লিখেছেন : ইতু ইত্তিলা

আমার নাস্তিক
বন্ধুরা আমাকে
নারীবাদের একটি সীমারেখা এঁকে দিয়েছেন,
এর বাইরে
কিছু বললে
তাঁরা আমাকে
'উগ্রনারী' আমার নারীবাদ'কে 'উগ্রনারীবাদ'
বলেন।
পুরুষতন্ত্রের স্রষ্টা যেহেতু পুরুষ সেহেতু
পুরুষতন্ত্রের কথা লিখতে পুরুষের কথাও
এসেছে।
আমার একসময়ের
সমমনা বন্ধুরা
আমাকে অবাক
করে বললেন,
আমি নাকি
সরলীকরণ করছি। যারা
পুরুষতান্ত্রিক চেতনার মানুষ নন তাঁদের
কেন আমার
কথা গায়ে
লাগাতে হয়
আমি বুঝে
উঠতে পারি
না।
বাঙ্গালি লেখকদের
লেখায় কত
পড়েছি বাঙ্গালি
নারী নিয়ে
নানান কথা। বাঙ্গালি
মেয়ে শাড়ি
পরতে পছন্দ
করে, শাড়ির
সাথে মিলিয়ে
একটা টিপ
পরে, সাথে
চুড়ি... আমি
শাড়ি পরি
না, টিপ
চুড়িও না। কিন্তু
আমার কখনো
নিজেকে বাঙ্গালি
মেয়ে নয়
বলে মনে
হয় নি। অথচ
আমার নাস্তিক
পুরুষ বন্ধুরা
যুক্তি দেখান,
আমি যখন
পুরুষ লিখে
পুরুষের সমালোচনা
করি তখন
নাকি তাঁরাও
অপমানিত বোধ
করেন।
অন্য পুরুষদের
দোষ তাঁদের
গায়ে এসেও
লাগে।
এমন সরলীকরণ
নাকি উগ্রতার
লক্ষণ।
আমাকে বলতে
হবে 'কিছু
পুরুষ' 'কিছু
ছেলে'।
আচ্ছা, স্কুলে
যখন স্যারেরা
বলতেন, ক্লাস
সেভেনের ছেলেগুলো
হল বদমাশের
হাড্ডি, একেকজন
বিচ্ছুর সেরা। এর
মানে কি
এই যে
ক্লাস সেভেনের
প্রতিটা ছেলেই
বিচ্ছু, ওই
ক্লাসে একজন
ভালো ছেলেও
নেই? তখন
কি আপনাদের
মনে হয়েছিল,
স্যার সরলীকরণ
করে খুব
অন্যায় করে
ফেলেছেন? উনি
একজন উগ্র
শিক্ষক? ক্লাসের
ভালো ছাত্রটি
ঠিক জানে
কথাগুলো স্যার
তাকে উদ্দেশ্য
করে বলেন
নি।
আবার ক্লাসের
বিচ্ছুরাও জানে কথাগুলো স্যার তাদেরকে
উদ্দেশ্য করেই
বলেছেন।
কিন্তু আমার
মুক্তমনা, প্রগতিশীল, নাস্তিক পুরুষ বন্ধুরা
এই সহজ
বিষয়টি বুঝতে
পারেন না
কেন? হয়তো
বুঝতে পারেন
বলেই প্রতিবাদ
করেন।
নাকি নিজেদের
ভিতরের পুরুষতন্ত্রকে
আড়াল করে,
নারীবাদীর মুখোশে পুরুষতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার
এটি একটি
নতুন কৌশল?
উগ্র নারীবাদীদের
কারণে শুনেছি
অনেক নারীবাদী
পুরুষ পুরুষতান্ত্রিক
আচরণ করছে,
এই উগ্র
নারীবাদীরা নারীবাদের জন্য ক্ষতিকর! যারা
উগ্র নারীবাদীদের
জন্য পুরুষতান্ত্রিক
হয়ে যাচ্ছেন
বলে দাবী
করছেন তাঁরা
কি নারীদের
দয়া বা
করুণা করতেন
বলে নারীবাদী
হয়েছিলেন যে,
উগ্র নারীবাদীদের
কারো দয়া
দরকার হয়
না বলে
জানিয়ে দেয়াতে
আপনারা আবার
আপনাদের আসল
রূপে ফিরে
যাওয়ার হুমকি
দিচ্ছেন? উগ্র
নারীবাদীরা আপনাদের দয়া দেখিয়ে ভালো
পুরুষটি সাজার
সুযোগ দিচ্ছে
না, আপনাদের
দয়া করুণা
প্রার্থনা করছে না। আর
এটিই বোধহয়
আপনাদের চোখে
উগ্র নারীবাদীদের
মূল উগ্রতা।
বুক ঢেকে
রাখতে হবে,
নিজের শরীর
নিয়ে লজ্জিত
বা বিব্রত
থাকতে হবে--
বাংলাদেশের সমাজের নিয়মটি যখন এই,
সেখানে আমি
যখন মেয়েদের
শরীর ঢেকে
রাখার এই
বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে লিখি আমি অবাক
হয়ে লক্ষ্য
করেছি নাস্তিক
পুরুষদের বদলে
যাওয়া রূপ।
না, তাঁরা
হিজাব-বোরখার
বিরুদ্ধে, যেহেতু এটি ইসলামি পোশাক।
কেউ কেউ
আবার ওড়নারও
বিরুদ্ধে। কিন্তু তাঁদের প্রগতি আটকে
যায় যখন
একটি ১৮
বছর বয়সী
মেয়ে প্রশ্ন
তুলে তারই
সমবয়সী একটি
ছেলে খালি
গাঁয়ে দৌঁড়ঝাঁপ
করে ঘুরে
বেড়াতে পারলে
সে পারবে
না কেন?
বাংলাদেশের মতো ইসলামিক দেশে একটি
মেয়ে যখন
তার ব্রা
পরা ছবি
পাবলিকলি দিয়ে
বুঝান যে
তিনি তাঁর
শরীর নিয়ে
লজ্জিত নন,
বিব্রত নন,
তখন আমার
নাস্তিক বন্ধুরা
ব্যঙ্গ সুরে
জিজ্ঞেস করেন,
তাঁরা যদি
এখন তাঁদের
শিশ্নের ছবি
পোস্ট করেন
তাতে কারো
অনুভূতিতে আঘাত লাগবে কিনা। শিশ্ন
কি গোপন
কিছু? রাস্তা
ঘাটে লুঙ্গি
তুলে প্রস্রাব
করতে বসে
যাওয়া কত
শিশ্নই তো
দেখেছি। দেখেও
না দেখার
ভান করেছি,
চোখ সরিয়ে
নিয়েছি। বাংলাদেশে
কোথাও দেখেছেন
কোনও মা'কে সবার
সামনে স্তন
না ঢেকে
বাচ্চাকে দুধ
খাওয়াতে? বাংলাদেশের
মত একটি
সমাজে যেখানে
মেয়েদের ওড়না
ঠিক বুকে
না থাকলে
একশ পুরুষ
ছুটে আসে
মেয়েটির স্তন
খুবলে খেতে,
যেখানে মা
বাচ্চাকে দুধ
খাওয়াতে ঢেকে
খাওয়াতে হয়
যেন কোনও
ফাঁকে আবার
স্তন দেখা
না যায়-
সেখানে মেয়েদের
বুকের সাথে
নিজেদের শিশ্নের
তুলনা দিয়ে
আমার নারীবাদ
গবেষক নাস্তিক
পুরুষ বন্ধুরা
কোন ধরণের
নারীবাদের চর্চা করেন?
'আগে কাননবালারা
আসতো পতিতালয়
থেকে, এখন
আসে বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে।'
এরকম উক্তির
ব্যাখায় শিক্ষক
ও লেখক
হুমায়ুন আজাদ
যখন বলেন,
'কানন বালা
ছিলেন এক
সময়ের বিখ্যাত
অভিনেত্রী; প্রখ্যাত নায়িকা। আমাদের বাঙলায়
অভিনয়ের যে
ইতিহাস, তাতে
দেখা যায়
পতিতা পল্লী
থেকেই প্রথম
নায়িকাদের মঞ্চে নেয়া হয়েছে। ..বিশ্ববিদ্যালয়
অভিনেত্রী তৈরির স্থান নয়, জ্ঞানী
তৈরির স্থান।
অভিনেত্রী হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের ভোগ্যপণ্য, আমি
চাই না
আমার ছাত্রী
ভোগ্যপণ্য হোক।' তখন শফি হুজুর
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষকের মধ্যে
আমি পার্থক্য
করতে পারি
না। অভিনয়ে
তাঁরা উভয়েই
কোনও শিল্প
খুঁজে পান
না, খুঁজে
পান শুধু
নারীর দেহ,
যাকে তাঁরা
ভোগ্যপণ্য বলেন। প্রগতিশীল শিক্ষক চান
না তাঁর
ছাত্রীরা কেউ
অভিনেত্রী হোক। আচ্ছা, উনি কি
তাঁর ছাত্রদের
অভিনয়ে কোনও
শিল্প খুঁজে
পেয়েছিলেন? নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন। কারণ তিনি
কাননবালাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাওয়া নিয়ে
আপত্তি তুলেছিলেন
কেবল। নারীবাদী
লেখক তসলিমা
নাসরিন'কে
যখন মোল্লারা
এবং প্রথাবিরোধী
লেখক নামে
পরিচিত কেউ
একই সুরে
পতিতা বলে
গালি দেয়
তখন আমি
প্রথাবিরোধী লেখক আর মোল্লাদের মধ্যে
পার্থক্য কীভাবে
করি? শুধু
বুঝে নিই,
প্রথাবিরোধীরাও নারীবিরোধী প্রথাগুলোকে যত্নে লালন
করেন। এদিক
থেকে শফি
হুজুররা আমার
চোখে অনেকটাই
সৎ। ধর্ম
মতে তাঁদের
নাটক, গান,
সিনেমা হারাম,
মেয়েরা তাঁদের
কাছে শস্য
ক্ষেত্রে- এটি তাঁরা স্বীকার করেন।
অথচ প্রগতির
মুখোশে আমাদের
প্রগতিশীলেরা নারীদেরকে শস্য ক্ষেত্র বানিয়ে
রাখেন বটে
কিন্তু অভিনয়
করেন যেন
তাঁরা নারীর
কর্তা নয়
বন্ধু হতে
চান।
আমার লেখাটি পড়ে
যাদের মনে
হচ্ছে, আমি
লেখাটি তাঁদেরকে
উদ্দেশ্য করে
লিখেছি, তাহলে
নিঃসন্দেহে লেখাটি তাঁদের মতো প্রগতির
মুখোশে পুরুষতান্ত্রিক
পুরুষের জন্যই
লেখা।
একসময় আমি
যা জানতাম
না বা
নতুন কিছু
শুনলে হেসে
উঠতাম, 'এও
আবার হয়
নাকি?' 'এটা
তো পাগলের
কাজ' এরকম
ভাব নিতাম। এখন
ভাবলে বুঝি,
তখন আমি
কতটা বোকা
ও বদ্ধ
মানসিকতার ছিলাম। নতুন কি
দেখলে সেটা
নিয়ে ব্যঙ্গ
করা, হেসে
উড়িয়ে দেয়া
মূলত আমার
চিন্তার সীমাবদ্ধতাকেই
প্রকাশ করে। এখন
দেখছি, এধরণের
চিন্তার সীমাবদ্ধতা
সম্পন্ন মানুষগুলোই
নাকি প্রথাবিরোধী,
একেকজন বড়
মুক্তমনা।
লড়াইটা কেবল
বিশ্বাসী আর
অবিশ্বাসীদের মধ্যে নয়। লড়াইটা
নিজের সাথে
নিজেরও।
আমাদের সকলের
মনেই বিভিন্ন
সংস্কার রয়ে
গেছে যা
আমরা ছোট
থেকে দেখে
বড় হয়েছি,
সেসব সংস্কার
থেকে প্রতিনিয়ত
মুক্ত হওয়ার
চেষ্টা করে
যাওয়া, ভুল
শুধরে নিয়ে
প্রতি মুহূর্তে
নিজের মধ্যে
পরিবর্তন আনার
চেষ্টা করা,
নিজেকে ভেঙ্গে
গড়ে প্রতিনিয়ত
শুদ্ধ হওয়ার
লড়াইটা কিন্তু
আমরা অনেকেই
লড়তে চাই
না।
এজন্যই বোধহয়
আমরা অনেক
প্রথার বিরুদ্ধে
গিয়েও শেষ
পর্যন্ত কোনও
না কোনও
প্রথার জালে
আটকে যাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন