লিখেছেন : মনোবর
সম্প্রতি ব্লগে সরস্বতী সম্বন্ধে অনির্বাণ বাবুর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বহু তথ্য সহযোগে তিনি বিষয়টি আলোচনা করেছেন। আগামীকাল প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে বাংলার ঘরে ঘরে দেবী সরস্বতী পুজিত হবেন। আমার এই লেখা অনির্বাণ বাবুর লেখার সমালোচনা নয় বরং আমার যা মনে হয় সেই চিন্তাধারা আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করবার লক্ষ্যেই লিখছি। প্রথমে দেবী সরস্বতীর প্রতীকি মূর্তিটির একটি সাধারণ ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করে আলোচনা শুরু করা যাক।
সম্প্রতি ব্লগে সরস্বতী সম্বন্ধে অনির্বাণ বাবুর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বহু তথ্য সহযোগে তিনি বিষয়টি আলোচনা করেছেন। আগামীকাল প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে বাংলার ঘরে ঘরে দেবী সরস্বতী পুজিত হবেন। আমার এই লেখা অনির্বাণ বাবুর লেখার সমালোচনা নয় বরং আমার যা মনে হয় সেই চিন্তাধারা আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করবার লক্ষ্যেই লিখছি। প্রথমে দেবী সরস্বতীর প্রতীকি মূর্তিটির একটি সাধারণ ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করে আলোচনা শুরু করা যাক।
সরস্বতী হলেন ব্রহ্মার সৃজন শক্তি। সংস্কৃতে এর মানে (এসেন্স
অব দ্য সেলফ) আপন সত্তার সর্বাপেক্ষা
গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক গুণাবলী। তার চারটি হাত। এক হাতে গোলাপ, এক হাতে বই এ দুটি হল
পেছনের হাত। সামনের দু হাতে তিনি বীণা বাজাচ্ছেন। তার পরিধানে সাদা বস্ত্র যা
শুদ্ধ জ্ঞানের প্রতীক। বীণা বাদন জাগতিক কর্ম আর পদ্মধারণ আধ্যাত্মিক জগতের প্রতীক
বলে বলা হয়েছে। পদ্ম পরম সত্তার প্রতীক। এর দ্বারা মনোযোগ,ধ্যান সমাধি এবং পরম
সত্তার সংগে একাত্মতা বোঝায়। হংস বাহন দ্বারা ভাল মন্দের প্রভেদ কারী জ্ঞান শক্তি
বোঝায়। তার কাছেই একটি ময়ুর থাকলেও তিনি হংসকেই বাহন করেছেন। ময়ুরের মুড আবহাওয়ার
সংগে বদলায়। তাই তিনি ময়ুর পছন্দ করেন নি বলে বলা হয়েছে।
এবার পুরানে যাওয়া যাক। মৎস্য পুরান মতে বিশ্ব সৃষ্টির
জন্য ধ্যানে বসে ব্রহ্মা দুভাগে ভাগ হলেন পুরুষ এবং নারী। আপন সত্তার নারী অংশকে
তিনি কামনা করে তার সংগে মিলিত হলেন। জন্ম হল মনুর আর মনু জগৎ সৃষ্টি করলেন।
সৃষ্টির জন্য ব্রহ্মা বাক্য উচ্চারণ করতেই তার জিহ্বাতে
সরস্বতীর জন্ম হল। ব্রহ্মার কপাল হতে সরস্বতী নির্গত হতেই তার সৌন্দর্য্যে মুদ্ধ
হয়ে ব্রহ্মা তাকে কামনা করলেন যদিও যুক্তি অনুসারে সরস্বতী তার কন্যা। সরস্বতী
ব্রহ্মার থেকে দূরে পালাতে চাইলেন কিন্তু যে দিকেই তিনি ধাবিত হলেন সেই দিকেই
ব্রহ্মার একটি করে মস্তক গজাল। এমন কি উপর দিকেও একটি মাথা গজাল। এবং দৈব আপত্তি
গ্রাহ্য না করে ব্রহ্মা সরস্বতীকে বিবাহ করলেন। এতে বিষ্ণু এবং শিব ক্রুদ্ধ হয়ে
অভিশাপ দিলেন যে এর ফলে ব্রহ্মা জগতে পুজা পাবেন না। যদিও সরস্বতী ঐতিহ্যগত ভাবেই
জ্ঞান এবং বিদ্যার দেবী হিসাবে পুজা পান।
স্কন্দপুরানে আবার অন্য গল্প। এখানে সরস্বতীর উৎস হলেন
বিষ্ণু এনং সরস্বতীর অবস্থান হল বিষ্ণুর জিহ্বাতে।
নারদপুরাণে বলা হয়েছে চরম অবস্থায় রাধা এবং কৃষ্ণ একই
দেহে বিরাজ করেন এবং তাদের মধ্যে কোন ভেদ নেই। এই অবস্থায় রাধা হতে পাঁচটি রূপ
আবির্ভূত হয় তারা হলেন লক্ষী, দূর্গা, সাবিত্রী, সরস্বতী,এবং রাধার নিজেরই আর একটি
রূপ।
কারো কারো মতে শক্তির রূপভেদ পাঁচটি নয় আটটি যথাঃ
শ্রীদেবী, ভূদেবী, প্রীতি, কৃতি, শান্তি, তান্তি, এবং পুস্তি।
বামন পুরাণে বিশ্বামিত্র এবং বশিষ্ঠ কোন্দলের গল্প
রয়েছে। বশিষ্ঠ তার আশ্রমে একটি প্রতিষ্ঠিত
লিঙ্গ এবং সরস্বতীর একটি বিরাট মূর্তির পুজা করতেন। বশিষ্ঠর ওখানে এভাবে পুজা করা
বিশ্বামিত্রের মনে ক্রোধ উৎপন্ন করায় তিনি নদী সরস্বতীকে বলেন বশিষ্ঠ কে ধরে তার
কাছে নিয়ে আসতে যাতে উপযুক্ত সাজা টা তিনি বসে বসেই দিতে পারেন। সরস্বতী বিশ্বামিত্রের
ক্ষমতা জানতেন। তাই তিনি বিশ্বামিত্রের কাছে বশিষ্ঠকে নিয়ে যেই হাজির হলেন অমনি
বিশ্বামিত্র তাকে মানে বশিষ্ঠকে হত্যার জন্য একটা অস্ত্র আনতে গেলেন এই সময়ে
সরস্বতী যিনি ছিলেন নদী তিনি নিজের জলধারার মাঝে বশিষ্ঠকে লুকিয়ে রাখলেন। বিশ্বামিত্র
রেগে গিয়ে অভিশাপ দিলেন সরস্বতী এর পর হবেন রক্ত নদী আর যত সব অসুর রাক্ষস তা পান
করে স্ফূর্তি করবে। তাই ফলে গেল। শেষে একদল সাধুর প্রার্থনায় সৃষ্টি হল প্রয়াগে
গঙ্গা,যমুনা সরস্বতীর সঙ্গম আর যত দুরাত্মা সেখানে স্নান করল সবাই পবিত্রাত্মা হয়ে
গেল। এটা হল বামনপুরাণের আখ্যান।
মহাভারতের শল্যপর্বে উল্লেখ আছে যে দধীচি একবার এক
অপ্সরা কে অবলোকন করে উত্তেজিত হয়ে ধাতুস্খলন করে ফেলেন। সেই ধাতু সরস্বতী নদীতে
পতিত হয় আর যতনে তা ধারণ করে সরস্বতী একটি শিশুর জন্ম দেন।
মহাভারতের আদিপর্বেও শান্তনু যিনি গঙ্গাকে বিবাহ করেছিলেন
তার এক পূর্বপুরুষ সরস্বতীর পুত্র ছিলেন বলে বলা হয়েছে এক্ষেত্রে পিতা ছিলেন এক
মুনি।
অতএব আমরা দেখলাম নদীরূপে, ব্রহ্মার কন্যারূপে, বিষ্ণুর
জিহ্বায় অবস্থান কারী রূপে ইত্যাদি নানা ভাবে আদি কাহিনীগুলিতে বার বার সরস্বতী
এসে হাজির হয়েছেন। সরস্বতী শব্দের যা অর্থ তা নদীর সঙ্গে মিল খায়না। যদিও সেইকালে
নদীর অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। পরবর্তী কালে তাকে বাগদেবী হিসাব পুজো করা শুরু হয়।
এইখানে আমরা বিগব্যাং থিয়োরীর কথাটা একবার মনে করতে পারি যা শব্দ থেকে
ব্রহ্মান্ডের উৎপত্তি কথাটার সঙ্গে একটা রিলেশন তৈরি করে। এবার আমরা যদি সহজ করে
ভাবি তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে একটা পরমসত্তা ছিল, একটা শব্দ নির্গত হল আর
ব্রহ্মান্ডের উৎপত্তি হল। সরস্বতী যদি সেই শব্দ হয় তবে সারা সৃষ্টির সঙ্গে তার
ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রয়েছে।
সমস্ত জ্ঞান যা শব্দ বা বাক্য দ্বারা ধারণা করা যায় তার
এক চিন্ময়ী মূর্তি হিসেবে দেবী সরস্বতীর পুজো করা হয় এইটা হচ্ছে মোদ্দা কথা। সমস্ত
প্রকার শক্তিকেই দেবীরূপে কল্পনা বা ব্যাখ্যা করা হয়েছে তাই সরস্বতী হলেন
বিদ্যাশক্তির অধিষ্ঠাত্রী। ব্যস! এবার আর কোন সমস্যা নেই। এই প্রবল শক্তি যা জগতের
বিকাশের অন্যতম ভিত্তি তার পুজো পাওয়া মানে ঐ বিদ্যার বিকাশের পথ সুগম হওয়া সেটা
আমাদের জন্য আনন্দদায়ক না হবার কোন কারণ নেই। যা আমরা গুরুত্বপুর্ণ ভাবি তাকে
শ্রদ্ধাভক্তি করায় দ্বিধার কোন কারণ তো নেই।
অতএব আগামীকাল যারা হিন্দুমতে ঐ শক্তির আরাধনা করবেন
তাদের আমার তরফ থেকে শুভেচ্ছে জানিয়ে এখানেই আলোচনা শেষ করা যাক। হ্যাঁ, একটা কথা,
যারা ঐভাবে পুজো পছন্দ না করে জ্ঞান দিয়েই জ্ঞানের পুজো করবেন বলে প্রতিজ্ঞা
করেছেন শুভেচ্ছা তাদেরও জানাচ্ছি কেননা কেবল জ্ঞানেই অস্তিবোধ সম্ভব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন