শুক্রবার, আগস্ট ০১, ২০১৪

ইদের চাঁদ, চাঁদের ইদ

অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ খুশির ইদ। ইদের চাঁদ দেখা এবং জশন বানানো শুরু হয়ে গেছে নিশ্চয়। চান্দ্র গণনায় ইদের দিন প্রতি বছর পালিত হয়। আমি ইসলাম ধর্মের অনেক কিছুই জানি না। জানার উপায় কী ? বাংলাদেশে বাস করেন এমন একজন মুসলিম বন্ধুকে বেছে নিলাম জানবার জন্য। টানা এক মাস তিনি নির্জলা রোজা রেখেছেন। ইফতার পার্টিতে আনন্দ করেছেন। ধর্মপ্রাণা মানুষ তিনি। তাঁকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম – ইদের চাঁদ দেখার বিষয়ে বিস্তারাত জানতে চাই। তুমি আমাকে জানাও। সে বলেছিল – চাঁদ তো চাঁদই। তার মানে উত্তর পেলাম না। অনুসন্ধান চালালাম। যা জানলাম তার সবটাই সকলের সঙ্গে শেয়ার করলাম।

হাজার বছর ধরে মুসলিমরা এ পৃথিবীতে আছেন। এতো বিশাল সময়ে চাঁদ দেখা নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। কেন হয়নি ? কারণ মুসলিমরা চাঁদের হিসাবে বার গুনেছে। সূর্যের হিসাবে বার গণনা করেনি। মনে করুন আজকে সোমবার, আজ রাত আসার সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম পণ্ডিতগণ একে মঙ্গলবার বলেছেন। কিন্তু সূর্যের হিসাবে আমরা রাত ১২টা থেকে বার গণনা করে থাকি। সেজন্য চাঁদের বার এবং সূর্যের বার একই নয়। ধরুন, মরোক্কতে রাত আসার সঙ্গে সঙ্গে মাসের প্রথম চন্দ্র দেখা গেল। তার মানে সেই রাত থেকেই নতুন মাস গণনা করা শুরু হয়ে গেছে, ঠিক তেমনই ভারতেও যদি চাঁদ দেখা যায় তাহলে সেখানেও প্রথম দিন গণনা শুরু হয়ে গিয়েছে। ধরুন সেই নতুন মাসটি রমজান, তাহলে ভারতের রাত হল রমজান মাস, ঠিক তেমনই মরক্কোর মাস হল রমজান মাস, কিন্তু সূর্যের হিসাবে তারা একই দিন নয়। এমনকি এদের মধ্যে সূর্যের হিসাবে ০ দিন কিংবা ১ দিন কিংবা ২ দিনের মতো পার্থক্যও হতে পারে। কিন্তু চাঁদের হিসাবে কোনো পার্থক্য নেই। ভাবুন সেই সময়ের খলিফা সবাইকে ১ রমজানে ১০টাকা করে বকশিশ দেবেন। তার মানে ভারতে যখন ১ রমজান আসবে তখন সেখান বকশিশ দেওয়া শুরু হবে। যখন মরোক্কোতে আসবে তখন সেখানেও দেওয়া শুরু হবে। এখানে আইনস্টাইনের তত্ত্বের মতো দুটো কাঠামো। প্রথম কাঠামো চাঁদ, দ্বিতীয় কাঠামো সূর্য। প্রথম কাঠামোর দৃষ্টিতে যেটি ১ তারিখ, সেটি দ্বিতীয় কাঠামোর দৃষ্টিতে একই তারিখ নাও হতে পারে। কোনো সমস্যাই হবে না, যদি আমরা একটি কাঠামো ফল করি।
চলুন আমরা দেখে নেই, মুসলিমগণ কোন্ কাঠামো মান্য করে থাকে -- “তোমার নিকট তারা জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদের বিষয়ে। বলে দাও যে এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ এবং হজ্বের সময় ঠিক করার মাধ্যম” (সুরা বাকারা আয়াত ১৮৯)। হে আল্লাহ ! আপনি আমাদের জন্য এই চাঁদকে সৌভাগ্য ও ইমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে উদিত করুন। আল্লাহই আমার ও তোমার রব।(জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৫১)। তোমরা (রমজানের) চাঁদ দেখে রোজা শুরু করবে এবং (ইদের) চাঁদ দেখেই রোজা ছাড়বে। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয় (এবং চাঁদ দেখা না যায়) তাহলে মাসের ৩০ দিন পূর্ণ করে। অর্থাৎ আকাশ পরিচ্ছন্ন না থাকার কারণে চাঁদ দেখা না গেলে শাবান মাসের ৩০ দিন পূর্ণ করতে রমজানের রোজা রাখা শুরু করবে।(সহিহ বুখারি ১/২৫৬, হাদিস : ১৯০৬)। -- এই দুই হাদিস থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, মুসলিমরা সকলে  চাঁদের কাঠামোই অনুসরণ করবে। সূর্যের কাঠামোতে নয়, এমনকি সূর্যের কাঠামোতে এটা কোন্ তারিখ সেটাও বিবেচ্য বিষয় নয়। মুসলিমগণ হিসাব করবে এভাবে, প্রথম চাঁদ এক তারিখ, ১৪,১৫,১৬ তারিখে পূর্ণিমা, আবার শেষের দিকে আমাবস্যা আসবে। এর কোনো ব্যাতিক্রম হবে না।
চাঁদ দেখে ঈদ করতে হবে এব্যাপারে মুসলিম সম্প্রদায়গণ সবাই একমত। কারণ উপরের বুখারি শরিফের হাদিস থেকে বোঝা যায়, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে ৩০ দিন পূর্ণ করতে হবে। এখানে হিসাবনিকাশের বালাই রাখা হয়নি। মানে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়াটাও আল্লাহ পাকের ইচ্ছার অধীন। এখানের মধ্যেও আমাদের ফয়সালা নিহিত আছে। তাই চাঁদ দেখাটা অত্যন্ত জরুরি।
এখন প্রশ্ন হল কতজন মানুষকে চাঁদ দেখতে হবে। তার উত্তর আছে এই হাদিসে -- আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে এমন এক ব্যক্তির চাঁদ দেখাই যথেষ্ট, যার দ্বীনদার হওয়া প্রমাণিত অথবা বাহ্যিকভাবে দ্বীনদার হিসাবে পরিচিত।(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৪০)। লক্ষ্যণীয়, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে কেবল একজনের সাক্ষ্যই গ্রহণযোগ্য। এখন প্রশ্ন হল সারা পৃথিবীতে দেখতে হবে, নাকি এলাকাভিত্তিক দেখতে হবে ? সৌদির চাঁদ দেখে ভারতে ইদ করার প্রশ্নই ওঠে না, কেন-না ভারত ভৌগোলিক দিক দিয়ে সৌদির পূর্বদিকে। মনে রাখতে হবে মুসলিমগণ চাঁদের কাঠামো অনুসরণ করেন, সূর্যের নয়। চাঁদ উঠলেই চাঁদের দিন গননা শুরু হবে, না উঠলে আগের গননায় থাকবেন। যেখানে নতুন মাস আসেনি সেখানে নতুন মাস কীভাবে নিয়ে আসবেন ? কথাটাকে একটু সূর্যের কাঠামোতে বলি -- সূর্যই উঠেনি, আপনি দাবি করছেন সকাল হয়ে গেছে। নতুন মাসের চাঁদই উঠেনি, আপনি দাবি করছেন নতুন মাস শুরু হয়ে গিয়েছে। আসলে এটি ভুল দাবি বলেই মনে করেন সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়। এলাকাভিত্তিক চাঁদ দেখতে হবে সেটার আরেকটা প্রমাণ হল, হাদিস দুটিতে “আকাশ মেঘাচ্ছন্ন” বলে শব্দ ব্যাবহার করা হয়েছে। এবং এই মেঘাচ্ছন্নের জন্য বুখারি শরিফের হাদিসটাতে ৩০ দিন পূর্ণ করতে বলা হয়েছে।
এমন কখনো হতেই পারে না যেখানে শুনবেন কোথাও শুনেছেন যে সারা পৃথিবীর আকাশ একসঙ্গে মেঘাচ্ছন্ন থাকে ? এক সঙ্গে কি সমগ্র পৃথিবীর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে এমন কোনো প্রমাণ কি কারোর পক্ষে সম্ভব ? কোনোদিনই সম্ভব নয়। যদি কোনোদিন সম্ভবও হয়, পৃথিবীতে ধ্বংস আসন্ন।
অপর এক কাহিনিতে আমরা যা দেখছি -- কুরাইব তাবেই বলেছেন, যে হারিসের কন্যা (লুবা-বা) তাকে শাম প্রদেশে সম্রাট মুয়াবিয়ার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। অতঃপর আমি শামে এসে তাঁর প্রয়োজন সমাপন করলাম এবং আমার শামে থাকা অবস্থায় রমজানের নতুন চাঁদ উদয় হল এবং আমি বৃহস্পতিবারের দিবাগত সন্ধ্যায় চাঁদ দেখলাম, তারপর মদিনা এলাম; অতঃপর আমাকে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) জিজ্ঞেসা করলেন যে, তোমরা (রমজানের) চাঁদ কবে দেখেছ ? আমি বললাম, জুম্মা রাত্রিতে ; পুনরায় বললেন যে, তুমি নিজে দেখেছ ? আমি বললাম, জি হ্যাঁ এবং অন্যান্য লোকেও দেখেছে এবং মুয়াবিয়া ও শামবাসীরা রোজা রেখেছেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন, আমরা কিন্তু শুক্রবারের দিবাগত সন্ধ্যায় চাঁদ দেখেছি, অতএব আমরা রোজা রাখতেই থাকব। ৩০-এ পর্যন্ত কিংবা ৩০শের পূর্বে ২৯শে চাঁদ দেখা পর্যন্ত। আমি বললাম, আপনি কি মুয়াবিয়ার চাঁদ দেখা ও তাঁর রোজা রাখার উপর নির্ভর করে রোজা ও ঈদ করবেন না ? ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন, না ; এটাই আমাদেরকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আদেশ দিয়েছেন যে, আমরা আপন দেশের লোকের চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করব ; অন্যান্য দূর দেশবাসীদের চাঁদ দেখাকে আমরা যথেষ্ট মান্য করব না।”(মুসলিম শরিফ)
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা রমজান মাসের একদিন বা দুই দিন আগে থেকে রোজা রেখো না। তবে কারও যদি আগে থেকেই কোনো নির্দিষ্ট দিন রোজা রাখার অভ্যাস থাকে এবং ঘটনাক্রমে সে দিনটি ২৯ ও ৩০ শাবান হয় তাহলে সে ওইদিন রোজা রাখতে পারে। (সহিহ বুখারি ১/২৫৬, হাদিস : ১৯১৪)
আয়েশা (রা) বলেন, “মহম্মোদ (সা) শাবানের মাসের দিন গণনার ক্ষেত্রে অতিশয় সাবধানতা অবলম্বন করতেন এবং তিনি যখনই নতুন চাঁদ দেখতে পেতেন তখন রোযা শুরু করতেন। আর যদি নতুন চাঁদ না দেখতে পেতেন তাহলে শাবান মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ করে রোযা রাখতেন”। (আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩১৮)। অপরদিকে “ওই দিন রোজা আরম্ভ হবে যেদিন সকলে রোজা রাখবে, রোজা ভাঙতে হবে, ওই দিন যেদিন সবাই রোজা ভাঙে। আর কুরবানি করতে হবে ওই দিন যেদিন সকলে কুরবানি করে”[তিরমিজি, হাদিস নং ৬৯৭]।এই হাদিস কি উপরের হাদিস গুলির কন্ট্রাডিকশনে যায় ? যায় না। কারণ এলাকা ভিত্তিক হলে সবাই একই সাথে রোজা রাখবে, রোজা ভাঙবে করবে। এলাকাভিত্তিক রোজা করার আরেকটি প্রমাণ হল নামাজ। মুসলিমগণ এলাকাভিত্তিকই নামাজ পড়েন, সারা পৃথিবী একসঙ্গে নয়। এবং দেখুন এটা এলাকাভিত্তিক না-হলে কীভাবে মানবেন, সব এলাকায় একই সঙ্গে সকাল হয় না। নির্দেশ দেখুন --“আর পানাহার কর যতক্ষণ-না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোজা পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত” (বাকারাঃ ১৮৭)।

এখন প্রশ্ন হল -- (১) এমন কোনো হাদিস আছে কী যাতে বলা হয়েছে সৌদি আরবকে দেখে রোজা এবং ঈদ করতে হবে ? (২) এমন কোনো প্রমাণ আছে যেখানে রাসুল সাঃ অ্যাস্ট্রোলজিস্টদের কিংবা প্রাচীন কোনো দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সহযোগিতা নিয়ে ঈদ করেছেন ? এখানে বিবেচ্য যে যারা পিরামিড বানিয়ে ছিল, তারাও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান রাখত। রাসুল সাঃ একজন ওইরকম অ্যাস্ট্রোলজিস্ট কিংবা দুরবীন জাতীয় কিছু প্রাচীন যন্ত্র যোগাড় করতে পারার ক্ষমতা খুব সম্ভবত রাখতেন। (৩) কোনো সাহাবি কিংবা তাবেয়িন, আরবের বাইরে থেকে মক্কায় যখন ইদ সেই খবর কোনোক্রমে জেনে সে অনুযায়ী ইদ করেছেন কি না ?
দেখা যায় যদি সারা পৃথিবীতে সূর্যের হিসাবে একই সঙ্গে ইদ করে, তাহলে যখন হাওয়াইয়ের মানুষ যে দিন ইদ করছে, ফিজির মানুষ তার আগের দিন ইদ করবে। কারণ, হাওয়াইয়ে যখন সোমবার, ফিজিতে তখন মঙ্গলবার। তাইলে একসঙ্গে ইদ কীভাবে সম্ভব ? হাওয়ায়ের আকাশে যে সূর্য একই সূর্য একই সময় ফিজিতে কিন্তু ফিজি একদিন আগে নিজেদের ধরে আর হাওয়াই একদিন পরে ধরে। ক্যাথলিকদের ক্রিসমাস আর অর্থডক্সদের ক্রিসমাস একই সঙ্গে হয় না। হিন্দুদের দুর্গাপুজোও সারা বিশ্বে একই নিয়মনীতি মেনে হয় না।
সবাই ইদ-উৎসব পালন করুন। কোনো উৎসব কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের কুক্ষিগত উৎসব না-হয়ে সব ধর্মসম্প্রদায়ের উৎসব হয়ে উঠুক। ধর্ম থাক ধর্মাবলম্বীদের কাছে, উৎসব হোক সবার।

 


কোন মন্তব্য নেই: