শুক্রবার, নভেম্বর ২২, ২০১৩

হিন্দি কি ভারতের রাষ্ট্রভাষা ?



                       লিখেছেন : রইসউদ্দিন গায়েন
না,হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা নয়।ভারতের কোনও নির্দিষ্ট রাষ্ট্রভাষা নেই।তাহলে হিন্দি ভাষা নিয়ে এতো হৈ-হুল্লোড় কিসের জন্য?১লা সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ দিন ধরে হিন্দি পখ্ওয়াড়া পালিত হয়।উদ্দেশ্য মহৎ।কিন্তু এটাও ভেবে দেখা দরকার আরও ২২/২৩ টা ভাষা,যা সংবিধান-স্বীকৃত,সেগুলির জন্য এরকম এক পক্ষকালব্যাপী ভাষাচর্চার সরকারি ব্যবস্থা আছে কি না(?)যদি না থাকে(বলাবাহুল্য,ব্যবস্থা নেই),তবে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক, কেন নেই? একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব জাতীয় ভাষাগুলি সমান মর্যাদার অধিকারী।  নানা ভাষা,নানা মত, নানা পরিধান/বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান।‌’‘বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যআমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। নিঃসন্দেহে বৈচিত্রশব্দটি গুরূত্বপূর্ণ।সেই বৈচিত্র অক্ষুন্ন রাখার আন্তরিক প্রয়াস যদি না থাকে,তবে জনকন্ঠে  প্রতিবাদধ্বণি উচ্চারিত হবেই।...
হিন্দি,উত্তর ভারতীয় জনগোষ্ঠির মিশ্রিত মাতৃভাষা।তাই তাঁদের জীবনে,মরণে এই ভাষা অমৃতময়।অপরদিকে দক্ষিণ ভারতীয়(বিশেষতঃ দ্রাবিড় সভ্যতা)মানুষের কাছে তা তীব্র বিষময়। সত্যমেব জয়তেঅমৃত বাণী সামনে রেখে, একজন ভারতীয় মিথ্যাচারে নিমজ্জিত হবেন,এ যেমন প্রত্যাশিত নয়; হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা বলে অপপ্রচার  করাও তেমনি কাঙ্খিত নয়। অ-হিন্দি ভাষীদের ওপর জোর করে হিন্দি-ভাষার বোঝা চাপিয়ে দেওয়াও এক অমানবিক অত্যাচার।

ভাষাসংক্রান্ত সাংবিধানিক বক্তব্যের সারসংক্ষেপ এই যে  দেবনাগরী লিপিতে আন্তর্জাতিক সাংখ্যমানসহ কেন্দ্রীয় সরকারের দাপ্তরিক ভাষা(Official Language) হবে হিন্দি এবং সহ-দাপ্তরিক ভাষা(Associate Official Language)হিসেবে থাকবে ইংরেজি। এখন দেখা যাক রাষ্ট্রভাষা-বিষয়ক বক্তব্যে কোথায় ভুল হচ্ছে (?)দাপ্তরিক ভাষা আর রাষ্ট্রভাষা কি এক? একটা মজার ব্যাপার দাপ্তরিক বা কার্যালয়ের ভাষাকে বলা হচ্ছে সরকারি ভাষা’,সরকারি ভাষাকে বলা হচ্ছে রাজভাষা’,আর রাজভাষা বলতে গিয়ে বলছে রাষ্ট্রভাষাএ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে গেল : এক চোখওয়ালা ব্যক্তি এক অন্ধ লোককে বুঝিয়ে বলছে:--
শরীর সুস্থ রাখতে হলে প্রতিদিন দুধ খাওয়া দরকার।
অন্ধ : দুধ? সে আবার কী?
চোখওয়ালা : আরে,তাও জানো না? দুধ হচ্ছে সাদা?
অন্ধ : :,তা  সাদা জিনিসটা কী?
চোখওয়ালা : তাও জানো না? সাদা হচ্ছে ঠিক বকের মতো।
অন্ধ : তাই বুঝি ? তা  বক কেমন,বুঝিয়ে বলুন না।
চোখওয়ালা : বেশ,আমার ডান হাতটি ছুঁয়ে দেখো,কেমন হাত ঘুরিয়ে বকাকৃতি বানিয়েছি।
অন্ধ :(ছুঁয়ে দেখল হাতটি বাঁকা) অ্যাঁ! এ কি? এই নাকি দুধ ? এই বাঁকা জিনিসটা আপনি আমাকে খেতে বলছেন ! কী সর্বনাশ! এমন জিনিস খেলেই  তো গলা আটকে মরে যাব!!
হিন্দি ভাষার প্রতি অতিশয় স্তাবকধর্মী মনোভাবের জন্য সাংস্কৃতিক ঐক্যর নামে অনৈক্য সৃষ্টি হচ্ছে।সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর একটা জ্বলন্ত উদাহরণ আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পোর্টব্লেয়ার শহর-কেন্দ্রিকএকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আনুষ্ঠানিক রিপোর্টটি এখানে পরিবেশিত হল :
ভারতে হিন্দির প্রতি অতিভক্তির কারণে তামিল-তেলুগু-বাংলা-মালয়ালম-প্রভৃতি স্বীকৃত জাতীয়-ভাষাগুলি অবমাননার শিকার হচ্ছে
আন্দামানের পোর্টব্লেয়ার শহর-স্থিত গভ: মডেল সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল-অডিটোরিয়ামে,আয়োজিত সঙ্গীত,নাটক ইত্যাদির প্রতিযোগিতা শেষ হল উপলক্ষ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ড: রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন পালন শিক্ষকদিবস রূপে অংশগ্রহণে ছিলেন বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আনুষ্ঠানিক পরিচালকবৃন্দ এবং বিচারকগণও ছিলেন হিন্দিভাষার স্তাবকধর্মী মানুষ শুধু ভাষা নয়,ধর্ম-নিরপেক্ষ দেশের সবোর্চ্চ পদাধিকারী একজন রাষ্ট্রপতি এবং আন্তর্জাতিক স্তরের শিক্ষাবিদের প্রতি শ্রদ্ধা-জ্ঞাপন করা হল গণেশ-বন্দনার গান দিয়ে। কেন,গণেশ-বন্দনা কেন? দেশে কি দেশবন্দনামূলক গানের কোনও অভাব ছিল ?
ফিরে আসি,আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে মঞ্চে-- একক কন্ঠে,সমবেত কন্ঠে বিভিন্ন ভাষায় গান যেমন ছিল,বিভিন্ন ভাষায় প্রাদেশিক নৃত্যশৈলীর প্রদর্শনও ছিল অসাধারণ কিন্তু হিন্দি-স্তাবকতার আলোয় বিচারকদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত-সূচীতে ঝলমল করে উঠল হিন্দি-ভাষায় পরিবেশিত অর্কেষ্ট্রা-কলাকারসহ স্কুলগুলির নামএ এক অভিনব সুযোগ হিন্দি লাও,হিন্দি গাও,প্রাইজ পাও;অন্য ভাষাগুলি গোল্লায় যাও
অনেকের বদ্ধমূল ধারণা,হিন্দি নাকি রাষ্ট্রভাষা হিন্দি প্রচার করা হয় অনেকটা বিজ্ঞাপনী কায়দায়যেমনরাজকীয় বরিষ্ঠ মাধ্যমিক বিদ্যালয়’,রাজভাষা প্রকোষ্ঠ ইত্যাদিএগুলিকে যদি বলা হত সরকারি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়,সরকারি ভাষা প্রকোষ্ঠতাহলে সাধারন মানুষের পক্ষে সহজবোধ্য হত এখন দেখা যাকরাজভাষাবলতে কী বোঝায়(?)এক হতে পারে,রাজার ভাষারাজভাষাআর এক হতে পারে,ভাষার রাজারাজভাষা প্রথমটির কথায় বলতে হয়,রাজা যখন নেই(গণতান্ত্রিক দেশে) তখন রাজার ভাষা বলা যায় না,দ্বিতীয়ত: যদি বলা হয় ভাষার রাজা,তখন প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক তামিল,বাংলা প্রভৃতি ভাষার মতো হিন্দি উন্নত ভাষা নয় তাই হিন্দিকে ভাষার রাজা কখনো বলা যায় না
সজ্ঞান মানুষগুলি যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করতেন,তাহলে খুব সহজেই ধরা পড়তো ভাষাদূষণের অপকীর্তি ভারতের জাতীয় সঙ্গীত কোন্ ভাষায় রচিত(?)এই প্রশ্ন তুললে,হিন্দি চাটুকারদের মুখে সদুত্তর থাকেনা বাংলাভাষায় রচিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের এই গানটি হিন্দি বলে অপপ্রচার চালানো হয় ভারত সরকারের ওয়েবসাইটেও এ এক অত্যাশ্চর্য মিথ্যাচার! আজও আমরা দৃপ্ত কন্ঠে গেয়ে বেড়াই :
মোদের গরব,মোদের আশা,-মরি বাংলাভাষা---
তোমার কোলে তোমার বোলে,কতই শান্তি ভালবাসা।‌

বাংলাকে ভালবেসে আমরা সারা পৃথিবীকে  আপন করে পেয়েছি বাংলাভাষাকে ভালবেসে আমি আমার নিজেকে চিনেছি আমাদের এই সংবেদনশীলতার গুরূত্ব যাঁরা দেন না বা দিতে জানেন না,তাঁরা নি:সন্দেহে ভারতীয় সংস্কৃতির শত্রুভাষা মানুষের গোপন আশ্রয়,হৃদয়ের সম্পদ,জীবন-পথের সাথী সেই ভাষাপ্রাণকে যাঁরা বিচ্ছিন্ন করতে চায়,তাঁদের বিরূদ্ধেই চলুক আমাদের ভাষা-সংগ্রাম,জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই আমাদের প্রকাশ ঘটুক মাতৃভাষায়!
এখানে একটা প্রশ্ন : যে ব্যক্তির জন্মদিন পালন করা হচ্ছে তার ঐতিহাসিক পটভূমিকা কী ? প্রকৃত ঘটনা হল এই : : সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তার গুণমুগ্ধ ছাত্র ও বন্ধুরা তাঁর জন্মদিন পালন করতে চাইলে তিনি বলেছিলেন : জন্মদিনের পরিবর্তে ৫ই সেপ্টেম্বর যদি শিক্ষক দিবস উদযাপিত হয়,তবে আমি বিশেষরূপে অনুগ্রহ লাভ করবো।‌: রাধাকৃষ্ণণ ভারতের উপরাষ্ট্রপতি ও রাষ্ট্রপতি হলেও তিনি নিজেকে একজন শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব অনুভব করতেন।এখন আমাদের জানা দরকার তিনি কোন্ ভাষায় এবং কোন্ বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন? ইংরেজি মাধ্যমে মাদ্রাজ ক্রিস্টান কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯০৬ খৃষ্টাব্দে।এরপর ১৯০৯ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত স্বদেশ-বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন।তাঁর অসাধারণ বাগ্মীতার জন্য তিনি বিশ্বখ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।...বলা বাহুল্য,: রাধাকৃষ্ণণ ইংরেজি ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন।ইংরেজিতে লেখা তাঁর প্রথম গ্রন্থ দ্য ফিলোজপি অফ রবীন্দ্রনাথরবীন্দ্র-দর্শন সম্বন্ধে তিনি মন্তব্য করেন তাঁরই ভাষায়: The Philosophy of Rabindranath Tagore is the GENUINE MANIFESTATION OF THE INDIAN SPIRIT`.অর্থাৎ রবীন্দ্র-দর্শন ভারতাত্মার সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি
অথচ আশ্চর্যের বিষয়, রবীন্দ্র-স্মরণোৎসবের জন্য ৩৬৫ দিনের একটি দিনও নির্দিষ্ট নেই কেন্দ্রিয় কর্ম-পঞ্জিকায়।
এবার আমরা সংবেদনশীল প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চাইব।ড:রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে এক পক্ষকাল ব্যাপী মহাসমারোহে যদি হিন্দি-চর্চা হয়,তবে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে কত পক্ষকাল হিন্দি-চর্চা করা হবে? আমার স্পষ্ট বক্তব্য এই যে ড:রাধাকৃষ্ণণ বা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের যত সৃষ্টি,কখনও হিন্দি ভাষায় ছিল না। তবে কেন হিন্দির এমন উপদ্রবধর্মী কার্যকলাপ।সর্বপল্লী নামে গ্রাম থেকে তিরুত্তানি পর্যন্ত মানুষের মুখে মুখে ফেরে যে ভাষা তা হল দ্রাবিড় সভ্যতার ভাষা। হিন্দি ভাষা সেখানে অকথ্য শুধু নয়,অস্পৃশ্য ও ঘৃণ্য।আন্তর্জাতিকতার কথা ভেবে তামিলনাডুর দৃপ্ত কন্ঠ : ‘ENGLISH EVER,HINDI NEVER.’ আবার অখন্ড বাঙলামায়ের দিকে তাকালেই রবীন্দ্রবাণীর মূর্ত প্রকাশ :
আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।
ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে
এ কথা ভুলে গেলে চলবেনা যে বাংলার মাটি থেকে ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল।তাই বাংলার ভাবনাকে বাদ দিয়ে ভারতীয়তার কথা ভাবা যায় না। রবীন্দ্র-নজরুল-নেতাজী-বিবেকানন্দের স্বপ্নের ভারতবর্ষ আমরা পাইনি; পেয়েছি গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেল কল্পিত খন্ডচিত্র। তাই তো আমার দেশ আজও প্রতি পদক্ষেপেই  পরমুখাপেক্ষি। সিংহমূর্তি আজ যেন রাজনৈতিক শিয়ালের রূপে বিবর্তিত হয়েছে।
ফিরে আসি মূল বক্তব্যে। ১৯৯১-এর জনগণনা অনুসারে সর্বভারতীয় হিন্দিভাষীর আনুপাতিক হার ছিল ৩৯.৮৫%(যদিও তাসম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য নয়) এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম সর্বভারতীয় বাঙলাভাষী ছিল ৮.২২%(এ হিসেবও নির্ভরযোগ্য নয়,আরও বেশি হবে।)তৃতীয় বৃহত্তম স্থানে তেলুগুভাষী ৭.৮০%,চতুর্থ স্থানে মারাঠী ৭.৩৮%,পঞ্চম স্থানে তামিল ৬.২৬% ইত্যাদি।সাংখ্যমানানুসারে লক্ষনীয়: এই পাঁচটি জনবহুল ভাষার মধ্যে চারটি দক্ষিণ ভারতীয় ভাষা,একটি পূর্ব-ভারতীয় ভাষা,আর একটি মাত্র উত্তর-ভারতীয় ভাষা।আর সেই উত্তর ভারতীয় ভাষাটি-ই হল হিন্দি,যার উৎপত্তি আঞ্চলিক ভাষা খড়িবোলি থেকে।এর সাথে উর্দু-আরবী-ফার্সী শব্দের  মিশ্রিত রূপ হল হিন্দি যা দেবনাগরী লিপিতে লেখা হয়।মজার ব্যাপার, এই পাঁচমিশালি ভাষা যখন আরবী বা উর্দুলিপিতে লেখা হয় তখন সেই ভাষার নাম হিন্দুস্তানিউপরোল্লেখিত ভাষাভাষীর আনুপাতিক হার দেখে একজন সাধারন মানুষও বলে দেবে যে ৪০% (৩৯.৮৫%) মানুষের মুখের ভাষা, বাকি ৬০% মানুষের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া যায় না।এটা শুধু অ-সাংবিধানিক নয়,অমানবিক। হিন্দির প্রচার,প্রসার এবং পরিচর্যার জন্য বিপুল আর্থিক মদত দেবার সুব্যবস্থা আছে। সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলিতে ইংরেজির সাথে হিন্দির যুগল চলন থাকবেই, অন্য কোনো ভাষার সেখানে স্থান নেই। ফলে, সরকারি কর্মক্ষেত্রে হিন্দিভাষীদের প্রতি, হিন্দুস্থানী ভাগ্যদেবীর কৃপাবৃষ্টি ঝরে পড়তে থাকে, অঝোর ধারায়। পরাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার নামে ক্ষমতা হস্তান্তরের খেলায় যেন কয়েকজনমাত্র বিজয়ী-বীরস্মরণীয়,বরনীয় হয়ে আছেন।অখন্ড ভারতবর্ষে যেন আর কোনো বীর-পুরুষ ছিলেন না।
বিদ্রোহী কবির কন্ঠধ্বণি
ফাঁসীর মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন্ বলিদান?
আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ।
দুলিতেছে তরী,ফুলিতেছে জল,কান্ডারী হুঁশিয়ার!
এর অর্থ তারা বুঝল না।বুঝবেও না কোনোদিন।
অথচ বিদেশী  শাসকরাও বাংলাভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন প্রথম বাংলা-ব্যাকরণ গ্রন্থকার ন্যাথানিয়েল হ্যালহেড। অথচ ভারতীয় হিন্দি বলয়ের মহারথীরা একবারও বাংলাভাষার কথা মুখে আনেন না।বরং তাঁদের কার্যকলাপে প্রমানিত হয় ,তাঁরা কতটা বাংলা-বিদ্বেষী। বাংলাভাষায় রচিত ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের ভাষা হিন্দি বলে প্রচার করা, তার জ্বলন্ত উদাহরণ,যা আগেই বলা হয়েছে১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত বিশ্বভারতীর সভায় ড:মহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে, বাংলাকে ভারতের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবী করেন।তিনি আরও বলেন: শুধু ভারতবর্ষে কেন,সমগ্র এশিয়া মহাদেশে বাংলার স্থান হবে সর্বোচ্চহিন্দির সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব লক্ষ্য করে ড: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন: ‘ I honestly feel  that I’m seeing an incipient HINDI IMPERIALISM, which will be all the more  ANTI-NATIONAL. [তথ্যসূত্র: ‘Letter from Sri B.G.Kher,Chairman,Official Language Commission to the President of India,Forwarding the report of theCommision,dated the31st July,1956.]

রবীন্দ্রনাথ, সাহিত্যে প্রথম নোবেল প্রাইজ পাওয়া কবি।ভারত এ জন্য গর্ব প্রকাশ করে।কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে জাতীয় কবির উপযুক্ত মর্যাদা দিতে তাদের কোথায় যেন সংশয়,দ্বিধা-দ্বন্দ্ব!হায়রে,হতভাগ্য জাতি!বিশ্বকবির জন্মদিনে নেই কোনো আবেগ-উচ্ছ্বাস;মৃত্যুদিনেও নেই কোনো তাঁর স্মৃতিচারণ।নেই তাঁর অমর সৃষ্টির  প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।
বাংলা ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠির ভাষা।তাই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাংলাভাষার প্রসঙ্গ উঠে আসাই স্বাভাবিক।এভাবে তেলুগু,মারাঠী,তামিল,গুজরাটির প্রসঙ্গও অস্বাভাবিক নয়।এ সব কারণে ভারতীয় ঐক্য ও সংহতির কথা মাথায় রেখে নির্দিষ্ট কোনো রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ সম্ভব হয়নি।অষ্টম তফশিলে সংবিধান-স্বীকৃত ২২টি ভাষার উল্লেখ আছে। প্রতিটি ভারতবাসীর কাছে এই বার্তা পৌঁছানো দরকার যে এই ২২ টি ভাষা আমাদের জাতীয় ভাষা।আর ইংরেজি এবং হিন্দি কেন্দ্রিয় সরকারের দাপ্তরিক ভাষা।আরও স্পষ্ট হওয়া দরকার প্রতিটি রাজ্যের বৃহত জনগোষ্ঠির ভাষা-ই হবে সেই রাজ্যের সরকারি ভাষা।যেমন তামিলনাডুর সরকারি ভাষা তামিল,গুজরাটের সরকারি ভাষা,গুজরাটি।উড়িষ্যার সরকারি ভাষা উড়িয়া ইত্যদি।
বেশ কিছু সংবেদনশীল শব্দগুচ্ছ আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে।হিন্দু-হিন্দুস্তানি-হিন্দি-হিন্দ্-মহাসাগর-জয়হিন্দ্ ইত্যাদি।এই শব্দগুলির উচ্চারণে আমরা আমাদের জাতীয়তাবোধের পরিচয় দিই,মনে-প্রাণে গর্ব অনুভব করি।কিন্তু একটু নিরপেক্ষভাবে ভেবে দেখলে আমাদের গর্ব,খর্ব হয়ে যায়।সিন্ধু শব্দ থেকে এই শব্দগুলির উৎপত্তি।খন্ডিত ভারতবর্ষে সিন্ধু আমাদের জাতীয় জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।আমাদের জাতীয়-সঙ্গীতে ব্যবহৃত সিন্ধু শব্দটির বর্জন প্রসঙ্গে তাই স্বাধীন ভারতে অনেক বিতর্কের ঝড় বয়ে গেছে।শুধু বিশ্বকবির গান বলে আজও তা অপরিবর্তিত আছে।বিখ্যাত উর্দু কবি ইকবালের হিন্দি হ্যায় হম্ বতন্ হ্যায়,হিন্দোস্তাঁ হমারা’—গানটিও অখন্ড ভারতবর্ষের জন্য রচিত হয়েছিল।নেতাজী সুভাষচন্দ্রের জয় হিন্দ স্লোগানটিও খন্ডিত ভারত-ভূমির জন্য উচ্চারিত হয়নি।
উপরিউক্ত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে একটা বিষয় বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সিন্ধু-হিন্দু-হিন্দুস্তানি প্রভৃতি মিথ্যে মোহময়ী শব্দ-মানসিকতার জন্য হিন্দি স্তাবকধর্মী মনোভাব গড়ে উঠেছে।আর তারই ফলস্বরূপ  রাজভাষা-রাষ্ট্রভাষা-র বোধ-বিকৃতি।
সিন্ধু-সভ্যতার  জন্য যদি আমরা এত গর্বিত হই,তবে দ্রাবিড়-সভ্যতার জন্য আমাদের গর্ব প্রকাশের কিছু থাকবেনা কেন? উত্তর-ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতি কেন জোর করে চাপানো হবে দক্ষিণ-ভারতীয়দের ওপর।আর বঙ্গীয়-ভাষা-সমাজ-সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রসঙ্গ তুললেই তো আর একটা বঙ্গীয়-মহাভারত তৈরি হয়ে যাবে।
সবশেষে,এ কথাই বলতে চাইবো যে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক অপ-প্রচার বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কেন্দ্রিয় দাপ্তরিক ভাষা হিন্দি-র প্রচার-প্রসার প্রচেষ্টার সঙ্গে-সঙ্গেই ইংরেজিসহ সংবিধান স্বীকৃত জাতীয় ভাষাগুলির প্রচার-প্রসার,বিকাশ-প্রকাশের কাজে উৎসাহিত করাএবং কেন্দ্রিয় আর্থিক অনুদান প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ মনোভাব না থাকলে কখনও জাতীয় ঐক্য ও সংহতির বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।আমাদের জাতীয় চরিত্র হোক সত্যানুসারী। সত্যমেব জয়তে!!

কোন মন্তব্য নেই: