্রথা বৈধ সেই রাষ্ট্র সত্যিকার কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। গণতন্ত্র মানবাধিকার নিশ্চিত করে, নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করে। কোনও সভ্যতা বা কোনও গণতন্ত্র মানুষের উপর নির্যাতনকে ছল-ছুতোয় মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে না। করতে পারে না। যদি করে, সেই গণতন্ত্রের নাম নিতান্তই পুরুষতন্ত্র, আর সেই সভ্যতার নাম বর্বরতা ছাড়া অন্য কিছু নয়”।
পতিতাবৃত্তি বা বেশ্যাবৃত্তিকে রোধ করতে হলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সামাজিকভাবে সকলে মিলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে আশা করা যায় বেশ্যাবৃত্তি বা বেশ্যালয়কে সমাজ থেকে ধ্বংস করা যাবে। লাস ভেগাস, ম্যাকাউয়ের বিখ্যাত বেশ্যালয়গুলি অতীত হয়ে যাক।

কোন মন্তব্য নেই: