‘তুমি কি করছ?’
‘রান্না। একটা ভাল জিনিষ রান্না করছি। খেতে চাইলে চলে এসো।’
‘একদিন হঠাৎ গিয়ে চমকে দেব তোমায়!’
‘কবে?’
‘সে তুমি দেখতেই পাবে।’
‘হ্যাঁ, বলো এবার তোমার কি কথা? কোন বিশেষ চাঁদার ব্যাপার নিশ্চয়?’
বৌদি চলে এসেছে। কিন্তু আমার মনটা এখন অন্য হাইটে রান করছে। কি হবে প্রতিশোধ নিয়ে! তবু কিছুতো একটা বলতে হবে। কি বলা যায় ভাবছি এমন সময় কলিং বেল বেজে
উঠল। হারুদা আমায় দেখে অবাক। ‘কিরে কি খবর? আমি ক্লাবে ছিলাম দেখতে পাসনি? ধুপ করে
সোফায় বসে পড়ে হারুদা। আমার ভাল হওয়া মনটা আবার জট পাকাতে শুরু করে। ‘তুমি আমার
মায়ের কাছে কি বলেছ?’ হারুদা সরলতার ভান করে। ‘কি আবার বললাম? কই তেমন কিছু মনে
পড়ছে না তো!’ আমাদের কথার ফাঁকে বৌদি আবার রান্নাঘরে চলে যায়। ‘তুমি দিনে ক’বার
শম্পাদের বাড়ীতে জল খেতে যাও বৌদি জানতে চাচ্ছিল। বলব নাকি?’ হারুদা শরীর সোজা করে
বসে। ‘এই! কি তুই উল্টো পালটা বকছিস?’ বলেই একবার দেখে নেয় বৌদি কোথায়। তারপর আমার
কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘ মাসীমা সেদিন এমন চেপে ধরল যে একটুখানি বলে ফেলেছি। যা
দেখেছি তাই বললাম। তুই যদি বারণ করতিস তাহলে বলতাম না।’ বলেই আবার যোগ করে, ‘ কেন? মাসীমা তোকে কিছু বলেছে নাকি?’ আমি
নির্বিকার থেকে বলি, ‘বললেও কিছু আসে যায় না। আমি তো আর নাবালক নয়।’ বৌদি এই সময়
দু-কাপ চা নিয়ে আসে। ‘কোন সমস্যা হয়েছে নাকি তোমাদের?’ বৌদি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা
করে। হারুদা আমাকে কোন সুযোগ না দিয়েই একটু অনাবশ্যক জোরের সঙ্গে মুখর হয়ে বলে,
‘না, না, না, ওর সঙ্গে কোন সমস্যা নেই আমার। আর ভবিষ্যতেও হবেনা। বৌদি আবার
রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। ‘এত তাড়াতাড়ি বাড়ীতে ঢুকে পড়লে? আজ জল খেতে যাবেনা?’ চায়ে
চুমুক দিতে দিতে আমি আক্রমণ জারী রাখি। হারুদা সতর্ক চোখে আমাকে লক্ষ্য করে। আমিও
সমানে লক্ষ্য করি হারুদাকে। কাপ শূন্য হতে থাকে, বেলা বাড়ে।
বেলা কারো তোয়াক্কা করেনা। বেলা অন্ধ। তার না আছে চোখ, না আছে কান। এক
অদৃশ্য অমোঘ নির্দেশে বেলা তার কাজ করে যায়। সেই নির্দেশ জীবন মঞ্চে আমার জন্য
বিশেষ নড়াচড়ার সুযোগ রাখে না।
কতকগুলো সাধারণ কাজ, ফোন, মেসেজ, চাকরীর পরীক্ষার কঠিন লড়াই আর অবাধ
কল্পনার পরিধির মধ্যেই আমি আটকে থাকি। বাবা আর ভালো হয়না, তার দেখাশোনাও আর আগের
মত হয়না। এই অবস্থায় আমি একদিন তার বিছানার পাশে দাঁড়ালে তিনি সচল হাত দিয়ে আমার
হাত শক্ত করে ধরেন এবং তার চোখে জল চিক্ চিক্ করে। আমি খুব অসহায় বোধ করি।
কর্মচারী সর্বেসর্বা হয়ে দোকান চালাতে থাকে। মা তার মেয়েদের সমস্যা, নাতি নাতনীর
সমস্যা আর জামাইদের ছোট বড় সমস্যা মাথা ঘামাতে গিয়ে আমাকে আর তেমন শাসনের সময়
পায়না। কেমন বিমর্ষতা গ্রাস করে নেয় আমাকে। চাকরীর পরীক্ষা সুফল প্রসব করেনা।
মলিও কেমন দূরে সরতে থাকে। ফোন করেও সবসময়
ওকে পাওয়া যায়না। দেখা করার ইচ্ছা থাকলেও দেখা করতে পারেনা। আবার একটা বর্ষা নামে।
তারপর আসে শরৎ আর দূর্গাপুজা। পুজার সময়েও মলি নানা কারণে দেখা করার মত সময় করতে
পারেনা। একবারই মাত্র আমরা দূর্গাপুজায় ঘুরে ছিলাম। সেটা প্রথম বছর। সেবার
ঘন্টাগুলো মাত্র ৬০ মিনিটের মধ্যে কেন ফুরোয় সেই কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু ঘন্টা তো
আমার কেউ নয় সে মহাকালের। শহরে বড় ভিড় আমরা ইচ্ছা থাকলেও সেভাবে কাছাকাছি হতে পারিনি। এক এক সময় খুব ইচ্ছা হত।
পূরণ না হতে হতে ইচ্ছারাও কি হলুদ হতে থাকে ক্রমশঃ?
তারপর এল শীত। বাবা চলে গেল। বিষন্ন সময়ে
দিন কে খুব বড় আর রাত কে ছোট মনে হত। শ্রাদ্ধ শান্তির পরে দিদিদের মধ্যে অশান্তি
বাঁধল। বাবার স্মৃতি হারিয়ে গেল। ‘আর কি কিছু বলবে’ বলে মলিও আর ফোন করত না। ও আর
নিজে থেকে ফোন করত না।
একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ভোট এল। বোমা,
পটকা, ছুরি, পুলিশের বাঁশীতে দিনের আলো মলিন আর রাতের অন্ধকার গভীর হল। সব থিতিয়ে
যাবার পর যখন কিছুটা শান্তি ফিরল ততদিনে হারুদা বোতল হারু নাম নিয়েছে, বৌদির
সন্মন্ধেও একটা কানাঘুঁষো ছড়িয়েছে। এমন একদিনে আমার মলির সঙ্গে দেখা করার ভীষণ
ইচ্ছা হল। ফোন রিং হতে থাকলেও কেউ তা ধরল না। পরদিন আবার চেষ্টা করলে বার্তা এলঃ
প্লীজ চেক ইওর নাম্বার। তবে কি মলি জীবন আর ফোনের সীমকার্ড বদলে নিল!
এইসময় এক দুপূরে পোষ্টম্যান এসে আমায়
খুঁজল। সই করিয়ে একটা রেজেষ্ট্রি চিঠি আমার হাতে ধরিয়ে বকশিশ দাবী করল। এই চিঠিটা
কি ছমাস আগে আসতে পারত না? আমি মহানির্দেশকের উদ্দ্যেশে বললাম, ‘ আপনি এটা কি
করলেন?’ কেউ ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি বলে আমিও কাউকে কিছু বললাম না। ফোন লিস্ট আর
যত কাগজ পত্র ঘেঁটে একটা ফোন নাম্বার পেতে চাইলাম। প্রত্যেকের একটা নিজস্ব জীবন
আছে, সেই জীবনে যত্নে আঁকা কিছু স্বপ্ন আছে। হতে পারে মলির এখনকার স্বপ্ন পথ
পরিবর্তন করেছে। কিন্তু আমাদের একটা ভাববার মত অতীত কি নেই? সেখানে ছড়িয়ে থাকা
প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসের কথা কি মলির মনে নেই।
অবশেষে নাম্বারটা পেয়ে গেলাম। রিং হল। মলির অন্যতম ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ‘ হ্যালো’ বলে কল রিসিভ করল। আমি না থেমে
অনেক কথা বলে গেলাম। মেয়েটি শুনল। ‘ মলির এখনকার নাম্বারটা কি দিতে পারেন? খুব
দরকার। মানে একটা সুখবর......এই পর্যন্ত বলেই আমি থমকে গেলাম। মলি তো ‘আর কিছু কি
বলবে’ বলে অনেকদিন ফোন করেনি। ‘বলুন, থামলেন কেন?’ ওপার থেকে সুরেলা কন্ঠ ভেসে এল।
‘আচ্ছা! মলি কি এখন অন্য কোথাও এনগেজড?’ ফোনে চাপা নিঃশ্বাস পড়ল। ‘ইয়েস।’ একটু পরে
মেয়েটি উত্তর দিল। মরীয়া হয়ে আমি বললাম, ‘ওর সঙ্গে কি কথা বলা যায়না?’ আবার
নিঃশ্বাস পড়ল, ‘স্যরি! আমি নাম্বারটা আপনাকে দিতে পারব না।’ একটু পরে ফোন অফ হয়ে
গেল। অথচ বাকি সব কিছুই যা না থাকলেও এমন কিছু ক্ষতি হতনা মহান নির্দেশকের ইচ্ছায়
সেই সব কিছুই অন হয়ে থাকল যেন এইসবে তাদের কারো কিছু যায় আসে না।
সমাপ্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন