লিখেছেন
: সুব্রত বিশ্বাস
সম্প্রতি খুন হয়ে গেলেন ভারতের কুসংস্কার-বিরোধী আন্দোলনের
নেতা নরেন্দ্র দাভোলকার। ওস্কারেশ্বর
সেতুর ওপর আততায়ীরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করেছে। ভারতবর্ষের মতো কুসংস্কারের দেশে এমন
হত্যাই স্বাভাবিক। ’অন্ধ
শ্রদ্ধা নির্মূলন’
সমিতির অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। অন্ধ
শ্রদ্ধা নির্মূলন? মারণ-উচাটন-বশীকরণ, তাবিজ-কবজের দেশে ঐ নামটাই তো আতঙ্কের কারণ। তাবিজ-কবচ, পাণ্ডা, ধর্ম-ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে দাভোলকারদের তো সরে যেতেই হবে।
দাভোলকারই কি এই প্রথম শিকার ?
না, গ্যালিও’র মতো ব্যক্তিকেও কত হেনস্তা হতে হয়েছে। আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি ১৬০০ সালের সেই
কোপার্নিকাসের কথা? ইতালির বিজ্ঞানী জিওর্দানো ব্রুনোকে কিভাবে পাদ্রীরা পুড়িয়ে মেরেছিল। সেই
থেকে তিনি হলেন বিজ্ঞানের শহীদ। যেমন
হলেন নরেন্দ্র দাভোলকার ২০১৩ সালের শেষার্ধে এসে ভারতের মাটিতে।
পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতে শিক্ষিতের হার বাড়ছে। ভারতের সাথে তুলনা না করেও বলা চলে
বাংলাদেশেও শিক্ষিতের হার বাড়ছে সন্দেহ
নেই। কিন্তু তাই বলে কমছে কী তাবিজ-কবচ, মারণ, উচাটন,
বিজ্ঞান-বিরোধী জ্যোতিষের সংখ্যা ? কমেছে কি অন্ধবিশ্বাস ?
আর কমবেই বা কি করে ! যে দেশের
নেতা-নেত্রীরা কথায় কথায় মন্দিরে ছোটেন, মাজারে ছোটেন, জ্যোতিষীদের শরণাপন্ন হয়ে নমিনেশন জমা করেন, শপথ নেন, কিংবা নারকেল ফাটিয়ে প্রকল্পের উদ্বোধন করেন,
সেদেশে সাধারণ মানুষের এই কুসংস্কার দূর হবে কী করে ? দেশের মানুষ ভক্তিতে যেমন মদ খায়, আবার তেমনি কাদা খায়, শিকড়-বাকড় খায়, প্রসাদ খায়, শিন্নী খায়, হাসপাতালেও যায়। আর যখন পূজায় দেবদেবীর প্রসাদ খেয়ে
অসুস্থ হয় কিংবা পূণ্য জল বলে জোয়ারের ঘোলা জল খেয়ে অসুস্থ হলেন,
সেই দেবদেবী কিন্তু আর
ভক্তের জীবনের দায়িত্ব নিলেন না। শেষ
পর্যন্ত ছুটতে হয় বিজ্ঞান-পড়া ডাক্তারের কাছে। তাই বলি, দেবদেবীর প্রতি এতই যখন ভক্তি এবং বিশ্বাস, তখন পূজা স্থলে শুয়ে রইলেইতো লেটা চুকে যায়? ভারত-বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশে নানান পূজায় এখনও ছাগল বলি,
মেষ বলি, হাঁস, কবুতর বলি হয়। কিন্তু কেন এই বলি? পুরোহিতের যুক্তি-ছাগল এবং মহিষদের পশু-জীবন থেকে মুক্তি দিতে তাদের
বলি দিয়ে স্বর্গে পাঠানো হচ্ছে। জানতে
ইচ্ছে করে, বলি দিলে যদি শাপমুক্তি
এবং স্বর্গালাভ হয়,
তাহলে পুরোহিতরা তাদের বাবা-মাকে বলি
দিয়ে স্বর্গপ্রাপ্তিতে
সাহয্য করছেন না কেন? নয়তো বলছেন না কেন, বলি দেওয়া, পশু ভক্ষণ পাপ? একথা কি অস্বীকার করা যায় যে, বলি-প্রথা, যজ্ঞ ইত্যাদি সৃষ্টি হয়েছিল ক্ষুধা নিবৃত্তির কারণেই?
যদিও এটা একমাত্র কারণ নয়। মজার
ব্যাপার, কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রে পড়েছিলাম,
’রাজ্যের স্বার্থে যজ্ঞ’। অর্থাৎ যজ্ঞ করলে শিল্প আসবে? দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিরোধ হবে?
বেকারী ঘুচবে ? তবে একথা ঠিক,
যজ্ঞে শিল্পবৃদ্ধি,
দ্রব্যমূল্যরোধ কিংবা
বেকারী ঘুচুক বা না ঘুচুক মন্ত্রী-এমপি,
মূখ্যমন্ত্রীর ভাগ্য যে খুলবে
সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো,
এতো সরাসরি বিজ্ঞান-বিরোধী চিন্তাধারা।
এটাতো মানুষকে তবোবনের যুগে ফিরিয়ে
নিয়ে যাবার চেষ্টা। শাস্ত্রেই দেখতে পাওয়া যায়, নাস্তি যজ্ঞ ফলং, নাসি পরলোক; আর দাভোলকাররা এ কথাগুলোই বলতে চেয়েছিলেন। তবু খুন হয়ে যেতে হলো। কারণ,
এর মূলে কুসংস্কার এবং অন্ধত্ব
আর আছে যুক্তিহীনতা। সাধারণ মানুষ একবারও
ভেবে দেখেন না, মন্দিরগুলোতে কোটি
কোটি টাকা, সোনা, রত্ন ইত্যাদি
জমে ওঠে কার স্বার্থে! ভারতেরই পত্রিকার খবর, সম্প্রতি ত্রিবান্দ্রমের পদ্মাভন মন্দির থেকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার ধনরত্ন পাওয়া
গেছে। যার মধ্যে এক হাজার কেজি সোনাও আছে। এই সম্পদ কার ?
দেবতা ? কে সেই দেবতা ? যিনি এমন ভোগী এবং লোভী, তিনি তো দেবত্ব অর্জন করতে পারেন না। কেউ ভাবতে পারেন, পুরী কিংবা তিরুপতি মন্দিরের বার্ষিক আয়
কত ? কোন্ দেবতা ভোগ করছেন
তা ? বছর কয়েক
আগে কাঞ্চীর শঙ্করাচার্য্য জয়েন্দ্র স্বরস্বতী খুনের মামলায় জেলে গেলে কেবল মাত্র কাঞ্চী মঠের হিসেব
বেরিয়েছিল ৬ হাজার কোটি টাকা সম্পদেরও
বেশি। মঠের বিগ্রহ সোনা দিয়ে তৈরীর জন্য ৭০ কেজি সোনা খরিদ করা হয়। জয়েন্দ্র স্বরস্বতীর বিরুদ্ধে এই
স্বর্ণের অর্ধেক আত্মসাৎ করার অভিযোগ
উঠে। ধর্মের নামে দান করা এসব অঢেল ধন সম্পদে ফুলে-ফেঁপে ওঠেন পাণ্ডা-পুরোহিতরা। শুধু কি তাই,
আরও অনেকসব ব্যাপার
আছে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তোলেন না।
প্রশ্ন তোলেন না বলেই আজও মহিলাদের ডাইনী বদনাম দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এইতো মাস ছয়েক আগে কলকাতা শহর
থেকে মাত্র ৬০/৭০ মাইল দূরে তিনজন মহিলার
ওপর ডাইনী অপবাদ তুলে অমানুষিকভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। আর তা করেছে খোদ সরকারী দলের
পা-ারা প্রকাশ্য দিবালোকে,
সভা করে, জমায়েত করে।
অসুখ-বিসুখে পানিপড়া খাওয়ানো হয়। ’ঈশ্বরা সিদ্ধে প্রমাণভাব’ একথা কিন্তু কমিউনিষ্টদের নয়। সাংখ্য প্রবচন সূত্রেই একথা বলা আছে। অর্থাৎ ঈশ্বরের
অস্তিত্ব নিয়ে সে যুগেই প্রশ্ন উঠে
গিয়েছিল। তবু অন্ধভক্তি? একথা অনস্বীকার্য,
যখন নগর-সভ্যতা বিভক্ত হয়ে একটি
পুরোহিত-শ্রেণীকে অন্তর্ভূক্ত করে, যে শ্রেণী চিন্তাজগতের বস্তুকে শাস্ত্রে বিধিবদ্ধ করে,
তখন তার ফল হয় ‘ধর্মতত্বের উদ্ভব’। সৃষ্টি হয়, তাকে কেন্দ্র করে কুসংস্কারের শাখা-প্রশাখা। দাভোলকারের লড়াইটা ছিল এই কুসংস্কারের
বিরুদ্ধেই। কিন্তু ধর্মান্ধরা তাঁকে
বাঁচতে দেয়নি। তিনি চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেছেন অজস্র প্রশ্ন আর অসংখ্য বিজ্ঞানমনস্ক
উত্তরসূরিদের। এই উত্তরসুরীরা রইলেন তার পাশে। তাই লড়াইটাও যে জারি রইলো তাতে সন্দেহ নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন