লিখেছেন ঐশিকা বসু
রেলস্টেশনের সামনের রাস্তাটা দিয়ে
হন্তদন্ত হয়ে হাঁটছিলেন কৌশিকবাবু। সাড়ে ন’টার ট্রেনটা
তাঁকে পেতেই হবে। না হলেই অফিস কামাই। কড়া বস। কিছুতেই প্রেসেন্ট করবে না। উলটে
কড়া কড়া কথা শোনাবে। ঘড়ি বলছে ন’টা পঁচিশ।
ট্রেন একেবারে রাইট টাইমে ঢোকে এ সময়ে। ট্রেন আসার আওয়াজ পেতেই দৌড় লাগালেন
কৌশিকবাবু। কিন্তু দু সেকেন্ডের জন্য দৌড়েই দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। কি ব্যাপার? একটা বেড়াল রাস্তাটা কেটে ওদিকে গেছে। কি সর্বনাশ! এই রাস্তা পেরিয়ে
যাওয়া যায়? আর এমন অবস্থা যে এই রাস্তাটায় বিশেষ
একটা কেউ আসেও না। অন্যদিন হলে কৌশিকবাবুও আসতেন না। কিন্তু দোকানের ফাঁক দিয়ে এই
রাস্তাটা দিয়ে এলে বেশ শর্টকাট হয়। তাই এসেছিলেন এদিকে। কিন্তু এ কি গেরো!
ট্রেনটাকে পরিষ্কার দেখলেন ‘পঁ’ শব্দ করে হর্ন বাজিয়ে স্টেশনে ঢুকল।
তবু রাস্তায় কেউ নেই। রাগের চোটে
মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন তিনি। কিন্তু সেসবে যেন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ট্রেনটা গেল
চলে। ‘যাঃ’ বলে হতাশ হয়ে
রাস্তাতেই বসে পড়লেন ভদ্রলোক। কি শুনে হাসছেন বুঝি?
কিন্তু
এ আমার নিছক বানানো গল্প নয়। ছোটবেলায় আমি যেখানে থাকতাম সেই বাড়ির ছাদ থেকে এই
ঘটনার সাক্ষী ছিলাম, হয়ত একমাত্র
আমিই। তখন আমার বয়সই বা কত? এই ধরুন নয় কি
দশ। তবু লোকটার এহেন কাণ্ড দেখে না হেসে পারিনি। লোকটাকে আমি চিনতামও। আমারই এক
বান্ধবীর বাবা। ‘দুর্গা, দুর্গা’ নাম জপ করে
বাড়ি থেকে বেরোতেন। কবচ, তাবিজ লক্ষকোটি
বাঁধনে হাতটাকেই তার আর দেখা যেত না। সমস্ত বিপদ থেকেই যেন তিনি মুক্ত থাকতে চান।
হ্যাঁ মুক্তি তিনি পেয়েছিলেন বটে। তবে একটা ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার
পর। ব্যাপারটা এইখানেই সিরিয়াস। কিন্তু এরপরেও তো লোকে কবচে তাবিজে বিশ্বাস করে।
অথচ নিজের ওপরেই কোন বিশ্বাস রাখতে পারে না। কিন্তু এই মারণ বিশ্বাসকে কি সহজে
তাড়ানো যায়? কখনোই না। তবু আমার মনে হয়, একটা বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলের দরকার। যা মানুষকে অন্তত স্বাধীন চিন্তা
করতে শেখাবে। যুক্তি দিয়ে বিশ্বাস করতে শেখাবে। অন্ধ অনুকরণের দাসত্বে নয়, চেতনার মুক্তি ডেকে আনবে বিজ্ঞানের আলোয়। আর সেই কাজটিই করতে
চেয়েছিলেন নরেন্দ্র দাভালকার। এইসব অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে
দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। মানুষের মনকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার কপালে কি
জুটল? জীবন থেকে নির্বাসন। কয়েকদিন আগে
আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন প্রবাদপ্রতিম এই বিজ্ঞানী। অপরাধ? তিনি আইন চেয়েছিলেন। যে আইনে এই কুসংস্কার আর ভেলকিবাবাজীদের
কার্যকলাপ বন্ধ করা যাবে। মহারাষ্ট্র সরকার সেই আইন করার ক্ষেত্রে বাধা দিয়েছে।
বাধা এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকেও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাধা দেওয়া আর
সম্ভব হয়নি। পুনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সম্মিলিতভাবে এই জঘন্য হত্যার
প্রতিবাদ করেছে। দাভালকারের অসমাপ্ত কাজ তারা এগিয়ে নিয়ে গেছে আরও অনেকদূর। আশার
কথা, মহারাষ্ট্র সরকার এখন তৎপরতার সাথে
বিষয়টিকে দেখভাল করেছে। যাতে আইনি পদ্ধতিটা সুষ্ঠুভাবে এগোতে পারে তার ব্যবস্থাও
সরকার করেছে। হয়তো তা সম্ভব হয়েছে জনমতের চাপেই। কিন্তু তবুও মহারাষ্ট্র সরকারকে
একাজের জন্য ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না। আর এ থেকেই বোঝা যায়, দাভলকারের মৃত্যু হয়নি। দাভলকারদের মৃত্যু হয়না। বরঞ্চ এই মৃত্যুতে
লোকঠকানো বাবাজীদের ব্যবসার আসল মুখোশ খুলে আসে। বেরিয়ে আসে এই নগ্ন জঘন্য রূপ, যুক্তির কাছে তাদের ভয়, তাদের
কাপুরুষতা। সারা ভারত জুড়ে এই কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসীদের ভিড়। সেখানে প্রকৃত
যুক্তিবাদী ও মানবপ্রেমিক মানুষের অভাব বড়ো চোখে পড়ে। ভণ্ড স্বামী অমুকানন্দেরা
কখনোও মানবপ্রেমিক হতে পারে না। তারা মানুষকে ভুল পথে চালায়। মিথ্যে প্রলোভনের
বিপাকে ফেলে প্রতারণার ব্যবসা করে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল আমার এক বান্ধবীর কথা।
ও-ও এসব তুকতাকে বিশ্বাস করত। একদিন ওর বাড়িতে গিয়ে দেখি আনন্দে লাফাচ্ছে। আমি
বললাম, কি রে?
মনে
অত পুলক জেগেছে কেন? ও যা জানাল
তাতে বুঝলাম, ও নাকি কোন জ্যোতিষীর দরবারে গেছিল।
তিনি নাকি তাকে মন্ত্রপূত তাবিজ দিয়েছেন। তাতে নাকি ওর চাকরি কেউ আটকাতে পারবে
না। সেদিন ওকে আমি বুঝিয়েছিলাম যে এগুলো সত্যি নয়। তা কখনোও হতে পারে না। কিন্তু
ও আমার কথায় পাত্তা দেয়নি। তাই আমিও আর কথা বাড়াইনি। সব জেনেবুঝেও চুপ করে
গেছি। এতে হয়ত মনে হতে পারে যে আমার যুক্তি ওর বিশ্বাসের কাছে হেরে গেল। কিন্তু
আজ? আজ ওর কি অবস্থা? বিয়ে হয়ে গেছে প্রায় ছ’বছর হল।
পাণ্ডুয়ায় থাকে এখন। গ্রাজুয়েশনটাও পাশ করেনি। চাকরি অবশ্য জুটেছে তার। তবে
সেটা শ্বশুরবাড়ির হেঁসেলে। এমনই বাড়ি যে বাইরে কোথাও বেরোনো তো দূরস্থ, সামনের উঠোনটাতেও বেশীক্ষণ ঘোরা মানা। একবারই গেছিলাম সে বাড়িতে। আর
যাইনি। আর যাবও না। ওকে দেখলেই যে আমার কষ্ট হয়। সত্যি খুব কষ্ট হয়। কিন্তু
আশ্চর্যের ব্যাপার, ও এখনও বিশ্বাস
করে। চাকরি ওর হবেই। কিন্তু আমি জানি তা হবে না। কারণ, ও মিথ্যাকে বিশ্বাস করে, নিজেকে নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন