রবিবার, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৩

উপস্থিত বুদ্ধি



                                     লিখেছেন অতনু বর্মন
উপস্থিত বুদ্ধি বলে একটা শব্দ আছে বাংলায়। স্বভাবতই মনে হল, অনুপস্থিত বুদ্ধি বলেও তাহলে কিছু থাকা উচিৎ। ঠিক সময়ে মগজে বুদ্ধি চাগাড় দিয়ে উঠলে তা যদি উপস্থিত বুদ্ধি হয়, তাহলে চোর পালালে যে বুদ্ধি বাড়ে, সেটি অবধারিত অনুপস্থিত বুদ্ধি।
কথা হচ্ছিল, উপস্থিত বুদ্ধি নিয়ে। আশৈশব উপস্থিত বুদ্ধি বললেই যে গল্পটি আমরা শুনে এসেছি, সে ওই দুই বন্ধু ও ভালুকের গল্প। সেই যে ভালুক
দেখে জঙ্গলের মধ্যে এক বন্ধু গাছে উঠে গেলে অন্যজন উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে মড়ার মতো শ্বাস বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিল, কারণ ভালুকে মৃত মাংস খায় না। ভালুক তাকে শুঁকেটুঁকে মৃত ভেবে চলে যাওয়ার পর গল্পটিতে একটি নীতিবাক্যের অনুপ্রবেশ ঘটে। গাছে ওঠা বন্ধু জানতে চায় যে, ভালুক দ্বিতীয় বন্ধুর কানের কাছে মুখ রেখে কি কিছু বললো? দ্বিতীয় বন্ধু জবাব দেয়- ভালুক বললো, যে বন্ধু বিপদের সময় বন্ধুকে ফেলে পালায়, সে বন্ধুই নয়। গল্পটি এখানেই শেষ তবুও আমার মনে হয় এরপর গাছে ওঠা বন্ধুটির উচিৎ ছিল ভালুকটিকে পাকড়াও করা এবং স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়া যে, তারা দুই বন্ধুই যা করেছে, তা আসলে প্রাণ বাঁচাবার জন্য উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োগ। প্রথমজনের মনে হয়েছে গাছে উঠলে বেঁচে যাব আর দ্বিতীয় জনের মনে হয়েছে মড়ার মতো শুয়ে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সুতরাং, কে হে তুমি ভালুক পণ্ডিত? সাধারণ উপস্থিত বুদ্ধিকে টেনেটুনে বন্ধুত্বর হিসেবে এনে ফেল? আপনি বাঁচলে বাপের নাম- এ তো শাস্ত্র বাক্য।
আসলে অনেক সময় খুব সাধারণ ও সহজ সমাধান আমাদের মনেই পড়ে না। ছোট থেকেই আর একটি গল্প শুনে আসছি পটাশিয়াম সায়ানাইডের স্বাদ নির্ধারণ সম্পর্কিত। এক হাতে পেনসিল আর অন্য আঙুলে ওই গরল নিয়ে কে নাকি তা জিভে স্পর্শ করে খাতায় শুধু লিখতে পেরেছিল ইংরেজি এসবর্ণটি। তা এসদিয়ে তো সল্টও হয়, সুইটও হয়। কোনটি বলতে চেয়েছিলেন আত্মাহুতি দেওয়া ব্যক্তিটি, তা জানা যাবে কীভাবে? তখন নাকি আরও একজন এই মহান কর্মে ব্রতী হয়ে একই পন্থা অবলম্বন করে মৃত্যুবরণ করেন এবং লিখে রেখে যান ডব্ল্যুবর্ণটি। সুতরাং, পটাশিয়াম সায়ানাইড যে মিষ্টদ্রব্য- তা জানতে দুটি প্রাণ চলে গেল। উপস্থিত বুদ্ধি থাকলে অন্তত একটি প্রাণ বাঁচান যেত। কীভাবে? খুব সহজে। একটা কাগজে পরপর সল্ট, সুইট, সাওয়ার শব্দ তিনটি লিখে জিভে আঙুল ঠেকিয়ে একটা টিক মার্ক দিলেই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যেত যে মালটা আসলে কী? নোনতা, মিষ্টি, না টক-টক। শুধু ওই তিনটি নয়, লেখা বাহুল্য যে, ঝাল, পানসে, তেতো, স্বাদহীন ইত্যাদি যত রকমের স্বাদ হয়ে থাকে বিশ্বসংসারে, তার সবগুলিই লেখা থাকত কাগজে এবং প্রথমজনই নির্ভুলভাবে টিক চিহ্ন দিয়ে এক মরণেই সমস্যার সমাধান করতে পারতেন। আসলে যে কালে ঘটনাটি ঘটেছিল, সেকালে তো বিস্তারিত উত্তর লেখার রেওয়াজ ছিল। একালের মতো মাল্টিপল চয়েজ থাকলে কেসটা হয়ে যেত জলবৎ তরলং।
উপস্থিত বুদ্ধির ডজনখানেক গল্প হাতের কাছে থাকলেও একটি না বললে অন্যায় হবে। রেলের এক কর্মকর্তার শ্বশুরবাড়ি ছিল রাঁচি। ভদ্রলোকের গিন্নি জেদ ধরলেন বাপের বাড়ি যাবেনই এবার পুজোয়। কিন্তু ভদ্রলোকের হাতে ছুটি নেই। কী করা যায়? তিনি পাকড়াও করলেন ছোটভাইকে। বউদি ও ছোট ভাইপোকে বাপের বাড়িতে রেখে আসাটা দেবরের অবশ্য কর্তব্য হলেও দেবর বেঁকে বসল এই কারণে যে, দাদার পাশ ব্যবহার করে যেতে হলে তাকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে। নিজের নামের ক্ষেত্রে শুধু যে অগ্রজের নাম ব্যবহার করতে হবে তাই নয়, উপরন্তু বউদিকে স্ত্রী এবং ভাইপোকে পরিচয় দিতে হবে নিজের সন্তান বলে। এদিকে দাদা কিছুতেই পাশের সুযোগ থাকতে টিকিট কাটতে রাজি নন। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত বউদির হস্তক্ষেপে দেবর রাজি হলেন। ট্রেনে উঠেই ভাইপো কখনও বলছে, ‘কাকা, ঝালমুড়ি কিনে দাওতো কখনও বলছে, ‘কাকা, বেলুন নেব। কাকা তো পড়েছে মহা মুশকিলে। বড়দের মিথ্যাচার ছোটরা কোনও দিনই বুঝতে চায় না। ওদিকে চেকার সাহেব কিন্তু লক্ষ্য করেছেন যে, বাচ্চাটি ভদ্রলোককে কাকা সম্বোধন করছে। টিকিট পরীক্ষা করতে এসে স্বাভাবিকভাবেই চেকার জানতে চাইলেন- নাম’? অম্লান বদনে দেবর মশাই আপন দাদার নামটি উগরে দিলেন। চেকারের দ্বিতীয় প্রশ্ন, ‘ইনি কে’? তোতাপাখির মতো দেবর বললেন- ইনি আমার স্ত্রীএটি কে’? দেবরের জবাব- আমার ছেলে চেকার কিছুটা বিদ্রুপ করেই বললেন- ছেলে তো দেখছি আপনাকে কাকা বলে ডাকছে’!
সপ্রতিভ দেবর জবাব দিলেন- আরে মশাই, রাঁচি কি বেড়াতে চললাম ভাবছেন? ওইটাই তো ওর রোগ

কোন মন্তব্য নেই: