১৯২০ সালে
বারাণসীর তিলভান্ডেশ্বরে বাঙালি ব্রাক্ষ্মণ পরিবারে জন্ম রবিশঙ্করের, মৃত্যু ক্যালিফর্নিয়ার সান দিয়েগোতে। আদতে
তাঁদের পদবী চট্টোপাধ্যায়, ‘চৌধুরী’ উপাধি পেয়েছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ। রবিশঙ্করের
বাবা তাঁর মা হেমাঙ্গিনী দেবীকে পরিত্যাগ করার পর ‘শঙ্কর’টাই পদবী হয়ে ওঠে। নামের বানান পালটে Robishonkor Choudhury থেকে Ravi Shankar করেন নিজেই।
নানা দেশে
থেকেছেন, অগুন্তি
মঞ্চে অসংখ্য মানুষের সামনে ঝংকার তুলেছে তাঁর সেতার। বিবাহ করেছেন একাধিকবার, ভালবেসেছেন অনেককে। দুই কন্যাই – অনুষ্কা ও নোরা – বিবাহসূত্রের বাইরে জন্মেছে। অনুষ্কার মা
সুকন্যা রাজন ছিলেন অন্তিম সহধর্মিনী, রবিশঙ্করের চেয়ে বয়সে ৩৪ বছর ছোট। অনুষ্কার
জন্মের পর তাঁকে বিবাহ
করেন রবি। নোরার প্রতি পিতৃত্বের কোন কর্তব্যই করেননি তিনি, অথচ রক্তে মিশিয়ে দিয়েছেন সঙ্গীতের আকুতি।
দশ বছরের
বালক রবিকে নাচের ট্রুপের সঙ্গে প্যারিস নিয়ে গিয়েছিলেন দাদা উদয়। আট বছর পর
নিজের ইচ্ছায় দেশে ফিরে মৈহারে গুরু উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন
তিনি। গুরুকন্যা অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে প্রথম বিবাহ ও প্রথম সন্তান।
১৯৭১।
বন্যা-মন্বন্তর-যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানচিত্রে এক সন্ধ্যায় হাজির করলেন
রবিশঙ্কর-জর্জ হ্যারিসন, ‘কনসার্ট ফর বাংলা দেশ’এ। নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কোয়ার
গার্ডেনের অনুষ্ঠানটি ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক ‘ফান্ড রেইজার’। রবিশঙ্কর ততদিনে নিজেকে স্পষ্টত বিটল্সদের
থেকে আলাদা করে
নিয়েছেন। হিপি-গাঁজা-রক অ্যান্ড রোলের সংমিশ্রনে যাতে তাঁর স্বকীয়তা হারিয়ে না যায়, যাতে লোকে তাঁকে ভারতীয় ‘স্পিরিচুয়ালিজম’এর অবতার মনে না করে, তাই তাঁর এই স্বেচ্ছা প্রস্থান। রবিশঙ্কর
সেতার-বাদক, সুরসাধক।
সেভাবেই থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্দিনে পাশে দাঁড়ানোও
তাঁর কর্তব্য। অতএব আবার হ্যারিসন, আবার আমেরিকার দর্শক।
রবিশঙ্কর
ভারতরত্ন, গ্র্যামি ও
নাইটহুড পেয়েছেন। বিধানসভার সদস্য হয়েছেন, ইহুদী মেনুহিন, জুবিন মেহতা, ফিলিপ গ্লাসের সঙ্গে কাজ করেছেন প্রথাগত সিম্ফনি
অর্কেস্ট্রা থেকে ইলেকট্রনিক ফিউসন অবধি সব কিছুতে।
শেষবার তাঁর
সেতারের মুর্ছনায় শ্রোতারা মাতোয়ারা হয়েছেন নভেম্বরের চার তারিখে, লং বিচ টেরেস থিয়েটারে মেয়ে অনুষ্কার সঙ্গে। ক্যালিফর্নিয়ার ঢেউয়ের
মতোই ভেঙে পড়েছে তাঁর আবেগ। ভিডিও ক্যামেরা সাক্ষী থেকেছে, আরো একবার নিজেকে ভেঙেগড়ে নিচ্ছেন এক শিল্পী।
আজীবন ক্লিন শেভেন রবিশঙ্করের সাদা দাড়ি সান্তা ক্লজের মতো নেমে গেছে, সঙ্গীতে হারিয়ে গিয়ে ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠেছে সেই চিরপরিচিত হাসি।
মানুষ পৃথিবীতেই স্বর্গ সৃষ্টি করতে পারলে যেভাবে হাসে।
এক মাস বাদে
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের বেডে খবর পেয়েছিলেন আবার গ্র্যামির দৌড়ে তিনি। রবিশঙ্করের নতুন কোম্পানি ইস্ট মিটস
ওয়েস্টের অ্যালবাম ‘লিভিংরুম
সেসন্স পার্ট ১’ পাল্লা দিচ্ছে মেয়ে নোরা জোন্সের সঙ্গীতের
সঙ্গে। পরদিন
অপারেশন হল সময়মতোই, কিন্তু অশক্ত
শরীরে আর জীবনের সাথে তাল মেলাতে পারলেন না তিনি।
বাঙালির
স্মৃতিতে তিনি থেকে গেলেন শীতের রাত্রিব্যাপী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরে আল্লা
রাখার একই রকম আবেগতাড়িত ঝড়ো তবলার সাথী হয়ে। ঠিক যেমন ব্রিটেনে তিনি বিটল্সদের
সেই ভারতীয় বন্ধু। মার্কিন মুলুকের ফিউসন আর্টিস্ট। ইউরোপের কনসার্টে অন্য স্বাদ
নিয়ে আসা ভারতীয় সেতারবাদক। আর মুম্বইএর এক নিভৃত গৃহকোণে প্রথমা পত্নী
অন্নপূর্ণার চোখে বিশ্বাসঘাতক, যে মৈহার ঘরাণার পবিত্রতা ভেঙে সঙ্গীতকে সাধনা থেকে
বাণিজ্য করে ফেলেছে।
পন্ডিত
রবিশঙ্কর চৌধুরী/চট্টোপাধ্যায় এমনি ছিলেন। একসাথে অনেক মানুষ। বাঙালি এবং বিশ্ব
নাগরিক। ৯২ বছরের জীবনে এত প্রাচুর্য্য ভরে নেওয়া সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর
আত্মজীবনী জানান দেয় কি অসম্ভব সত্যনিষ্ঠ ছিলেন রবিশঙ্কর। ব্যক্তিগত জীবন
নিয়ে বিন্দুমাত্র ভণিতা ছিল না তাঁর। আর সঙ্গীত প্রেমও ঠিক ততটাই নিখাদ। রবীন্দ্রনাথ ও
সত্যজিৎ রায়ের পর হয়ত তিনিই ছিলেন শেষ আন্তর্জাতিক বাঙালি শিল্পী।
Courtesy : Yahoo.IN.BN.news
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন