লিখেছেন : কমলেশ চৌধুরী
নভেম্বর , ২০০৪৷ বনগাঁয় ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন কাজলী -অপর্ণা৷ ফেব্রুয়ারি , ২০১১৷ নন্দীগ্রামের সোনাচড়ায় আত্মঘাতী হন স্বপ্না -সুচেতা৷
উত্তর ২৪ পরগনা আর পূর্ব মেদিনীপুরের ঘটনা দু’টিকে একসুতোয় বেঁধে দিয়েছিল সুইসাইড নোট৷ যাতে লেখা ছিল --- আমাদের সম্পর্ক তোমরা মেনে নিতে পারলে না ! তাই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম৷ আরও লেখা ছিল --- আমাদের দেহ একসঙ্গে দাহ কোরো৷ একসঙ্গে ‘যাওয়ার ’ শেষ আকুতি কেউ শোনেনি৷ মুখ ঘুরিয়ে ছিলেন ‘সমপ্রেম -শহিদদের ’ মা -বাবারা৷ প্রত্যন্ত গ্রামে থেকে এক হতে পারেননি ওঁরা৷ শহরের আরিয়ান -রঞ্জিত , রুক্মিণী -স্বর্ণালি , দীন্তি -লতিকা , অনির্বাণ -দীপকরা নিজেদের চার দেওয়াল খুঁজে বের করেছেন৷ লড়াই করে৷ পরিবারকে বুঝিয়ে৷ সমাজের সঙ্গে যুঝে৷ কিন্ত্ত এ বার ? দিল্লি হাইকোর্ট যে অভয় দিয়েছিল , সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সেই দরজা হঠাত্ বন্ধ৷ রুক্মিণী সরাসরিই বললেন , ‘কী হবে ? পুলিশের হয়রানি বাড়বে৷ বাড়ির অত্যাচার দু’গুণ হয়ে যাবে৷ চাকরির জায়গাতেও সমস্যা তৈরি হবে৷ ’ কেন ? জবাবটা এল লতিকার কাছ থেকে৷ দীন্তির সঙ্গে ১৪ বছরের সম্পর্ক৷ ৫ বছর হল একসঙ্গে থাকেন৷ ‘বাড়ির লোকেরা যখন প্রশ্ন তুলত , দিল্লি হাইকোর্টের রায় আমাদের কাছে একটা উত্তরের মতো ছিল৷ যাঁরা আমাদের বিরোধী , সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের মুখে কথা জুগিয়ে দিল৷ এ বার আমার ভাইও চোখে আঙুল তুলে বলবে , তুই অপরাধী৷ এই খোঁচাটা সহ্য করেই নতুন করে পথ দেখতে হবে৷ ’বছর ত্রিশের দীপকের মনে হচ্ছে , আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে৷ সেই আট বছর আগে নন্দনে আড্ডা দিতে গিয়ে অনির্বাণের সঙ্গে আলাপ৷ বাড়িতে জানাজানি , অশান্তি৷ শেষে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গঙ্গার ঘাট , রেলস্টেশনে রাত কাটানো৷ দার্জিলিংয়ে পালিয়ে লুকিয়ে থাকা৷ শেষে অনির্বাণের মায়ের সম্মতিতে সংসার পাতা৷ কথা বলতে বলতে প্রায় কেঁদেই ফেললেন দক্ষিণ কলকাতার যুবক , ‘দাদা , দাদার বন্ধুরা মিলে ঘরে আটকে আমাকে রেপ করার চেষ্টা করেছিল৷ বলছিল , আমাদের সঙ্গেই তো শুয়ে পড়তে পারিস৷ এরা কেউ বোঝে না , সমকাম মানেই শুধু শরীর নয়৷ কাঁধে মাথা রাখা , হাত ধরাধরি , সঙ্গীর অনুভূতি বোঝা --- এসবও পড়ে৷ ’ ময়দানে , শহরের পে অ্যান্ড ইউজ টয়লেটে পুলিশ হেনস্থা করেছে৷ ফ্যাশন ডিজাইনিং কলেজে পড়া শেষ করতে পারেননি , চাকরি গেছে৷ ২০০৯ -এর ২ জুলাই দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এ পি শাহ ও বিচারপতি এস মুরলীধরের রায় কাঁধে হাত রেখেছিল৷ বুধবার সেই হাত সরে গেল৷ বিচারপতি জি এস সিংভি ও বিচারপতি এস জে মুখোপাধ্যায়ের রায় বেরোতেই ভয় গ্রাস করেছে দীপককে৷ বললেন , ‘এ বার হয়তো বাড়িতে এসে অত্যাচার করবে পুলিশ !’ লতিকার মুখেও এক কথা , ‘দেখুন ৩৭৭ ধারায় অভিযুক্ত করে প্রমাণ করা পুলিশের দায়৷ সেটা সহজে ওঁরা করতে পারবে না৷ তাই সেই ভয় পাচ্ছিও না৷ কিন্ত্ত যে ভাবে আইনের ফাঁক গলে যৌনপল্লিতে হয়রানি করে পুলিশ , এখানেও তাই করবে৷ ’ ওঁদের ভয় , প্রত্যন্ত অঞ্চলে অত্যাচারের মাত্রাটা বেড়ে গেল বলে ! স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজ করা রঞ্জিত যেমন বললেন , ‘জেলা থেকে এত ফোন আসছে , ছেলেমেয়েগুলো ফোনে কেঁদেই ফেলছে৷ কী যে হবে !’সব দরজা কি তা হলে বন্ধ ? মানেন না রঞ্জিত , ‘আমাদের লড়াই ছিল , থাকবে৷ রায় আমাদের অনুকূলে হলে ভালো হত৷ কিন্ত্ত এতেও খারাপ হল না৷ বিষয়টা সামনে এল৷ লোকে জানল৷ ২০ -২২ বছর ধরে লড়ছি৷ আরও না -হয় লড়ে নেব৷ একটা কথা মানি , যিশু খ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন বলেই একটা ধর্মের জন্ম হয়েছিল৷ ’ রঞ্জিতের পাশেই থাকছেন আরিয়ান৷ বলছেন , ‘আইনি স্বীকৃতি পাওয়া গেল না ঠিকই , কিন্ত্ত এতে আমাদের সম্পর্কে চিড় ধরবে না৷ আমাদের আবেগ এক জায়গাতেই থাকবে৷ ’১১/১২/১৩৷ ঐতিহাসিক রায় দিয়ে বিরল সংখ্যার দিনটা ইতিহাসের পাতায় ঢুকিয়ে দেবে সুপ্রিম কোর্ট৷ এমনই আশায় ছিলেন গোটা দেশের সমপ্রেমীরা৷ ঘটল উল্টোটা৷ কিন্ত্ত দিনটাকে সাক্ষী রেখেই নতুন লড়াই শুরু করে দিয়েছেন ওঁরা৷ জাতিস্মরের সুরেই গাইছেন --- উদাসীন থেকো না , সাড়া দাও ! সারা দেশকে সাড়া দিতে বাধ্য করিয়েই থামবেন ওঁরা৷ (নিরাপত্তার স্বার্থে কয়েকজনের নাম পরিবর্তিত )
সৌজন্যে : এই সময়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন