শনিবার, জানুয়ারী ১৮, ২০১৪

ভবঘুরের দিনলিপি

                  লিখেছেন : মনোবর
ঘরের ভেতরটা ঠান্ডা এবং অন্ধকার। কমপিউটার চলছে। আশ্চর্য্যজনক ভাবে সব ফাইল ডাউনলোড হয়ে গেছে। বাড়ীওয়ালী আর তার বোন একসপ্তাহ ধরে দেশের বাড়ীতে গিয়ে উঠেছে। ওদের কোন ভাইপো বাইক অ্যাক্সিডেন্টে ঘায়েল হয়ে বিছানা নিয়েছে তাই দুই পিসী ভার নিয়েছে তাকে সুস্থ করার। এখন না হবে চা না হবে টা। সে পা ধুতে যায়। পা না ধুলে সে স্বস্তি পায়না। এখন এই ভিজে পায়ের কারণে আরো অস্বস্তি হয়। এবার কম্পিউতার বন্ধ করতে হবে। রেষ্ট দিতে হবে। তার পর হবে আর একটা টেনসনের ব্যাপার। গত কয়েকদিন ধরে কোন ডিস্ক বার্ন করতে গেলে কোরাপটেড হয়ে যাচ্ছে। মোট পনেরটা ডিস্ক নষ্ট হয়েছে। বিভিন্ন সফটওয়্যার দিয়ে চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নি। অথচ ডিভিডি ড্রাইভ ঠিক আছে। ভেবে কিছুই পাওয়া যাচ্ছেনা। হাত মুখ ধোবার পর সে বীর ভঙ্গীতে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে আর ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকে। শীত আর স্বপ্ন দুটোই সে টের পায় এবং একসময় উঠে পড়ে। ঠিক একঘন্টাই অতিক্রান্ত হয়েছে।
সে একটা গরম আলখাল্লা গায়ে দিয়ে চাদর জড়ায়। আলো জ্বালে। এবং আবার বার্ন করার চেষ্টায় সামিল হয়। বার্ন হবার পর দেখা যায় ডিস্ক আনরিডেব্‌ল।এবার তাকে হতাশা গ্রাস করে। সে শুয়ে ভাবতে থাকে আর কিছু করার বাকি আছে কিনা। তার মনে হয় ল্যাপটপটা তার শত্রু কেননা এটা এখন অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মাথায় একটা চিন্তা আসে আচ্ছা, টরেন্ট থেকে ফাইলগুলো অন্য ড্রাইভে কপি করে তার পর বার্ন করলে কি হতে পারে। অতএব সে ১০জিবি কপি করতে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে।
এই সময়ে সেই কালুয়া ফোন করে। এই লোকটা এই বাড়ীতে রোজ আসে। বাড়ীওয়ালীর দোসর। ওদের মধ্যে একটা রহস্যময় সম্পর্ক আছে। কিন্তু লোকটা বলে বাড়ীওয়ালী তার চেয়ে বয়সে বড় এবং সম্পর্কে তার মাসী। এবং ওদের বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই বলে লোকটা তাকে পছন্দ করে। সে একদিন তাকে এও বলেছে যে সে এখানে আসে বলে তার বৌ তাকে সন্দেহ করে। বলেছে যে তার বৌ খুব ডেঞ্জারাস। করতে পারেনা এমন কাজ নেই। সে তার বৌকে একবার এই বাড়ীতেই দেখেছে। সালোয়ার কামিজ পরা একটা শ্যামবর্ণ মোটামুটি সুশ্রী মেয়ে। লোকটা তার হাত ধরে এও বলেছে বউ যদি সত্যি কোনদিন আসে তাহলে সে যেন তার পক্ষ নিয়ে কথা বলে। সে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছে। কাল পাশের ঘরে এক বুড়ো রিটায়ার্ড কর্মীর যুবক ছেলে বাবাকে গালাগালি করছিল। তাও আবার মধ্যরাতে। এখানে ঝগড়াঝঁআটি, গলায় দড়ি সবই হয়। কিছুদিন আগে এক একাকী মহিলা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। লোকটা বা তার বৌ কি একদিন তাই করবে। সে ভাবে। আর করুণ দৃষ্টিতে তার সদ্য আত্মহত্যা করা ডিস্কের দিকে চেয়ে থাকে। সে একটা লাল কালির কলমে তার উপর একটা ক্রশ চিহ্ন দেয় এবং আগের পনেরটা মৃতদেহের ওপর তাকে শুইয়ে দেয়।
সে লোকটাকে অপছন্দ করেনা। কারণ বাড়ীওয়ালীর নির্দেশে সে এখানে এসেছে তাকে চা করে খাওয়াতে। কেন এই নির্দেশ শার্লক হোমস? এই নির্দেশ এ কারণে যে সে সব জেনেও কোন বিরাগ দেখায় না। লোকটা সে না থাকলে এই ঘর খোলে সে জানে। কারণ পরিপাটি বিছানা তো আপনি আপনি কোঁচকায় না। সে কিছুই বলেনা। কারণ? কারণ ওরা তার কোন জিনিষ চোট দেবেনা এটা এতদিনে বোঝা গেছে। লোকটা চা করে দিয়ে যায় এবং নিজে ওঘরে টিভি খুলে বিছানায় বসে। ওর নামটা তার মনে থাকেনা। সে মনে মনে তাকে কালুয়া বলে ডাকে।
আশ্চর্য্যজনক ভাবে নতুন পদ্ধতিতে ডিস্ক সফলভাবে বার্ণ হয়।একটু পরে বাড়ীওয়ালীর এক ভাইপো আসে। ও একটা থানায় কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে পুলিশের কাজ পেয়েছে। একটা পুলিশের পোষাক পরে সেই কাজে যায় আর পিসীরা না থাকলে রাত্রে এখানে থাকে। সারারাত টিভি চালায় আর সকালে ১০টার আগে ওঠেনা। কুঁড়ে, আগোছালো কিন্তু আবার ছোটখাট মিস্ত্রী। নানারকম খুট খা্ট কাজ জানে। আর জানে রান্না করতে। কিন্তু ও আসে প্রায় রাত দশটায়। তার আগে সে মোড়ের দোকানে গিয়ে খেয়ে আসে। সেখানে আর এক কালুয়া চারটে কর্মচারী দিয়ে এক খাবার দোকান চালায়। তন্দুরী, রুটি, ফ্রায়েড রাইস, রেশমী বাটার, চিকেন কাবাব এইসব পাওয়া যায়।
রবার্ট রুসের চেয়ে সে কিছু কম যায়না। শেষ পর্যন্ত উপায় তো বার হল। দুটো ডিস্ক সফলভাবে বার্ন হবার পর সে স্বস্তি পায়। আরো স্বস্তির ব্যাপার হল কালুয়ার উপদেশে হালুয়া ভাইপো আজ দুজনের রান্না চাপিয়েছে। মানে হোটেলে আর যেতে হল না। খানিক পরে ডিমের ঝোল আর বেগুনভাজা দিয়ে একটু বেশী ভাত খেয়ে ফেলে সে। থালা ধোবার সময় বিরক্ত লাগে। তারপর ফেসবুক, ব্লগ, ব্রাউজিং এইসব করতে করতে রাত তিনতে বাজে। এবার প্রস্তুত বিছানায় শুতে যাবার আগে কম্পিউটার অফ করে সে। কারন সকালে উঠে আরও দুটো ডিস্ক বার্ন করতে হবে।

উঠে দেখে ৯টা ৩৫ বাজে। হালুয়াকে ডেকে তোলে সে কারন না হলে চা খাওয়া হবেনা। দাঁড়িকাটা, দাঁতমাজার পর হালুয়া ভাইপো চা করে ডাকে। এরপরের ঘৃণ্যকাজটা হল বরফ ঠান্ডা জলে স্নান করা। তারপর অবশ্য ভাল লাগে। আমগাছে যে থাকে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজী করাতে হবে। এই কালুয়া হালুয়ার দেশ ছেড়ে যেতে হবে নতুন এক দেশে। সেখানে একতলার ঘর। প্রথম মন বসান মুষ্কিল। এই ঘর ভালই ছিল। কিন্তু বিবর্তনের জগতে স্থির বলে তো কিছু নেই ডার্লিং, শুধু পারাপার আছে।

কোন মন্তব্য নেই: