মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০১৩

বিড়ি শিল্প – পশ্চিমবাংলায় শোষণ চলছেই



--- লিখেছেন ঘনাদা
আমরা বিড়ি ( সিগারেট নয়) খাই অনেকেই, কিন্তু জানি কি যারা বিড়ি বাঁধেন তাদের দুর্দশার কথা ? জানি না আমরা সিংহভাগ লোকেরাই ।
বিড়ি বাঁধার মতো কুটির শিল্প প্রচন্ড সমস্যার সম্মুখীন। কম বেতন, অমানবিক কাজের পরিবেশ এবং শ্রমিকের কোন রকমের অধিকার ছাড়াই কাজ করতে হয়। দিনে হাজার বিড়ি বাঁধলে যেখানে ৬৫টাকা পাওয়ার সরকারী নিয়ম। সেখানে শ্রমিকরা পায় মেরেকেটে ৪৫টাকাই ।
এখানেও নারী, পুরুষ এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ভাগ আছে । মহিলারা পান, ৪০ টাকা আর অপ্রাপ্তবয়স্করা পায় ২৫ টাকা ।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, স্থানীয় ক্ষেত্রে উপার্জনের অন্য কোন পথ না থাকায় তারা এই বিড়ি বাঁধার কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে ।
মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলাতেই বিড়ি শ্রমিকের সংখ্যা বেশী ।

উপকরণ : লোহার একটা ফর্মা, কাঁচি, সুতো এবং কুলো- এই হলো উপকরণ । মহাজনেরা ওজন করে কেন্দুপাতা ( মূলত ওডিশা থেকে আসে) দেয় শ্রমিকদের । সাথে থাকে তামাক এবং তামাক পাতার ডাঁটি ( খড়কে সাইজের)।
প্রথমে কেন্দুপাতাকে ফর্মায় বসিয়ে কাঁচি দিয়ে কাটতে হয় । তারপর কুলোয় তামাক আর ডাঁটি পাতায় জড়িয়ে বিড়ি বাঁধতে হয় । ডাঁটি দেওয়া হয়, যাতে বিড়ি বারবার নিভে না যায় । যত কম হবে, বিড়ি বারবার নিভে যাবে ।
দিনের শেষে মহাজনের কাছে গেলে, তারা বিড়ি গুণে নিয়ে পয়সা দেয় । সব বিড়ি গোণার মধ্যে পড়ে না । বাতিল করে নানা অজুহাতে । কেউ হয়তো ৮০০ বিড়ি বেঁধে নিয়ে গেল, কিন্তু মজুরী পেলো ৫৫০ থেকে ৬০০ বিড়ির ।
পরে শ্রমিক চলে গেলে সেই বাতিল বিড়ি গুলোও নিয়েই প্যাকেট তৈরি হয় বিক্রির জন্য ।

সরকারি তরফে মহিলা-শ্রমিকদের পুরুষ-শ্রমিকের সমান বেতন দেওয়ার জন্য আইন (ইকোয়াল রেমিউনারেশন অ্যাক্ট) হয়েছে ১৯৭৬ সালেই। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন যে মেয়েরা, তাঁদের জন্য রয়েছে আরও একগুচ্ছ সুযোগসুবিধের ফিরিস্তি। বিড়ি বাঁধেন যাঁরা, কর্মস্থলেই তাঁদের শিশুদের জন্য মোবাইল ক্রেশ রাখার বন্দোবস্ত করার কথা আইনে রয়েছে। এ আইন কার্যকর হলে তো আর আফিম খাইয়ে কচি শিশুকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয় না।

শ্রমিক-মায়ের বড় জ্বালা। বাড়িতে মাতাল স্বামীর পিটুনি। আর কাজের জায়গায় মালিকের খিটমিট। ঘুমপাড়ানি আফিম পরে হয়তো ওই ছেলেরই নেশার খোরাক হয়ে উঠবে, জেনেও মা নিরুপায়। পেট বড় দায়। ছেলে/মেয়ে বড় হলে-শ্রমজীবীদের সারিতে নাম লেখাবে। মানুষের জীবনের অধিকার ছাড়াই।

মেটারনিটি বেনিফিট অ্যাক্ট’ (১৯৬১) অনুসারে সন্তান জন্মানো বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরের ৬ সপ্তাহ মহিলা শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো যাবে না।

পরিচয় পত্র দেওয়ার কথা, বিপিএল কার্ড পাওয়ার কথা, অধিকাংশ শ্রমিক নারী পুরুষ নির্বিশেষে কিছুই পান না এই সব ।
ভারতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে প্রায় ৪ কোটি মহিলা শ্রমিক কাজ করেন। (তথ্যসূত্র: পাটিয়ালার পাঞ্জাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন রিসার্চ সেন্টার)। তাঁরা বলছেন, এ দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রে যে সব মহিলা শ্রমিক কাজ করেন, তার কোনও সরকারি পরিসংখ্যান বা হিসেব পাওয়া যায় না।
মালিকও আলাদা করে হিসেব রাখেন না নিজেদের স্বার্থে। সরকারি নথিভুক্তকরণ হয় না বলে মহিলাদের কাজছদ্ম-কাজ’, এলেবেলে। কম টাকা দিয়ে, কোনও সুবিধে না দিয়ে ওঁদের দিব্যি খাটিয়ে নেওয়া যায়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিড়ি বাধার কাজে যুক্ত কিশোরী অথবা মহিলা। আঠেরোর গেরো। তাই শিশু শ্রমিককে তো আর পরিচিতি দেওয়ার জো নেই।

অথচ , ধর্ষণ করলে এই আঠেরোর গেরোতে লঘু হয়ে যায় কিশোরের পাপ ।
জাতির পিতা মহাত্মা গাঁধি বলেছিলেন :-Before the hungry even God dares not come except in the shape of bread.

ক্ষুধিতের সামনে স্বয়ং ভগবানও খাদ্য ছাড়া অন্য চেহারায় আসতে সাহস পান না ।

তাই এই অবিচার সব জায়গাতেই । বিড়ি শিল্প তার একটি উদাহরণ মাত্র ।

কোন মন্তব্য নেই: