লিখেছেন : মনোবর
পরিণাম হল
মারাত্মক। মনোজ মিতালী মাসীর কাছে অভিযোগ করল যে আমি পড়লে ওর পড়ার ডিসটার্ব হয় তাই
কার্তিক মামার কাছে ও একাই পড়বে। মাসী আমার কাছে জানতে চাইল যে ব্যাপারটা আসলে কি।
কিন্তু আসল ব্যাপার তো আর বলা যায়না। আমি কোন উত্তর না দিয়ে মুখ গোমড়া করে চলে
এলুম। এবার পরদিন মা জানতে চাইল। আমি বললুম মনোজ যেতে বারণ করেছে। মা শুনে চুপ করে
গেল। একদিন কার্তিক মামা এসে বলল, কি করব দিদি! আমার তো কিছু করার নেই। আর
ভাগ্নাকে যে এখানে এসে পড়াব তার সময়ও নেই। এই বলে টিফিন করে কার্তিক মামা বিদায়
নিল। দাদু ডাক্তার বলে মনোজকে স্কুলের শিক্ষকরা সবাই চিনত। ওর জন্য আরো একজন
শিক্ষক বহাল হল। আর বহাল হল একজন সঙ্গীত শিক্ষক। সে নাকি মুনাব্বর আলির কাছে
ক্লাসিক শেখা সঙ্গীতজ্ঞ। তান করলে দেয়াল থর থর করে কাঁপত। সেই রকম তান আয়ত্ত করার
জন্য মনোজ এক অদ্ভূত রেওয়াজ শুরু করল। আশে পাশের বাড়ীর লোকের ঘুম ছুটে গেল কিন্তু
ডাক্তার যেহেতু সবার দরকার হয় তাই কেউ আর ওদের চটাবার সাহস পেল না।
এদিকে আমিও বেশ বুঝে গেলুম অজন্তা শিল্প ভালো করে
বোঝবার কোন সুযোগ আর যারই হোক আমার অন্ততঃ হচ্ছেনা। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে
আমাকে এবার পড়তে পাঠান হল অজন্তার দাদা শিবুর কাছে। ওরা সব ভাইবোন সাহেবের মত
ফর্সা ছিল। তার উপর শিবু বেশ লম্বাও ছিল, আর ছিল একজন ফাস্ট বোলার। বেশ হীরো হীরো
ছিল। আমার কাছে জানতে চাইল ইংরাজী কতদূর কি শিখেছি। তা যখন দেখল যা দরকার তার
কিছুই শিখিনি তখন শেখাতে আরম্ভ করল। প্রথমে টেন্স, তারপর ভয়েস চেঞ্জ। কিছুদিন পর
বলল, তোমার ইমাজিনেশন খুব ভাল। আর ম্যানেজিং পাওয়ার মন্দ নয়। টুকলি না করেই তুমি
পাশ করে যাবে। তবে অংক, বিজ্ঞান অবহেলা করলে হবে না।
ওদিকে মনোজ পড়েছে মুস্কিলে। ওর বক্তব্য
শোনার মত সারাক্ষনের কোন সঙ্গী নেই। কিছুদিন পরেই ও সেধে সেধে ভাব করতে চাইল। আমি
তখন টেন্স বুঝি, আবার ভয়েস বুঝি। দু একটা মেয়ে আবার এইসব আমার কাছে বোঝবার চেষ্টা
করা শুরু করেছে। মানে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছে আর কি! আমি পাত্তাই দিলাম না। হাফ
ইয়ারলি পরীক্ষায় ইংরাজীতে ১১ পেল মনোজ। আরো তিনটেতে ফেল করল। আমি ইংরাজীতে ৬৪ পেতে
ক্লাসে প্রায় হীরো হয়ে গেলাম। দাঁড়ি, কমা, ফুলস্টপ সমেত দু চার পাতা মুখস্থ করতে
আমার কোন অসুবিধা হতনা। মনোজ যা পড়ত সব ভুলে যেত। মেয়েদের কাজই ছিল ওকে সব ভুলিয়ে
দেওয়া।
সুতরাং যখন প্রমাণ হয়ে গেল আমি ওর
খারাপ ফলের জন্য দায়ী নয় তখন মিতালী মাসি একদিন আমায় ডেকে পাঠিয়ে দু জনের ভাব
করিয়ে দিলেন। শুনতে পেতাম থানার ওসির বড়ছেলে যে মিতালী মাসির সঙ্গে কলেজে পড়ে তার
সঙ্গে নাকি মিতালী মাসির প্রেম হচ্ছে। তবে প্রেমটা কি এক অজানা কারণে কেটে গেল।
গ্রাজুয়েশন শেষ হবার পর মিতালী মাসি বাড়ীতেই থাকত। সেলাই করত, গান করত, টিভি দেখত।
আনন্দলোক, সানন্দা এই সব পড়ত। সেই সময় আমার মামার আর এক বন্ধু সুনীল মজুমদার চাকরিসূত্রে
আমাদের ওখানে এল। কি ভাবে যেন মিতালী মাসির সঙ্গে তার পরিচয় হল। সন্ধ্যের পর আমরা
ঘরে পড়তাম আর সুনীলমামা আর মিতালী মাসী বারান্দায় বসে গল্প করত। গ্রীষ্মকালে কোন
অসুবিধা হলনা। কিন্তু শীতকালে বারান্দায় গল্প জমেনা বলে মামাকে ঘরে ঢুকতে হল
আর আমার উপর আদেশ হল এবার থেকে
সন্ধ্যেবেলায় আমি যেন বাড়ীতেই পড়াশুনা করি। মিতালী মাসির এই নির্মমতায় দুঃখ পেলাম।
এই সব ছোট ছোট দুঃখের কারুকাজ দিয়েই নিজেকে বজ্রকঠিন করে তুলতে হয়।
পরবর্তী
কালের ঘটনা আমাকে সংক্ষেপিত করতে হবে কারণ উপন্যাস লেখার ধৈর্য্য আমার নেই। ক্লাস
নাইনে পড়ার সময় ইলোরা থানার এক ড্রাইভার যে আবার একটু চুল্লু টুল্লু খেত তার উপর
ঢলে পড়ায় ওর স্কুলে আসা সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে গেল। এই বয়সের প্রেম আসলে এক ধরণের
হিস্টিরিয়া। তিনমাস বিজোড় রাখতে না পারলে সুইসাইড প্রেম হয়ে যায়। ইতিমধ্যে এঁচোড়ে
পাকবো বলে আমি ফ্রয়েডের নারী চরিত্র, আরব্য উপন্যাস টাস সব পড়ে ফেলেছি। আমাদের
পাড়ায় একটা সরকারী লাইব্রেরী আছে। তার লাইব্রেরিয়ানের নাম ছিল প্রদীপ। তার ফর্সা
পিঠে অটোম্যাটিক ম্যাসেজ বলে একটা ম্যাসেজ করে দিলে সে আমাকে ইচ্ছামত একটা করে বই
পড়তে দিত। শুধু যৌনবিজ্ঞান বলে একটা বই ছিল যেটা আমার পড়া নিষেধ ছিল। তা ভগবান যদি
তোমার পড়ার সুযোগ করে দেয় তুমি কি পড়বে না। সুনীলমামা বিয়ে করবে করবে করছে। তার ইচ্ছা
মিতালী মাসীকেই বিয়ে করবে। তবে মামার মায়ের পাত্রী দেখে পছন্দ হতে হবে। সেই
টালমাটাল সময়ে মামাগুলো সব লাইব্রেরীতেই আড্ডা দিত। মামার ঘরে বিছানার তলা উঁচু
হয়ে আছে কেন ইনভেশটিগেশন করতে গিয়ে দেখি ভক্তবৎসল ভগবান আমার পড়ার সুবিধার জন্য
মামাকে দিয়ে বইটা ওখানে আনিয়ে রাখিয়েছে। মামা সাড়ে দশটায় অফিসে গিয়ে বিকেলে একবার
বাড়ী আসত। আবার বেরিয়ে রাত দশটা নাগাদ ফিরত। ঘরের একটা চাবি আমার কাছে থাকত যাতে
নিরিবিলিতে আমি মন দিয়ে সব বিজ্ঞান টিজ্ঞান গুলো পড়ে জ্ঞান আহরণ করতে পারি। মিথ্যা
কথা বলবনা ভাই ভালোভাল বইগুলো দুবার তিনবার পর্যন্ত পড়ে নিয়েছি। সেইসব বীজের ফসল
ফলিয়ে এখন তোমাদের মুখে উপাদেয় অন্ন তুলে দিচ্ছি। সোনা পাঠক আমার এজন্য আমার দোষ
নিওনা প্রিয়সকল! ( ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন