লিখেছেন : রইসউদ্দিন আরিফ
ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক লেখালেখিতে বিশিষ্ট
চিন্তাবিদ ও গবেষক ম. জামিলুল বাসারের প্রথাবিরোধী চিন্তা-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়
তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সংস্কার’-এ। লেখকের বর্তমান গ্রন্থ ‘কোরআন বনাম শরিয়ত’ মূলত পূর্ববর্তী
গ্রন্থেরই বৃহৎ কলেবরের নতুন সংস্করণ। ‘ঘাসফুল নদী’র প্রকাশনায় এই গ্রন্থটি নিয়ে ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকায় কোনো
আলোচনা বা বিতর্ক হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে প্রথাবিরোধী ধর্মতাত্ত্বিক
বিতর্ক-সমলিত এই গ্রন্থটির ওপর বিস্তৃত আলোচনা হওয়া খুবই দরকার। পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের দেশের শরিয়তী ধারার ইসলামী চিন্তাবিদরা এ ধরনের বই
নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনায় আগ্রহী হন না। ধর্মতত্ত্বের ওপর আমার জ্ঞান খুবই সীমিত বলে
আমি শুধু আলোচ্য গ্রন্থে ইসলাম, হিন্দুধর্ম, কোরআন ও বেদ-উপনিষদ নিয়ে লেখা কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ের ওপর
আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
লেখকের সাথে আমার ব্যক্তিগতভাবে
পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য না হলেও কথিত ধর্মীয় কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে
আপোষহীন সংগ্রামী মনোভাবের জন্য তাঁর প্রতি আমি খুবই শ্রদ্ধাশীল। এ কারণে তাঁর
সংস্কারমুক্ত মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আলোচ্য গ্রন্থের কিছু বিশেষ অংশ নিয়ে
যে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো তা যদি কোনো কারণে লেখকের মনোকষ্ট বা ক্ষোভের কারণ ঘটায়
তাহলে তার জন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
এক.
ধর্ম নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার দুইটি
দিক আছে। একটি ধর্মতাত্ত্বিক, আরেকটি
রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক । ধর্মের ধর্মতাত্ত্বিক সাধারণ ব্যাখ্যা মতে পৃথিবীর সকল
ধর্মগ্রন্থের বাণী হলো আসমানী বাণী, আল্লাহ/ঈশ্বর বা ভগবানের বাণী। আবার উদারনৈতিক ধর্মতত্ত্বের ব্যাখ্যা মতে সকল
ধর্মগ্রন্থের মূল বাণী অভিন্ন এবং বলা হয় এসব বাণী দেশ-কাল-ভাষা ভেদে
আল্লাহ/ঈশ্বর-গড-ভগবান বিভিন্ন নামে হলেও মূলত একই সৃষ্টিকর্তার বাণী। কারণ
সৃষ্টিকর্তা একাধিক নন, একজনই।
যদি তাই হয় তাহলে ধর্মতত্ত্ব মতে
একথাও সুনিশ্চিত যে, দেশ-কাল ও ভাষার
প্রেক্ষাপটে তিন হাজার বছর আগের ধর্মগ্রন্থের আবেদনের তুলনায় তার চারশ’ কি পাঁচশ’ বছর পরের
ধর্মগ্রন্থের আবেদন হবে অধিকতর অগ্রসর (আপ-ডেট) বা পূর্ণাঙ্গ। আবার তারও
পরবর্তীকালের ধর্মগ্রন্থের আবেদন হবে আরো অগ্রসর, আরো পূর্ণাঙ্গ। সে হিসেবে মুসলিম কমিউনিটির দাবিমতে দুনিয়ার সর্বশেষ
ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের আবেদন সবচেয়ে অগ্রসর ও সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ। কোরআনেই রয়েছে, আল্লাহ বলছেন, ‘কোরআনকে আমি তোমাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছি’। এ কথা যদি সত্য হয়, তাহলে ধর্মতত্ত্বের মতে পৃথিবীর সকল ধর্মপ্রাণ মানুষের কর্তব্য হওয়া উচিত
সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থ কোরআনকে সবচেয়ে অগ্রসর ও সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ বাণী বলে মানা ও সে
অনুযায়ী সমাজ ও জীবন পরিচালনা করা। ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যামতে এটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু লক্ষ্য করা যায়, জামিলুল বাসারের ধর্মতাত্ত্বিক গ্রন্থ কোরআন বনাম শরিয়ত-এ
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোরআনকে সর্বশেষ ও সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসেবে, পূর্ণাঙ্গ ধর্মমত হিসেবে এবং হজরত মুহাম্মদ-(স.) কে সর্বশেষ
ও শ্রেষ্ঠ নবী বা একমাত্র বিশ্বনবী হিসেবে মানা হয়নি। পক্ষান্তরে লেখক সকল
ধর্মগ্রন্থকে একই কাতারে সমমানে দাঁড় করিয়েছেন এবং সকল নবী ও অবতারকে বিশ্বনবী ও
বিশ্বঅবতার বলে আখ্যায়িত করেছেন। শুধু তাই নয় - লেখক তাঁর পুস্তকের ১৬৮ পৃষ্ঠা থেকে
১৭১ পৃষ্ঠাব্যাপী কোরআন ও বেদ-বেদান্তের বাণীর উদ্ধৃতি টেনে এসব গ্রন্থের বাণীকে
হুবহু একই বাণী বলে দাবি করেছেন। পুস্তকের ২৫১ পৃষ্ঠা থেকে ২৫৪ পৃষ্ঠাব্যাপী বৈদিক
ধর্মমতে বেদে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ, গরু খাওয়া ও মৃতদেহ
কবর দেওয়া সিদ্ধ বলে দাবি করেছেন। তিনি লিখেছেন, “প্রচলিত মূর্তিপূজা বেদ কখনো সমর্থন করেনি, বরং বিরোধিতা করেছে।” গো-হত্যা ও গোমাংস
ভক্ষণ সম্পর্কে লিখেছেন, “হিন্দুদের গরু
খাওয়া বেদে কোথাও নিষেধ নেই; বরং গরু খাওয়ার
বিধান বেদে সমর্থন করেছে।” বেদের শ্লোক কোট
করে লেখক বলেছেন, “গো-হত্যা স্থানে
গাভীগণ হত্যা হতো”। ঋগে¦দের শ্লোক কোট করে লিখেছেন “ইন্দ্রের জন্য গোবৎস্য উৎসর্গ করা হয়েছে।” উপনিষদ থেকে উদ্বৃতি টেনে তিনি লিখেছেন, “বেদজ্ঞান লাভ করতে হলে, স্বাস্থ্যবান
সন্তান লাভ করতে হলে ষাঁড়ের মাংস খাওয়া জরুরী।” ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন হলো, হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ বেদের বাণী যদি কোরআনের বাণীর ‘সমতুল্য’ হয়, বেদে যদি মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ হয় এবং বেদ ও উপনিষদে যদি
গো-হত্যা ও গোমাংস খাওয়া উত্তম কাজ হয়, তাহলে সেই বেদ উপনিষদের খবর শুধু জামিলুল বাসার জানেন, আর হিন্দুরা জানেন না, ব্রাহ্মণরা জানেন না, এমনকি গান্ধী-বালগঙ্গাধর
তিলক-অরবিন্দরা জানেন না, তা তো হতে পারে না।
তাহলে প্রশ্ন হলো, ভারতবর্ষে হাজার
হাজার বছর ধরে মূর্তিপূজা (পৌত্তলিকতা)
এতো প্রবল শক্তি নিয়ে টিকে থাকলো কেন? ব্রিটিশ ভারতে বালগঙ্গাধর তিলকরা এতো তোড়জোড় করে ‘গোরক্ষিণী সমিতি’ গঠন করে গো-রক্ষা আন্দোলনের নামে মুসলমানদের গো-হত্যা ও গো-মাংস ভক্ষণের
বিরুদ্ধে নির্মম আক্রমণ চালিয়ে, সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গা সৃষ্টি করে হাজার হাজার মুসলমানের রক্তে পবিত্র ভারতের মাটি কলংকিত করলেন
কেন?
এমনকি আজকের আধুনিক স্বাধীন ভারতে ‘গো-খাদক’ মুসলমানদের ওপর
নরেন্দ্রমোদীদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পরিচালিত হয় কেন? ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস সরকারের আমলে আদভানী-বালঠেকারেদের
হাতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয় কেন? প্রশ্ন আরো আছে, বেদ ও কোরআনের কথা যদি এক হয় তাহলে ভারতবর্ষের উচ্চবর্ণীয়
হিন্দুরা সাতশ’ বছরের কোরআনপন্থী মুসলিম শাসনামলকে ‘অন্ধকার যুগ’ আখ্যায়িত করলেন কেন? ব্রাহ্মণ্যবাদী
হিন্দুরা প্রতিবেশী মুসলমান ও তার ধর্ম ইসলামকে ঘোরতর শত্রু হিসেবে গণ্য করলেন কেন?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জনাব জামিলুল বাসার ‘আদি’ বেদ, ঋগ্বেদের শ্লোক কোট
করেছেন, তিনি সম্ভবত জানেন
না যে,
লিখিতভাবে গ্রন্থাকারে তথাকথিত ‘আদি বেদ, ঋগে¦দের কোনো অস্তিত্ব অতীতে কোনোকালেই ছিল না। বেদ, ঋদ্বেদের শ্লোকগুলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছেঁড়া-ছেঁড়াভাবে, অবিন্যস্ত ও অসম্পূর্ণভাবে হাজার হাজার বছর ব্রাহ্মণদের
স্মৃতি ও মুখে মুখে ছিল। ব্রাহ্মণদের স্মৃতি-নির্ভর অবিন্যস্ত ছেঁড়া-ছেঁড়া
শ্লোকগুলোকে লিখিতভাবে বৃহৎ কলেবরে বেদ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এইমাত্র
সেদিন,
অর্থাৎ আঠারো শতকের শেষে। এটি ঘটে বিখ্যাত জার্মান পন্ডিত
ম্যাক্সমূলারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ও সম্পাদনায় [তথ্যসূত্র: ড. এসএম লুৎফর রহমান:
বাঙালীর লিপিভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস (বেদ আবিস্কারের নেপথ্যে) ঢাকা
- ২০০৫,
পৃষ্ঠা: ৪৮-৫০]।
সম্পাদনা করতে গিয়ে লিখিত বেদে
ম্যাক্সমূলার বেশ কিছু নতুন শ্লোক সংযোজন করেছেন বলে কথিত আছে। তিনি কী উদ্দেশ্যে
এটা করেছেন সেটা হয়তো আস্তে আস্তে আমরা জানতে পারবো। জামিলুল বাসারের গৃহীত
উদ্ধৃতিগুলো যে ম্যাক্সমূলারের সম্পাদিত বেদ-ঋগে¦দ থেকেই নেয়া তাতে সন্দেহ কি। ড. এসএম লুৎফর রহমান আমেরিকান
নৃ-বিজ্ঞানী উইলিয়ম সি. বয়েডের জেনেটিক্স অ্যান্ড দি রেসেস অব ম্যান গ্রন্থ থেকে
সংগৃহীত তথ্য টেনে করিৎকর্মা ম্যাক্স মূলার সম্পর্কে বলেছেন :
“এই জার্মান পন্ডিত সারাজীবন
কাটিয়েছেন লন্ডনে। জীবনে একবারও ভারতে না এসে ভারতীয় ও ইউরোপীয় ইঙ্গ-ব্রাহ্মণ্যবাদী
বর্ণগর্বীদের জন্য আর্য রক্ত, আর্য জাতি, আর্য ধর্ম, আর্যভাষা ও
আর্যসভ্যতার ফ্যানাটিসিজম তৈরিতে কি বিশাল ভূমিকা রেখে গিয়েছেন, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।” (ড. এসএম লুৎফর রহমান : বাঙালীর লিপিভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস :
দ্বিতীয় খন্ড: পৃষ্ঠা - ৪০)।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, একই প্রেক্ষাপটে কবি রবীন্দ্রনাথ ম্যাক্সমূলারকে উপহাস করে
কবিতা লিখেছেন, যেমন :
“মোক্ষমূলার বলেছে আর্য
তাই শুনে সব ছেড়েছি কার্য
মোরা বড় বলে করেছি ধার্য
আরামে পড়েছি শুয়ে।”
(সূত্র. এসএম লুৎফর রহমান : বাঙালীর
লিপিভাষা বানান ও
জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস : দ্বিতীয়
খন্ড: পৃষ্ঠা - ৪১)।
কে জানে, জামিলুল বাসার বেদ, ঋগ্বেদ, উপনিষদ থেকে মূর্তিপূজাবিরোধী ও
গোমাংস ভক্ষণের পক্ষে যেসব স্পর্শকাতর শ্লোক কোট করেছেন সেসব হয়তো ম্যাক্সমূলার
সাহেবেরই তৈরি ‘ফ্যানাটিসিজম, আর ব্রাহ্মণরা হয়তো ‘দেবতুল্য’ ম্যাক্সমূলারের এসব ফ্যানাটিসিজমকে নিরবে হজম করে নিয়েছেন, কিন্তু ধর্মানুশীলনে এসবের স্থান দেননি!
দুই.
ব্রিটিশ-সৃষ্ট এই ফ্যানাটিক আর্য
রক্ত,
আর্য জাতি, আর্য ধর্ম, আর্য ভাষা, আর্য ধর্মগ্রন্থ
(বেদ-ঋগ্বেদ) ও আর্য সভ্যতার যে বিরাট এক ভীতিকর কাহিনী ও ইতিহাস আছে। আমরা অনুমান করি, জামিলুল বাসার সাহেবরা সম্ভবত ‘সাম্প্রদায়িক’ হয়ে যাওয়ার ভয়ে সে ইতিহাসের তত্ত্ব-তালাসের কোনো প্রয়োজন
মনে করেন না অথবা তার সন্ধান পাননি। কারণ তাঁদের কাছে সে ইতিহাস কথিত মৌলবাদীদের
ইতিহাস,
মুসলমান-পক্ষপাতিত্বের ইতিহাস। তাঁদের কাছে সে ইতিহাস
হিন্দুবিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক মুসলমানের ইতিহাস।
জামিলুল বাসার সাহেবদের আমরা সবিনয়ে বলতে চাই, তাঁরা মুসলমান ও হিন্দুর ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য, বেদ ও কোরআনের মিলন ঘটাবার জন্য এবং একক ধর্মভিত্তিক বিশ্ব
প্রতিষ্ঠার জন্য লেখালেখি করুন, ভালো কথা। কিন্তু
আমাদের দাবি - তার আগে ভারতবর্ষ তথা উপমহাদেশের তিন হাজার বছরের (মতান্তরে ২৭
হাজার বছরের) ইতিহাস পাঠ ও পর্যালোচনা করতে হবে। বেদ-ঋগ্বেদ ও উপনিষদপন্থী
ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দুই হাজার বছরের রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার ইতিহাস পাঠ ও পর্যালোচনা
করতে হবে। সেইসাথে পর্যালোচনা করতে হবে সাতশ’ বছরের মুসলিম শাসনামলের ইতিহাসের। তবে অবশ্যই সে ইতিহাস
ইঙ্গ-ব্রাহ্মণ্যবাদীদের তৈরি মিথ্যা ও বিকৃত ইতিহাস নয়। যে ইতিহাস তারা এতদিন চেপে
রেখেছে সেই ইতিহাস আমাদের উদ্ধার, পাঠ ও পর্যালোচনা
করতে হবে। ভারতের মুসলিম শাসনামলের ইতিহাস সম্পর্কে কার্লমার্কসের গভীর মনোযোগী
অনুসন্ধানের বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। প্রধানভাবে মুসলমানদের নেতৃত্বে
পরিচালিত ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবকে মার্কস ভারতের ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ কেন বলেছেন সেটিও আমাদের অনুধাবন করতে হবে। আর তারই ধারাবাহিকতায় আজকের
ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইলি ও ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত-আগ্রাসনের
কারণে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের ৯০ কোটি জনগণের উপর চরম বিপর্যয় কীভাবে ঘটল এবং
ঘটছে সেই ইতিহাসও আমাদের পাঠ করতে হবে। প্রকৃত ইতিহাস পাঠ ও পর্যালোচনা না করে হিন্দু
ও মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার এবং কোরআন ও বেদ একাকার করার ধর্মতাত্ত্বিক প্রয়াস যতই
মহৎ হোক না কেন, তা সাম্পদ্রায়িক ভেদবুদ্ধির বিনাশ না
ঘটিয়ে আরো বাড়িয়েই তুলবে। আমাদের মেধা বৃদ্ধি করতে হবে। বলাবাহুল্য, আমাদের দেশের সুশীল-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক-শিক্ষকদের মধ্যেও
অনেক মেধা আছে। কিন্তু সেই মেধা সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদীদের কাছে অর্থ, প্রতিপত্তি, খ্যাতির বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যাওয়া মেধা। এই মেধা দিয়ে আমাদের চলবে না। আমাদের
নতুন মেধার বিকাশ জরুরি।
তিন.
এবারে ধর্ম নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক
রাজনৈতিক আলোচনা-পর্যালোচনা প্রসঙ্গে যৎকিঞ্চিৎ কথা বলে নেওয়া দরকার। এই ব্যাপারটি
ধর্মতাত্ত্বিকদের কাছে যতই এ্যালার্জিক মনে হোক না কেন, ধর্মের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ডিসকোর্সটা, আমরা মানি বা না মানি, আমাদের শুনে রাখা দরকার।
ধর্মের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা
প্রচলিত ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। যেমন ধর্মের বৈজ্ঞানিক
রাজনৈতিক ব্যাখ্যা মতে কোনো ধর্মগ্রন্থের বাণীই প্রচলিত ধারণার আসমানী বাণী বা
বেহেস্তে অবস্থানকারী কোনো আল্লাহ/ঈশ্বর-ভগবানের বাণী নয়। ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে
পৃথিবীতে যত ভাষা ও বাণী আছে তা যতই সুন্দর-সুললিত হোক, যতই মহৎ ও প্রজ্ঞাবান হোক, তা সবই মানুষেরই তৈরি। এগুলো সবই মানুষের প্রজ্ঞার ফসল। এই প্রজ্ঞাকেই কেউ
বলেন আল্লাহ, কেউ বলেন ঈশ্বর, বোধি, ভগবান বা নিরঞ্জন। এমনকি আল্লাহ/ঈশ্বর/নিরঞ্জনের ধারণাও
মানুষের প্রজ্ঞার তৈরি। মূলত প্রজ্ঞাই হচ্ছে আল্লাহ/ঈশ্বর/নিরঞ্জন। ‘প্রজ্ঞা’ নামের নিরাকার
আল্লাহ/ঈশ্বর সাকার মানুষের মাধ্যমেই পৃথিবীতে প্রকাশিত হয়। আর প্রজ্ঞা বা বোধিই
যদি নিরাকার আল্লাহ/ঈশ্বর/নিরঞ্জন হয় তাহলে সে অর্থে ধর্মতত্ত্বের ‘অহি’ বা ‘প্রত্যাদেশের’ ধারণাও গ্রহণযোগ্য।
সমস্ত প্রধান ধর্মগ্রন্থের সার্বজনীন
বাণীর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষ, জীব ও প্রকৃতির
মুক্তি। সুতরাং ধর্মগ্রন্থগুলোর এইসব সার্বজনীন নীতি-আদর্শের ওপর ভিত্তি করে
রাজনীতিতে জাতির মুক্তির প্রশ্নে, শ্রেণীর মুক্তির
প্রশ্নে সব ধর্মের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। কিন্তু ধর্মতাত্ত্বিক ধর্মের ভিত্তিতে
এই ঐক্য সম্ভব নয়। এ ঐক্য কেবল রাজনৈতিকভাবেই সম্ভব। ধর্মতত্ত্বের ভিত্তিতে এক
ধর্মানুসারীদের সাথে আরেক ধর্মানুসারীদের ঐক্য তো দূরের কথা, এমনকি বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, একই ধর্মের অনুসারীদের নিজেদের মধ্যেও ঐক্য সম্ভব নয়।
বেদ/কোরআন/তাওরাত/বাইবেলের মিলন ঘটিয়ে সব ধর্মের লোকদের এক কাতারে ঐক্যবদ্ধ করার
ধর্মতান্ত্রিক প্রকল্প একটি অলীক প্রকল্প। জনাব জামিলুল বাসারের গ্রন্থটি আমাদের
কাছে এই রূপই একটি অলীক ধর্মতাত্ত্বিক প্রকল্প বলেই মনে হয়।
ধর্মের রাজনৈতিক আলোচনার ইতি টেনে
আবার ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনায় ফিরে আসা যাক। সাত শতকে কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা
অনুযায়ী নবী মুহাম্মদ-(স.) এর নেতৃত্বে আরবে ইসলামের অভ্যুদয় হয়েছিল পৌত্তলিকতা ও
সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে, আর সেই সাথে অতীতের সকল বিকৃত ধর্মগ্রন্থ বাতিল ঘোষণার মাধ্যমে। জনাব জামিলুল
বাসার তাঁর পুস্তকে বেদ-ঋগে¦দ-উপনিষদ থেকে যেসব উদ্ধৃতি টেনেছেন সেগুলো আদি শ্লোক কিনা সে ব্যাপারে আমরা
নিশ্চিত নই, বরং সন্দিহান। তবু জামিলুল বাসার যদি
সেগুলোকে আদি ভাষ্য বলে মনে করে থাকেন, তাহলে সেগুলোর বিকৃতি ঘটে গেছে কয়েক হাজার বছর আগেই। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সেসব ‘বিকৃতি’ দূর করা তো দূরের
কথা,
বরং সেই ‘বিকৃতি’ বা ‘পাপাচারের’ বিরুদ্ধে যারাই প্রতিবাদ করেছে, বিদ্রোহ করেছে, তাদেরকেই ব্রাহ্মণ্যবাদীরা নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছে, নিশ্চিহ্ন করেছে। তিন হাজার বছর আগে চার্বাকের বিদ্রোহ, আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধ ও তাঁর অনুসারীদের বিদ্রোহ
এবং বৌদ্ধ, জৈনসহ অপরাপর ধর্মাবলম্বীদের ওপর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের
নিপীড়ন ও ধ্বংসের ইতিহাস সকলেরই জানা।
ভারতবর্ষে তার পরের ইতিহাস সুদীর্ঘ
সাতশ’
বছরের মুসলিম শাসনের ইতিহাস। সেই ইতিহাস হচ্ছে
প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাহ্মণ্যবাদীদের পরাজয়ের ইতিহাস এবং নতুন শাসনব্যবস্থার চাপের
মুখে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অবদমিত থাকার ইতিহাস। এ সাতশ’ বছরের আরো ইতিহাস হচ্ছে ভারতবর্ষের
হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-জৈন-বৈষ্ণব নির্বিশেষে জনকওমের তুলনামূলকভাবে
অর্থনীতি-ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির ইতিহাস, এবং সে ইতিহাস আপেক্ষিক মাত্রায় শান্তি ও নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির
ইতিহাস। ফা-হিয়েন, ইবনে বতুতা, আলবিরুনি, ইবনে খালদুন, ফ্রাসোঁয়া বার্নিয়েরের মত বিশ্ববরেণ্য পরিব্রাজকদের বর্ণনা
থেকে এই ইতিহাস জানা যায়। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে সে ইতিহাস বিষয়ময়, দুঃস্বপ্নের ইতিহাস। মুসলিম শাসনের সাতশো বছরের সেই ঐতিহাসিক কালকে ব্রাহ্মণ্যবাদী ও তাদের অনুসারীরা
যে আড়াইশ’
বছর ধরে ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে অভিহিত করে এসেছেন সেই মিথ্যাচারের জাল থেকে এখনো
আমরা মুক্ত হতে পারিনি।
এরপর আঠারো শতকের মাঝামাঝি মুসলিম
শাসনের অবসানের পর দুশো বছরের ব্রিটিশ রাজত্বকালে ভারতবর্ষের গোটা মুসলিম
কমিউনিটিসহ বিপুল সাধারণ জনগণের উপর নেমে আসে অতীতের ব্রাহ্মণ্যবাদী
শাসন-শোষণ-নিপীড়নের অনুরূপ মহাবিপর্যয়। তবে এ সময়ে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় যেটি ঘটে
সেটি হল, ইঙ্গ-ব্রাহ্মণ্যবাদী জোটের নিয়ন্ত্রণে জঘন্য ইতিহাস বিকৃতি ও
মিথ্যাচার। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ও ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদের
শাসন-শোষণ-আধিপত্য চিরস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে সবচেয়ে বড় যে অপকর্মটি করেছে সেটি হল, সাতশো বছরের
মুসলিম শাসনের ইতিহাসসহ উপমহাদেশের কয়েক হাজার বছরের সত্য ইতিহাস ধামাচাপা দিয়ে
মিথ্যা ও বিকৃত ইতিহাস তৈরি করা এবং তা ভারতবাসীর ওপর চাপিয়ে দেয়া। সেই ইতিহাসের
ওপর ভর করে এবং আরো নতুন নতুন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন সৃষ্টি
করার ফলে সাম্প্রদায়িক সংঘাত চরমে পৌঁছায়। তারই ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার
প্রক্রিয়ায় দেশ বিভক্ত হয়। সেই চেপে রাখা ইতিহাস আজ যতই প্রকাশ পাচ্ছে ততোই
উন্মোচিত হচ্ছে ইঙ্গ-ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ভয়ঙ্কর সব ষড়যন্ত্রের বিষয়।
চার.
জনাব জামিলুল বাসার তাঁর পুস্তকে
বেদ-উপনিষদকে কোরআনের সমতুল্য মর্যাদা প্রদানের প্রয়াসের মাধ্যমে এবং সকল
নবী-রসুল/অবতারদের সমমর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে মুসলিম ও অমুসলিম মিলন ঘটানোর যে
কোশেশ করছেন তার ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা তিনি কি ভেবে দেখেছেন? তিনি কি আরো ভেবে দেখেছেন, এই ধরনের অলীক ধর্মতান্ত্রিক প্রকল্প বাংলাদেশ ও ভারতের
মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে মারাত্মক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে ও হিন্দু-মুসলিম
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে আরো বিনষ্ট করতে পারে ?
অতীতে মোঘল যুগে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের
চক্রান্তে সম্রাট আকবর (মহৎ ?) উদ্দেশ্য নিয়ে
এরকমই এক প্রকল্প ‘দ্বীন-ই-ইলাহির
প্রবর্তন করেছিলেন। তার পুরস্কারস্বরূপ -- ইতিহাসে একমাত্র চিতোর গড়ের যুদ্ধেই
ত্রিশ হাজার ব্রাহ্মণ-হত্যাকারী সম্রাট আকবরকে ব্রাহ্মণরা ‘জগদীশ্বর’ ভূষণে ভূষিত
করেছিলেন। হাজার হাজার ব্রাহ্মণ হত্যাকারী মহাপাতক আকবরকে ব্রাহ্মণরা সেদিন জগদীশ্বর
উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন শুধুমাত্র এই কারণে যে, আকবরের ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’ ধর্ম - ইসলাম, কোরআন ও মুসলমানদের উপর আঘাত হেনেছিল। দ্বীন-ই-ইলাহির চূড়ান্ত পরিণতির কথাও
আমরা জানি। সমগ্র ভারতবর্ষে এই ধর্মের অনুসারী হয়েছিলেন আবুল ফজলসহ মাত্র ১৮ জন
(তাদের একজনও কোনো ব্রাহ্মণ ছিলেন না)। [তথ্যসূত্র: শ্রীবেনু গঙ্গোপাধ্যায়ের
দুর্গে দুর্গে পুস্তক থেকে উদ্ধৃতি-সম্বলিত গ্রন্থ গোলাম আহমাদ মোর্তজার ইতিহাসের
ইতিহাস,
পৃষ্ঠা : ১৫১-১৫৩]।
অথচ ‘জগদীশ্বর’ প্রবর্তিত এই ধর্মটি তো যাঁরা আকবরকে
জগদীশ্বর উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন, সেই ব্রাহ্মণদেরই
দলে দলে গ্রহণ করা উচিত ছিল, না কি ? আমরা জানি, এই দ্বীন-ই-ইলাহির
বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আকবরের শাসনামলের শেষদিকে ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমানদের
সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটার উপক্রম হয়েছিল। সেই ইতিহাসও চাপা দেওয়া হয়েছে এবং
পরবর্তীকালে তার ‘উদোর পিন্ডি’ আওরঙ্গজেব নামের ‘বুদোর’ ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। জামিলুল বাসারের বেদ ও কোরআন একাকার
করার ‘মহৎ’ প্রচেষ্টাটি
দ্বীন-ই-ইলাহিরই কোনো ক্ষুদ্র সংস্করণ কি না তা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহের উদ্রেক
ঘটা অসম্ভব নয়।
মোদ্দা কথা হলো, বাংলাদেশ ও ভারতে হিন্দু-মুসলিম মিলন প্রচেষ্টায় জামিলুল
বাসারের বেদ-কোরআনের মিলন ঘটানোর এই ‘প্রকল্পের’ উদ্দেশ্য যদি মহৎও হয়, তবুও তাঁর এই প্রকল্পটি আমাদের কাছে মারাত্মক বিভ্রান্তিকর বলেই মনে হয়। তার
কারণ বেদ-ঋগ্বেদ ও উপনিষদে মূর্তিপূজা ও গোরু খাওয়া নিয়ে কোনকালে কি লেখা ছিল অথবা
‘মোক্ষমূলার’ মহাশয় সেসব গ্রন্থে কি কি নতুন মাল-মসলা ঢুকিয়েছিলেন - তার চেয়েও বাস্তব কথা
হলো,
ভারত উপমহাদেশের হিন্দুধর্মাবলম্বীরা হাজার হাজার বছর ধরে
পৌত্তলিকতা চর্চা করে এসেছেন এবং বহু দেব-দেবীর মূর্তি পূজা করে এসেছেন। এটা হাজার
হাজার বছরে তাদের সরল ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আর গো-হত্যা বা
গোমাংস ভক্ষণ তো দূরের কথা, কোটি কোটি হিন্দু
জনগণের কাছে গরু ‘সবলা দেবী’ হিসেবে পূজ্য। এই ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কার হিন্দু জনগণের
মধ্যে এমনই দৃঢ়মুল হয়ে আছে যে, জামিলুল বাসারের
বেদ-উপনিষদের ‘মূর্তিপূজা বন্ধ’ ও ‘গোরু খাওয়ার’ ছাড়পত্র প্রচার করে বেদ/কোরআনের মিলন ঘটিয়ে হিন্দু-মুসলিম
ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস খুবই বিভ্রান্তিকর।
পাঠক এবার আসুন আমরা দেখি, জামিলুল বাসার
সাহেবদের এরূপ অলীক স্বপ্নের জাল বোনার তুলনায় ব্রিটিশপূর্বকালের ভারতবর্ষে মুসলিম
শাসকরা এবং মুসলিম সুফি অলি-আওলিয়া-আলেমরা কতটা বাস্তব দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। চেপে
রাখা ইতিহাসের পৃষ্ঠা খুললেই জানা যায় - আরবে পৌত্তিকতার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী
লড়াইয়ের মাধ্যমে ইসলামের অভ্যুদয় ঘটলেও সুফি দরবেশ-আলেমরা মূর্তিপূজক জনগোষ্ঠীর
দেশ ভারতবর্ষে এসে তাঁদের ইসলাম প্রচারের প্রক্রিয়ায় পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে কোনো
লড়াই ঘোষণা করেননি। খুবই ব্যতিক্রমিক দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া তারা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে হিন্দুদের দিয়ে গো-হত্যা
বা গোমাংস ভক্ষণ করাননি। বরং প্রকৃত ইতিহাস পাঠ করলে জানা যায়, তাঁরা ধর্মীয় সহনশীলতা ও সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে
মুসলিম ও অমুসলিমদের সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার বিরল নজির স্থাপন করেছেন। এছাড়াও
হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-জৈন-শাক্ত-বৈষ্ণব সকল ধর্মের কবি-লেখক-পুথিকারদের সম্মিলিত
প্রয়াসে ভারতের নানা জাতির ভাষা, লিপি ও সাহিত্যকে
উন্নত ও সমৃদ্ধশালী করে তোলারও বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মুসলিম শাসকরা। এসব
করে তাঁরা মূলত ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদের ‘লাকুম-দ্বীনুকূম
অলিয়াদ্বীন [তোমাদের ধর্ম (কর্মফল) তোমাদের, আমাদের ধর্ম (কর্মফল) আমাদের]’, এই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিরই বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। চেপে
রাখা ইতিহাসের পাতা যতই উন্মোচিত হচ্ছে ততই প্রকৃত ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে
দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
পাঁচ.
ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে
বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়েছে সাতশো বছরের
মুসলিম শাসন অবসানের পর ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা এবং সেটি ঘটেছে চরম ইসলাম-বিদ্বেষী, মুসলিম-বিদ্বেষী ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সক্রিয় উদ্যোগে। এটি
ঘটেছে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিকল্পিত ভেদনীতি চালু করার মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে এই
ভেদনীতি তারা চালু করেছিল শিক্ষা, চাকুরি, ব্যবসা, অর্থনীতি, পোশাক-আশাক, সামাজিক মেলামেশা, ধর্মপালনসহ সকল
ক্ষেত্রে মুসলমানদের ওপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এমনকি রাজনীতি ও ব্রিটিশবিরোধী
স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলিম ঐক্য ধ্বংস করার জন্যও তারা বারবার জঘন্য
ভেদনীতি প্রয়োগ করেছে। এর শত শত দৃষ্টান্তের মধ্যে মাত্র একটি দৃষ্টান্তই মনে হয়
যথেষ্ট। দৃষ্টান্তটি এখানে তুলে ধরার জন্য ভারতীয় লেখক-গবেষক গোলাম আহমাদ মোর্তজার
ইতিহাসের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। গোলাম আহমাদ মোর্তজা
লিখেছেন, “তিনি (খেলাফত
আন্দোলনের নেতা আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের অন্যতম মওলানা মোহাম্মদ আলী, লেখক) উপলব্ধি
করেছিলেন,
স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের মার খাওয়ার প্রধান কারণ
হিন্দুদের আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানো। তাই তিনি বড় আলেমদের সাথে গোপনে পরামর্শ
করলেন এবং জানালেন, ভারতে হিন্দু জাতি
বিরাট একটা শক্তি, তাকে বাদ দিয়ে
স্বাধীনতা আনা যায় না। যদিও তারা দূরে আছেন, তবু তাদের কাজে লাগাতে হবে। এমন একজন
নেতাকে বলে জয়ঢাক বাজাতে হবে, যার ফলে হিন্দু
জাতি তাঁর আহবানে দলে দলে আসতে পারবে। তিনি জানান, যদি স্বাধীনতাই কাম্য হয়, তাহলে নেতৃত্বের
সর্বোচ্চ আসনে যদি কোনো হিন্দু নেতাকে বসাতে হয় তাতে হিংসা করা সঠিক হবে না।
মুসলমানদের আন্দোলনে হিন্দুদের যোগ না দেওয়ার অন্যতম কারণ আন্দোলনটি পুরোপুরি
ধর্মভিত্তিক ছিল। তাতে বড় ভুল বোধ হয় এটাই হয়েছিল হিন্দুধর্মের সংরক্ষণের বা
ধর্মের উন্নতির জন্য তাদের আহ্বান করা হয়নি। শেষে গান্ধীজিকেই বাছাই করা হয়। তাঁকে
মহাত্মা উপাধির পোশাক পরানো হয় এবং সারা ভারতে তাঁর নাম প্রচার করে তাঁর অধীনস্থের
মতো মুসলিম নেতারা সভা সমিতি করে বেড়াতে থাকেন। তখনই সারা ভারতে জনগণ ইংরেজবিরোধী
হতে উদ্বুদ্ধ হতে থাকে। (গোলাম আহমাদ মর্তোজা : ইতিহাসের ইতিহাস : পৃষ্ঠা - ৪২৯)।
এটি ১৯২১ সালের কথা। এভাবেই
ব্রিটিশের বিরুদ্ধে পুর্ণ স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য মহাত্মা গান্ধীর
নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস এবং আলী ভ্রাতৃদ্বয় মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বাধীন দল
খেলাফত কমিটি নিয়ে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের জোট গঠিত হয়। ঐ অবস্থায়
হিন্দু ও মুসলমানের আকস্মিক মিলনে ব্রিটিশরা অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়ে। মুসলমানরা
পূর্ণস্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দেওয়ায় এবং গান্ধীজি ও কংগ্রেস সেই ডাকে সাড়া দেওয়ায়
১৯২১ সালে হিন্দু-মুসলিম জোট গঠিত হওয়ার পর বহু মুসলমান নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে
গান্ধী সভাসমিতি করতে থাকলে, গান্ধীজি তখন
হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানদের বড় নেতা হয়ে ওঠেন। আর তখনই ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা
আন্দোলনের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বিয়োগান্তক ঘটনাটি ঘটে। এ সময়ে কংগ্রেসের
হিন্দুবাদী নেতাদের ষড়যন্ত্রে এবং উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের উস্কানিতে - ‘গান্ধী মুসলমান হয়ে গেছেন’ বলে যখন প্রচার শুরু হয়ে যায় তখন আজীবন একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু গান্ধীজি নিজের
ইজ্জত ও অস্তিত্ব রক্ষার্থে প্রথমে খেলাফত-কংগ্রেস জোট ভেঙে দেন এবং পরে গোঁড়া
হিন্দুদের সাথে সুর মিলিয়ে ঘোষণা করেন :
“আমি নিজেকে প্রাচীন সনাতনী হিন্দু
বলি যেহেতু (ক) আমি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ - অর্থাৎ হিন্দুশাস্ত্র মতে যা কিছু বোঝায়, অবতারবাদ এবং পুনর্জন্ম
বিশ্বাস করি। (খ) বেদের বিধানসম্মত বর্ণাশ্রয়ী ধর্ম আমি বিশ্বাস করি অবশ্য প্রচলিত
ব্যবস্থায় আমার আস্থা নেই। (গ) প্রচলিত অর্থে নয়, বৃহত্তর অর্থে আমি গোরক্ষানীতি সমর্থন করি (ঘ) মূর্তিপূজায় আমি বিশ্বাসী।” (ইয়ং ইন্ডিয়া, অক্টোবর ১২, ১৯২১ থেকে উদ্ধৃত, গো.আ.ম : ইতিহাসের ইতিহাস: পৃ-৩৬৪)।
ভারতবর্ষের হিন্দুজনগোষ্ঠীর ধর্মীয়
বিশ্বাস ও সংস্কারের মধ্যে যখন এই রকম অবস্থা, অর্থাৎ স্বয়ং গান্ধীজিকেও যেখানে নিজেকে খাঁটি হিন্দু প্রমাণ করার জন্য করজোড়ে
বলতে হয়,
‘আমি অবতারবাদ ও বর্ণাশ্রয়ী ধর্মে বিশ্বাসী’, ‘আমি মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী’ এবং ‘গোরক্ষা সমিতির সদস্য’, সেখানে জামিলুল বাসারের আবিস্কৃত বেদ-উপনিষদের ‘মূলমন্ত্র’ দিয়ে হিন্দুদেরকে ‘তৌহিদী’ হিন্দু বানিয়ে
হিন্দু ও মুসলিম মিলনের স্বপ্ন দেখা যে কতটা অলীক তা সহজেই অনুমান করা যায়।
বাংলাদেশ ও উপমহাদেশে মুসলিম ও হিন্দুর ঐক্য অবশ্যই জরুরি। কিন্তু সে ঐক্য এই ধরনের ধর্মতাত্ত্বিক ফর্মূলা দিয়ে সম্ভব
নয়।
ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনার আড়ালে আকবরের ‘দ্বীন-ই-ইলাহীর’ অনুরূপ জামিলুল বাসারের এই ‘টোপটি’ বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম সম্ভবত খুব সাগ্রহেই গিলবে।
ইঙ্গ-ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্রের মিথ্যা ইতিহাস গিলিয়ে এ দেশের মানুষের মগজ
ইতিমধ্যে যেভাবে ধোলাই করা হয়েছে, বর্তমান প্রজন্মকে
মেধাশূন্য করা হয়েছে, তাতে মিথ্যা
ইতিহাসের জঞ্জাল থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মেধা বিকাশের পথে এবং
সত্যিকারের ইতিহাস সচেতন হয়ে ওঠার পথে এই বইটি একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করবে বলে
আমরা মনে করি।
অতএব, উপরের আলোচিত বিষয়গুলোর প্রতি আলোচ্য গ্রন্থের লেখককে ‘সেকেন্ড থট’ দিতে ও নতুন প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যাদি পর্যালোচনা করে দেখার জন্য বিশেষভাবে
অনুরোধ জানাচ্ছি।
রইসউদ্দিন আরিফ : লেখক, গবেষক, রাজনীতিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন