লিখেছেন : মনোবর
বাড়ীটার
রঙ যে সাদা ছিল তার কারণ মনোজরা যখন ঐ বাড়ীতে এসে ওঠে তখন ঐ বাড়ীর যারা মালিক সেই
হালদাররা তড়িঘড়ি রঙ করাতে গিয়ে চুণ টানা পর্যন্ত করে আর এগোতে পারেনি। তারপর আর
রঙের পোচ টানাও হয়নি। বাড়ীটার পেছনে ঝোপঝাড় আর তারপরে একটা পুকুর ছিল। দক্ষিণমুখী
বাড়ীর সামনে বেশ খনিকটা উঠোন আর তারপরে ছিল পূব পশ্চিমে বিস্তৃত পাকারাস্তা।
রাস্তার ওপারে দক্ষিণ দিকে বড় একটা পুকুর ছিল, তার পাশে আরও একটা পুকুর। প্রথম
পুকুরের পশ্চিম পাড়ে ছিল সতীশ ডাক্তারের দোতলা বাড়ী। এই দুই ডাক্তারের মধ্যে একটু
রেষারেষি ছিল। সতীশ ডাক্তারের পসার ছিল বেশী। যদিও দাদুর ডাক্তারখানাতেও যথেষ্ট
ভিড় লেগে থাকত। আমরা যখন স্কুলে যেতাম মনোজ ডাক্তার খানায় ঢুকে দাদুর কাছ থেকে
টাকা নিত। দাদু কোন কথা না বলে তার টাকা রাখবার ড্রয়ারটা টেনে খুলতেন আর মনোজ যা
খুশী তাই নিয়ে বেরিয়ে এলে আমরা স্কুলের পথ ধরতাম। মনে মনে আমি ভাবতাম যে কবে আমার
এমন সৌভাগ্য হবে। মা বলতো খেয়ে যাচ্ছ আবার এসে খাবে, ব্যাস। মাঝখানে আর কিছু না
খেলেও চলবে।
মনোজ
অনেক টাকা জমিয়ে ফেলত। আর আমায় বলত ভবিষ্যতে যখন ওর টাকার ঘটটা ভাঙবে তখন আমাকেও
কিছু দেবে। পুজোর সময়ে আর রথের মেলার সময়ে ও ঘট ভেঙে একরাশ টাকা বার করে বলত যে
এবার আমাকে কিছু দিতে পারবে না তবে পরের বার দেবে কারণ বন্ধুদের সঙ্গে সব কিছু ভাগ
করে নিতে হয়। বছর খানেক পরে বোঝা গেল ওর কোনকিছুর ভাগই আমি পাবোনা।
পুজোর
সময়ে ওর তিনসেট পোষাক হত। আমার মা বলত পুজোয় যে নতুন জামা পরতে হবে এমন কথা নয়।
আমার যথেষ্ট জামা আছে তাই পরলেই হবে। কিন্তু এই কথা শুনলে রাতের ঘুম উবে যেত আমার।
শেষে অনেক টালবাহানার পর পঞ্চমী বা ষষ্ঠীর দিনে আমায় জামা-প্যান্ট কিনে দেওয়া হত।
রাতে আমি সেটা আমার বালিশের তলায় রেখে ঘুমোতাম কারণ আমাদের পাড়ায় চুরি চামারি হত।
এত কষ্টের পোষাক তো আর চোর কে দেওয়া যায়না। তবুও যদি চোর ঢুকে পড়ে তবে তার পেটে
ঢুকিয়ে দেবার জন্য একটা জংধরা চাকুও হাতের কাছে রেখে দিতাম। ঐ চাকুটা ছিল পাঁচফলা।
সুনীলমামা আমার ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিষ্ঠ হয়ে ঐটা আমায় কিনে দিয়েছিল। এমন পবিত্র
চাকু যে কারো পেটেই সেটা কোনদিন ঢোকান যায়নি।
পুজোর
সময় নতুন জুতোজামা পরে মনোজ বড়দের দলে ভিড়ে যেত। সেক’টা দিন আমাকে বিশেষ পাত্তা
দিতনা। তবে মনোজ ছাড়াও বন্ধু ছিল আমার। চৈতালী মাসীর সংগে যে দারোগার ছেলের প্রেম
হয়েছিল সেই বিজয়বাবুর ছোট ভাই ভজাও আমার বন্ধু ছিল। ভজা খুব প্রানবন্ত ছেলে। ওর
একটা অ্যালসেসিয়ান কুকুর ছিল। তার সংগে আমার ভাব করে দিয়েছিল। আমি তার মাথায় হাত বোলালেও
সে কিছু বলত না।ওর নাম ছিল টমি। কিন্তু মজা হত পুজোর সময়ে। ভজা আমাকে বারান্দায়
দাঁড়াতে বলে ওর বাবার ঘরে প্রার্থনার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকত। ওর বাবা ছিল বেঁটে আর
মোটা কিন্তু ভজার দাদারা সব লম্বা ছিল। মোটা দারোগা বেশ কিছুক্ষন ভজাকে দেখেও
দেখতে পেতনা। তারপর বহুক্ষন গড়ালে খ্যাক করে গর্জে উঠে বলত, কি চাই? ভজা হাত জোড়
করে বলত, বাবু, ২০ টাকা দাও, ঠাকুর দেখতে যাবো। অনেকক্ষণ কটমট করে ভজার দিকে
তাকিয়ে থেকে লোকটা থুপ থুপ করে তার প্যান্টের পকেট খুঁজে টাকা বার করে ১০টাকা
ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দিত। ভজা ছোঁ মেরে সেটা নিয়েই বারান্দায় এসে সেই টাকাতে তিন
চারটে চুমু খেত। আর ভজা এমনই উদার ছিল যে অত কষ্টের টাকাতেও যা কিনত তার হাফ আমাকে
দিত।
ও এত
পাকা ছিল যে কেউ সিগারেট খেতে খেতে যদি দু হাত পিছনে রেখে দাঁড়াত ও ঘুরে পেছনে
গিয়ে সেই সিগারেট থেকে একটান মেরে লোকটার মুখেই ধোঁয়া ছেড়ে মিচকি হাসি দিয়ে চলে
আসত। ওর এইসব কীর্তি আমাকে মুগ্ধ করে বলে ও আমাকে দেখাবার জন্য এইসব করত। অথচ
মনোজের কাছে এই গল্প করলে ও তাচ্ছিল্য করে বলত, ওসব আমিও করতে পারি কিন্তু ধরা
পড়লে দাদু চামড়া তুলে দেবে তাই করিনা। ভজার দিদির নাম ছিল মিনতি। সে ড্যাব ড্যাব
করে আমাকে দেখত। একদিন বলে, এই শোন, কি নাম তোমার?
আমার
নাম মানব।
কোন
ক্লাসে পড় তুমি?
ক্লাস
এইটে।
সব
বিষয়ে পাস কর?
হ্যাঁ।
ভজা
কটায় ফেল করে জান?
না।
কেন?
জিজ্ঞাসা করতে পারো না? দু জনে তো সারাক্ষন ভুটুর ভাটুর কর।
আমি কেন
জিজ্ঞাসা করব? তোমার ভাই তুমি জিজ্ঞাসা কর।
দ্যাখ!
দ্যাখ! কিরকম মুখে মুখে তর্ক করছে! আমি কার মেয়ে জান? হাজতে ঢুকিয়ে দিতে পারি তা
জান?
এই সময়
ভজা হস্তক্ষেপ করে এবং দিদিকে ধাক্কা মারে। ওর দিদি তখন হাসতে হাসতে বলে, খুব না!
ভজার
দিদির নাম ছিল মিনতি। ভজার মা মরে গিয়েছিল। ও বলত ওর দিদি ওকে মায়ের মতই ভালবাসে। (ক্রমশঃ )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন