লিখেছেন
: আসিফ হাসান
মহাবিশ্বে বাসযোগ্য পৃথিবী কি একটাই? নাকি অনেক পৃথিবী রয়েছে। যদি থেকে থাকে, তবে কোথায়? বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ দিন ধরে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আর এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে নানা তত্ত্বের। তবে সাধারণভাবে সবাই একমত, আমাদের এই পৃথিবী এই মহাবিশ্বে কোটি কোটি বিশ্বের সঙ্গী।
বিশ্বের সৃষ্টিরহস্য নিয়ে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের
গবেষণা মাইলফলক হয়ে আছে।
তবে তারপর আরো গভীর পর্যালোচনা ও গবেষণা হয়েছে। আইনস্টাইন কেবল
পদার্থবিদ্যার সূত্রের মধ্যেই বাঁধতে
চেয়েছিলেন এই বিশ্বরহস্যকে। কিন্তু এখন কেবল আর অনুমান বা তত্ত্বনির্ভর নয়, গবেষকেরা পরীালব্ধ প্রমাণ হাজির করতে কাজ করছেন। প্রথম দিকের গবেষকেরা কেবল আমাদের
বিশ্বের মধ্যে কী রয়েছে, সে গবেষণা
করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে গবেষকেদের ল্য, আমাদের এই বিশ্বের বাইরে অন্যান্য বিশ্বের সন্ধান করা। মাল্টিভার্স বা
অনন্ত বিশ্বের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বিগ ব্যাং তত্ত্ব, ইনফ্যাশনারি কসমোলজি বা স্ফীতিতত্ত্ব ও
স্ট্রিং থিওরি। এই তিনটি তত্ত্ব নিয়ে
কাজ করছেন- এমন গবেষকদের ভাষ্য, আমরা
অনন্য বিশ্বে নয়, আমরা অনন্ত ও কোলাহলপূর্ণ বিশ্বে বাস করছি। আমাদের
বিশ্বের বাইরে যেসব বিশ্ব রয়েছে, সেই বিশ্ব আমাদের বিশ্বের চেয়ে সম্পূর্ণ
আলাদা হতে পারে।
অনন্ত মহাবিশ্ব বা একাধিক বিশ্বের এই তত্ত্ব নিয়ে সব
গবেষকেরা একমত নন। অনেকে
এই ধারণাকে এখনো অনুমাননির্ভর ও বিজ্ঞানের ব্যাখ্যাতীত ও বাস্তবতা-বিবর্জিত বিষয় বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। আমরা কোন পে
যাব,
কী বিশ্বাস করব? অনন্ত
মহাবিশ্ব,
নাকি একক মহাবিশ্ব? এ প্রশ্নের জবাবের জন্য বিগ ব্যাং
তত্ত্বের শরণাপন্ন হতে হবে।
১৯১৫ সালে ‘জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি’ বা আপেকিতার তত্ত্ব প্রকাশ করেন আইনস্টাইন। একটি সমীকরণের মাধ্যমে তিনি মহাবিশ্ব
সৃষ্টি ও পরিণতির ব্যাখ্যা
দিলেন। এই ব্যাখ্যার ফলেই ‘স্পেস-টাইম’ বা স্থান-কালের ধারণার বিবর্তন দেখা যায়।
গবেষকদের পরবর্তী তত্ত্ব ছিল মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ।
অর্থাৎ প্রতিটি গ্যালাক্সি
বা ছায়াপথ পরস্পর থেকে প্রতিনিয়ত দূরে সরে যাচ্ছে। মার্কিন
জ্যোতির্বিদ এডউইন হাবল ১৯২৯ সালে
বিষয়টি নিশ্চিত করেন। গবেষকেরা ভাবতে শুরু করলেন, মহাবিশ্ব যদি সম্প্রসারিত হতে থাকে, এই সম্প্রসারণ শুরুর আগে নিশ্চয় মহাবিশ্বের উপাদানগুলো একসঙ্গে প্রচণ্ড ঘনত্ব
নিয়ে ুদ্র অবস্থায় ছিল।
সুদূর কোনো অতীতে এই ুদ্র বস্তুটিই বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং
ক্রমাগত প্রসারিত হতে থাকে। গবেষকেরা এই
ঘটনাটিরই নাম দিলেন ‘বিগ ব্যাং’। এ তত্ত্বটি অনেকের সমর্থনও পেল। তবে তারা বিগ ব্যাং
তত্ত্বের মধ্যেও দুর্বলতা
খুঁজে পেলেন। তাদের প্রশ্ন, বিগ
ব্যাংয়ের ফলে সবকিছুই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে
পড়লে এই অঘটনের পেছনে কোন শক্তি আর কেনই বা ঘটল বিগ ব্যাং? এই শক্তির প্রমাণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা গবেষকেরা দাঁড় করাতে
পারেননি।
গত শতকের আশির দশকে পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালেন গোথ বিগ
ব্যাং থিওরির বর্ধিত সংস্করণ
উপস্থাপন করলেন; যাকে বলা হয়
ইনফ্যাশনারি কসমোলজি বা স্ফীতিতত্ত্ব। তার তত্ত্বে উঠে এলো মহাজাগতিক এক
জ্বালানির তথ্য, যা এই বিগ
ব্যাং ঘটাতে পারে। আর এই জ্বালানির ফলে
মহাজাগতিক বিস্ফোরণে বেলুনের মতো স্ফীত হতে শুরু করে মহাবিশ্ব। বিগ ব্যাং তত্ত্ব
প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আশির দশকে ইনফ্যাশন বা স্ফীতিতত্ত্ব নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের
প্রান্তিক গণিতগুলো সমাধান
করতে গিয়েই এই অদ্ভুত ব্যাপারটি ক্রমেই বেরিয়ে আসছিল। এ সময়কার
গবেষক আলেকজান্ডার ভিলেঙ্কিন এবং আদ্রে
লিন্ডে খুব অবাক হয়ে ল করলেন মহাজাগতিক স্ফীতি একবার শুরু হলে আর থামে না। এ
ব্যাপারটিকেই বিজ্ঞানীরা বর্তমানে ‘চিরন্তন স্ফীতি’ নাম দিয়েছেন। অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা মূলত এই
চিরন্তন স্ফীতিতত্ত্বেরই স্বাভাবিক একটি
গাণিতিক পরিণতি। আমাদের মহাবিশ্ব যদি কোয়ান্টাম ফাকচুয়েশনের মধ্য দিয়ে স্থান-কালের
শূন্যতার ভেতর দিয়ে আবির্ভূত
হয়ে থাকে,
তবে এই পুরো প্রক্রিয়াটি কিন্তু
একাধিকবার ঘটতে পারে। সৃষ্টির
উষালগ্নে স্ফীতির মাধ্যমে সম্প্রসারিত বুদবুদ থেকে আমাদের মহাবিশ্বের মতোই অসংখ্য মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে, যেগুলো একটা অপরটা থেকে পৃথক।
মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের আবিষ্কার বৈপ্লবিক হলেও
সম্প্রসারণের একটি বিষয়ে সব গবেষকেরা একমত। পৃথিবীর মহাকর্ষ বল যেমন কোনো বলকে
ওপরের দিকে যেতে বাধা দেয়, তেমনি প্রতিটি গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের মধ্যে বিদ্যমান
আকর্ষণ বলও মহাবিশ্বের
সম্প্রসারণের েেত্র প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। ১৯৯০ সালে জ্যোতির্বিদদের দুটি দল সম্প্রসারণের েেত্র এ ধীরগতির
তথ্য বের করেন। বিভিন্ন
ছায়াপথ পর্যবেণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে গবেষকেরা মহাবিশ্ব
সম্প্রসারণের একটি নির্দিষ্ট গতি বের
করেন। এই বিশ্লেষণ শেষ হলে তারা ল করলেন ৭০০ কোটি বছর আগে থেকে এই মহাবিশ্বের মধ্যে
সম্প্রসারণের গতি বেড়ে গেছে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব এখন কেবল সম্প্রসারিত হচ্ছে।
গবেষকদের মতে ‘ডার্ক
এনার্জির’ কারণেই এই সম্প্রসারণ ঘটছে। তবে এখনো ডার্ক এনার্জির
বিস্তারিত জানা
যায়নি।
ডার্ক এনার্জি রহস্যের সমাধান করতে মাল্টিভার্স বা অনন্ত
এই মহাবিশ্বের প্রশ্নের
একটা সমাধান হতে পারে। গবেষণার তৃতীয় প্রান্তিকে এসে দেখা মেলে
স্ট্রিং তত্ত্বের।
স্ট্রিং তত্ত্ব হচ্ছে, আইনস্টাইনের ইউনিফায়েড থিওরি বা একীভূত করার
তত্ত্ব, যেখানে তিনি সব বস্তু ও বলকে একটি গাণিতিক সূত্রের
মাধ্যমে এক করার চেষ্টা
করেছেন। পদার্থের গঠনকাঠামো ব্যাখ্যা করার কষ্টসাধ্য এই বিষয়টিকে
চমৎকার ও সরলভাবে উপস্থাপন করা যায়
স্ট্রিং তত্ত্ব দিয়ে। অতিপারমাণবিক কণা দিয়ে সব ধরনের পদার্থ, সর্বোপরি মহাবিশ্বের সৃষ্টিকে আসলে তুলনা করা যায়
বেহালার তার বা ড্রামের মেমব্রেনের
মাধ্যমে সুর সৃষ্টির সঙ্গে। স্ট্রিং তত্ত্ব মতে, ইলেকট্রনের ভেতরটা যদি অত্যাধুনিক অণুবীণ যন্ত্র দিয়ে
দেখা সম্ভব হতো, তাহলে আমরা কোনো কণা দেখতাম না, আমরা দেখতাম কম্পিত এক তার। অর্থাৎ বর্তমানে পাওয়া মৌলিক কণাগুলো আসলে মৌলিক নয়, এরাও বিভাজ্য। আমরা যদি একটি অতিপারমাণবিক কণার সূক্ষ্ম তারের কম্পনের হার
পরিবর্তন করে দিই, তাহলে
ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আরেকটি অতিপারমাণবিক কণা সৃষ্টি হবে। ধরা যাক
কোয়ার্ক। এখন সেটি যদি আবার পরিবর্তন
করি,
তাহলে হয়তো পাওয়া যাবে
নিউট্রিনো।
স্ট্রিং তত্ত্ব ডাইমেনশনের বা মাত্রার ধারণাও পরিবর্তন
আনে। এতে আপেকিতা আর
কণার বলবিদ্যার একটা পুরোনো বিরোধ মীমাংসার দিকে এগিয়ে যায়। গবেষকেরা
ধারণা করছিলেন, স্ট্রিং তত্ত্ব গাণিতিক কাঠামো হয়তো সবকিছু একই সংজ্ঞার
আওতায় আনতে পারবে। কিন্তু সময় পেরিয়ে
গেলেও এই তত্ত্বের গাণিতিক সূত্র নিয়ে নানা বিশ্লেষণ করে নানা ফল পেলেন গবেষকেরা। সবাই
আলাদাসংখ্যক মহাবিশ্বের সন্ধান পেলেন। আর এই মহাবিশ্বের সংখ্যা এতটাই বেশি হতে
পারে যে ১০-এর পর ৫০০টিরও
বেশি শূন্য হলে যে সংখ্যা দাঁড়ায়, তার
সমান। স্ট্রিং তত্ত্বের মাধ্যমে অনন্য বা একক মহাবিশ্ব খুঁজতে ব্যর্থ হয়ে তারা
মাল্টিভার্স বা অনন্ত
মহাবিশ্বের গুরুত্ব নিয়ে ভাবতে বসেন।
এর পর গবেষকেরা স্ফীতিতত্ত্ব ও স্ট্রিং তত্ত্ব একসঙ্গে
করে সমাধানে চেষ্টা
চালিয়েছেন। তাদের মতে, অনন্ত এই
মহাবিশ্বের সংখ্যা অসংখ্য। স্ফীতিতত্ত্ব ও স্ট্রিং তত্ত্বের সমন্বয়ে অসংখ্য
মহাবিশ্বের মধ্যে একটি পর একটি বিগ ব্যাংয়ের ফলে আমাদের মতো বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে।
এখন পর্যন্ত ব্ল্যাকহোলের কোনো প্রত্য প্রমাণ পাওয়া
যায়নি। কারণ এ থেকে আলো
বিচ্ছুরিত হতে পারে না কিন্তু এর উপস্থিতির প্রমাণ আমরা পরোভাবে পাই।
ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্বের প্রমাণ কোনো
স্থানের নত্রের গতি এবং দিক দেখে পাওয়া যায়। এই তত্ত্বটিরও কোনো পর্যবেণ করা হয়নি। অর্থাৎ
কেবল অনুমাননির্ভর।
(ওয়েবসাইট অবলম্বনে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন