লিখেছেন : জাহাঙ্গীর হোসেন
বাঙালি! বসবাস করে পৃথিবীর দু’টো ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে। একটিকে তারা দাবি করে
নিজ স্বাধীন দেশ বলে, নাম ‘বাংলাদেশ, অন্যটি বিশাল ভারতের একাংশের
প্রদেশ, নাম ‘পশ্চিম বাংলা’। অভাব, দুর্যোগ আর কষ্ট বাঙালি জীবনের চিরন্তন সত্য।
হাজার বছরের পুরনো ‘চর্যাপদে’ও বাঙালি জীবনের অভাব, বঞ্চনা আর কষ্টের কথা সুষ্পষ্টভাবে
দৃশ্যমান। যে কারণে ‘সুখের কাঙাল’ বাঙালি
নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে হতে চায় অভিবাসী, অনেকটা পরিজায়ী পাখির মত। কিন্তু তারপরও কষ্ট আর দুঃখ যেন তার পিছু ছাড়তে চায়না স্বদেশ কিংবা বিদেশে।
বিশাল ভারতের অংশ ছিল ‘বাংলা’ প্রদেশ। একসময় ভারতবর্ষের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করেছিল বাঙালির অহঙ্কার ‘কোলকাতা’। মুসলিম লীগের দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করা হয় ১৯৪৭ সনে, যাতে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান বিশাল জনগণের কোন ম্যান্ডেট নেয়া হয়নি কখনো। পাঞ্জাব ও বাংলাকেও করা হয় বিভক্ত ধর্ম অনুসারে। একাংশ পড়ে পাকিস্তানের ভাগে, নতুন নামকরণ হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান’।
ধর্মীয় পরিচয়ে রাষ্ট্র বিভাজন হওয়াতে পাকিস্তানের উভয় অংশ থেকেই ব্যাপকহারে
হিন্দুরা গমন করতে থাকে ভারতে ‘নিরাপদ শান্তির প্রত্যয়ে’ ১৯৪৭ থেকেই। এরমধ্যে নানা সময়ে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কারণে পরিজায়ী প্রথা অব্যাহত থাকে ‘বিভক্ত’ ২-রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ভারত থেকে আগত মুসলমানরা
পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলেই পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবে নিজেদের আইনী মর্যাদা প্রতিষ্ঠা
করতে সক্ষম হয়, বিশেষ
করে করাচীতে বসবাসকারী মুসলমানগণ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে উদ্বাস্তু
হিসেবে প্রবেশকারীগণ ‘উরংঢ়ষধপবফ চবৎংড়হং জবযধনরষরঃধঃরড়হ ধহফ ঈড়সঢ়বহংধঃরড়হ অপঃ, ১৯৫৪’ আইন অনুসারে শুধু ভারতের নাগরিকত্বই পায়নি, তারা পাকিস্তানে ফেলে আসা সম্পত্তির ক্ষতিপুরণও পেয়েছে যথাসময়ে।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত মধ্য প্রদেশ ও রাজস্থানে বসতি স্থাপনকারী কয়েক
হাজার হিন্দু উদ্বাস্তুকে নাগরিকত্ব প্রদান করা ছাড়াও, ভারতের ২০০৩ সনের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন পাস হওয়ার পরও, ২০০৪ সনে আইনের বিধান সংশোধন করে ‘গুজরাট’ ও ‘রাজস্থানে’ আগত
প্রায় সকল হিন্দুদের ৫-বছর বসবাসের সহজ শর্তে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। বর্ণিত প্রদেশে সংশোধিত আইনটি হচ্ছেঃ (ঈরঃরুবহংযরঢ় জঁষব (অসবহফসবহঃ) অপঃ ২০০৪), ‘১৯৬৫ ও ১৯৭১ পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে আগত এবং গুজরাটের কুচ, পাটান, বনসকণ্ঠ ও আহমেদাবাদ জেলায় কমপক্ষে ৫-বছর বসবাসকারী সকল উদ্বাস্তু হিন্দুুকে ‘জেলা কালেক্টর’ ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য করতে পারবেন’। এ ছাড়া ‘রাজস্থানের বাদমের ও জয়সালমের জেলায় ১৯৬৫ ও ১৯৭১ এর পাক-ভারত যুদ্ধের পর
পাকিস্তান থেকে আগত কমপক্ষে ৫-বছর বসবাসকারী ব্যক্তিগণকে জেলা কালেক্টর নাগরিকত্ব প্রদান করতে পারবেন’। বিধানটি ২৮/০২/২০০৪ তারিখ ভারতে সরকারী গেজেটে প্রকাশিত ও কার্যকর হয়। বিশাল ভারতের অংশ ছিল ‘বাংলা’ প্রদেশ। একসময় ভারতবর্ষের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করেছিল বাঙালির অহঙ্কার ‘কোলকাতা’। মুসলিম লীগের দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করা হয় ১৯৪৭ সনে, যাতে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান বিশাল জনগণের কোন ম্যান্ডেট নেয়া হয়নি কখনো। পাঞ্জাব ও বাংলাকেও করা হয় বিভক্ত ধর্ম অনুসারে। একাংশ পড়ে পাকিস্তানের ভাগে, নতুন নামকরণ হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান’।
এ ক্ষেত্রে ভারত ভাগের বলিপ্রাপ্ত ‘কপাল পোড়া’ বাঙালি হিন্দুরা ১৯৪৭ এর পর ক্রমাগতভাবে ভারতে বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় বসতি স্থাপন করলেও, অদ্যাবধি অনেকেই এখনো সেখানে ‘ছিন্নমূল উদ্বাস্তু’। ধর্মীয় কারণে ভারতের রাজনৈতিক বিভক্তির সময় যদিও লোক বিনিময়ের প্রস্তাব ওঠে কিন্তু পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল তথা বাংলা অঞ্চলে কখনো লোক বিনিময় ঘটেনি, যা ঘটেছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। বিভক্তির পরই ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দ বার বার প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল, পাকিস্তান থেকে ভারতে গমনকারী হিন্দু উদ্বাস্তুদের ভারতে বসবাসের যৌক্তিকতা, নাগরিকত্ব প্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ঘোষণা করেন, ‘হিন্দু ও শিখরা যে কোন সময় ভারতে যেতে পারে, এ ক্ষেত্রে ভারত সরকারের প্রধান কর্তব্য হবে আগতদের জীবিকার সংস্থান’ (সূত্র ঃ ম.গা.র পৃ. ১০-১১)। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ভাষ্য ছিল, ‘রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট উদ্বাস্তুদের সুখ দুঃখের সম অংশীদার আমরা থাকব’ (সূত্র ঃ ওহফবঢ়বহফবহপব ্ অভঃবৎ পৃ. ৫)। ভারতের ১ম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ শপথ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘উদ্বাস্তুদের সকলকে পুনর্বাসন ও পুন:প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমরা উদ্বিগ্ন’ (সূত্র ঃ ডারাপ্রব পৃ. ২)। ১৫/০১/১৯৫৩ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের প্রতিশ্র“তি ছিল, ‘তাহারা (উদ্বাস্তুরা) আমাদের কাছে বিদেশী হইতে পারে না’ (সূত্রঃ প্রচার বিভাগ, ভারত সরকার, পৃ. ১২১)। এভাবে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি (এআইসিসি), ভারতের পুনর্বাসন মন্ত্রী মহাবীর ত্যাগী প্রমুখ সকলেই পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশকারী উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে তাদের মানবিক ও যৌক্তিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। উল্লেখ্য যে, ভারতের সংবিধানের ৭ম তফশিলভুক্ত ৩ নং সূচির ২৭ ধারায় উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
১৯৫০ ও ১৯৬৪ সনে পাকিস্তানের উভয় অংশে হিন্দু-মুসলমান মারাত্মক দাঙ্গা শুরু হলে ব্যাপকহারে হিন্দুরা ভারতে গমন করে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চল থেকে। এ সময় ভারত সরকার কোনরূপ প্রমাণপত্র (ডকুমেন্ট) ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশকারী হিন্দু উদ্বাস্তুদের বসবাসের অধিকার, নাগরিকত্ব, রেশনকার্ড ও ভোটার করার প্রতিশ্র“তি দেয়। ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত এ ব্যবস্থা মোটামুটি প্রতিপালনের ব্যবস্থা ভারতে ছিল। ১৯.০৩.১৯৭২ সনে সম্পাদিত ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতেও বাংলাদেশ অঞ্চল থেকে ভারতে গমনকারী হিন্দুদের ব্যাপারে কোন বিধি নিষেধের আরোপের কথা বলা হয়নি। যে কারণে ১৯৪৭-এ হিন্দু-মুসলমান রাষ্ট্র বিভক্তির পর পাকিস্তান অঞ্চল থেকে নানা সময়ে বাঙালি হিন্দুরা নানা প্রক্রিয়ায় ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় বসতি স্থাপন করে। এরমধ্যে অনেকে ভারত তথা পশ্চিম বাংলায় ‘প্রয়াত’ হলেও, তাদের ভারতে জন্মগ্রহণকারী সন্তান সন্তুতিরা বাড়ি-ঘর বানিয়ে, ভোটার হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্তি করে, যায়গা জমি ক্রয় করে রীতিমত ‘ভারতীয়’ হয়ে ভারতে বসবাস করছে। অনেকে চিন্তাও করেনি, তাদের ভবিষ্যত পরিণতি কিংবা নাগরিকত্ব বিষয়ক আসন্ন জটিলতর সমস্যার কথা। এই প্রাক্তন ‘উদ্বাস্তুরা’ এখন আক্রান্ত ভারতীয় ‘১৯৪৬ সনের বিদেশী আইন (ঋড়ৎবরমহবৎং’ অপঃ, ১৯৪৬)’ ও ‘২০০৩ সনের নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন (ঈরঃরুবহংযরঢ় অসবহফসবহঃ অপঃ, ২০০৩)’ দ্বারা। এই আইনের বিভিন্ন ধারা বলে ৪০-৫০ বছর সময় ধরে ভারতে বসবাসকারীদের কাউকে কাউকে হয়রানি, মামলা, গ্রেফতার ইত্যাদি করা হয়েছে। ২০০৬ সন থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন উদ্বাস্তু এলাকা থেকে ১৭৩৬ জন উদ্বাস্তুকে গ্রেফতার ও ১৫৫টি কেস দায়ের করা হয়েছে (সূত্র: পুস্তিকা-অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্ট. পৃ-২২)।
রাজনৈতিক কারণে উদ্বাস্তু হিসেবে পরিগণিত এই ভাগ্যহীনদের অধিকার রক্ষায় ২০০৪ সনে কোলকাতায় গঠিত হয় ‘অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্ট’। যারা কাজ করে যাচ্ছে রাজনৈতিক বিভাজনের বলিপ্রাপ্ত উদ্বাস্তুদের অধিকার রক্ষার জন্যে। এ সংগঠন ভারত বিভক্তির সময় উদ্বাস্তু বিষয়ে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বিবিধ প্রতিশ্র“তি, ঐ সময়ের ভারতীয় আইন, উদ্বাস্তুবিষয়ক জাতিসংঘ সনদ (সিদ্ধান্ত নং ৪২৮(৫), ১৯৫০ সনের নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি, ১৯৭২ সনের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি, উদ্বাস্তু বিষয়ে গুজরাট-রাজস্থান প্রভৃতি প্রদেশে গৃহীত কর্মকাণ্ড, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আইন ও আচরণের প্রতিবাদ, পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু আন্দোলন জোরদার, সম্মিলিত কেন্দ্রীয় উদ্বাস্তু পরিষদ গঠন, পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের বসতি মরিচঝাঁপিতে পরিকল্পিত আক্রমণ (মরিচঝাঁপি ১৯৭৮-৭৯, আক্রান্ত মানবিকতা, তথ্যচিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন) এবং উদ্বাস্তুদের আন্দামানে পাঠানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি, ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সমস্যাটির ব্যাপারে স্মারকলিপি পেশ ও প্রতিবাদ এবং জনমত গঠনে পত্র-পত্রিকায় উদ্বাস্তু বিষয়ক সমস্যাটি তুলে ধরার নানাবিধ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে অক্লান্তভাবে।
পৃথিবীর দারিদ্রক্লিষ্ট, কষ্ট আর বঞ্চিত বাঙালির অংশী একজন ‘বাংলাদেশী বাঙালি’ হিসেবে উদ্বাস্তু পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের বর্তমান সমস্যাটিকে নিতান্তই মানবিক বলে মনে করি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টিকে গুজরাট ও রাজস্থানের প্রেক্ষাপটে বিচার করতে পারেন মানবিক দৃষ্টিতে। আর পশ্চিম বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় সকল মানবিক সমস্যায়ই ‘মমতাময়ী’। তিনি সিঙ্গুরের মত এ সমস্যাটির ব্যাপারে এগিয়ে এলে, অভিবাসীর লক্ষ্যে পাকিস্তান ত্যাগী, বর্তমানে ভারতে বসবাসকারী ‘ভারত ভাগের বলিপ্রাপ্ত’ উদ্বাস্তু বাঙালিরা হয়তোতাদের অনাগত সন্তানদের সুখ চিন্তায় নিশ্চিন্তে পরপারে যেতে পারবেন। অন্যথায় জীয়নকালের মতই মৃত্যুর পরও তাদের আত্মা ‘উদ্বাস্তু’ হিসেবে ঘুরে বেড়াবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের যত্রতত্র!
Email: jahangirhossaindhaka@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন