লিখেছেন : ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
(আজ আলোচনা
জিশুর জন্মবৃত্তান্ত
নিয়ে।
সে মার্গে
গমনের পূর্বে
দুটি কথা
বলে নেওয়া
প্রয়োজন।
প্রথমত, গত
দুই পর্বে
আপনাদের সামনে
কিছু বিশ্লেষণ
হাজির করেছি। অনেকেরই
হয়তো সেসব
অজানা ছিল। কিন্তু
আজ থেকে
আমরা প্রবেশ
করব এক
চূড়ান্ত বিতর্কিত
অথচ ঐতিহাসিক
জগতে।
মসীহাকে অপমান
করার বিন্দুমাত্র
ইচ্ছা আমার
নেই।
যেমন নেই
কোনো বিশ্বাসীকে
আঘাত করার
বাসনা।
ধর্মের জগদ্দল
পাথরে চাপা
পড়ে থাকা
তথ্য তুলে
ধরাই এ
প্রবন্ধের একমাত্র লক্ষ্য।)
রোমান চার্চ জন্মক্ষণ
থেকেই অস্তিত্ব
সংকটে ভুগেছে
জিশুর রহস্যাবৃত
জন্মকে নিয়ে। প্রথমে
আমরা দেখে
নেব জনের
সুসমাচারের একটি প্রসিদ্ধ বচন: Jesus said unto them, ...I proceed forth
and came from God; neither came I of myself, but he sent me. (John 8:41-2)
এই রূপ
বিভিন্ন বাণী
চার্চ বারংবার
উদ্ধৃত করেছে
জিশুর ঐশ্বরিক
জন্মকথার ভিত্তি
রূপে।
কোনও মানব
যখনই ভক্তদের
অভিলাষে দেবত্বে
উপনীত হন,
তখনই তাঁর
অযৌন জন্মবৃত্তান্তের
গপ্প প্রচলনের
প্রয়োজন পড়ে। প্রয়োজন
হয় স্বয়ং
ঈশ্বরকে পিতার
ভূমিকায় অবতীর্ণ
করার।
বুদ্ধ, মহাবীর,
চৈতন্য - সকলের
ক্ষেত্রেই এই পথ অনুসৃত হয়েছে। ক্যাথলিক
চার্চও যে
একই রাস্তায়
হাঁটবে সেটাই
স্বাভাবিক।
যেন মনে
হয়, ঈশ্বর
স্বমৈথুন করে
তাঁর শুক্রাণু
কোথাও জমা
রাখতেন, যেমন
রাখা হয়
আধুনিক স্পার্মব্যাঙ্কে। অতঃপর
সেই শুক্রাণু
এক অদৃশ্য
ইথার তরঙ্গের
মাধ্যমে প্রতিস্থাপন
করা হয়
মেরী প্রভৃতি
'কুমারী মাতা'র গর্ভে।
যে কোনো শিক্ষিত
মানুষই স্বীকার
করবেন, মানুষের
ক্ষেত্রে অযৌন
জনন অসম্ভব। আফিমের
নেশায় আচ্ছন্নরা
মানতেই পারেন
যে জিশু
শুধুমাত্র Y ক্রোমোজোম নিয়েই কাজ চালাতেন,
X ক্রোমোজোমের কোনো প্রয়োজন পড়েনি তাঁর। ঈশ্বরের
প্রতিভূরা এরকম বিজ্ঞান অসম্মত কাজকর্ম
হামেশাই করে
থাকেন।
কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠ
মন এ
দাবী মানতে
অক্ষম।
তাই খোঁজ
জিশু নামক
মানবে, প্রথম
প্রাণস্পন্দন দানকারী শুক্রাণুর।
NTতে আমরা জিশুর
পালকপিতা হিসেবে
পাই যোসেফের
নাম।
যোসেফের পিতৃত্বের
দাবী ঝেঁটিয়ে
বিদায় করে
ম্যাথিউ জানিয়েছেন:
This is how Jesus Christ came to be born. His mother Mary was betrothed to
Joseph; but before they came to live together she was found to be with child
through Holy Spirit. (Mat 1:18)
ম্যাথিউ এর এই বক্তব্যের অনুরণন জন 8:42 তে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণভাবে, জন 8:41এ ইহুদিরা জিশুকে বলেছিলেন: We be not born of fornication; we have one Father.
ম্যাথিউ এর এই বক্তব্যের অনুরণন জন 8:42 তে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণভাবে, জন 8:41এ ইহুদিরা জিশুকে বলেছিলেন: We be not born of fornication; we have one Father.
ইহুদিরা জিশুকে বললেন যে তাঁরা অবৈধ যৌনতার ফসল নন, তাঁদের একজন পিতা। উত্তরে জিশু বলছেন, তিনি ঈশ্বরের পুত্র। কোথাও যেন একটা সুপ্ত অভিযোগের তীর কি ভেসে আসছে? ইহুদিরা কি জিশুকে দোষারোপ করছেন fornication এর ফলাফল বলে? তা বলে পাঠক যেন ভাববেন না যে এই ইহুদিরা জিশুর বিরুদ্ধাচারণকারী। জন পরিষ্কার বলেছেন: (these are) Jews which believed on him. (8:31)
অভিযোগের তর্জনী যত
উত্থিত হয়,
ততই তাকে
ঢেলে ফেলার
করুণ প্রয়াস
সংঘবদ্ধ হতে
শুরু করে। সামান্য
ঘটনাকেও পরিমার্জিত,
সংস্কৃত করা
হয় স্থান,
কাল, পাত্র
বা আলাপের
পরিবর্তনে।
সমস্যা হল
- পরিবর্তনের মেকীত্ব আরও বেশি বাঙ্ময়
করে তোলে
সত্যর নগ্নতা।
100AD তে রচিত জন
6:42 বলছে, জিশু যখন নাজারেথের মন্দিরে
প্রচার করছিলেন
তখন ইহুদিরা
তাঁকে : Is not this Jesus, the son of
Joseph বলে সম্বোধন করে। কিন্তু
NT এর প্রাচীনতম
দস্তাবেজ, 70AD তে রচিত মার্কের প্রবচনে
পাই অন্য
কথা।
মার্ক 6:3 বলছে ইহুদিরা জিশুকে সম্বোধিত
করে বলেন:
Is not this the carpenter, the son of Mary, the brother of James, and Joses,
and of Juda, and Simon? and are not his sisters here with us?
মার্ক জিশুর মা, ভাই, বোন সকলের উল্লেখ করলেও বাদ গেলেন যোসেফ। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত, ল্যুক ও জনের সমাচার বহুলাংশে মার্কের রচনার ওপর নির্ভরশীল। পরবর্তীকালের লেখক যখন পূর্বসূরীর অনুসারী হন, তখন তিনি অতি অবশ্যই পূর্ববর্তীর রচনার অসামঞ্জস্যকেও 'সঠিক' করে নেবার মহৎ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। জনও একই প্রয়াসে ব্যপ্ত হন। জিশুর পিতৃত্ব-জনিত সন্দেহের অবসান তিনি করতে চাইলেন ইহুদিদের মুখ দিয়ে, মার্ক কে সংশোধন করে।
মার্ক জিশুর মা, ভাই, বোন সকলের উল্লেখ করলেও বাদ গেলেন যোসেফ। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত, ল্যুক ও জনের সমাচার বহুলাংশে মার্কের রচনার ওপর নির্ভরশীল। পরবর্তীকালের লেখক যখন পূর্বসূরীর অনুসারী হন, তখন তিনি অতি অবশ্যই পূর্ববর্তীর রচনার অসামঞ্জস্যকেও 'সঠিক' করে নেবার মহৎ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। জনও একই প্রয়াসে ব্যপ্ত হন। জিশুর পিতৃত্ব-জনিত সন্দেহের অবসান তিনি করতে চাইলেন ইহুদিদের মুখ দিয়ে, মার্ক কে সংশোধন করে।
পরোক্ষ পারিপার্শ্বিক এসব
প্রমাণে যুক্তি
প্রতিষ্ঠিত হয় না। শতাব্দীর
পর শতাব্দী
ধরে গড়ে
ওঠা মিথ্যার
ইমারত ভাঙার
জন্য চাই
জোরালো প্রত্যক্ষ
সম্ভাষণ।
তাও আছে। নিকোডিমাসের
জিনস্টিক সমাচার
অনুসারে, বিচারক
পাইলেটের সম্মুখে
ইহুদি পুরোহিতরা
জিশুকে অভিযুক্ত
করেন: In the first place, we know this
concerning thee, that thou wast born through fornication. (Gospel of Nicodemus
2:17)
কোথাও কি এবার
সাযুজ্য বন্ধন
হচ্ছে জন
8:41 এর সঙ্গে?
একই সুরে
নিও-প্ল্যাটোনিস্ট
ঐতিহাসিক সেলসাস
200AD নাগাদ জিশুকে কানীনপুত্র বলে অভিযুক্ত
করেন।
শুধু অভিযোগ
করেই সেলসাস
ক্ষান্ত হননি,
তিনি জিশুর
বায়োলজিক্যাল পিতা হিসাবে প্যান্ডোরা বা
প্যান্থেরা নামে এক ব্যক্তিকে চিহ্নিতও
করেন।
(Henry Chadwich p.28)
জিশুর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে
শুধু সন্দেহ
প্রকাশ করেই
ক্ষান্ত হননি
তৎকালীনরা।
খাস নামটাও
উঠে এসেছিল। সেলসাস
লিখছেন: ...the mother of Jesus ...
having been turned out by the carpenter who was betrothed to her, as she had
been convicted of adultery and had a child by a certain soldier named Panthëra.
(1:32)
এই প্যান্ডোরা বা
প্যান্থেরা কে নিয়ে শতাব্দীর পর
শতাব্দী ধরে
রীতিমতো অশান্তিতে
ভুগেছে রোমান
চার্চ।
বারংবার প্যান্ডোরাকে
হাতিয়ার করে
খ্রিস্টান-বিরোধিরা আক্রমণ শানিয়েছে জিশুর
বিরুদ্ধে।
এই হল
সেই প্রকৃত
Pandora's box, যার উপস্থিতি ক্যাথলিক
চার্চকে এতটাই
বিব্রত করে
তুলেছিল যে
প্যান্ডোরাকে শেষাবধি জিশুর পূর্বপুরুষদের মধ্যে
আশ্রয় দান
করা হয়
বিতর্ক থামাতে। ফাদার
এপিফেনাস চতুর্থ
শতকে ঘোষণা
করেন: যোসেফের
পিতা Jacob Pantera নামে পরিচিত
ছিলেন।
আবার দামাস্কাসের
জন অষ্টম
শতকে বলেন
যে মেরীর
প্র-প্র-পিতামহ প্যান্টেরা
নামে পরিচিত
ছিলেন।
(James D Tabor p.64)
গোঁজামিলের কারবারে প্রত্যেকে
নিজের নিজের
মতো করে
ব্যাখ্যা করে
গোরুর গাছে
হাঁটার প্রকল্প। অথচ,
জিশু যে
যোসেফের বীর্যের
ফসল নন,
সেকথা তো
প্রথম দিন
থেকেই স্বীকার
করে নিয়েছিল
খ্রিস্টান জগৎ। কিন্তু প্যান্ডোরা
কাঁটার খচখচানি
কাটাবার মতো
উপায় একটাই
ছিল।
আর রোমান
চার্চ সেটাকেই
আঁকড়ে ধরেছিল। পল্লবিত
করে প্রচার
করেছিল জিশুর
অযৌন-জননের
কাহিনি।
এখন প্রশ্ন হল,
কে এই
প্যান্ডোরা? জিশুর কোনো পূর্বপুরুষ কখনোই
এ নামে
পরিচিত হতে
পারেন না। Pantera আর যাই হোক, হিব্রু
নাম নয়। তবে?
তবে কি
জিশুর শরীরে
ইহুদি ছাড়া
অন্য কোনো
জাতির রক্তও
প্রবাহমান ছিল?
সম্ভবত উনিশ শতকের
শেষভাগে ব্রিটিশ
ঐতিহাসিক চেম্বারলেন
প্রথম এই
প্রশ্ন পর্যালোচনা
করেন।
(p. 202) পরবর্তীতে এলফ্রেড রোসেনবার্গ
থেকে শুরু
করে জেন
স্কেবার্গ পর্যন্ত অনেকেই এ বিষয়ে
চর্চা জরেছেন। মিথের
আবরণ ভেঙে
উন্মোচিত করেছেন
সত্যনিষ্ঠ তত্ত্ব।
সেলসাস ও নিকোডিমাসের
বিবরণ আমরা
আগেই পড়েছি। এবার
দেখা প্রয়োজন
ইহুদি গ্রন্থগুলি
এ সম্পর্কে
কী বলছে। কিন্তু
তার সাথে
সাথেই আমাদের
মাথায় রাখতে
হবে, ইহুদি
লেখকদের কোনও
দায় ছিল
না জিশু
ও তাঁর
প্রচারিত খ্রিস্টান
ধর্ম সম্পর্কে
তথ্য পরিবাশনের। তাঁরা
সেটুকুই নথিভুক্ত
করেছেন, যেটুকু
তাঁদের মনে
চূড়ান্ত ভাবে
নাড়া দিয়েছে। বা,
যেটুকু তাঁরা
প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করেছেন।
জিশুর জীবনী সংক্রান্ত
একমাত্র ইহুদি
গ্রন্থ Toledoth Yeshu -তে জিশুর
পিতা রূপে
প্যান্থেরা চিহ্নিত হয়েছেন। কিন্তু
এটি ত্রয়োদশ
শতাব্দীর রচনা। অর্বাচীন
বলে গণ্য
করা যেতেই
পারে।
আরও পুরোনো
সূত্র প্রয়োজন। ইহুদি
ধর্মগ্রন্থ তালমুদ-এ জিশুকে দুই
পিতার সন্তান
- Mamzer - অভিধায় ভূষিত করা
হয়েছে।
প্রথমজন, যিনি
মেরীর স্বামী
এবং দ্বিতীয়
জন, যিনি
মেরীর প্রেমিক। (Shabbath 104b, M.Jeb iv.13, Sanh
67b। মিসনাহ্ নামক মূলগ্রন্থের অধ্যায়। আনু.
রচনাকাল দ্বিতীয়
শতক)
পাঠকের নিশ্চয় স্মরণে আছে জন 8:41 এ ইহুদিদের অভিযোগ: "আমাদের একজন পিতা"। আসলে NT তে জিশুর জীবনিতে রয়েছে প্রচুর ফাঁকফোকড়, যেগুলি ভরাট করে এই ধরনের বিভিন্ন নথি।
পাঠকের নিশ্চয় স্মরণে আছে জন 8:41 এ ইহুদিদের অভিযোগ: "আমাদের একজন পিতা"। আসলে NT তে জিশুর জীবনিতে রয়েছে প্রচুর ফাঁকফোকড়, যেগুলি ভরাট করে এই ধরনের বিভিন্ন নথি।
তালমুদে অন্যত্র জিশুকে
ben-stada বা ben-pandira বলেও উল্লেখ
করা হয়েছে। (Herford p.37) ben শব্দের অর্থ
পুত্র।
অর্থাৎ ben-pandira বলতে বোঝায়
প্যান্ডিরার পুত্র। কিন্তু Stada? এটি
একটি অ্যারামিক
ভাষার বিশেষণ
যা দুশ্চরিত্র
মহিলাদের উদ্দেশ্যে
ব্যবহৃত হতো।
মেরীর কানীনপুত্র জিশুর
পিতা হিসেবে
বারংবার প্যান্ডোরার
নাম উল্লেখ
করা হয়েছে
বিভিন্ন সূত্রে। এখন
দেখা প্রয়োজন,
সত্যই এই
নামের কোনো
ব্যক্তির অস্তিত্ব
আমরা খুঁজে
বের করতে
পারি কিনা। আমাদের
হাতে কি
কোনো ঐতিহাসিক
তথ্য আছে
এই প্যান্ডোরা
সম্পর্কে? অবশ্যই আছে, নতুবা ধর্মবিশ্বাসীর
এতক্ষণে ভ্যাম্পায়র
হয়ে তেড়ে
আসতেন লেখকের
শোণিত আস্বাদনে।
রোমের রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর
দস্তাবেজ ও
জার্মানির Roman Antiquities Museum, Bad
Kreuznach Town -এ উপস্থিত কবরস্তম্ভ
অনুসারে, Tiberius Julius Abdes Pantera নামে একজন
গল তীরন্দাজ
6 BC থেকে 6 AD - এই বারো
বছর জেরুশালেমের
রোমান গ্যারিসনে
কর্মরত ছিলেন। নীচের
মূর্তিটি জার্মানির
মিউজিয়ামের।
মেরী পতিতা ছিলেন,
নাকি পরাজিত
জনগোষ্ঠীর একজন লাঞ্ছিত নারী - দু
হাজার বছর
পরে তা
নির্ণয় অসম্ভব। বিজয়ী
সৈন্যবাহিনীর হাতে, পরাজিত সমাজের মহিলাদের
কতটা নিগৃহীত
হতে হয়
তা সর্বজনবিদিত। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সমাপনে বিজয়ী আমেরিকানদের চিত্ত
বিনোদন ও
অবকাশ যাপনের
নিমিত্ত জাপান
গভর্ণমেন্ট রীতিমতো সার্কুলার জারি করে
দেশের মহিলাদের
এগিয়ে আসতে
বাধ্য করে। আই.এস. জঙ্গিদের
হাতে কুর্দ
জনগোষ্ঠীর মহিলাদের যৌনদাসীতে পর্যবসিত হওয়ার
ঘটনা আজ
বহুল প্রচারিত।
কিন্তু সে অনির্ণীত
তত্ত্ব জিশুর
জন্মকথন প্রকাশে
বাধা হয়ে
দাঁড়ায় না। জিশুর
নর্ডিক উত্তরাধিকার
আজ তথ্য
ও তত্ত্বের
মিশ্রণে এক
প্রতিষ্ঠিত সত্য। (ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন