প্রায়
প্রতিদিন মারধর হয় বলেই হয়তো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আর একটি নাম প্রাইমারি স্কুল– এইরকম একটা ধারণা ছিল আমার। রবিঠাকুর
বারান্দার রেলিংগুলিকে
ছাত্র বানিয়ে শিক্ষকতার যে অবশ্যকর্মটি সম্পাদন করতেন তাঁর ছেলেবেলায়, সেটি যে ক্রমাগত বেত্রাঘাত তা লেখাই বাহুল্য।
আমাদের শৈশব
কেটেছিল এই চিরায়ত শিক্ষা পদ্ধতিতেই। সে যে কতরকমের প্রয়োগবিধি তা ভাবলে
অবাক হতে হয়। হাতের তালুতে বেত্রাঘাত, হাঁটুর নিচে কাঁকড় রেখে নিলডাউন, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল ঢুকিয়ে চেপে ধরা, কানমলা, পিঠে তাল পড়া এসব তো ছিলই। মাস্টারমশাইদের
বেতন ছিল সামান্য, হয়তো সে কারণেই অসামান্য ছিল
তাঁদের বেত।
প্রহারের
পাশাপাশি আর একটি বস্তু ছিল যার নাম বলা যেতে পারে ক্ষমতার অপব্যবহার। মাথার পাকা
চুল তুলে দেওয়া, গা হাত-পা
টিপে দেওয়া, পিঠ চুলকে দেওয়া এসব অনেক কিছুই
করতে হত ছাত্রদের। চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চের বালাই ছিল না। অধিকাংশই চট, দু-একজন আসন বগলে স্কুলে যেতাম।
মাস্টারমশাইয়ের বসার আসনটি ছিল চার-পাঁচ ভাঁজ করা সতরঞ্চি। সাকুল্যে চারজন শিক্ষক
ছিলেন, যথাক্রমে হেডমাস্টার, সেকেন্ড মাস্টার, থার্ড মাস্টার ও দিদিমণি। দিদিমণি পড়াতেন প্রথম শ্রেণির
বাচ্চাদের, সেকেন্ড
মাস্টার দ্বিতীয়, থার্ড
মাস্টার তৃতীয় ও হেড মাস্টার চতুর্থ শ্রেণির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। বাংলা-অঙ্ক-ভুগোল-ইতিহাস-বিজ্ঞান
সবই যে একজন পড়াতেন সে তো না বললেও চলে। হেডমাস্টারের ঘরে থাকত রোলকলের খাতা, চক ও গোছা গোছা বেত।
প্রাইমারি
স্কুলের এই নির্ঝঞ্ঝাট পঠন-পাঠনের একমাত্র আপদ ছিল ইন্সপেক্টরের আগমন। সে
এক মূর্তিমান গলগ্রহ। সব থেকে আতঙ্কে থাকতেন হেডমাস্টার। ইন্সপেক্টরের রিপোর্টের উপর
নির্ভর করত তাঁর সংসার। ফলত তিনি যেদিন আসতেন সেদিন হেডমাস্টারের পকেট থেকে
ভালই টাকা-পয়সা খসত। পরিদর্শকের জন্য আনা হত মিষ্টি-সিঙারা। তিনি চলে গেলে
মনসাতলায় একটা সিকি দিয়ে প্রণাম করে আসতেন আমাদের হেডস্যার।
প্রাইমারি
স্কুলের শিক্ষাদান পদ্ধতি চলত নিজস্ব নিয়মে। সে নিয়ম সকলের জানার কথা নয়। সে যে
কেমন বস্তু তার মোক্ষম একটি গল্প চালু ছিল সে সময়।
এক অজ
পাড়াগাঁয়ে ইন্সপেক্টর এসেছেন স্কুল পরিদর্শনে। ছাত্রদের প্রশ্ন করলেন– ভারতের রাজধানীর নাম কী? ছাত্ররা স্পিকটি নট। তিনি ভাবলেন গ্রামের যোগাযোগ বর্জিত স্কুল, হয়তো প্রশ্নটি বুঝতে তাদের অসুবিধা হচ্ছে। তাই
একটু সহজ করে এবার
বললেন– ‘তোমরা তো
দিল্লির নাম শুনেছ, বলো তো
দিল্লিটা কী?’ তবু ছাত্রদের
নীরবতা ভাঙে না দেখে ইন্সপেক্টর ধরলেন হেডমাস্টারকে। ‘কী ব্যাপার মাস্টারমশাই? এত সহজ প্রশ্ন ওরা বলতে পারছে না, কী পড়ান আপনি?’ হেডমাস্টার বললেন– ‘আঞ্জে প্রাইমারি ইস্কুলে পড়ানোর একটা সিস্টেম
আছে, সেটা অ্যাপ্লাই না করলে ওরা
তো বলতে পারবে না। যদি অনুমতি করেন আপনি সিস্টেমটি অ্যাপ্লাই করে দেখাতে
পারি।’ ইন্সপেক্টর
অনুমতি করলেন। হেডমাস্টার সমবেত ছাত্রদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন– ‘বলো তো বাবারা, দিল্লি ভারতের কী ধানি?’ ছাত্ররা উচ্চস্বরে জানিয়েছিল– ‘রা-জ-ধা-নী।’
প্রশ্নোত্তরের
এই পাঠপ্রক্রিয়ায় মাঝে মাঝে অভিনব কিছু উত্তর পাওয়া যেত। যেমন– ‘গরু আমাদের কী দেয়?’ উত্তর আসত– ‘গুঁতিয়ে দেয় স্যার।’ ‘যাহা অবশ্যই হইবে– এককথায় কী?’ উত্তর আসত– ‘বিবাহ স্যার।’
এসব কাহিনি
সত্তর দশকের শুরুর দিকে। তখনও প্রাইভেট স্কুলগুলির আবির্ভাব ঘটেনি। প্রাথমিক
শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আধা-সরকারি প্রাইমারি স্কুল ছাড়া গতি ছিল না। আমাদের
স্কুলের নাম ছিল মৃত্যুঞ্জয় প্রাথমিক অবৈতনিক বুনিয়াদি বিদ্যালয়। বুনিয়াদি
শব্দটির অর্থ জানতে চেয়েছিলাম হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে। জবাবটি আজও মনে আছে– ‘বনেদি বুঝিস? বুনিয়াদি মানে হল বনেদি ইস্কুল।’ আজ বুঝি দরিদ্র মাস্টারমশাই অনেক দুঃখেই একথা
বলেছিলেন। ক্রমাগত বঞ্চনা-অপমান সইতে হত যাঁদের, সেই মাস্টারমশাইরা বুনিয়াদিকে ‘বনেদি’ বলে হয়তো ব্যঙ্গ করতেন। আজ মনে হয় স্যার
যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তাঁকে গিয়ে বলতাম– ‘স্যার, আপনি যথার্থ বলেছেন, বুনিয়াদি হল বনেদিয়ানা।’ প্রয়োজন হলে বঙ্কিমবাবুর ‘ইন্দিরা’ উপন্যাসটি বের করে দেখিয়ে বলতাম, ‘এই দেখুন স্যার, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন– ‘আমার পিতা হরমোহন দত্ত বুনিয়াদি বড় মানুষ।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন