লিখেছেন : ধর্মপ্রাণ প্লেবয়
বহু মানুষের মতে নাস্তিকতা একটি ধর্ম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধার্মিকরা ধর্ম
দ্বারা এতই প্রভাবিত যে,
কোনোপ্রকার ধর্মবিশ্বাসহীন একজন মানুষ
কল্পনা করা তাদের
বোধশক্তির বাইরে। যারা নাস্তিক্যবাদকে ধর্ম বলে দাবী করে,
তাদের নাস্তিক্যবাদ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই এবং যখন ধর্মের
সংজ্ঞা দ্বারা এটিকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করা হয়, তখন সেটি একটি হাস্যকর চেষ্টা হয়ে
দাঁড়ায়।
নাস্তিক্যবাদ কোনো কাঠামোবদ্ধ বিষয় নয়। সাধারণভাবে বলা যায় স্রষ্টা,
দেবতা বা অতিপ্রাকৃত কোনো কিছুতে
অবিশ্বাসই নাস্তিক্যবাদ। নাস্তিক্যবাদ সব ক্ষেত্রে এক রকম নয় এবং এটা কোনো জীবনদর্শন ও নয়। কারো ইউনিকর্নে অবিশ্বাস যেমন জীবনদর্শন নয়,
তেমনি স্রষ্টায় অবিশ্বাসও জীবনদর্শন হতে
পারেনা। নাস্তিক্যবাদ আস্তিক্যবাদের মত
কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও নির্দেশের সমাবেশ নয়। একজন নাস্তিকের দর্শন যে আঙ্গিকেই হোক না
কেন, ঈশ্বরে
অবিশ্বাস করলেই সে নাস্তিক্যবাদের
আওতাভুক্ত। এটি আস্তিক্যবাদের মত প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করতে বলে না,
এখানে যে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করা যায়,
প্রমাণ চাওয়া যায়।
আস্তিক্যবাদ ও নাস্তিক্যবাদের মধ্যে কিছু তুলনামূলক বৈশিষ্ট্য ও
পার্থক্যসমূহ:
১. আস্তিকরা স্রষ্টা/দেবতা ও অতিপ্রাকৃত বিষয় ও ঘটনাবলিতে বিশ্বাস করে,
কিন্তু নাস্তিকরা এ ধরনের কোনো কিছুতে
বিশ্বাস করে না।
২. ধর্মগুলোয় কিছু অন্ধবিশ্বাসের বিষয় থাকে, যে-ব্যাপারগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ, কিন্তু নাস্তিক্যবাদে এমন কোনো অন্ধবিশ্বাসের স্থান নেই।
৩. ধর্মগুলোয় 'পবিত্র'
ও 'অভিশপ্ত' এ দুই ভাগে বস্তুসমূহ ও
প্রাণিজগৎকে ভাগ করা হয়, কিন্তু নাস্তিক্যবাদে এমন কিছু নেই।
৪. ধর্মগুলোয় স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নিত্যপালনীয় কিছু কাজ থাকে,
যা নাস্তিক্যবাদে অনুপস্থিত।
৫. নাস্তিকরা যৌক্তিক চিন্তা ও বৈজ্ঞানিক তথ্য দ্বারা ধর্মের অযৌক্তিক বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা
করতে ও তা তুলে ধরতে পারে, কিন্তু আস্তিকরা
ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টায় প্রাণপাত করে থাকে।
৬. আস্তিকরা বিশ্বাস করে, তাদের প্রধান কাজ - স্রষ্টার উপাসনা করা, কিন্তু নাস্তিকরা এ ধরনের বিশ্বাস থেকে মুক্ত।
৭. আস্তিকরা অস্বাভাবিক ঘটনায় স্রষ্টার প্রভাব খুঁজে পায়,
আর নাস্তিকরা খুঁজে পায় বাস্তব কারণ।
৮. নাস্তিকরা আস্তিকদের মত কোনো বইকে ঈশ্বরপ্রদত্ত ও সম্পূর্ণ নির্ভুল দাবী
করে না।
৯. আস্তিকদের নির্দিষ্ট উপাসনার স্থান ও ধর্মীয় সঙ্গীত/প্রার্থনাবাণী থাকে,
থাকে পবিত্র তীর্থস্থান,
যা নাস্তিকদের জন্য অবান্তর।
১০. আস্তিকদের নির্দিষ্ট ধর্মগুরু (পাদ্রী, ইমাম, পুরোহিত ইত্যাদি) থাকে।
কিন্তু নাস্তিকদের এমন কেউ নেই, যার মত
বা বাণী তাদের জন্য শিরোধার্য। অবশ্য যদি অন্যদের সাথে নিজমত বিনিময় করলে তাকে প্রচারক বলা হয়,
তবে প্রত্যেক নাস্তিকই প্রচারক। কিন্তু
প্রকৃত অর্থে
তাদেরকে ধর্মপ্রচারকদের সাথে তুলনা করা যায় না। কারণ ধর্মপ্রচারকরা
সুনির্দিষ্ট একটি মত প্রচার করে যেখানে
ভিন্ন মতের কোন মূল্য নেই,কিন্তু
নাস্তিকরা শুধুমাত্র নিজ মত অন্যদের সাথে
বিনিময় করে, ধার্মিকদের মত
অন্যের ওপর নির্দিষ্ট মত চাপিয়ে দেয়
না।
১১. আস্তিকদের বাধ্যতামূলকভাবে ধর্ম সম্পর্কিত কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনা বিশ্বাস করতে হয়, কিন্তু নাস্তিকদের এমন কিছু বিশ্বাস করতে হয় না।
১২. আস্তিকরা তাদের কল্পিত স্রষ্টার সাথে যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন রীতি-নীতি পালন করে,
কিন্তু নাস্তিকরা যেহেতু
স্রষ্টায় বিশ্বাসই করে না,
সেহেতু এমন যোগাযোগের চেষ্টার প্রশ্নও
নেই।
১৩. নির্দিষ্ট ধর্মে সকল ভৌগোলিক অঞ্চলের জন্য একই এবং সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতি পালন করতে বলা হয়।
কিন্তু নাস্তিক্যবাদ ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে গড়ে ওঠে এবং সে অঞ্চলের সভ্যতা ও
সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে,ধর্মের মত একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতিকে
সর্বজনীন বলে জোর করে চাপিয়ে দেয় না।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে নাস্তিক্যবাদ ধর্মের সবকটি বৈশিষ্ট্যকে অমান্য করে।
কাজেই নাস্তিক্যবাদকে কোনোভাবেই ধর্ম বলা
যায় না। আস্তিক্যবাদ ও নাস্তিক্যবাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন শ্রেণীর, ভিন্ন প্রকৃতির ও বস্তুত বিপরীতমুখী।
নাস্তিক্যবাদ হল একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে
(স্রষ্টা ও অতিপ্রাকৃত বিষয়) অবিশ্বাস, যেখানে আস্তিক্যবাদ হল কিছু রীতিনীতি, প্রাচীন কিছু ঘটনাবলির কাল্পনিক রূপ ও ঈশ্বরবিশ্বাসের সংমিশ্রণ। এদের মধ্যে
সামান্যতম মিলও নেই। প্রকৃতপক্ষে আস্তিকদের অজ্ঞতা ও ধর্ম বিষয়ে ধারণার অভাবই নাস্তিক্যবাদকে
ধর্ম হিসাবে দাবী করার কারণ।
(পাঠকদের কেউ ধর্মের সঙ্গে নাস্তিক্যবাদের আমূল পার্থক্য বিষয়ে আরও কিছু
যুক্তির অবতারণা করতে পারলে সেসবও এই
পোস্টে সংযোজন করা হবে)
নাস্তিক্যবাদকে ধর্মের সঙ্গে যারা তুলনা করে থাকে, তাদের বলতে
ইচ্ছে করে:
১. নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে "অফ" বাটনকে টিভি চ্যানেল বলতে হয়।
২. নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে টাককে বলতে হয় চুলের রং।
৩. নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে স্ট্যাম্প না জমানোকে হবি বলতে হয়।
৪. নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে "বাগান না করাও একটি শখ, ক্রিকেট না
খেলাও একটি ক্রীড়া, কোকেইন সেবন না করাও একটি নেশা।" (ইনভার্টেড কমাবদ্ধ অংশটির সূত্র : জুবায়ের
অর্ণব)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন