ধর্ম, ঈশ্বর এবং মানুষ
লিখেছেন : মনোবর
প্রত্যেক ধর্মমতই জগতের সৃষ্টি ও তার ক্রিয়াকলাপের এক বিশেষ ব্যাখ্যা
উপস্থাপিত করে যা আবার অন্য ধর্মমতের সঙ্গে মেলেনা। এর থেকে সিদ্ধান্ত করা
যায় যে এর কোন একটি ঠিক এবং অপরগুলি ভ্রান্ত। কিন্তু এগুলির কোনটিই
বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে মেলে না। আবার বিজ্ঞান যে ভুল তাও প্রমাণ করা
যায়না। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে ধর্মমতের মধ্যেই সৃষ্টির ব্যখ্যা
সংক্রান্ত ভুল বিদ্যমান। বর্তমান পৃথিবীতে যে আবিষ্কার গুলি হয়েছে এবং যে
সব উন্নত ব্যবস্থা মানুষের হাতে এসেছে তার পূর্বাভাষ কোন ধর্মগ্রন্থেই
পাওয়া যায়না। যে ধর্ম আদি সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম তা কেন ভবিষ্যতের
পথনির্দেশ দিতে ব্যর্থ এই প্রশ্ন আমরা এড়িয়ে যেতে পারিনা। এমন অনেক প্রমাণ
পাওয়া যায় যে ভন্ড ও প্রতারকরাও মানুষের কাছে পূজিত হয়ে বহুভাবে মানুষকে
দীর্ঘদিন ধরে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করেছে আর এইভাবে প্রভূত অর্থ রোজগার করে
তা অবাধ ভোগবিলাসে ব্যয় করেছে।
ইতিহাসে দেখা গেছে যে শাসক শ্রেনী ও
পুরোহিত শ্রেণী বরাবরই এক নীরব সমঝোতার মধ্যদিয়ে আপন আপন প্রভাব
প্রতিপত্তি বজায় রেখেছে। যেহেতু ধর্মমত ও গ্রন্থগুলি এই পুরোহিত শ্রেণীর
একচেটিয়া প্রভাবের দ্বারা প্রভাবিত ছিল তাই সহজেই অনুমাণ করা যায় যে
নিজেদের সুবিধা যাতে বজায় থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তারা এগুলির রচনা বা
ব্যাখ্যা করেছেন। সবযুগেই এমন কিছু মানুষের কথা শোনা যায় যারা অলৌকিক
ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন যদিও এই ধরনের ক্ষমতা থাকা সম্ভব বলে বিজ্ঞান
বিশ্বাস করেনা। এবং এই ক্ষমতা কখনও সর্বসমক্ষে প্রমাণ করা হয়নি। আজও মানুষ
এই ধরনের ক্ষমতা কারও কারো আছে বলে বিশ্বাস করে ঠকছে। অথচ যারা এই ধরনের
ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করা হয়েছে তারাও রোগে ভুগে অথবা আক্রান্ত হয়ে
জীবন ত্যাগ করেছেন। তারা অসুস্থ হলে বলা হয়েছে যে উনি কৃপাবশতঃ অন্য কারো
রোগ নিজের শরীরে ধারন করেছেন। ধর্ম ও ধর্মমত নিয়ে সমালোচনা করা হলে
রাজশক্তি প্রয়োগ করে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়া
হয়েছে আর পুরোহিত শ্রেণীর উদ্যোগেই সে কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
কিন্তু
ধর্মের বিরুদ্ধে যাই বলা হোক একথা অনস্বীকার্য যে সারা পৃথিবীর এক
বৃহদাংশের মানুষ কোন না কোন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মানব সমাজ ধর্মমতের
দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবান্বিত এবং এ থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যার শিকড় এত
গভীরে প্রোথিত তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন হয়ত নয়। ধর্ম এবং দর্শন গ্রন্থগুলি
তাই বরাবর মানুষের আগ্রহের বস্তু হয়েছে এবং তার প্রকৃত অর্থ নিয়ে বিরামহীন
আলোচনা চলছে। এই আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষন কেবল প্রতিষ্ঠানগত হওয়া বাঞ্ছনীয়
নয়। তা কেবল ধর্মের ধ্বজাধারী কয়েকজন মানুষের ব্যক্তিগত বিচারের উপর
নির্ভরশীল হয়ে থাকলে সমাজ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলি এই
ব্যবস্থা সহজে মেনে নেবেনা। তারা উলটো যুক্তি খাড়া করে বলবে যারা
ধর্মাচরনকে জীবনের অঙ্গীভূত করেনি তারা এই গ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যা করে
মানবসমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে অতএব তারা প্রাণ দেবেন কিন্তু এই পবিত্র
অধিকার অন্যকে সমর্পন করবেন না। তারা ঘোষণা করবেন যে তাদের ধর্মই একমাত্র
অনুসরণযোগ্য এবং অন্য ধর্মাবলম্বীরা ভ্রান্ত। তারা বলবেন যে তারা এই
ধর্মরক্ষার জন্য আদেশপ্রাপ্ত। কেউ বলবেন যে ধর্মকে রক্ষার জন্য তারা রক্তের
নদী বইয়ে তাতে নিজের প্রাণ আহূতি দিতে প্রস্তুত। আর এই মনোভাবের
শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়ে ভোগবাদী স্বার্থপর গোষ্ঠীগুলি তাদের অস্ত্র ও প্রয়োজনীয়
সরঞ্জাম যোগান দিয়ে ব্যবসা বাড়াতে তৎপর হয়ে উঠবে। অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ
প্রতিনিয়ত এই ধর্মরক্ষাকারী উন্মাদদের হাতে প্রাণ বিসর্জন দেবেন। এই কি
সভ্যতার অনিবার্য পরিণতি? গোষ্ঠী ও সাম্প্রদায়িক চেতনার উর্ধ্বে উঠে সমগ্র
মানবসমাজ কে এ নিয়ে ভাবতে হবে। এই ভাবনা ও তা বাস্তবায়িত করবার সক্রিয়তাই
সমাজকে রক্ষা করতে পারে। নিরপেক্ষভাবে সত্যসন্ধানের পথে যে বাধাই আসুক তাকে
উৎপাটিত করাই হবে যথার্থ প্রগতিশীলতা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন