শনিবার, ডিসেম্বর ২১, ২০১৩

আগামী থেকে বলছি (৩য় পর্ব)

                             লিখেছেন : মনোবর

ভয় আর শোক দুটো মিশে গেলে যে ককটেল তৈরি হয় তার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক।
‘আমি নিজের কানে শুনেছি।’
‘ভুল শুনেছিস তুই। শোন, আমার কাছে শান্ত হয়ে বস মা।’
‘ না। ও আমায় ডেকেছে। আমি ভুল শুনিনি।’
মাথার চুল এলো হয়ে এদিক ওদিক উড়ছে। পলি উত্তেজিত হয়ে বারান্দার এমাথা থেকে ওমাথা হন্ত দন্ত হয়ে যাচ্ছে আর আসছে। দেখে শুনে ওর মায়ের চোখ কপালে ওঠবার উপক্রম হয়েছে। কেন যে চিতার ধোঁয়া হয়ে মহাকাশে মিলিয়ে না গিয়ে এই গাড্ডায় পড়লুম! ছোট হয়ে ওর ইয়ার রিংটার ওপর বসে গভীর ভাবে ভাবতে লাগলুম যে কি করা যায়। ওকে বিরাট একটা দৈত্য মনে হচ্ছে। একখানা চুল সাপ্টে টারজানের মত একটু দোল খেলে কেমন হয় এমন দুষ্টুমির চিন্তাও একবার মাথায় এল। সব চিন্তাকে কাজে পরিণত করা উচিত নয়। কিছুপরে ও মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। দু একজন প্রতিবেশী আবার উঁকি ঝুঁকি মারতে শুরু করেছে।
‘ও দিদি, পলির কি শরীর খারাপ হল নাকি! হলেই বা দোষ কি! রাত নেই দিন নেই শুধু পড়া আর পড়া। একটু তালমিছরির জল খাইয়ে দিন। ওতে খুব শরীর ঠান্ডা হয়।’
এই বলে বারান্দায় উঠে থেবড়ে মেঝেতে বসেই পড়ল উপকারী বহিনটি। আমি কিছু না বলে ওর হাবভাব দেখে যাচ্ছি। ওর চিন্তাগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। ও এসেছে ভেতরের ব্যাপারটা ভাল করে জানতে। ও মনে মনে ভাবছিল এইবার জব্দ হও। আর মনে মনে খুশীই হচ্ছিল। শক্তিপ্রয়োগের কলাকৌশল গুলো একটু শিখে নিতে দাও বাছা তারপর তোমায় এমন কলসী পালিশ দেবো যে তুমি হাড়ে হাড়ে টের পাবে।
‘আমার কিছুই হয়নি মাসীমা। আর হবার মত কিছু নেইও আমার।’এই বলে পলি আবার ঝর ঝর করে কেঁদে ভাসাতে শুরু করল।
তা দেখে ওর মাও যখন ফোঁপাতে শুরু করল তখন আমার নিজের উপর ধিক্কার জন্মাল। আমি দুম করে আত্মহত্যা না করলে কি আর এই পরিস্থিতি তৈরি হত!
‘ও মা! ক্ষিদে পেয়েছে বাড়ীতে এস না।’ এই বলে সমাজসেবী বহিনের এক ছানাও এসে হাজির হল।
‘তোদের নিয়ে ভাজা ভাজা হয়ে গেলুম। মানুষের আপদ বুঝিস না বিপদ বুঝিস না খলি রাতদিন খাই খাই করিস।’ এই বলে অনিচ্ছা সহকারে উনি উঠে দাঁড়াতে যাবার সময় গভীর ভাবে চিন্তা করলুম যে আমি ওর হাঁটু আর তারপর নিজেকেই কড়াৎ করে মচকে দিলুম। ফলাফল যা হল তা অত্যাশ্চার্য।
‘ ও বাবা রে আমি গেলুম রে!’ বলে দুম করে মাটিতে পড়ে সোনা বহিনটি আমার আর্ত চীৎকারে পাড়ামাথায় তুলল।
সিচুয়েশন এই পিক আপে তুলে দিয়ে পলিকে একবার ভাল করে দেখে নিয়ে সোজা শ্মশানে গিয়ে হাজির হলুম।
আমরা একটা অন্যরকমের আলোতে সবকিছু দেখতে পাই। একটা স্নিগ্ধ আলো। দুনিয়ার স্বাভাবিক আলো সে তুলনায় বড়ই বিবর্ণ। শ্মশানে এখন সেই আলো বিরাজ করছিল। খিরীশ গাছটা ফাঁকা দেখে একটু মন খারাপ হল। সবুজ হোক আর পাঁশুটে হোক সঙ্গী থাকলে ভালই লাগে। এই সময় একটা বিশেষ দিকের প্রতি আকর্ষন বোধ করায় সেইদিকে ধাবিত হয়ে দেখি শ্মশানের বড় পুকুরটার পশ্চিমপাড়ে যেখানে আগছা আর জঙ্গল ভর্তি সেখানে জনা দশবারো বিদেহী একত্রিত হয়ে গুরুগম্ভীর ভাবে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। সবুজ পন্ডিত বসেছে আমড়াগাছের মগডালে। অন্যরা তাকে ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই সময় বেশ মেঘ ডাকতে শুরু করায় ওদের যেন খুব ফূর্তি হচ্ছে বলে মনে হল। কৌতূহলী হয়ে আমি কাছাকাছি যেতেই সেই ছাইরঙ্গাটা খিক খিক করে হেসে বলল, ‘ ঐযে এসে গেছে।’ আর সেই মুহূর্তে প্রবল আলোর একটা তরঙ্গ এসে পড়ল ঠিক ও যেখানে ছিল সেইখানে। তার পরেই চারদিক কাঁপিয়ে বাজ পড়ার শব্দ।  আমি আগের সংস্কার মত একটু ভয়ই পেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ ওরা চেঁচামেচি শুরু করতেই অবাক হয়ে ভাবলাম ব্যাপারটা কি।
সবুজ বলল, ‘আমাদের একজন আজ অন্য জগতে গেল।’

‘কে?’ আমার এবার অবাক হবার পালা। আর ছাইরঙ্গাটাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। ‘ঠিকই ধরেছ। ওর বিদেহী জীবন শেষ হল। আবার দেহ নিয়ে শুরু হবে।’ এই বলে সবুজ যেন বেশ গম্ভীর হয়ে গেল। আমাদের শরীর ভেদ করে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে।  (ক্রমশঃ)

কোন মন্তব্য নেই: