শনিবার, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৩

আগামী থেকে বলছি

                    লিখেছেন : মনোবর
 (বিঃদ্রঃ ধারাবাহিকতা অনুসরণের জন্য পর্ব গুলি খেয়াল রাখুন)
                              (১ম পর্ব)
মরে গিয়ে বেশ মুষ্কিলেই পড়লুম বলা যায়। ব্যাপারটা যে এতটা ফক্কিবাজি আগে ধরতেই পারিনি। বুঁদ হয়ে থাকা একটা অবস্থা থেকে যখন হুঁশে ফিরলুম ততক্ষনে যা হবার তা শুরু হয়ে গেছে। একরাশ কাঠের ভেতরে চিত করে শোয়ান দেহটা চড়বড় শব্দে ততক্ষনে পুড়তে শুরু করেছে। দুজন মাথায় ফেট্টি বাঁধা চেনা ছোকরা চোখ নাক কুঁচকে বাঁশ দিয়ে চেপে চেপে আমার দেহখানি উত্তম রূপে পোড়াবার সুবন্দোবস্ত করছে। বিরক্ত হয়ে ওদের ধাক্কা মেরে সরাতে গিয়ে দেখি ওদের শরীর ফুঁড়ে এপাশ থেকে ওপাশে চলে যাচ্ছি অথচ ওরা টেরই পাচ্ছেনা। ওদিকে একটু দূরে কালিমন্দিরে খোল কত্তাল সহকারে জোর কীর্তন শুরু হয়েছে। মন্দিরের পেছনে হাতে হাতে পলিথিনের পাউচে মাল চালাচালি হচ্ছে। শবদাহ তে এসব হয়েই থাকে। দূরে এক চাতালে বসে আমার দু দিদি মাঝে মাঝে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে তখনও কান্না চালিয়ে যাচ্ছে। কেননা তাদের ভাই পটল তুলেছে। অথচ আমি চেনাদের মধ্যে অচেনা বিদেশী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি সেটা কেউ গায়েই মাখছে না। এই ধরণের মুষ্কিলের মোকাবিলা কি করে করা যায়! কোন জায়গা মনে করা মাত্রই সেখানে পৌঁছান প্রভৃতি সুবিধাগুলো গৌণ হয়ে এই মুষ্কিলটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াল। আর আমার সঙ্গে যার এতদিনের সম্পর্ক সেই সুখ দুঃখের বন্ধু শরীরটাও দেখতে দেখতে কাঠকয়লার আকার ধারণ করল। উদভ্রান্ত হয়ে কি করা যায় ভাবছি এমন সময় শ্মশানের উপর ডালপালা মেলে যে বিশাল খিরিশ গাছটা দাঁড়িয়ে তার মগডাল থেকে কেউ আমাকে আকর্ষণ করে তার পাশে বসাল। হাল্কা সবুজ রঙ বিশিষ্ট এক দেহহীন এই মালটাই যে এখানকার সবচেয়ে পুরান তা জেনেছি পরে।

কি ভায়া, কেমন লাগছে?’ বলে মালটা আবার বেগুনি দাঁত বার করে হাসতে লাগল। তুমি আবার কে?’ আমি শুধোলাম। তোমার মতই একজন। এখানে আরো অনেকে আছে। সব এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখতে পাবে ক্রমে ক্রমে।বলে আবার দাঁত বার করে শব্দহীন হাসি দিল। ওদিকে কীর্তন হচ্ছে। নিতাই শমন দমন নাম এনেছে ভয় দূরে গিয়াছে।
এই সময়ে চোখের নিমেষে ছাইরঙ্গা এক মক্কেল এসে খিরিস গাছের পাতার উপর গড়াগড়ি খেতে শুরু করল। নিজের দিকে চেয়ে দেখি আমারও একটা অবয়ব হয়েছে। তবে সেটা ঠিক আগেকার মত নয়। রংটা কুয়াশার মত। রংটা কোন স্থায়ী জিনিস নয়। সবসময় বদলাতে থাকবে। ঐ নিয়ে ভেবনা।এই বলে সবুজটা আবার দাঁত বার করল। তার মানে ও আমার চিন্তা ধরতে পারছে। কিন্তু আমি তো ওরটা ধরতে পারছিনা। ভাবা মাত্রই ও বলে উঠল আস্তে আস্তে সবই পারবে। শোন যেজন্য তোমায় ডেকে নিলাম। তুমি কি স্বাধীন থাকবে, না আমাদের সঙ্গে থাকবে এটা ঠিক কর। এ জগতের ব্যাপার স্যাপার আগেকার সঙ্গে মিলবে না। সুতরাং একা হলে তোমার মুষ্কিল হবে। আর আমাদের সঙ্গে থাকলে কয়েকটা ব্যাপার তোমাকে বুঝে নিতে হবে।
কি ব্যাপার?’ আমি চিন্তা করি।
যেমন ধর। অন্যরা যা করবে তাতে বাধা দেবে না। এখানে সবাই আলাদা আলাদা ধরণের কিন্তু কেউ কাউকে জোর খাটায় না। কারণ তাতে কোন লাভ হয়না উপরন্তু সময় নষ্ট হয়।
অন্যরা কি করে?’ আমি ভাবি আর অমনি সবুজ তার উত্তর দেয়।
কিছু আছে যারা মানুষের অনিষ্ট করে বেড়ায়। এটা ওদের কাছে মজার ব্যাপার। কিছু আবার তাদের উপকার করে বেড়ায়। তবে এই সংখ্যাটা কম। কিছু আবার আপনমনে ঘুরে বেড়ায়। কিছু মাটির তলায় বুঁদ হয়ে আগের জীবনের কথা ভেবেই চলে বছরের পর বছর। ওদের বিরক্ত করলে অসুবিধা আছে। বুঝলে?’
মরতে না মরতেই একদল মাতব্বরের পাল্লায় পড়লুম নাকি! ভাবা মাত্রই সবুজ বলে ওঠে, ‘ওরকম ভাবলে জানবে তুমি আগের প্রভাবে আচ্ছন্ন। ওটা কাটাতে হবে।
এদিকে এইসব হতে হতে নীচে জল ঢেলে চিতা নেভানো শুরু হয়েছে। যার চিতা ধোঁয়া পাক খেয়ে তার দিকেই আসছে। এই দুনিয়ায় কেউ আমার নাম জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনি। আগের কথা মনে এসে মনটা দুলে উঠল। আবার শ্মশানভুমিতে অবতরন করলুম। এখানে ওখানে কয়েক মাতাল ইতিমধ্যেই ভূমিশয্যা নিয়েছে। দুই জামাইবাবু আর এক কাকা মিলে শ্মশান যাত্রীদের খাওয়ানোর বিষয় আলোচনা করছে। আমার বড়দি তখনো কেঁদে চলেছে। ও যে এইভাবে চলে যাবে কোনদিনও ভাবিনি গো!এই বলে আর একবার করে হেঁচকি তোলে। ওর টিকি ধরে একবার টানার চেষ্টা করলুম কিন্তু হলনা। এই প্রায় অদৃশ্য শরীর কন্ট্রোল করাটা আয়ত্ব করতে আরো সময় লাগবে। হঠাৎ আমার পলির কথা মনে পড়ল। ওর ভূগোলের থার্ড ইয়ার অনার্সের পরীক্ষার আজ ফল বেরোবার কথা। আমার পটল তোলার চেয়ে সেটা নিশ্চয় বেশী গুরুত্বপূর্ণ। যেই না ভাবা অমনি দেখি আমার কুয়াশা কুয়াশা শরীর এক বিল্ডিং এর ছাদে হাজির হয়েছে। তা গমনাগমন যেকালে এত দ্রুত সম্পন্ন হচ্ছে তখন রেজাল্ট টা দেখে নিয়েই আবার নয় শ্মশানভূমিতে হাজির হব। শতহোক দাহকাজটা যখন আমারই হচ্ছে আমার কি সেখানে একটু দেখাশোনা করা উচিত নয়? ভাবনাটা চলতে চলতেই শুনলুম, ‘ ওসব নিয়ে মাথা ঘামানোর আর কি কোন দরকার আছে?’ চেয়ে দেখি সেই পাতার উপর গড়াগড়ি খাওয়া ছাইরঙা মালটা হাজির। সিমেন্টের ফলকে যেখানে সতীঝিল কলেজলেখা তার উপর সমানে ডিগবাজি খেতে খেতে আমার সঙ্গে কথা চালাচ্ছে। নিশ্চয় সেই সবুজ শালা ওটাকে আমার পেছনে জুড়ে দিয়েছে। (ক্রমশঃ)

কোন মন্তব্য নেই: