লিখেছেন : অভিরূপ সরকার
কেন্দ্রের বঞ্চনা কথাটা বাম আমলে খুব শোনা যেত৷ বাম নেতারা বলতেন , কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণের জন্যই রাজ্যের এই হাল৷ বলতেন , কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না বলে রাজ্যের উন্নতি আটকে যাচ্ছে , ইস্কুল -কলেজ , রাস্তাঘাট -হাসপাতাল কিছুই দরকার মতো তৈরি করা যাচ্ছে না৷ অথচ রাজধানী দিল্লির দিকে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যাবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালা হচ্ছে সেখানে৷ একে বঞ্চনা না বললে বঞ্চনা কাকে বলব ? তখন কেন্দ্রে , বছর পাঁচেক বাদ দিলে , কংগ্রেসেরই রাজত্ব৷ তার মধ্যে আবার কিছু দিন বামেদের সমর্থনে রাজত্ব করেছে কংগ্রেস৷ যখন বাম -কংগ্রেসে ঝগড়াঝাটি চলত তখন কংগ্রেসিরা বলতেন , বামফ্রন্ট নিজের অপদার্থতা ঢাকার জন্য নানা রকম অজুহাত দেখায়৷ তার ভিতর কেন্দ্রের বঞ্চনার অজুহাতটা ফাটা রেকর্ডের মতো বেজেই চলেছে৷
কেন্দ্রের বঞ্চনা কথাটা বাম আমলে খুব শোনা যেত৷ বাম নেতারা বলতেন , কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণের জন্যই রাজ্যের এই হাল৷ বলতেন , কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না বলে রাজ্যের উন্নতি আটকে যাচ্ছে , ইস্কুল -কলেজ , রাস্তাঘাট -হাসপাতাল কিছুই দরকার মতো তৈরি করা যাচ্ছে না৷ অথচ রাজধানী দিল্লির দিকে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যাবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালা হচ্ছে সেখানে৷ একে বঞ্চনা না বললে বঞ্চনা কাকে বলব ? তখন কেন্দ্রে , বছর পাঁচেক বাদ দিলে , কংগ্রেসেরই রাজত্ব৷ তার মধ্যে আবার কিছু দিন বামেদের সমর্থনে রাজত্ব করেছে কংগ্রেস৷ যখন বাম -কংগ্রেসে ঝগড়াঝাটি চলত তখন কংগ্রেসিরা বলতেন , বামফ্রন্ট নিজের অপদার্থতা ঢাকার জন্য নানা রকম অজুহাত দেখায়৷ তার ভিতর কেন্দ্রের বঞ্চনার অজুহাতটা ফাটা রেকর্ডের মতো বেজেই চলেছে৷
লক্ষ করার ব্যাপার হল , রাজ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলানোর পরেও ছবিটা পাল্টালো না৷ বঞ্চনার অভিযোগের তির এখনও সেই কেন্দ্রের কংগ্রেসি সরকারের দিকে , তবে এ বার অভিযোগকারিণী স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বস্ত্তত , এই দু’দিন আগেও রঘুরাম রাজন কমিটির রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি আর্থিক বৈষম্যের অভিযোগ নিয়ে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর দন্তরের সামনে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদরা বিক্ষোভ জানিয়েছেন৷ সত্যিই কি এই সব অভিযোগ এক কথায় উড়িয়ে দেওয়ার মতো ? বাম আমলেও কি এই অভিযোগের কোনও সারবত্তা ছিল না ? আর সম্প্রতি কি এমন কিছু ঘটেছে যার ফলে অভিযোগের কারণগুলো তীব্রতর হয়েছে ? এতগুলো প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর পেতে গেলে আমাদের কিছু প্রাসঙ্গিক তত্ত্ব ও তথ্যের দিকে তাকাতে হবে৷
যে সব তাত্ত্বিক কেন্দ্র -রাজ্য আর্থিক সম্পর্কের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা নিয়ে চিন্তা -ভাবনা করেন তাঁরা বলেন , কেন্দ্রে এবং রাজ্যে যদি দু’টি বিরুদ্ধ দল ক্ষমতায় থাকে কিংবা যদি রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয় তা হলে সাধারণত কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যকে তার প্রাপ্যের তুলনায় কম অর্থ মঞ্জুর করার চেষ্টা করবে৷ এর কারণগুলো বোঝা শক্ত নয়৷ প্রথমত , কেন্দ্রে ও রাজ্যে দু’টি আলাদা দল ক্ষমতায় থাকলে কেন্দ্রীয় সরকারের এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে , কেন্দ্রের পাঠানো অর্থ খরচ করে রাজ্য সরকার নিজে বাহবা নিতে পারে , রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে পারে৷ কাজেই টাকা যত কম পাঠানো যায় ততই কেন্দ্রের পক্ষে নিরাপদ৷ দ্বিতীয়ত , রাজ্যে সরকার যত স্থায়ী হবে ততই সেখানে বাড়তি টাকা খরচ করার উপযোগিতা কমবে৷ রাজ্যে কেন্দ্রের বন্ধু সরকার থাকলেও কমবে , বিরোধী সরকার থাকলেও কমবে৷ অর্থাত্, রাজ্যে যদি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আশা ক্ষীণ হয় তা হলে টাকা খরচের হয় দরকার নেই নয় উপযোগিতা নেই৷ এই সব ব্যাখ্যার অবশ্য ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলিকে স্বার্থান্বেষী ও সংকীর্ণমনস্ক হিসেবে ভাবা হয়েছে যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ভোট পাওয়া৷ এই ভাবনা একশো ভাগ না হলেও খানিকটা সত্য তো বটেই৷
প্রশ্ন হল , তথ্য দিয়ে এই সব তত্ত্বকে দাঁড় করানো যায় কি ? বছর চারেক আগে বিলেতের ওয়ারিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন এবং দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আর এক জন অর্থনীতিবিদ যৌথ ভাবে এই বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন (অরুলামপলম , দাশগুন্ত , ধীলোঁ এবং দত্ত --- ‘ইলেকটোরাল গোল্স্ অ্যান্ড সেন্টার --- স্টেট ট্রান্সফার্স্: এ থিয়োরেটিকাল মডেল অ্যান্ড এম্পিরিকাল এভিডেন্স ফ্রম ইন্ডিয়া ’, জার্নাল অফ ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স , ২০০৯ )৷ ১৯৭৪ -৭৫ থেকে ১৯৯৬ -৯৭ এই বাইশ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে এঁরা দেখিয়েছিলেন , ভারতের যে রাজ্যগুলি কেন্দ্রের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন এবং যেখানে সুইং ভোট বেশি তারা অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় কেন্দ্রীয় অনুদান বেশি পেয়েছে৷
এখানে দুটো কথা বলার আছে৷ প্রথমত , কেন্দ্রীয় অনুদানকে দু’টি ভাগে ভাগ করা যায় , একটি ফর্মুলা ভিত্তিক , অন্যটি অনেকাংশেই কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল৷ ফর্মুলা ভিত্তিক অনুদানে খুব বেশি বৈষম্যের জায়গা ছিল না , কেন্দ্রীয় ইচ্ছাধীন যে অনুদান সেখানেই বৈষম্যটা ঘটেছে৷ দ্বিতীয়ত , উপরি উক্ত দু’টি কারণেই পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রের কৃপালাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছে৷ আলোচ্য বাইশ বছরের প্রথম দু’টি বছর বাদ দিলে বাকি কুড়ি বছর কেন্দ্রে এবং রাজ্যে পরস্পরের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন দু’টি সরকার ক্ষমতাসীন ছিল৷ তা ছাড়া এই রাজ্যে দীর্ঘ কাল রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সম্ভাবনা ছিল না৷ অতএব , দু’দিক থেকেই পশ্চিমবঙ্গ মার খেয়েছে৷
গত কুড়ি -পঁচিশ বছরে ভারতীয় রাজনীতির চেহারাটায় একটা আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে৷ আঞ্চলিক দলগুলি প্রভূত শক্তি অর্জন করেছে , বিভিন্ন রাজ্যে সর্বভারতীয় দল কংগ্রেস এবং বিজেপির উল্লেখযোগ্য শক্তিক্ষয় হয়েছে৷ কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার জন্য বড়ো দলগুলোকে এখন অনিবার্য ভাবে আঞ্চলিক দলগুলোর উপর নির্ভর করতে হয়৷ ফলে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার এই বিকেন্দ্রীকরণকে সামলাবার জন্য কেন্দ্রকে এমন একটা আইন প্রণয়ন করতে হয়েছে যা দিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতাসীন আঞ্চলিক দলগুলির উপর খানিকটা কর্তৃত্ব বজায় রাখা যায়৷ এই নতুন আইনের পোশাকি নাম ‘ফিসকাল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট ’ বা সংক্ষেপে এফ আর বি এম৷
আপাতদৃষ্টিতে এফ আর বি এম -এর উদ্দেশ্য মহত্ , ঋণগ্রস্ত রাজ্যগুলির ঋণের পরিমাণ আয়ত্তের মধ্যে রাখা৷ এই আইন অনুযায়ী , প্রত্যেক বছর প্রতিটি রাজ্যকে তার মোট রাজকোষ ঘাটতি রাজ্যের মোট বাত্সরিক উত্পাদনের আড়াই শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখতে হবে এবং রাজস্ব ঘাটতি নামিয়ে আনতে হবে একেবারে শূন্যে৷ অবশ্য রাজ্যকে এই আইন গ্রহণ করতেই হবে এমন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই৷ কিন্ত্ত রাজ্য যদি এই আইন গ্রহণ না করে তা হলে সে কেন্দ্রীয় অনুদানের একটা বড়ো অংশ থেকে বঞ্চিত হবে৷ অতএব , আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও , বছরের পর বছর এই আইনকে উপেক্ষা করা কোনও রাজ্যের পক্ষেই সম্ভব নয়৷ প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুন্ত অবশ্য এই আইন মেনে নেওয়ার তুলনায় ক্রমাগত ঘাটতি বাড়িয়ে যাওয়াটাকে রাজ্য শাসনের সহজতর পন্থা মনে করেছিলেন৷ ২০১০ সালের জুলাই মাসে , বামফ্রন্ট রাজত্বের একেবারে শেষ পর্যায়ে , যখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন প্রায় নিশ্চিত , একমাত্র তখনই তিনি পরবর্তী সরকারের ঘাড়ে ঋণের বিপুল বোঝা চাপিয়ে দিয়ে , এফ আর বি এম গ্রহণ করেছিলেন৷ অডিটর অ্যান্ড কম্পট্রোলার জেনারেলের রিপোর্ট অনুযায়ী দেরিতে এফ আর বি এম আইন গ্রহণ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতি হয়েছে অন্তত ৩১৫৮ কোটি টাকা৷
কারণ ২০০৫ থেকে ২০১০ এই কয়েক বছরে ঋণমুক্তি বাবদ যে সুবিধে কেন্দ্রের কাছ থেকে পাওয়া যেত তা পাওয়া যায়নি৷
এ নিয়ে তর্ক চলে না যে , রাজ্যগুলির ঘাটতিতে রাশ টানার বিলক্ষণ দরকার আছে৷ কিন্ত্ত এফ আর বি এম আইনের মূল সমস্যা হল রাজ্যগুলিকে যেখানে অত্যন্ত কড়া নিয়মের মধ্যে থেকে আয় বাড়ানো এবং খরচ কমানোর চেষ্টাটা চালিয়ে যেতে হচ্ছে , কেন্দ্রীয় সরকারের তেমন কোনও বালাই নেই৷ গত কেন্দ্রীয় বাজেটে যে ঘাটতির অনুপাত জাতীয় আয়ের পাঁচ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছে সে ব্যাপারে এফ আর বি এম নীরব৷ অথচ , অনুদান কেটে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে সমস্ত রাজ্যগুলিকে তাদের রাজকোষ ও রাজস্ব ঘাটতি কমাতে বাধ্য করা হয়েছে৷ আইনের এই বৈষম্য , বলাই বাহুল্য , অভিপ্রেত নয়৷ এর থেকে মনে হয় , রাজ্যগুলির বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও এই আইনের উদ্দেশ্য রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল করে রাখা৷ বস্ত্তত , জোট রাজনীতির বাতাবরণে আঞ্চলিক দলগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার কাজে এফ আর বি এম আইন কেন্দ্রের তূণে এক অপরিহার্য আয়ুধ৷
কী ভাবে এফ আর বি এম রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল করে তুলছে সেটা আর একটু স্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে৷ প্রত্যেক রাজ্যেই কিছু খরচ আছে যা রাতারাতি কমানো যায় না , যেমন , সরকারি কর্মচারীদের বেতন , পেনশন , সুদ সমেত পুরনো ধার শোধ৷ এ দিকে এফ আর বি এম -এর শর্ত মেনে চলতে গেলে খরচ কমাতেই হবে , কারণ রাতারাতি রাজস্ব বাড়ানোও সম্ভব নয়৷ অতএব , খরচ কমানোর খাঁড়াটা গিয়ে পড়ছে উন্নয়নমূলক কাজের উপর৷ কিংবা বলা যেতে পারে , উন্নয়ন খাতে খরচের জন্য রাজ্যগুলিকে আলাদা করে কেন্দ্রের কাছে হাত পাততে হচ্ছে৷ বাড়ছে কেন্দ্রের উপর রাজ্যগুলির নির্ভরতা৷ এই প্রসঙ্গে আর একটি গবেষণাপত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে৷ নতুন দিল্লির ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক ফাইনান্স অ্যান্ড পলিসি ’-র পিনাকী চক্রবর্তী এবং ভারতীভূষণ দাস সম্প্রতি দেখিয়েছেন , এফ আর বি এম আইন প্রণয়নের ফলে ভারতীয় রাজ্যগুলিতে উন্নয়নমূলক খরচ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছে৷
অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের সংকট আরও বেশি৷ ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা বিরাট ঋণের বোঝা উত্তরাধিকার সূত্রে নতুন সরকারের ঘাড়ে চেপে বসেছে৷ রাজ্যের আয় অনেকটা বাড়িয়েও তেমন লাভ হচ্ছে না যেহেতু বর্ধিত রাজস্বের বেশির ভাগটাই পুরনো ঋণ ফেরত দিতে এবং পুরনো ঋণের উপর সুদ গুনতে চলে যাচ্ছে৷ এই অবস্থায় এফ আর বি এম -এর কামড়টা রাজ্যের অর্থনীতিকে , বিশেষ করে উন্নয়নকে , আরও সাংঘাতিক ভাবে জখম করেছে৷ অতএব , মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি দিল্লির কাছ থেকে ঋণমুক্তির জন্য একটি এককালীন অর্থনৈতিক প্যাকেজ দাবি করেন এবং সেই দাবি অগ্রাহ্য করাটাকে কেন্দ্রের গাফিলতি মনে করেন তা হলে সেই ভাবনাকে অন্যায্য বলা চলে না৷ মনে রাখতে হবে , কিছু দিন আগে বিহারের সাংসদরাও অনুরূপ দাবি নিয়ে দিল্লিতে ধর্নায় বসেছিলেন৷
সৌজন্যে : এই সময়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন