লিখেছেন : অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
পৃথিবীতে যত রকম পানীয় আছে তার মধ্যে জলের
পরই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় চা। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের
পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রার ধরনে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তবে
এসব ব্যবধানকে বহু আগেই অতিক্রম করেছে চা নামক এ পানীয়টি। পৃথিবীর প্রায়
প্রতিটি মানুষের কাছে এক কাপ চা প্রশান্তির সমার্থক হিসেবে খ্যাত। জনপ্রিয় এ
পানীয়টির ইতিহাস যতটা দীর্ঘ ঠিক ততটা জটিলও। বিভিন্ন সভ্যতার বিভিন্ন
সংস্কৃতিতে চা পানের প্রথা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে কয়েক হাজার বছর। ধারণা করা
হয়, ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১০৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী কোনো এক
সময় শাংদের রাজত্বকালে ঔষধি পানীয় হিসেবে চিনে প্রথম উৎপত্তি লাভ করে চা।
তবে চা পানের প্রথম বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় হুয়া তো-এর একটি
লেখায়। ওই লেখা অনুসারে খ্রিস্টাব্দের তৃতীয় শতাব্দীতে প্রথম চা পান করা
হয়। এর অনেক পর ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজ পুরোহিত ও বণিকদের চায়ের সঙ্গে
পরিচয় করে দেয় চিনারা।
সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে ব্রিটেনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে
চা। ততদিনে চায়ের রমরমা ব্যাবসা শুরু করে দিয়েছে চিনারা। আর এ ব্যাবসাতে
ভাগ বসাতেই ভারতে চা নিয়ে আসে ব্রিটিশরা। পাশাপাশি চায়ের উৎপাদনেও কাজ শুরু
করে তারা। চায়ের উৎপত্তি নিয়ে আরেকটি মজার গল্পও প্রচলিত আছে। ২৭৩৭
খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে শেনাং নামের চিনের এক সম্রাট একটি নিয়ম করেছিলেন।
নিয়মটি ছিল, প্রজাদের অবশ্যই জল ফুটিয়ে পান করতে হবে। এ রকম একসময় শেনাংয়ের
জন্য যে জল ফোটানো হচ্ছিল তাতে কিছু পাতা উড়ে এসে পড়ে। এতে জলের রং পালটে
যায়। আগ্রহের বশে সেই জল পান করে মুগ্ধ হয়ে যান সম্রাট শেনাং। এ ধরনের আরও
বেশ কিছু কাহিনি প্রচলিত আছে জনপ্রিয় এ পানীয়টির উৎপত্তি নিয়ে। তবে এসব
কাহিনির কোনোটিরই ঐতিহাসিক কোনো সত্যতা পাওয়া যায় না।মধ্য চিনের হুপেই প্রদেশে উ ইয়ুন শান চা পার্ক নামের একটি চা পার্ক আছে। এটা চিনের প্রথম চা পার্ক। ২০০৬ সালে চিনের কৃষি পর্যটনের নমুনা স্থান হিসেবে এটাকে চিহ্নিত করা হয়। চা পার্কে বেড়ানো, উ ইয়ুন শানের চা খাওয়া, প্রাকৃতিক অক্সিজন উপভোগ করা এবং কৃষক পরিবারের রান্না খাওয়া পাহাড়ের গভীরে একটি অদ্বিতীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উ ইয়ুন শানের 'চা ভ্রমণ' খুবই জনপ্রিয়। প্রতি বছর ২ লাখেরও বেশি পর্যটক এখানে আসেন। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ব্রিটেন ও জাপানসহ বিদেশি বন্ধু ও ব্যবসায়ীরাও এখানকার সুনাম শুনে এখানে বেড়াতে আসেন। চা খাওয়া ও দৃশ্য দর্শন ছাড়া তাঁরা চা বাগানে এসে চা পাতা তোলার ও চা তৈরির আনন্দ উপভোগ করেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা একসাথে উ ইয়ুন শানের চা বাগান দেখব ও সেখানকার চা সংস্কৃতি জানব।
পাহাড়গুলোর মধ্যে সড়ক পার হয়ে উ ইয়ুন শান চা পার্কে প্রবেশ করুন। এখানকার কবি ও ছবির মতো দৃশ্য সত্যি নিজের সুনাম রক্ষা করে চলেছে। দূরে তাকালে মনে হয় জায়গাটি পাহাড়ে পরিবেষ্টিত। লাল টালি ও সাদা দেয়ালের কৃষক ভিলা এর মধ্যে রয়েছে। অস্পষ্টভাবে দেখা যায় লাল ও সবুজ রঙের কাপড় পরা কৃষক নারী ঝুড়িতে করে চা তুলে নিচ্ছেন। নিচে হ্রদের জল সবুজ ও উদাত্ত। নীল আকাশ ও সাদা মেঘ আর সবুজ গাছের ছায়া জলে পড়ে। সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক দৃশ্য মিলেমিশে উ ইয়ুন শান চা পার্কের বৈশিষ্ট্যময় আকর্ষণীয় শক্তি গড়ে তুলেছে।
উ ইয়ুন শানে উত্কৃষ্ট চা আছে। কথিত আছে,১৮ শতাব্দীতে ছিং রাজবংশ সময়পর্বে সম্রাট ছিয়ানলোং উ ইয়ুন শান গ্রামের এক কৃষক বাড়িতে এসেছিলেন। তৃষ্ণার্ত হওয়ায় তিনি এক কৃষক নারীর কাছ থেকে চা-জল খেয়েছিলেন। চা মুখে দিয়ে সম্রাটের মুখটা হঠাত্ সুগন্ধে ভরে ওঠে এবং তাঁর মনটাও প্রশান্তি বোধ করে। তিনি বলে ওঠেন, 'ভালো চা ভালো চা'। সে সময় থেকে উ ইয়ুন শানের চা বিশ্ববিখ্যাত হয়ে ওঠে। তবে বিশ্ববিখ্যাত চা থাকা সত্ত্বেও উ ইয়ুন শানের গ্রামবাসীরা কিন্তু সমৃদ্ধ ছিল না। উ ইয়ুন শান গ্রামের আয়তন ২.৩ বর্গকিলোমিটার। সারা গ্রামের ৬টি গ্রুপে ২৬৩টি পরিবার আছে। আগে গ্রামের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ২০০ ইউয়ানেরও কম ছিল। এখন অবস্থাটা বদলেছে। উন্নয়ন চাইলে নিজের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে হবে। আবাদি জমি কম হওয়ার এবং কৃষিফসল ভালো না হওয়ার অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য উ ইয়ুন শান 'চা' ধরেছে।
উ ইয়ুন শানের আবাদী জমি কম হলেও সেখানে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত উ ইয়ুন মন্দির। সে মন্দির সমৃদ্ধ থাং রাজবংশের মি লে বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। বিদেশি উচ্চপদস্থ জ্যেষ্ঠ সন্ন্যাসীদের সম্মান দেখানোর পাশাপাশি সম্রাট ছিয়ানলোং মন্দির চা খাওয়ার কারণে বিশ্ববিখ্যাত। এছাড়া উ ইয়ুন শানে 'তাও কুয়া শিয়ান রেন ইয়া', 'উ ইয়ুন জু চি' ও 'সি আর পেন'সহ বিখ্যাত প্রাকৃতিক দৃশ্য রয়েছে। বৃদ্ধিমান উ ইয়ুন শানের অধিবাসীরা এ সব সুবিধাজনক প্রাকৃতিক অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে 'পর্যটন শিল্প উন্নয়ন, চা সংস্কৃতি ত্বরান্বিতকরণ' কাযক্রমের মাধ্যমে ধনী হওয়ার পথে চলে এসেছেন।
শহর থেকে আমাদের ভৌগোলিক স্থান মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে। এছাড়া পাহাড় ও জল এবং সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থা থাকার কারণে ওখানকার আদিবাসীরা চা শিল্পের মাধ্যমে পর্যটন শিল্প উন্নয়ন করে।
জেলা সরকার এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের ব্যাপক সমর্থনে গ্রামীণ কমিটি শিগগির উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। দেশ-বিদেশের কোথাও না-থাকা 'চা পার্কের' জন্ম হয়। ১৯৯৮ সালের ২০ এপ্রিল 'উ ইয়ুন শান চা পার্ক' আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৭ সালে চিনের শিল্প ও কৃষি পর্যটন প্রদর্শন প্রকল্পের পরীক্ষা ও মূল্যায়ন কমিটি 'উ ইয়ুন শান চা পার্ককে'চিনের কৃষি পর্যটনের নমুনা প্রকল্প হিসেবে অনুমোদন দেয়। ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কীভাবে চা পার্ক চালু হয় এবং কৃষকদের নতুন ধনী হওয়ার পথ খুলে যায়। এখন উ ইয়ুন শান গ্রামবাসীদের মাথাপিছু আয় ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চা পার্কের নির্মাণ এবং চা-ভিত্তিক স্থানীয় শিল্পের মাধ্যমে সবুজ প্রাকৃতিক কৃষি গড়ে উঠার পর উ ইয়ুন শান ও সারা জেলায় সর্বপ্রথম 'কৃষক পরিবারের আনন্দ'পরিকল্পনার ব্যবস্থা করে। ব্যস্ত সময়ে ৩৬টি 'কৃষক পরিবারের আনন্দ' ছিল। এ প্রকল্প বছরে ৩ লাখেরও বেশি পর্যটককে অভ্যর্থনা জানায়। এটা কৃষকদের আয় ৬ লাখ ইউয়ান পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন