পশ্চাদপটে বৃদ্ধ প্রধানমন্ত্রীর ব্যস্ততা বড় বেশী ছিল।
প্রধান সেনাপতির অনুগত সকল সেনাকে নিরস্ত্র করিয়াও তাহার আশংকা দূর হইল না।
নিঃশব্দে চিনির চটের তাঁবু ঘেরাও করিয়া বিরোধী অমাত্যগণকে অত্যন্ত সাবধানতার সহিত
গোপন কারাগারে নিক্ষেপ করা হইল। কিন্তু গুপ্তচর বিভাগের প্রধানকে বশ্যতাস্বীকার
করাইতে গিয়া বড়সড় বাধা আসিল। তাহার বারোজন দেহরক্ষীর প্রায় সকলকেই হত্যা না করিয়া
দমন করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। ইহারা বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বলিয়া এবং উন্নত
আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা সুসজ্জিত বলিয়া নিঃশব্দে কর্মসম্পাদন সম্ভব ছিলনা। পরন্তুঃ
তাহারা সকলেই তাহাদের প্রধানের একান্ত অনুগত ছিলেন। উপায় না দেখিয়া জেদী বৃদ্ধ
প্রধানমন্ত্রী স্নাইপার বাহিনীর শরনাপন্ন হইলে তাহারা সম্রাটের নির্দেশ ভিন্ন হত্যাকান্ডে
সম্মত হইল না। অতঃপর একান্ত আলাপের পর তাহারা সম্মত হইয়া অস্ত্রশস্ত্র লইয়া
বিভিন্ন উন্নত অবস্থানে পজিসন লইবার পর প্রধানমন্ত্রী গুপ্তচর বিভাগের প্রধানের
সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিলেন।
গুপ্তচর বিভাগের প্রধানের নাম ছিল বলবন্ত সিংহ। বলবন্ত
খবর পাঠাইলেন কেবল একক ভাবে প্রধানমন্ত্রী ভিতরে প্রবেশ করিতে পারিবেন ইহার অন্যথা
হইলে গুলিগোলা চলিবে। প্রধানমন্ত্রী উত্তরে জানাইলেন বাহিরের উন্মুক্ত প্রান্তরে
আলাপ হইতে পারে ২০০ গজের মধ্যে কোন রক্ষী থাকিবে না। তিনি আশ্বাস দিলেন আলোচনা
বলবন্তের পক্ষে লাভজনক হইবে। লাভের প্রস্তাবে উৎসাহিত বলবন্ত অবশেষে রাজী হইলেন।
উভয়পক্ষের রক্ষীগণ দূরে অপেক্ষারত রহিল। নিরস্ত্র বলবন্ত এবং বৃদ্ধ প্রধানমন্ত্রী
উপেন্দ্রমোহন বিশাল প্রাঙ্গনের কেন্দ্রস্থলে পরস্পরের সন্মুখীন হইলেন। কথোপকথন
এইরূপ হইলঃ
বলবন্তঃ বলুন
প্রধানমন্ত্রী এই সন্ধ্যাকালে কি লাভের প্রস্তাব এই অভাজনের জন্য বহন করিয়া
আনিয়াছেন?
উপেন্দ্রঃ আপনার
তো সম্রাটের সুরক্ষা দেখাশুনা করিবার কথা। আপনি সন্ধ্যাকালে কক্ষমধ্যে কি কর্মে
ব্যস্ত?
বলবন্তঃ হাঃ!
হাঃ! হাঃ! সম্রাট! আপনি আমি দুজনেই জানি সম্রাট আর বড়জোর কয়েক ঘন্টা জীবিত
থাকিবেন। এখন বলুন আমার জন্য কোন পদ মনোনীত? যদি আমার পছন্দ জিজ্ঞাসা করেন তবে
আপনার কানে কানে বলি প্রধান সেনাপতির পদটির প্রতি আমার সবিশেষ দূর্বলতা।
উপেন্দ্রঃ
আপনি প্রধান সেনাপতি হইলে আমি আর কয়ঘন্টা রাজত্ব করিবার সুযোগ পাইব! এই
বিবেচনায় আপাততঃ আপনাকে কারাগারে নিক্ষেপ শ্রেয় বিবেচনায় সেই প্রস্তাব লইয়া আপনার
সন্মুখীন হইয়াছি। প্রাণরক্ষার প্রস্তাবের মত লাভজনক প্রস্তাব ইতিপূর্বে কখনও
বোধকরি আপনি প্রাপ্ত হন নাই!
বলবন্তঃ
স্তব্ধ হও উন্মাদ! আমাকে কি মুর্খ ভাবিয়াছ? অবিলম্বে আমার প্রস্তাব না
মানিলে গুলিতে ঝাঁঝরা হইয়া মাটিতে লুটাইবি শয়তান!
উপেন্দ্রঃ এই
মুহূর্তে অন্ততঃ দশটি রাইফেল তোমার বুক লক্ষ্য করে উদ্যত মুর্খ। এখন বল মরিবে না
কারাগারে প্রবেশ করিবে?
সামরিক শিক্ষাপ্রাপ্ত বলবন্ত অবিলম্বে বুঝিল সে যথার্থ
মৃত্যুর সন্মুখীন। তথাপি শেষরক্ষার চেষ্টায় সে কাষ্ঠহাসি হাসিয়া বলিল, পাঁচটি
বন্দুক তোমার দিকেও তাক করা আছে অতিমুর্খ।
উপেন্দ্র বলিলেন, বেশ তাহাদিগকে আদেশ দাও। বলবন্ত দূরে
তাকাইয়া কোন সাড়াশব্দ পাইলেন না। উচ্চঃস্বরে চীৎকার করিয়া আদেশ দিলেন, অ্যালার্ট!
কিন্তু তথাপি কোন প্রত্যুত্তর পাইলেন না। উপেন্দ্রর নির্দেশে তাহার অনুগত বাহিনী
আসিয়া কোন রক্তপাত ছাড়াই বলবন্ত কে গ্রেপ্তার করিল। উপেন্দ্র কহিলেন, ভাবিও না।
পরবর্তী আলোচনার জন্য শীঘ্রই তোমার সহিত দেখা করিব।
সন্মুখে মঞ্চে তখন ইন্দ্রপুরীর পরিবেশ রচিত হইয়াছে।
সুমধুর সঙ্গীতের তালে তালে আহিতির ছন্দবদ্ধ অঙ্গসঞ্চালন, মঞ্চোপরি মলি ও আইতির
গমনাগমন দর্শন করতঃ সমবেত সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া সেই অপরূপ নৃত্য লহরীতে দেশকাল
বিস্মৃত হইলেন। উভয়েই মিশরের রানীর ভঙ্গীতে সজ্জিত হইয়া সুদক্ষ নৃত্যে দর্শক গণকে
এরূপ প্রভাবিত করিয়া ফেলিলেন যে বেরসিক ঝুম্পানভঃ পর্যন্ত নৃত্যের তালে তালে মাথা
দোলাইতে লাগিলেন। ঝুম্পা বসু ঘন ঘন ছবি লইতে লাগিলেন। যাহাদের ভিডিও ক্যামেরা ছিল
তাহারা নিজেদের ভাগ্যবান বিবেচনায় বিভিন্ন কোন হইতে ছবি লিতে ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন।
অন্যরা তাহাদের এইরূপ আচরণে বিরক্তিসূচক মন্তব্য করিলেও তাহারা উহা গায়ে মাখিলেন
না।
নৃত্যমোহিত সম্রাট সন্মুখে রক্ষিত স্বর্ননির্মিত
সুরাপাত্র হইতে মধ্যে মধ্যে সুরাপান করায় তাহার নয়ন ও গন্ডদেশ আরক্ত হইয়াছিল।
নৃত্যের অপূর্ব ভঙ্গিমা সহ আহিতি যখন মঞ্চ হইতে অবতরণ পূর্বক সম্রাটের দিকে অগ্রসর
হইল তখন মিশরের রানী মলিও ফ্যারাও কে অনুসরণ করিয়া তথায় উপস্থিত হইল। ইতিমধ্যে উপেন্দ্র
আসিয়া সম্রাটের অদূরে আসনগ্রহণ করিয়াছিলেন। মলি ও আহিতি যখন সম্রাট কে ঘিরিয়া
নৃত্যকৌশল প্রদর্শন করিতেছিলেন উপেন্দ্র তখন তীব্র দৃষ্টিতে তাহাদের লক্ষ্য
করিতেছিলেন। বাদ্যকারগন এইরূপ নৃত্যশোভায় মোহিত হইয়া যথাসম্ভব দক্ষতার সহিত সঙ্গীত
পরিবেশনায় নিয়োজিত হইলে আহিতি ও মলির হস্তসঞ্চালন পানপাত্রের নিকটবর্তী হইল। এক
বিশেষ ভঙ্গীতে পানপাত্র হস্তদ্বারা উত্তোলিত করিয়া আহিতি তাহা সম্রাটের ওষ্ঠে
স্পর্শ করাইবার প্রয়াস লইলে সম্রাটও আমোদিত হইয়া ঐ পাত্র ধারন করতঃ নিজে পান
করিবার পূর্বে আহিতিকে উহা হইতে পান করিতে বলিলেন।এইরূপ আদেশ যে কোন অতিথির পক্ষেই
বিশেষ সম্মানবাচক। অতএব ছন্দ অবিকৃত রাখিয়া আহিতি উহা হইতে মদিরা পানে বাধ্য হইল।
ইহা দর্শন পূর্বক মলি নৃত্য থামাইয়া আর্তনাদ করিয়া উঠিলে মঞ্চে যেন বজ্রপাত
হইল। (ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন