অনলাইনে ঢুকেই প্রথম নজরে এলো, মিতা হক ’৭১ টিভিতে বলেছেন, মাথায় ঘোমটা যারা দেয়, তারা বাঙালী নয়। এবং এই কমেন্টের জের
ধরে চলছে বাদ-প্রতিবাদের ঝড়, এবং বলাই বাহুল্য,
প্রতিবাদের ভাষা খুবই কুৎসিত এবং
অশ্লীল। মানুষটি যখন মিতা হক,
এবং
গালাগালি যখন উনার বিরুদ্ধে, স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহল জেগেছে মনে, মিতা হকের মত এমন একজন ব্যক্তিত্ব ঠিক এমন অস্থির সময়ে, কি করে এমন বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্য
করে বসলেন!ভিডিও ক্লিপ অন করে মিতা হকের বক্তব্য শুনলাম। গালিগালাজকারীদের পক্ষ না নিয়েই বলতে পারি, উনার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগেনি, কারণ এই ব্যক্তিত্বময়ী শিল্পী যা বলতে চেয়েছিলেন বা বুঝাতে চেয়েছিলেন, টকশো’র সীমিত সময়ের কারণেই হয়তোবা সেটা শুনতে অগোছালো, এলোমেলো মনে হয়েছে।
টকশো’তে মিতা হক কি বলেছেন? উনি যা কিছু বলেছেন, আসলেই কি উনি কথাগুলো সেভাবে বলতে চেয়েছিলেন? তিন মিনিটের ভিডিও ক্লিপে উনার মত একজন ব্যক্তিত্ব এমন অগোছালোভাবে, হড়বড় করে, এক কথার সাথে আরেক কথার সামঞ্জস্য না রেখে কি করে এতগুলো কথাকে বলে গেলেন, ভেবে অবাক হয়ে যাই। উনি বলেছেন, বর্তমান সরকারকে উনি সমর্থণ করেন একটিমাত্র কারণে যে এই সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী অসাম্প্রদায়িক, এই সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। এই পর্যন্ত ঠিক আছে, কারণ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন প্রতিটি মানুষই স্বীকার করবে যে আওয়ামীলীগ এবং বিএনপির রাজনৈতিক দর্শনে মূল পার্থক্যটুকুই এখানে। বিএনপি সরকারের আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের যেভাবে নাজেহাল হতে হয় অথবা মনোবল হারিয়ে মাথা নীচু করে চলতে হয়, আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সংখ্যালঘু এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সেই হারিয়ে যাওয়া মনোবল কিছুটা হলেও ফিরে আসে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরে পায়। এই কথাগুলোই অতি আবেগ এবং উচ্ছ্বাসের সাথে বলতে গিয়ে মনে হয় উনি গড়বড় করে ফেলেছেন এবং সত্যি কথা বলতে কি হিতে বিপরীত করেছেন।
খুবই অগোছালোভাবে উনি বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ এখন আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগছে। আইডেনটিটি ক্রাইসিসের সমস্যা বলতে গিয়ে উনি নিজেই আইডেনটিটি হারিয়ে ফেলেছেন। উনার কথা শুনে আমার খুবই হতাশ লাগছিল, মনে হচ্ছিল, প্রস্তুতি না থাকলে কারোরই মিডিয়ার সামনে মুখ খোলা উচিত নয়, অথবা প্রস্তুতি থাকলেও এমন গা জ্বালানো ইস্যু নিয়ে কথা বলাও উচিত নয়। আমরা সকলেই জানি এবং বুঝি, বাংলাদেশে এখন ‘শনির দশা’ চলছে। এই সময়ে সকলেরই উচিত মেপে কথা বলা, মাপা পথে চলা। সরকারে যাঁরা থাকেন, তাঁদেরতো ক্ষমতার সময়সীমা শেষ হয়ে এলে উলটো পালটা কথার মাত্রা এমনিতেই বেড়ে যায়, তার সাথে যদি মিতা হকের মত ব্যক্তিত্বময়ী নারীর মুখ থেকে এমন অগোছালো, আপত্তিকর কথা বেরিয়ে যায়, তখন ‘শনির দশা’র সাথে যোগ হয় ‘রাহুর দশা’। ফেসবুক, ব্লগ, অনলাইন পাঠকের কমেন্ট পড়ে তাই মনে হচ্ছে।
‘শাড়ীতে নারী সুন্দর’ কথাটিই হয়তো মিতা হক বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তা বলতে পারেননি। উনি বলেছেন অন্যভাবে, বিশেষ বড় কোন জমায়েতে উপস্থিত হলে উনার নিজেকেই শুধু বাঙ্গালী নারী মনে হয়, কারণ সর্বত্রই উনি একা শাড়ী পরিহিত থাকেন এবং উনার মাথায় ঘোমটা থাকেনা। উনি একথা কীভাবে বললেন বুঝা গেলোনা। উনি কি ‘হিজাব’ কে ঘোমটার সাথে মিলিয়ে ফেলেছেন? নাহলে ঘোমটা তো বাঙ্গালী নারীর বিনম্র, লজ্জা প্রকাশের একটি সুন্দর অনুষংগ মাত্র। আর বাংলাদেশের মত একটি দেশে, বর্তমান সময়ের মত অস্থির সময়ে, আশাহীন, ভরসাহীন আগামীর কথা মাথায় রেখেই ‘হিজাব’ নিয়ে উনার কিছু বলা উচিত হয়নি। যেমনটি উচিত নয় সিঁদুরের টিপ বা সিঁথিতে টানা সিঁদুরের নিয়ে কটাক্ষ করা। টিভি মাধ্যমে শাড়ী, ঘোমটা, বাঙ্গালীয়ানা বিষয়ে এমন একটি সেনসিটিভ কথা বলে ফেলা, কতখানি যুক্তিযুক্ত হয়েছে, তা আমার ধারণাতে নেই।
শিল্পীর নিজের কাছে ‘শাড়ী’ এখনও বাঙ্গালী নারীর অহংকার মনে হতে পারে, বাস্তবতা হলো এই যে, বাংলাদেশের মেয়ে থেকে শুরু করে বুড়ীরাও এখন সালোয়ার কামিজ পড়েন, দেখতে ভালো লাগছে নাকি খারাপ লাগছে, মোটা লাগছে নাকি স্লীম লাগছে সেদিক বিচার না করেই পরেন। সারাদেশের মানুষ তা দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, ঘরে-বাইরে, হাটে-বাজারে, শহরে –বন্দরে সর্বত্রই সালোয়ার কামিজেই নারীকে দেখা যায়। বাঙ্গালী নারীর শাড়ীর বদলে সালোয়ার কামিজ পড়াকে একেকজন একেকভাবে দেখেন। কেউ বলে, সালোয়ার কামিজ পড়লে নারীর আব্রু রক্ষা হয়, (তারা অবশ্য বলেনা শাড়ীতে কোথা দিয়ে আব্রু বেরিয়ে যায়,) কেউ কেউ মনে করে, সালোয়ার কামিজ পড়লে নিজের তরুণী বয়সকে ফিরে পাওয়া যায়, কেউ কেউ মনে করে,সালোয়ার কামিজ পড়ে রাস্তায় চলতে, বাসে ট্রামে চড়তে অনেক সুবিধে, তরুণীরা মনে করে, শাড়ী হচ্ছে ভীষণ ঝামেলার পোষাক, তার চেয়ে সালোয়ার কামিজ অনেক সুবিধার, পাকিস্তানপন্থী নারীরা মনে করে সালোয়ার কামিজ হচ্ছে তাদের মূল দেশে (পাকিস্তান)র ঐতিহ্যবাহী পোষাক।
মিতা হক রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী এবং অত্যন্ত গুণী শিল্পী। উনার কন্ঠে গীত রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনলে বিশেষ এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে মনপ্রাণ ভরে যায়। একজন রবীন্দ্রপ্রাণ মানুষের অন্তরে বাংলা এবং বাঙ্গালী যে কতখানি, তা শুধুমাত্র রবীন্দ্র অনুরাগীরাই বলতে পারবেন। এই মানুষটির মুখের দিকে তাকালেই মনে শ্রদ্ধা জাগে, সম্ভ্রম জাগে। টিভিতে সকলেই উনাকে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করতে দেখে, উনার মুখে কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক বক্তব্য কেউ শুনেছে বলে মনে হয়না, এবং উনিও কখনও রাজনীতি বিষয়ে কিছু বলেছেন বলেও মনে হয়না। তাই বোধ হয় মন-প্রাণ ঢেলে গান গাইলেও, কথা বলার বেলায় অপ্রিয় সত্যি কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারেননি।
এটা তো মানতেই হবে, বাংলাদেশের কালচারে শাড়ির যে উপজীব্যতা ছিল, শাড়ির যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল, বাংগালী নারী বললেই চোখের সামনে শাড়ী পরিহিত লাজনম্র নারীর যে মুখচ্ছবি ভেসে উঠতো, তা আজ হারিয়ে যাচ্ছে। কেন হারিয়ে যাচ্ছে, কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে, সেটি বলতে হলে কথায় কথা বেড়ে যাবে। যদিও মিতা হক ঘোমটা পরেননা বলেছেন, তবে্ বাঙালী নারীর পরণে যদি শাড়ীই থাকে, শাড়ীর সাথে ঘোমটা আসবেই। ঘোমটা শুধু হিন্দু ,মুসলিম নারীরাই দেয়না, বাঙালী মাত্রেই দেয়। ঘোমটা দেয়া না দেয়া ব্যক্তির রুচীর উপর নির্ভর করে। শাড়ী বা ঘোমটা দিয়ে কারো জাত বিচার করা যাবেনা। আসল কথা হচ্ছে, বিবেক বোধ। প্রতিটি বাঙালী নারীরই বুঝা উচিত, ‘নারী সুন্দর শাড়ীতে’। যেদিন নারী নিজে বুঝবে, ‘নারী সুন্দর শাড়ী’তে, সেদিন মিতা হক দেশের সর্বত্রই শাড়ী পরিহিত নারীকে দেখতে পাবেন। অবশ্য শাড়ী পড়লেই যে সব নারী বাঙ্গালী হয়ে উঠবেন, তা কিন্তু বলা কঠিন। আমাদের দেশের দুই দলের দুই নেত্রীই কিন্তু শাড়ী পড়েন। তারপরেও জর্জেট নেত্রীকে খাঁটি বাঙালীর মত লাগেনা, কিন্তু জামদানী নেত্রীকে খাঁটি বাঙালীর মত লাগে। পার্থক্যটা কোথায়? পার্থক্য উনাদের চলনে-বলনে, আচার-আচরণে। বাঙালীত্ব এভাবে বিচার করা যায়না। ছেলেরা দাড়ি টুপী রাখলেই কি আর বাঙালীত্ব হারিয়ে অবাঙালী হয়ে যায় নাকি জামাতী হলেই ক্লিন শেভড হওয়া যায়না? তাহলে তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কি বলা যাবে? মাওলানা ভাসানীর মত খাঁটি বাঙালীই বা কয়জন আছে?
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, অনলাইনে শুধুমাত্র মিতা হকের তিন মিনিটের বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ এসেছে, যা দেখে পুরো অনুষ্ঠানের পূর্বাপর আলোচনা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা করা যায়নি। ঠিক কোন প্রসঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে একজন রবীন্দ্র অনুরাগীকে এতটা বেখেয়ালী হয়ে কথা বলতে হয়েছে, তা জানার উপায় ছিলনা। পাঠক শুধু মিতা হকের কয়েকটি কথাকেই লুফে নিয়েছে এবং মিতা হকের সমালোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধটুকু করতে ভুলেনি। সাথে হিন্দুদেরকে গালি দিতেও ভুলেনি, অবশ্য বাংলাদেশের হিন্দুরা তো ‘ফুটবল’ এর মত, পায়ের কাছে পেলেই হলো, এক লাথিতে ইন্ডিয়ার গোলপোস্টে পাঠাও,কাজেই রবি গুরুর সাথে সাথে হিন্দুরাও গালি খেয়েছে। যে সকল পাঠক মিতা হককে বকতে গিয়ে কবিগুরুকে গালি দিয়েছে, তাদেরই পূর্বপুরুষদের একজন, খুব সম্ভবত মোনায়েম খাঁ, তার চাটুকারদের ঊদ্দেশ্যে বলেছিল “আপনাদের মধ্যে কেউ কি দুই চারটা রবীন্দর সঙ্গীত লিখতে পারেননা?”
পরিশেষে একজন গুণী শিল্পীর পক্ষ নিয়ে দুটো কথা বলিঃ
মিতা হককে আমি অনেক আগে খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম, শান্ত-শিষ্ট এক মা, ছোট একটি বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে ওয়াই ডাব্লিউ সি এ স্কুলে আসতেন, একই স্কুলে, আমার হাত ধরে আমার মৌটুসীও যেত। উনি তখন টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন, শুনে প্রাণ জুড়িয়ে যেত। কারো সাথে গায়ে পড়ে কথা বলার অভ্যাস আমার নেই বলেই এই গুণী মানুষটির সাথে কখনও আলাপ পরিচয় হয়নি। অনেক পরে জেনেছি, ছায়ানটের শিক্ষক, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ, কলামিস্ট ওয়াহিদুল হক সাহেবের ভাইয়ের মেয়ে হচ্ছে মিতা হক। বিশাল সংস্কৃতিমনা পরিবারের মেয়ে, বাংলাদেশের গৌরব, বাঙ্গালীর গৌরব। গৌরব ধূলায় লুটিয়ে দিতে নেই, যত সামান্যই হোক, তাকে এভাবে হেলা অশ্রদ্ধা করতে নেই, এতে করে আমরাই ছোট হই। একটি মাত্র টকশো’তে অনেক কথার ফাঁকে একটি আংশিক অংশকে ঊদ্দেশ্যমূলকভাবে যারা অনলাইনে প্রচার করে এই স্নিগ্ধরূপা মানুষটিকে অশালীণ ভাষার মহাসমুদ্রে ছুঁড়ে দিয়ে মহানন্দে ডিগবাজী খাচ্ছে, তারা আজ বুঝতে পারছেনা কি ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে এই সমাজের, কি ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে এই দেশের, কি ক্ষতিটাই না হয়ে যাচ্ছে বাংলা ভাষার এবং বাংলাভাষীদের।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন