মঙ্গলবার, জানুয়ারী ০৭, ২০১৪

সেই সাদা বাড়িটা

                          লিখেছেন : মনোবর
সন্ধ্যেবেলা মা বলল, যা, বইপত্র নিয়ে তোর দাদুর বাড়িতে চলে যা। তোর কার্তিক মামা ওদের পড়ায় ওখানে তোকেও পড়িয়ে দেবে বলেছে। শুনে মন বেশ উৎফুল্ল হয়ে ঊঠল। দাদুর বাড়ি মানে ডাক্তার প্রবোধ রঞ্জন দাসের বাড়ি। ওরা আগে আধমাইল দূরে একটা বাড়িতে থাকত। সেই বাড়ি ছেড়ে কয়েকদিন আগে রাস্তার গায়ে যে নতুন সাদা বাড়িটা হালদাররা কিনেছে সেই বাড়িতে ওরা ঊঠে এসেছে। যেদিন এল সেদিন আমরা হাতে হাতে জিনিষ পত্র ধরাধরি করে সাহায্য করেছি। মা সেদিনই ঘোষণা করেছে ডাক্তার বাবু আমার কোন এক দূর সম্পর্কের দাদু হয়। আর ওনার চার মেয়ে সবাই আমার মাসী হয়। চারের মধ্যে দুজনের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। মিতালী মাসী এখন কলেজে পড়ছে, আর চৈতালী মাসী বারুইপুরের রাসমণি বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে। আর একজন হচ্ছে দাদুর বড়ছেলের ছেলে মনোজ সে ক্লাস সেভেনে পড়ে।

                     তার সঙ্গে প্রথম দিনই ভাব হয়ে গেল। পড়তে পড়তে মনোজের জন্য একগ্লাস দুধ এল। আমি তো রোজ পড়তে যাবো। আমাকেও কি রোজ একগ্লাস করে দুধ দেওয়া সম্ভব। অতএব দুধের প্রতি দূর্বলতা থাকলেও করার কিছু ছিলনা। ভাব আরো গভীর হলে তলানি টলানি একটু মিলতে পারে এই আশায় বুক বেঁধে কার্তিক মামার কাছে পড়া শুরু করলাম। কার্তিক মামা সব বই পড়াতো। বেশ হাসি খুশী মামা। আমার আপন মামার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তাহলে পাণিপথের যুদ্ধটা কবে হয়েছিল? এই দেখো এইযে এইখানে লেখা রয়েছে। এই দাগ মেরে দিলুম। পর্বত কাকে বলে? এই মনোজ, তুমি বলত পর্বত কাকে বলে? মনোজ তখন আমার টর্চলাইটটার প্যাঁচ খুলে ব্যাটারিগুলো বার করে কি একটা গবেষণায় রত ছিল। প্রশ্নটা শুনে চোখ ঘোরাতে লাগল। ও ট্যারা ছিল বলে পড়াবার সময়ে ফাঁকি মারার বাড়তি সুবিধা ছিল। কারণ শিক্ষকের দিকে চেয়ে আছে না তেঁতুলগাছের দিকে চেয়ে আছে বোঝা যেতনা। আজ কিন্তু হাতে নাতে ধরা পড়ে গেল। কার্তিক মামা ওর কান ধরে যুদ্ধের জায়গাটা দেখিয়ে দিল। মামা আমার দিকে কোন নজরই দিতনা। কারণ আমার এমনি পড়াত।
              কিন্তু আমাদের বাড়ীতে মামা গেলে মা পরোটা, আলুভাজা, চা করে মামাকে খুশী করত। মামা মুখভর্তি পরোটা চিবোতে চিবোতে প্রচুর মিথ্যা কথা বলে যেত। দিদি, তোকে বলব কি! এই ভাগ্নাকে নিয়ে আমার যত চিন্তা। প্রত্যেকটা জিনিষ যতক্ষণ না ওকে ভালকরে বোঝাতে পারি আমি শান্তি পাইনা। তবে ভাগ্নার মাথা ভালো, একবার বললেই টপ করে ধরে নেয়। এসব বলার পর মামার জন্য আরো পরটা আসত। যাবার সময় মামা আমার গালটিপে ‘ সোনা ছেলে একটা’ এই বলে বিদায় নিত। সেইদিন হাফ ডিমের পরিবর্তে আমায় একটা গোটা ডিম রাত্রে খেতে দেওয়া হত। খেয়েদেয়ে আমি অবাক হয়ে মামার কথা ভাবতাম। মামা আমার মাকে উপদেশ দিয়েছিল, একটু ডিম, মাছ, মাংস খাওয়াবি দিদি। নইলে ব্রেন শুকিয়ে গেলে কঠিন কঠিন জিনিষ আর ধরতে পারবে না।

              এইভাবে আমি ও বাড়ীর একজন হয়ে গেলুম। রাত আটটার সময় দাদু ডিস্পেনসারি থেকে ফিরে একটু জলযোগ করে আমাদের পাটিগণিতের অংক করাত। তার আগেই গিয়ে বসে থাকতুম। মিতালী মাসি রোজ সন্ধ্যেবেলা বারান্দায় পায়চারি করতে করতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। ‘আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান’ আর ‘তুমি তাই তুমি তাই গো’ এই দুটো ছিল মাসীর ফেভারিট গান। রান্নাঘর থেকে ইলিশমাছ ভাজার গন্ধ আসত। সে ছিল এক স্বপ্নের পরিবেশ। তার ভেতরে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখাদিত ঐ পাটিগণিত। দাদু মনোজকে খুব ভালবাসা সত্বেও তিন চারটে বিষয়ে যখন মনোজ ফেল করল তখন থেকে দাদু ওর উপর খাপ্পা হয়ে গেল। মনোজের বাবাও ছিল হাসপাতালের ডাক্তার। সেই সময় তার বিহারে পোষ্টিং ছিল। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবার পর তারা দাদুর বাড়ীতে বেড়াতে এল। কার্তিক মামা একটা হফবয়েল ডিম আর পাউরুটি টিফিন পেয়ে আবেগে গদগদ হয়ে বলল, মাসীমা মনোজের মত মাথা খুব কম ছেলের হয়। ওর হল গবেষণার মাথা। শুধু পরীক্ষার বেলা সেইটা ও কাজে লাগাচ্ছে না। নইলে ওর কাছে কেঊ দাঁড়াতে পারে! তা মনোজের এই চাপা গুণটা অন্য কোন টীচার খুঁজে পায়নি বলে কার্তিক মামা পরের বছরের জন্যও বহাল থাকল তবে আমি সব বিষয়ে পাশ করার কারণে মামীর বিষ নজরে পড়ে গেলুম।

              শিগগিরই ওরা আবার বিহারে ফেরত গেল আমারও টেনশনের অবসান হল। মিতালী মাসী ছিল বাড়ীর আসল কর্তা। অতএব তার সন্তুষ্টির ব্যাপারটা খেয়াল করে চললেই কলাটা মুলোটা সব পাওয়া যেত। মাঝে মাঝে দুপূরে পর্যন্ত খাবার নিমন্ত্রণ হত। কিন্তু মনোজের মন যোগান অত সহজ ছিলনা। ওর ধারণা ছিল যে কোন কাজই ও ইচ্ছা করলে করতে পারে শুধু ইচ্ছা করেনা তাই পারেনা। নিউটন দাদুবাড়ী থেকে বৈজ্ঞানিক হয়েছিল কারণ তাকে রোজ কো এডুকেশন ইস্কুলে যেতে হতনা। মেয়েরা হচ্ছে পড়াশুনার রাস্তায় সবচেয়ে বড় বাধা। তিন চারটে মেয়ের মধ্যে কার কথা বেশী ভাববে এটা ঠিক করতে গিয়েই তো ও ফেল মারল। নতুবা ও বোঝেনা কি যে পরীক্ষায় উত্তর লিখতে পারবে না। তা ফেল করুক আর যাই করুক ইলোরার কথাই ও ভাববে। কারণ ও যেমন সুন্দর তেমনই ঠাট ঠমক। সে তো হবেই কারন ইলোরা ছিল আমাদের থানার মেজ দারোগার মেয়ে। ওদের আসল বাড়ী নাকি বরানগরে। ও ছিল বরানগরের রসমালাই। ওর কাছে মফস্বলের জিভেগজারা পারে কখনও! তবে মনোজ আমাকে কথা দিল ও যদি ইলোরাকেই বিয়ে করে তবে ওর বোন অজন্তাকে বলে দেবে আমাকে বিয়ে করতে। ইলোরা আমাদের সঙ্গে আর অজন্তা আমাদের চেয়ে একক্লাস নীচে পড়ত। ফর্সা অজন্তা একটা ডিপ ব্লু টপ পরে জানালার কাছে বসে পড়া মুখস্থ করত। বাজারে যাবার সময় রাস্তা থেকে বেশ দেখা যেত। একদিন ইলোরা মনোজের সঙ্গে কথা বলল। সেদিন থেকে ওর বিভিন্ন কল্পনা আর ভবিষ্যৎ ভাবনার সঙ্গে তাল দেওয়া আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল। একদিন বলেই ফেললুম ইলোরার বাবা কখনই ওর মত প্রতিবারে ডাব্বা মারা ছেলের সঙ্গে অত সুন্দরী মেয়ের বিয়ে দেবেনা। তখন কি আর জানতুম সুন্দরী মেয়েরা বেশীর ভাগই চোর ছ্যাঁচোরের প্রেমে পড়ে!  ( ক্রমশঃ)


কোন মন্তব্য নেই: