বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৩

সলিল সাগরে


--লিখেছেন ঘনাদা
মৃত্যুর পর কেটে গেছে ১ বছর, তাও বাঙ্গালীর সঙ্গীত মননের অনন্ত প্রবাহে; আজ-ও সলিল চৌধুরী। এই নামটা শুনলেই আনন্দে কেঁপে ওঠে রোমকূপ! ভেসে যায় অতীতে। সুরেরসেই ঝরঝর ঝর্ণার” “তরলিত চন্দ্রিকার” –তে মন ঝট করে স্নান করে ফেলে।

নভেম্বর ১৯, ১৯২২, মতান্তরে ১৯২৩। দিনটা বাংলা সংগীতের জগতে একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ দিন। শুধু বাংলাই বা বলি কেন! সারা ভারতের সংগীতের জগতেই একটা মহত্ত্বপূর্ণ দিন।
হুগলী জেলার হরিনাভীর মাহীনগর গ্রামে জন্ম এই কিংবদন্তী সুরকার, গীতিকার, সাহিত্যিক এবং কবির । আসামের চা বাগানে বাবা ডাক্তার ছিলেন। বাবার সংগ্রহে থাকা পাশ্চাত্য সংগীত শুনে শুনে, সুরের বীজ তৈরী হয় তাঁর মননে। কি ছিল তাঁর বাবার সংগ্রহে? বলতে হয়, কি ছিল না! মোঝার্ট, বিঠোভেন,চ্যাইকোভোস্কি, শঁপ্যা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল ওই বাগানে শোনা- ওলা বিবির গান, শিবের গাজন, যাত্রা, ঢপ এর গান, সুর আর গায়কী। ফলে, নিজের অজান্তেই তৈরী হয়েছিল এক অনবদ্য নিজস্ব সুরলোকের।
কোলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বি এ পড়ার সময় থেকেই আই. পি. টি. এ র সংস্পর্শে আসা। ১৯৪৪ সালে অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। বাবাকে দেখেছিলেন- বাগানের কুলিদের নিয়ে নাটক করতে। কুলিদের যন্ত্রণা, শোষণ তাঁকে নাড়া দিয়েছিল। ১৯৪৫ সালে বিদ্যাধরী নদীর বানভাসী অঞ্চল দেখতে গিয়ে লিখেছিলেন, প্রথম গণসঙ্গীত-দেশ ভেসেছে বানের জলে আর সেই গান, গানের জন্য গান নয়।মানুষের প্রয়োজনের জন্য এই গান!!!!!!!!!! এরকম আরও অনেক গান, তিনি পরবর্তী কালে তিনি লিখেছেন আর সুর দিয়েছেন।
নির্বাক যুগে চিত্রা সিনেমায় পিয়ানো বাজিয়ে পেশাগত জীবনের শুরু। ১৯৪৯ সালে তাঁর সুরারোপিত বাংলা চলচিত্র পরিবর্তনমুক্তি পায়। জুলাই ১৪, ১৯৫২ সালে বিয়ে করেন জ্যোতি চৌধুরীকে। তিনটি কন্যা সন্তানও হয় তাঁর- অলকা, তুলিকা আর লিপিকা!
সন ১৯৫৩!!!!! সদ্য বিবাহিত সংসারে, অভাবের তাড়নাতে পার্টির ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে বিমল রায়ের ডাকে চলে যান বোম্বেতে( মুম্বাই)। তাঁর নিজের লেখা গল্প রিক্সাওয়ালাথেকে বিমল রায় তৈরী করেন সেই বিখ্যাত হিন্দী চলচিত্র- দো বিঘা জমিন
তারপর? আর ফিরে তাকান নি। সংগীত পরিচালক নৌশাদ একবার সলিলদার মাকে জুহু বীচে দেখতে পেয়ে, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন। বলেছিলেন- এমন রত্নগর্ভাকে প্রণাম করতে পেরে তিনি ধন্য। আরও যোগ করেছিলেন- সলিলদা হচ্ছেন সুরকারদের সুরকার! সাতটি স্বর ছিল তাঁর হাতের খেলার পুতুল।
মৃণাল সেন বলেছিলেন- সলিলদা হচ্ছেন আধুনিক সঙ্গীতের ব্যাকরণ।স্বনামধন্য গায়িকা সুচিত্রা মিত্র বলেছিলেন- রবীন্দ্র- নজরুলের পরই সলিল চৌধুরীর স্থান।
সন-১৯৫৮। সেই বিখ্যাত মধুমতী”! জন্মান্তরের ওপর বোধহয় প্রথম হিন্দী চলচিত্র। গল্প-ঋত্ত্বিক ঘটক। পরিচালনা- বিমল রায়। গীতিকার- শৈলেন্দ্র। ২০০৭ সালে ফারহা খান তৈরী করেন- ওম শান্তি ওম। মধুমতীর অনেক প্রভাব এই চলচিত্রে থাকলেও, তাঁরা স্বীকার করেন নি, সে কথা!
যাক, সে কথা! সবিতা চৌধুরীকে বিয়ে করে বোম্বে ছাড়তে বাধ্য হন এই সুরকার। প্রচুর গল্প চালু আছে এই নিয়ে। কিন্তু থাক সে কথা!
মধুমতীর কথা হচ্ছিল। মুকেশের কণ্ঠে সেই বিখ্যাত গান!!!!!!!!!দিল তড়প তড়প” !!!! বলা হয়, হলাণ্ডের ধান কাটার গানের লয় বাড়িয়ে এই গান তিনি তৈরী করেছিলেন। কিন্তু, তাতে কি যায় আসে? আমরা তো পেয়েছি, সেই কালজয়ী গান!!!! ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছিল এই ছবিটি- শুধুমাত্র সুরের জন্য। এই পাশ্চাত্য প্রভাব দেখা গেছে তাঁর প্রচুর গানে।
মোঝার্টের সিম্ফোনী- ৪০ কে অনুকরণ করে, হিন্দী চলচিত্র ছায়ার তাঁর সেই বিখ্যাত গান- ইতনানা মুঝসে তু প্যার বড়া!
আজকে বিচারের নামে প্রহসন দেখে-তাঁর সেই বিখ্যাত গানটাই মনে পড়ে- বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা!
হায়! জনতা আজও ঘুমিয়ে!!!!!!!!!
তারপর সেই গান!!!! হেই সামালো ধান হো! কত আর বলব? সেপ্টেম্বর ৫, ১৯৯৫!!! সলিলদা, নিজেই ভেসে গেলেন অথৈ মহাকালে! বড় দুঃখ নিয়ে চলে গেছিলেন। তাঁর সাধের রেকর্ডিং ষ্টুডিওর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ধার শোধ করতে না পেরে! ষ্টুডিওর নীচে থাকা এক কারখানার কম্পনের মাত্রা তিনি আর ঠিক করতে পারেন নি!
সলিল সাগরের যে এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে না.....
মেলে না নারে মেলে না!

কোন মন্তব্য নেই: