--- ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
মিশনারি স্কুলের ছাত্র
হওয়ার সুবাদে
বাইবেলটা প্রথম
শ্রেণি থেকেই
পড়তে হয়েছিল। মাথায়
প্রায় পেরেক
ঠুকে অধ্যাপকরা
গেঁথে দিয়েছিলেন
চিরকুমার সবার
প্রধান নট
জিশুর পড়শিকে
ভালোবাসার স্ক্রিপ্ট। কিন্তু শুধু
জ্ঞান শুনে
আর বই
পড়ে কি
সেবার প্রবৃত্তি
জন্মায়? সমাজের
সব ভালো
কি শুধু
পেনাল কোডের
চোখ রাঙানিতেই
বেঁচে আছে
নাকি? পুরোহিতশ্রেণি
অন্তত তাই
মনে করে। মনে
করে বলেই
আমাদের প্রাত্যহিক
জীবনের প্রত্যেকটা
খুঁটিনাটি বিষয়ে মাথা ঘামায়।
সদা সর্বদা
সতর্ক পাহারার
বেড়াজালে অাবদ্ধ
রাখে মানব
জীবন।
সব ধর্মেই
এই এক
প্রথা।
আমাদের যেমন
মনু, তেমনি
খ্রিস্টান ধর্মের সেন্ট পল।
পল খ্রিস্টান ধর্মকে
শুধু পরিবর্তিত
ও পরিবর্ধিতই
করেননি, তার
সঙ্গে সঙ্গেই
নির্দিষ্ট কিছু আইন-কানুনের ফাঁসে
বেঁধে রাখতে
চেয়েছেন সাধারণ
খ্রিস্টানদের জীবন যৌবন। মুক্তিমার্গের
পথকদের জন্য
সমস্ত রকম
যৌন সংস্পর্শ
নিষিদ্ধ করেছেন। কোরিন্থিয়ানদের
প্রতি লিখিত
চিঠিতে তিনি
পরিষ্কার বলেছেন:
it is well for a man not to touch woman।
প্রচলিত খ্রিস্টধর্মের
প্রথম ও
প্রধান বক্তব্যই
হল: পৃথিবীর
অন্তিম ক্ষণ
সমাগত প্রায়। যে
কটা দিন
বেঁচেছে, বৃথা
বিবাহ বা
যৌনতা নিয়ে
সময় নষ্ট
করলে পরকালের
জন্য রোজগার
হবে কবে?
শেষ দিনে
জবাব দেওয়ার
সময় কি
বলবে? তার
চেয়ে যতটা
পার কৃত
কুকর্মের প্রায়শ্চিত্ত
করে সময়
কাটাও।
জন্নত প্রাপ্তির
পথ সুগম
করতে হবে
তো।
বস্তুতপক্ষে, পল বিবাহ
নামক প্রতিষ্ঠানটাই
লোপাট করতে
চেয়েছিলেন।
প্রেম, ভালোবাসা
প্রভৃতি তাঁর
কথিত ঈশ্বরের
প্রতি নিবেদিত
হল তো
ঠিক নতুবা
এগুলি মূল্যহীন। পলের
কাছে বিবাহ
ছিল যৌনাকাঙ্ক্ষা
নিবৃত্তির উপায় মাত্র। বিবাহ
একমাত্র তাদের
জন্যই নির্দিষ্ট
যারা শরীরের
কামোত্তেজনা দমনে অক্ষম।(1 Cor 7:1-9) বিবাহ মানুষের
ঈশ্বরের প্রতি
আত্মসমর্পণের পথে অন্তরায় মাত্র।
এমনকি বিবাহিতদেরও
তিনি আধ্যাত্মিক
চেতনা উন্নতির
জন্য যৌনতায়
লিপ্ত না
হওয়ার নির্দেশ
দিয়েছেন।
(1 Cor 7:25-40) পলের চোখে তিনিই
আদর্শ পুরুষ
যিনি নিজের
কামকে ক্রুশবিদ্ধ
করে আধ্যাত্মিকতার
পথে প্রাগ্রসর
কারণ যৌনতা
ও আধ্যাত্মিকতা
একসাথে সমাপন
অসম্ভব।
অন্তরের ডাক
শুনে ঈশ্বর
পুত্র প্রদত্ত
পথে আগুয়ান
হতে গেলে
প্রথম শর্ত
শরীরের ডাক
উপেক্ষা।
(Gal 5:16-25)
ব্রহ্মচর্যের প্রথা প্রাচীন
কাল থেকেই
চলে আসছে। কিন্তু
তা বলে
যৌনতা পাপ
বলে গণ্য
হয়নি আগে
কখনও।
খ্রিস্টান ধর্মের অগ্রদূতরূপী ইহুদি ধর্মে
অবিবাহিত যৌনতার
বিরুদ্ধে বিবিধ
শাস্তির বিধান
থাকলেও বিবাহিতদের
যৌন সম্পর্ককে
উৎসাহিত করা
হতো।
এমনকি সপ্তাহের
অন্য কোনো
দিন না
হোক, সাবাথের
দিন বিবাহিত
নারী পুরুষের
মিলন ছিল
শাস্ত্রাজ্ঞা। (David Biale p.33) কিন্তু
খ্রিস্টধর্মের প্রাথমিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকারী যাজকরা
অবিবাহিত যৌনতা
তো দূর
অস্ত, বিবাহিতদের
যৌনতাও নিষিদ্ধ
করলেন চার্চের
প্রার্থনার সময় ও বিভিন্ন শুভদিনে। ঈস্টারের
সময় তো
টানা সাত-আট দিন
যৌনতার চিন্তা
মনে আনাও
পাপ বলে
গণ্য করা
হয়।
(Derrick Sherwin Bailey p.133) সমস্ত চিন্তার উৎস
পলের সেই
চেতাবনি: ধর্ম
ও যৌনতা
একত্রে বসবাসে
অক্ষম।
আসলে পল গড়ে
তুলতে চেয়েছিলেন
এমন এক
সমাজ ব্যবস্থা,
যেখানে প্রত্যেকটি
অবিবাহিত নারী
ও পুরুষ
শুধু নিজেদের
কৃতকর্মর জন্য
অনুশোচনা করবে। তৎকালীন
কালখণ্ডে শুধু
ইহুদুদের মধ্যেই
নয়, সমগ্র
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রচলিত প্রথার বিরোধে
গিয়ে পলের
এই চিন্তা। ইহুদি
মানসিকতায় নারী ছিল পুরুষের সম্পত্তি। নারীর
নিজস্ব চিন্তাভাবনার
কোনো মূল্য
ছিল না
তাদের কাছে। নারী
নিজের ইচ্ছেতে
সন্ন্যাসিনী হয়ে পুরুষকে তার প্রাপ্য
যৌনসুখ থেকে
বঞ্চিত করবে
- এ ছিল
এক কল্পনাতীত
ব্যাপার।
বিপরীত পক্ষে
সিরিয়া অঞ্চলে
বহু প্রাচীনকাল
থেকেই নারীরা
সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে মঠে বাস
করতেন পুরুষ-সংস্পর্শরহিত হয়ে। সিরীয়
পল নিজের
আঞ্চলিক প্রথা
আমদানি করলেন
খ্রিস্টান জগতে। সৃষ্টি হল
নান এবং
সিস্টারদের। (Marina Warner p32) গড়ে
উঠল এক
কৌমার্য সংস্কৃতি
যেখানে পুরোহিত,
প্রচারক, চিন্তাবিদ্
দের যোগ্যতা
বিচার হয়েছে
যৌন-সংস্পর্শহীনতার
নিক্তিতে।
আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী হয়েছেন
কৌমার্যব্রত পালনকারীরা।(Joseph
Selling p.25)
আজ থেকে প্রায়
চারশো বছর
আগে প্রথম
এই অবস্থানের
প্রতিবাদ করেন
মার্টিন লুথার। লুথার,
কেলভিন প্রমুখরা
বলেন: Sex is medicine for the soul, as
important to life as eating and drinking।
(TG Tappert p.274) এঁরা প্রজননহীন যৌনতাকেও
সমর্থন করলেন। এ
সমর্থন প্রধানত
এসেছিল ক্যাথলিক
চার্চের বিরোধিতায়
প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের প্রতিষ্ঠার খাতিরে।
দ্বিতীয় কারণ
ছিল সমাজের
বুকে বেশ্যাবৃত্তির
ব্যাপক প্রসার
রোধের প্রচেষ্টা। কিন্তু
লুথার প্রমুখরাও
কৌমার্য সংস্কারের
মোহ কাটাতে
পারেননি; তাঁরাও
আধ্যাত্মিক জগতে অবিবাহিতদের উচ্চ স্থান
প্রদান করেছিলেন।...
কুমার হোক কিংবা
কুমারী, পল
সবাইকেই ধর্ম
প্রচারের অধিকার
দিয়েছিলেন।
ডেকনেস ফিবিকে
তাঁর প্রধান
সহকারিণী ঘোষণা
করেছিলেন।
কিন্তু আজ
এই নারীমুক্তির
যুগেও কেন
ক্যাথলিক চার্চে
মহিলারা ব্রাত্য?
কেন মাত্র
চল্লিশ বছর
আগেও পোপ
ষষ্ঠ পল
ঘোষণা করেছিলেন:
মহিলাদের পক্ষে
যাজক হওয়া
সম্ভব নয়
কারণ মসীহা
ছিলেন একজন
পুরুষ, যাঁর
প্রকৃত শিক্ষা
কখনোই একজন
নারীর পক্ষে
আত্মস্থ করা
সম্ভব নয়। (H Pagels p.83)
আসলে এ হল পুরুষতন্ত্রের কায়েমি
স্বার্থ তথা
কর্তৃত্ব বজায়
রাখার খেলা। সিরীয়
পলের ন্যায়
উদারমনস্ক ছিলেন না ইহুদি পিটার। সেই
পিটার, যিনি
the rock upon which Christianity is established বলে
খ্যাত।
পিটারের পক্ষে
নারীকে সন্মাননার
আসন প্রদান
তথা তার
অনুগামী হওয়া
ছিল কল্পনাতীত। বহু
আগে থেকেই
ইহুদি জগতে
নারীকে চিত্রিত
করা হতো
পুরুষের ব্যবহার্য
ও গোরু-ছাগলের সমগোত্রের
গৃহপালিত রূপে। ক্ষমতালোভী
পিটার খ্রিস্টান
জগতে বয়ে
আনলেন তাঁর
ইহুদি উত্তরাধিকার। আর
তাঁর অনুগামীরা
পরবর্তীতে মহানন্দে রচনা করলেন নারী
অবমাননার সনদ। প্রবন্ধের
চলমানতায় প্রকাশ
পাবে, কেমনভাবে
পিটার বারংবার
বিরোধিতা করেছেন
স্বয়ং মসীহার
আদেশের।
পিটারপন্থীদের নারী-বিরোধী
অবস্থানের প্রধান হাতিয়ার Old
Testament এর Genesis অধ্যায়।
সেই বহুশ্রুত
ঈভের জ্ঞানবৃক্ষের
ফলভক্ষণের ঘটনাবলী, যার নিরিখে ইহুদি
ও খ্রিস্টান
সমাজ চিরকাল
নারীকে প্রতারকের
তকমা দিয়েছে। যে
ঘটনার সাপেক্ষে
গ্রেগরি নাজিয়াজেনের
মত ধর্মতাত্ত্বিক
ঈভকে দোষারোপ
করেছেন: beguiling (Adam) by means of
pleasure এর অপরাধে।
(Christian literature p.257)
সরীসৃপের কুপরামর্শে ঈভ
নিষিদ্ধ ফল
ভক্ষণ করলেন। শুধু
নিজেই খেলেন
না, আদমকেও
খাওয়ালেন।
ফলস্বরূপ তাঁদের
জ্ঞাননেত্র উন্মোচিত হল; তাঁরা অনুভব
করলেন যে
তাঁরা নগ্ন। ঈশ্বরের
আগমনের পদধ্বনি
শুনে লজ্জা
অনুভব করলেন। OT- র ঈশ্বর আর যাই
হোন না
কেন, ক্ষমাশীল
নন।
তাঁর প্রতিশোধ
স্পৃহা OT-র ছত্রেছত্রে লিপিবদ্ধ।
তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণেও তিনি অভিশাপ বর্ষণ
করে নিজের
ক্ষমতা জাহির
করেন।
সেখানে এ
তো রীতিমতো
তাঁর বিরুদ্ধে
জেহাদ ঘোষণা। তাঁর
কথা অমান্য
করে ঈভ
নিষিদ্ধ ফল
ভক্ষণ করেছে
অনুভব করা
মাত্র তিনি
অভিশাপের ঝাঁপি
খুলে বসলেন। ঈভকে
শাস্তি দিলেন:
I will greatly multiply thy sorrow, and thy conception; in sorrow thou shalt
bring forth children; and thy desire shall be to the husband, and he shall rule
over thee. (Gen 1:26-7; KJV)
নারীকে অন্তঃপুরবাসিনী ক্লীবসম
করে রাখা
থেকে শুরু
করে পুরুষের
নারীকে যথেচ্ছ
ব্যবহার ও
ভোগের উপকরণমাত্রে
পর্যবসিত করেছিল
রোমান চার্চ
- শুধুমাত্র এই অভিশাপটিকে দৃষ্টান্ত করে। খ্রিস্টান
যাজকরা নারীজাতিকে
কতটা নিকৃষ্ট
মনে করতেন
তার হাতে
গরম নমুনা
রয়েছে তৃতীয়
শতকের যাজক
Tertullian এর রচনায়: "কঠোর যন্ত্রণার মধ্যে
সন্তানের জন্মদান
কর তোমরা,
তোমাদের স্বামীরা
তোমাদের ওপর
প্রভুত্ব করেন। হে
নারী, তুমি
কি জানো
না যে
তুমিও একজন
ঈভ? এই
লিঙ্গের প্রতি
ঈশ্বরের অভিশাপ
আজও সমরূপে
কার্যকর।
তোমরা নরকের
দ্বার।
তোমাদের পাপের
তথা অভিশাপের
ফলস্বরূপই স্বয়ং ঈশ্বরের পুত্রকেও মৃত্যুবরণ
করতে হয়েছে।" (On the dresses of Women)
মধ্যযুগের ইউরোপে ইনক্যুইজিশন
নামক ভয়ানক
প্রথার যূপকাষ্ঠে
বলি হয়েছে
কয়েক লাখ
নিরাপরাধ 'ডাইনি' নারী। বিপরীতপক্ষে
খ্রিস্টান জগতের সমগ্র চিন্তাশীলতা আবর্তিত
হয়েছে পুরুষের
মোক্ষ লাভের
উপায় নির্ধারণে। নারী
তো যৌনতা
নামক কুব্যধিগ্রস্ত
যন্ত্র মাত্র। তার
কোনো অধিকারই
নেই মোক্ষলাভে।
নারীত্বের অবমাননা ও
অবদমনের ইহুদি
উত্তরাধিকার রোমান চার্চ বহন করছে
প্রায় দু
হাজার বছর
ধরে।
রিফরমেশানের সময়কাল থেকে শুরু হয়
এর বিরোধিতা,
যার ফলশ্রুতি
আজকের পাশ্চাত্য
নারীমুক্তি আন্দোলন। তা বলে
পাঠক ভাববেন
না নারীকে
সম্মান তথা
শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা প্রদানের প্রচেষ্টা আধুনিক
আবিষ্কার।
দু হাজার
বছর অাগেই
মসীহা সূত্রপাত
ঘটিয়েছিলেন এই বিদ্বিষ্ট মনোভাবের পরিপন্থী
আন্দোলনের।
স্বীকৃতি দিতে
চেয়েছিলেন নারীর কর্তৃত্বকে।
কিন্তু ইতিহাস চিরকালই
রচিত হয়েছে
বিজয়ীর অসির
ডগায় পরাজিতের
শোণিতকে মসী
করে।
সম্রাট কনস্টানটাইনের
সভাপতিত্বে নিসা-র (Nicaea) কাউন্সিলে 325 খ্রি.
সংঘটিত হল
প্রথম খ্রিস্টান
অধিবেশন।
প্রায় দেড়শো
থেকে দুশো
সুসমাচারের মধ্যে পিটারপন্থী যাজকদের হাতে
মান্যতা লাভ
করল মোটে
চারটি, তাও
পরিমার্জিত ও সম্পাদিত রূপে।
মার্ক, ম্যাথিউ,
ল্যুক ও
জন গৃহীত
হল আদর্শ
পুরুষ নির্মাণের
আধার রূপে। দ্বিতীয়
শতাব্দীর মধ্যভাগ
থেকেই কৌমার্য-পরিপন্থী সুসমাচারগুলিকে
ভ্রান্ত ও
বিকৃতরুচি বলে প্রোপাগান্ডা চলছিল।
রাজানুগ্রহ লাভের ফলে এবার শক্তিশালী
হয়ে উঠল
কৌমার্যপন্থীরা। প্রাগুক্ত চারটি সম্পাদিত
গ্রন্থা ও
আরও প্রায়
তেইশটি লেখনি
নিয়ে সংকলিত
হল New Testament বা নতুন
সুসমাচার।
সমগ্র রোমান
সাম্রাজ্য জুড়ে পুড়িয়ে ফেলা হল
শত শত
বিরোধি চিন্তাভাবনার
শরিক গ্রন্থগুলিকে। গড়ে
উঠল এমন
এক প্রাতিষ্ঠানিক
খ্রিস্টধর্ম যেখানে, Christ's Gospels (were replaced) with a Gospel about
Christ। (Holger Kersten p.28)
নারীকে সম্মান
ও শ্রেষ্ঠত্বর
যে আসনে
জিশু প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন তা
মুছে ফেলে
তাঁকে চিত্রিত
করা হল
চিরকুমার ও
নারীবিমুখ এক সত্ত্বা রূপে।
আমরা অগ্রসর
হব মহামানব
কথিত বাণী
ও আচরিত
ধর্মানুষ্ঠানের বিশ্লেষণে। কিন্তু তার
আগে আমাদের
জানতে হবে
মসীহার জন্মবৃত্তান্ত। (ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন