|
সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদ পত্র সহ বাংলাদেশের বাংলা পত্রিকা দৈনিক ‘নয়া দিগন্তে’ ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলার রায় সম্বন্ধে পড়তে পড়তে ত্রিপিটকের দশরথ জাতক শীর্ষক পুরানো বৌদ্ধ ইতিহাসের
কথা মনে পড়ে গেল।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ভারতীয় আদালতের রায়ে তিন
ভাগের মাত্র এক ভাগ পাবেন
মুসলিম জনতা। সর্বগ্রাসী
হিন্দুধর্মের রাম কাহিনি নিয়ে ঢক্কানিনাদের সময় দশরথ জাতক এবং ‘আল্লাহ উপনিষদ’ নিয়ে বিচার
বিশ্লেষনের জন্য কার ও
কোন লজ্জা হয় না বলে। “মুসলিম তার
নয়নমণি,
হিন্দু তাহার প্রাণ;” না মেনে রাম মন্দির আন্দোলনের উত্তাল ঢেউয়ের মাথায়
১৯৯২ সালে ৬ই ডিসেম্বর প্রায় দুই হাজার অপাপবিদ্ধ মানুষ হত্যা করা হয়েছিল লালকৃষ্ণ আডবাণী সহ
হিন্দু রাজনীতিবিদের বকওয়াস রাজনীতির
জন্যে।
হিন্দু রাজনীতির দাদারা বৌদ্ধ ধর্মকে কবর দেবার পর (দেশ, ৪ মে ২০০১ কলিকাতা পৃষ্ঠা ১২), ভারত বিজয়ী ইসলাম ধর্মকে নিয়ে অভিনব ‘বক্ওয়াস’ কূটনীতি
করার মানসে সম্রাট আকবরের
রাজত্বকালে “আল্লাহ উপনিষদে” রচিত হলো: “আল্লো জ্যেষ্ঠং শ্রেষ্ঠং পরমং , পূর্ণং ব্রহ্মানং
অল্লাম। অর্থাৎ দেবতাদের রাজা আল্লাহ আদি সকলের বড় ইন্দ্রের গুরু।”
জনতার প্রশ্ন : আল্লাহ উপনিষদের আলোকে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা অন্যায় ও অমানবিক নয় কি? শুধু পরম করুনাময় আল্লাহের নামে
উপনিষদ শীর্ষক শূন্যগর্ভ কথার বুদবুদ যা
রাজনীতির নানা কক্ষের আধো অন্ধকার চন্ডীমন্ডপ পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। আল্লাহ এবং রাম সর্ব শক্তিমান স্রষ্ঠা হলে
হিন্দুশাসকগণ ভারতের বৌদ্ধ মন্দির সমূহ (পুরীর
জগন্নাথ মন্দির, তিরুপতি
বালাজী সহ শত শত বৌদ্ধ মন্দির) দখলে রেখে
ভগবান রামের নামে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করলো কেন? কারন ভারতে
অহিন্দু ধর্মসমূহকে হিন্দুধর্মের লেজুর বানাতে অবতার ও আল্লাহ উপনিষদ ব্যবহার করা হবে।
গৌতমবুদ্ধকে হিন্দুরাজনীতি নবম অবতার বানিয়ে আজ ও বৌদ্ধ মূল্যবোধকে গিলে গিলে খাচ্ছে। গোটা
রামজন্মভূমির আন্দোলনটাই বকওয়াসের
রাজনীতি। হিন্দু ধর্মে সব মায়া, তাই
চতুরার্য সত্য নেই এবং বৌদ্ধধর্ম থেকে ধার
করে অশোকস্তম্ভে লেখা হয়, “ইহাই
ভারতের রাষ্ঠ্রীয় প্রতীক।” আনন্দবাজার পত্রিকার (সম্পাদকীয়, ২২ আগষ্ট, ১৯৯৩) মতে, “রামায়নের
আদি হিসাবে তাঁহাদের কেহ কেহ প্রাচীনতর ভারতীয় কাহিনীর যথা: “দশরথ জাতক” (জাতক নম্বর :
৪৬১) এর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়াছেন। ... সেই উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা কেমন করিয়া ভুলিয়া গেলেন যে, একদা রাশি রাশি বৌদ্ধ ধর্মস্থান ধ্বংস করিয়া একদিন গড়িয়া উঠিয়াছিল রাশি রাশি
হিন্দু মন্দির। তাঁহারা কি জানেন, হিন্দুর কাছে অতি পবিত্র পুরীর মন্দিরের
প্রাক্ ইতিহাস সম্পর্কে কানিংহাম কিংবা
রাজেন্দ্রলাল মিত্রের কী অভিমত? তাই
বলিতেছিলাম, অযোধ্যা একটি বৃহৎ প্রশ্ন বটে, কিন্তু নিতান্তই মনগড়া এক নির্বোধ প্রশ্ন।”
এই প্রসঙ্গে ইহা ও বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য যে, কলিকাতার দেশ (৪ মে, ২০০১, পৃষ্ঠা, ১৩) পত্রিকায় সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ের মতে, “হিন্দু মন্দিরের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকা বৌদ্ধ উপাসনা
গৃহগুলি ও কি অত:পর একই
যুক্তিতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে বৌদ্ধদের হাতে? বস্তুত, ইতিহাসের
সমস্ত অসংগতির ক্ষতিপূরণ বর্তমানে দাবী
করার রীতি এইভাবে স্বীকৃত হতে থাকলে ‘বর্ণ হিন্দু’ আধিপত্যহীন
হিন্দুধর্মে ধ্বজাধারীদেরও সুনিদ্রা সুনিশ্চিত থাকার কোনও কারন আদৌ নেই।” একে বলা হয় হিন্দুধর্মের সহনশীলতার বকওয়াস।
বিচারের বানী নিরবে নিভৃতে কাঁদে এবং ইহার
ফাঁদে সর্বগ্রাসী হিন্দু রাজনীতি নিয়ে মসজিদে হিন্দুত্বকরণ রায় নয় কি? যবনের স্পর্শে হিন্দুর জাত যায়, আর জাত ফেরে
না। যবন রাম জন্মভূমির ভিটের ওপর বাবরি মসজিদ প্রতিষ্ঠার শত শত বছর যাবত নামাজ আদায় করার পর ও হিন্দু মন্দিরের জাত
গেল না কেন? ইহাই
হিন্দু রাজনীতির ‘বকওয়াস’ অধ্যায়। মানবিক মর্যাদায় মনুষ্যত্ব ধ্বংস হলে “রাম নাম সত্য হে ?”
ইতিহাস চুরির চাতুর্যে রামায়নের তথ্য ফাঁস : গৌতমবুদ্ধ তাঁর ভিক্ষুসংঘকে উপদেশ প্রসঙ্গে দশরথ জাতক সমাধান করতে
গিয়ে বলেছেন, “তখন (পূর্ব জন্মে) শুদ্ধোধন রাজা ছিলেন দশরথ মহারাজা, মহামায়া ছিলেন সে মাতা, রাহুলমাতা
(গোপা) ছিলেন রাজকুমারী সীতা, আনন্দ
ছিলেন রাজপুত্র ভরত, সারীপুত্র
ছিলেন রাজপুত্র লক্ষন, বুদ্ধ পরিষদ
সে পরিষদ, আমি (বুদ্ধ) ছিলাম সে রাম পন্ডিত ( দশরথ জাতক নম্বর
৪৬১,
জাতক অট্টকথা, পালি টেক্সট সোসাইটি, লন্ডন)।” বৌদ্ধ প্রধান দেশ থাইল্যান্ডের
রাজধানী ব্যাংকক মহানগরীর বিখ্যাত রাজকীয়
এমারেল্ড (মরকত মনি) বুদ্ধ মন্দিরের চারিদিক জুড়ে আছে দশরথ জাতকে রামকীর্তির অভিনব চিত্রশালা।
প্রসঙ্গত: উল্লেখযোগ্য যে, আজকের থাইল্যান্ডের মহারাজা ভূমিপল অডুল্যডেজা
হচ্ছেন নবম রাম। প্রথম রাম (১৭৮১ থেকে ১৮০৯) ১৭৮২ সালের ৬ই এপ্রিল
ব্যাংককে (দেবনগরী) রতœকোষিন
ডাইনেষ্ঠি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বৌদ্ধ রাজনীতিতে বোধিসত্ত্ব রামকে (দশবিধ রাজধর্ম) অনুসরন করে রাজত্ব পরিচালনা
করার শপথ গ্রহন করা হয় । থাইল্যান্ডে
অযোধ্যা (আয়োথায়া) এবং রাজা রাম আজ ও বিরাজমান।
ইতিহাসের সূত্র বিশ্লেষনে দেখা যে, প্রায় সাড়ে তিন হাজার
বছর পূর্বে বৈদিক রাজা ইন্দ্র প্রাগৈতিহাসিক বৌদ্ধ নগরদ্বয়
মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা ধ্বংস করার পর প্রাচীন ভারতে বৈদিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন (লেখক স্বপন বিশ্বাসের লেখা
ইংরেজি বই ‘বৌদ্ধধর্ম’ মহেঞ্জোদারো হরপ্পার ধমর্, কলিকাতা
১৯৯৯),
এবং হিন্দুর বকওয়াস রাজনীতির কারনে আজকের
বৌদ্ধধর্মই হিন্দুধর্মের পরমশত্র“। বৌদ্ধ
ত্রিপিটকের মধ্যম নিকায়ের
মাগন্দিয় সূত্রে (সূত্র নম্বর:৭৫) গৌতমবুদ্ধ
ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “পূর্বের
বুদ্ধগণ আরোগ্য পরম লাভ এবং নির্বান পরম
সুখ সম্বন্ধে যেই শিক্ষা দিয়েছিলেন বর্তমানে সেই শিক্ষা সমূদয় জনসাধারনের মধ্যে প্রচলিত হয়ে
রয়েছে।”
হিন্দুধর্ম ও রাজনীতি অতীত বুদ্ধগণকে
স্বীকৃতি না দিয়ে সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ সাম্রাজ্যকে
(ভারত) লুটে পুটে খাচ্ছে।
“মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
বিধাতার রুদ্ররোষে দুভিক্ষের দ্বারে বসে /
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।”
শ্রীরামচন্দ্র লোভ লালসা ত্যাগ করে মানব জাতির ভগবান হলেন। আজকের হিন্দু রাজনীতি ভারতে
সর্বগ্রাসী হিন্দুত্বকরণের জন্য রক্তগঙ্গা
প্রবাহিত করতে সর্বদা প্রস্তুত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু জাতিকে শিক্ষা দিয়েছিলেন:
“সেই সত্য যা রচিবে তুমি,
ঘটে যা, তা সব সত্য
নহে,
কবি, তব মনোভূমি,
রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে
সত্য জেনো।” চোরে না
শোনে ধর্মের কাহিনি। হিন্দু রাজনীতি শক্তের ভক্ত (সম্রাট আকবরের ভক্ত ছিল) এবং
নরমের (সংখ্যালঘুদের) যম।
অযোধ্যায় বৌদ্ধ
স্থাপত্যের একটি থামের শালভঞ্জিকায় ঐতিহাসিক ছবি বিরাজমান যেখানে
গৌতমবুদ্ধের মাতা শালপাতা তুলছেন। চীনা
পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর ভ্রমন কাহিনি থেকে জানা গিয়েছে যে সপ্তম শতকে অযোধ্যায় ছিলেন তিন হাজার
বৌদ্ধভিক্ষু। বৌদ্ধ বিহার ছিল প্রায়
একশোটি। বৌদ্ধযুগে অযোধ্যা ছিল বৌদ্ধ প্রধান অঞ্চল এবং আজকের অযোধ্যার স্থাপত্যেকীর্তির পুরাতাত্বিক অতীত
অনুসন্ধান করতে গিয়ে বৌদ্ধ প্রাধান্যের
যুগে ফিরে যাওয়া সহজ।
রামায়নের অযোধ্যা
কান্ডের (অধ্যায়) বত্রিশ নম্বর শ্লোকে বুদ্ধকে (যথাহি চৌর স তথাহি
বুদ্ধ, তথাগতং নাস্তিকমত্র বিদ্ধি।) চোর বলে গালাগাল করার পর সেই
মহাকাব্যটি কি বৌদ্ধ জাতকের আগে রচিত? “তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, / আমি হলাম চোর বটে।” ধর্মের গোড়ামি ত্যাগ করে রামায়নের ঐতিহাসিক উৎস নিরুপণ
করতে গিয়ে পন্ডিত ও ভাষাতত্ত্ববিদ ড. সুনীতি
কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির এক আলোচনা সভায় বলেছেন, “দশরথ জাতকই রামায়নের উৎস ( দৈনিক বসুমতি, কলকাতা, ২ মার্চ ১৯৭৮
ইং)।”
যেমন কথিত আছে, কর্ণসুবর্ণের
শৈব রাজা শশাংক সেতুবন্ধ থেকে হিমগিরি পর্যন্ত বালকবৃদ্দ
নির্বিশেষে সমস্ত বৌদ্ধকে হত্যা করার আদেশ
দিয়েছিলেন। আদেশ পালনে শিথিলতা যে দেখাবে তার ও শাস্তি ছিল মৃত্যু।” ডাক্তার কে যমানাদাসের লেখা ‘তিরুপতি বালাজি ওয়াজ
এ বুদ্ধিষ্ঠ স্রাইন’ শীর্ষক
মহাগ্রন্থে লেখা আছে, “আসলে এটি
একটি প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি। ভারতবর্ষে
বৌদ্ধধর্ম পতনের সময় হিন্দুরা স্রেফ গায়ের জোরে বিহারটিকে দখল করে নেয়। পুরীর (উড়িষ্যা) জগন্নাথ দেবের মন্দির
ও আসলে বুদ্ধ মন্দির।
স্বামী বিবেকানন্দ ও তাই মনে করতেন। স্যার যদুনাথ, নগেন্দ্রনাথ বসু, ডঃ ভাও
লোকান্ডের উদ্ধৃতি ও নৃতাত্বিক প্রমাণাদিসহ ড. যমানাদাস হিন্দু ধর্মের সহনশীলতা এই বহু কথিত গুণটিকেই
কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।
ভারতের সাবেক রাষ্ঠ্রপতি ডক্টর রাজেন্দ্র প্রসাদ ও বলেছিলেন, ‘বুদ্ধগয়ার মন্দিরটিকে দখলে এনে আসলে আমরা অন্যায় করে
চলেছি।’
উত্তরে মহান বিদ্বান লেখক রাহুল সাংকৃত্যায়ন বলেন, ‘বুদ্ধগয়া মন্দিরের ষোল আনাই বৌদ্ধদের হাতে দিয়ে দেওয়া উচিত (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ ফেব্র“য়ারী ১৯৯৭, বৌদ্ধ মঠের
কঙ্কাল বিধু বাহিরেতে)।”
সমাজতত্ত্ববিদগণ মনে করেন যে, ভারতে বিজ্ঞানের
অগ্রগতির সঙ্গে হিন্দুরাজনীতিবিদদের সজাগ সতর্ক সহ নৈতিক
বোধের অবনতির ফলে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরী
হচ্ছে,
তা আজ ও আগামী দিনে সমাজের
বুকে এক ভয়াবহ ধ্বংসের রুপ নেবে।
মানবাধিকারের অস্তিত্বের আলোকে বাবরি মসজিদ আলোকিত মানবতার প্রতিশ্র“তি এবং ১৩৩৮
বঙ্গাব্দে “ বৈশাখী পূর্ণিমা ” শীর্ষক কবিতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৌদ্ধকবি
হয়ে লিখেছিলেন,
“সকল কলুষ তামস হর’ জয় হোক তব
জয়!
অমৃক বারি সিঞ্চন কর ’ নিখিল
ভুবন ময়।
জয় হোক তব জয়!
মহাশান্তি মহাক্ষেম,
মহা পুণ্য, মহা প্রেম!”
জ্ঞানসূর্য উদয় ভাতি
ধ্বংস করুক তিমির রাতি,
দুঃসহ দুঃস্বপ্ন ঘাতি ’ অপগত
কর ভয়।
জয় হোক তব জয়।
মোহ মলিন অতি দুর্দ্দিন, শঙ্কিত
চিত্ত পান্থ,
জটিল গহন পথ সঙ্কট সংশয় উদভ্রান্ত।
করুনাময়, মাগি শরন,
দুর্গতিভয় করহ হরণ;
দাও দুঃখ বন্ধ তরণ মুক্তির পরিচয় ।
জয় হোক তব জয়।
মহাশান্তি মহাক্ষেম
মহাপুণ্য, মহাপ্রেম।”
উত্তর আমেরিকার খ্যাতিমান লেখক সোনা কান্তি বড়–য়া বিবিধ গ্রন্থ প্রণেতা এবং কানাডিয়ান বৌদ্ধ পরিষদের জাতিসংঘ প্রতিনিধি।
|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন