মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল তার।
দড়াম করে একটা শব্দ হল’না কোথায়। হাত বাড়িয়ে বৌয়ের কাঁধ ধরে ঝাঁকাল সে। দু এক
ঝাঁকুনিতে কি আর তার ঘুম ভাঙ্গে! বার কত ঝাঁকাবার পর বৌ ধড়মড় করে উঠে বসে কাপড়
চোপড় ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ‘কি হয়েছে?’ একটু গম্ভীর হয়ে সে বলে, দরজায় জোর
ধাক্কা দেবার মত শব্দ পেলাম। ‘কোথায় আবার কে ধাক্কা দিল? তুমি শুয়ে পড় তো!’ এই বলে
বউ বিছানায় আবার শুয়েছে কি শোয়নি দুম দুম করে বাইরের দরজায় কুড়ুল মারার শব্দ হয়।
মুহূর্তে সে বুঝে যায় বাড়ীতে ডাকাত পড়েছে। তার বুক ধড়াস করে ওঠে, আর শরীর কাঁপতে
থাকে। তার বৌ চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। ‘ কিছু কর না গো ওরা যে ঢুকে পড়ল।’
কিন্তু কোন রকমে খাট থেকে নামতে নামতেই সে বুঝে যায় কিছু করবার মত শক্তি তার নেই।
তার শরীর অদ্ভূত আতংকে ঠক্ ঠক্ করে শুধু কাঁপতে থাকে।
মিনিট
দুয়েকের মধ্যেই দরজা ভেঙ্গে ডাকাতরা ভেতরে ঢুকে পড়ে। এবার এই ঘরের দরজায় জোরে ঘা
মেরে একজন গালাগালি দিয়ে দরজা খুলে দিতে বলে। ‘শুয়োরের বাচ্চা যদি বাঁচতে চাস তো
দরজা খুলে দে আর যদি ভেঙ্গে ঢুকতে হয় তাহলে তোদের খন্ড খন্ড করে কাটবো।’ তার বউ
ততক্ষনে হাতে আর কানে যা ছিল হ্যাচোর প্যাচোর করে খুলে ঠাকুরের পেছনে বইয়ের তলায়
গুঁজে খাটের এককোনে জড়সড় হয়ে বসে কান্না শুরু করেছে। সে কোন রকমে দরজার খিল
নামাতেই একধাক্কায় তাকে পেছনে চিৎপাত করে দিয়ে তিনজন মুখে গামছা জড়ান লোক ঘরের
মধ্যে ঢুকে পড়ে। যার হাতে ভোজালি সে গিয়ে তার বউয়ের চুলের মুঠি চেপে ধরে গলায়
ভোজালি ঠেকিয়ে কর্কশ গলায় বলে, ‘যদি ইজ্জৎ বাঁচাতে চাস তবে গয়নাগাঁটি কোথায়
রেখেছিস বার কর।’
বৌটা
তার পা জড়িয়ে ধরতে চায় কিন্তু তাহলে তাকে খাট থেকে নামতে হবে।তার গায়ে ব্লাউজ নেই
বলে সে নামবার ভরসা পায়না। লোকটা চুলের মুঠি ধরে চাপ দিতেই সে ব্যথায় চিৎ হতে
বাধ্য হয়। লোকটা খাটে উবু হয়ে বসে তাকে চেপে ধরে বলে, ‘গয়না দিবি না ইজ্জৎ দিবি?’
এই লোকটার নাম মোহন সরদার। মেয়েছেলের উপর অত্যাচারে সে দারুণ দক্ষ। নেহাৎ সরদারের
কঠিন নিষেধ আছে নতুবা বৌটাকে দেখে তার বড়ই লোভ হচ্ছে। এই সময়ে দূর থেকে বহুলোকের
চীৎকার শোনা যায়। কুড়ুলের শব্দে অনেকেই জেগে উঠেছে। নীচে সে ইতিমধ্যে কয়েকবার লাথি
খাবার পর আলমারির চাবি বার করে দিয়েছে আর প্রানপণ মিনতি জানাচ্ছে তার বৌকে মুক্তি
দেবার জন্য। কিন্তু বাকি দুজনেই আলমারি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সে অভিযোগ জানাবার মত
কাউকে পাচ্ছেনা আবার সাহস করে ভোজালির দিকে এগুতেও পারছেনা। ইতিমধ্যে বাইরের
সাকরেদরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বার সঙ্কেত জানাচ্ছে। বারণ সত্বেও মোহন আর নিজেকে সংযত
রাখতে না পেরে গয়না ভুলে শরীর নিয়ে টানা হেঁচড়া শুরু করেছে। আর এইসব করতে গিয়ে
বউটার কানের পাশে ভোজালি লেগে রক্তপাত শুরু হয়েছে।
আজকের
অভিযানে মোট নয়জন ডাকাত ছিল। তিনজন বাইরে, তিনজন ঘরে আর উঠানের আশেপাশে আরও তিনজন
ছিল। বাইরের তিনজন শেষ বিপদ সঙ্কেত জানিয়ে প্রাণ বাঁচাতে নিজেরা সরে পড়ার চেষ্টা
করল। উঠানের তিনজন বার বার তাড়া দেওয়ার যা পাওয়া গেল তাই নিয়ে বেরোতে গিয়ে মোহনের
কীর্তি চোখে পড়ল ঘরের দুজনের। ইয়াকুব মোল্লার হাতে কিছু মালপত্র থাকায় সে আঘাত না করে মোহনকে শাসানি দিতে মোহন নিরুপায় হয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে
সরদার কে সাহায্য করতে বাধ্য হল। কিন্তু ততক্ষনে বেশ দেরী হয়ে গেছে। জনতার তাড়া
খেয়ে তিনজনই হাতের মাল খালি করে প্রাণ বাঁচাতে তৎপর হল। সরদার কোমর থেকে পাইপগান
বার করে দু-বার ফায়ার করতে জনতা একটু পিছিয়ে গেল। মোহন তখন প্রানপণ দৌড়চ্ছে। লাঠি,
বল্লম নিয়ে তার পেছনে জনতা। শর্টকার্ট করার জন্য মোহন মাঠে নেমেই ভুলটা করল। কারণ
মাঠের সব প্রান্ত থেকে লোক নেমে তাকে ঘিরে ফেলায় শেষ পর্যন্ত সে এক পুকুরের পানার
মধ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হল।
তার ঘরেও শুভার্থীরা
ততক্ষনে পৌঁছে গিয়েছিল। দূর থেকে জনতার উল্লাসধ্বনি শুনে বোঝা গেল তারা কাউকে
পাকড়ে ফেলেছে। প্রতিবেশী মহিলারাও কেউ কেউ সাহস করে বেরিয়ে এসে দুঃখের দিনে তার
পাশে দাঁড়াল। বৌটার মহাভাগ্য যে তার সম্মান বেঁচেগেল।এমনকি অতবড় বিপদের মুখেও সে
গয়নার কথা বলেনি কারণ গয়না দিলেও যে সে বিপদমুক্ত হবে তেমন তার মনে হয়নি। আর শত
হোক সে ছিল ডাকাতের দেশের মেয়ে। শেষ পর্যন্ত সে ঠিকই করেছিল বিছানায় ভোজালিটা
রাখলেই ওটা নিয়ে সে ডাকাতটার পেটে ঢুকিয়ে দেবে।
মর্মান্তিক
মৃত্যু হল মোহনের। তার সারা জীবনের মিলিত
অত্যাচারের চেয়েও তার নিজের শাস্তি হল অনেক বেশী। দু হাঁটু ভেঙ্গে উলটে দিয়ে, তার
সারা শরীর ইঁট দিয়ে থেঁতো করে দেওয়া হয়েছিল। লাশ থানায় আনার সময় ওসি সুবিমল বাবু
গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘এরা কি মানুষ! আমায় এবার জবাবদিহি করতে হবে লোকটাকে এভাবে
থেঁতলে মারল কারা।’ খানিক পেছনে হাঁটা এস আই চঞ্চলবাবু অবশ্য আতঙ্কিত গ্রামবাসীকে
আশ্বাস দিলেন, ‘শালা! আপদ গেছে বাঁচা গেছে।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন