বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৩, ২০১৭

বাকস্বাধীনতা এবং এর বিরুদ্ধ মতবাদ

 লিখেছেন : পাপ্পন দাস
মৌলবাদের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলতে গিয়ে কবি শ্রীজাত লিখলেন---'আমাকে ধর্ষণ করবে যদ্দিন কবর থেকে তুলে--/কন্ডোম পরানো থাকবে,তোমার ধর্মের ত্রিশূলে।''---এ কি লিখলেন কবি?কন্ডোম পরা থাকলে কি যে কেউ যে কোনো কিছু করতে পারে?তার সব গুনাহ মাফ?কন্ডোম পরে যদি কেউ ধর্ষণ করে,তবে কি সেটা ধর্ষণ নয়?আর কন্ডোম না পরে ধর্ষণ করলেই কি তাকে শুধু ধর্ষণ বলে?কবির এ মানদণ্ড ভুল।কবি আমাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করেছেন।কবিকে সামনে পেলে তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিতাম।
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও তো রামারণ নিয়ে লিখবেন বলেও সেটা লিখেননি।কিভাবে তিনি লেখেন যে,সীতাকে হরণ করে রাবণ যখন নিয়ে যায়,প্রথম রাত্তিরে কিন্তু সীতাকে সে অশোক বনে রাখেনি,রেখেছিল তার নিজের অন্ধকারময় ঘরে।সেখানে কি সে সীতার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে নি?কিভাবে লিখবেন এই কথাটা?তাছাড়া গর্ভবতী সীতাকে নিয়ে বাল্মীকি যা ইঙ্গিত দিয়েছেন,লব-কুশ নিয়ে তিনি যা যা বলেছেন,কৌশল্যাকে নিয়ে রাজশেখর বসু যা যা বলেছেন,তা কিভাবে লিখবেন?না না,তা লেখা যায় না।তাই লেখা বাদ।রামায়ণ বাদ।কারোর ধর্মানুভূতিতে আঘাত করলেন না।
     এ জায়গায় দাঁড়িয়ে শ্রীজাত কিভাবে আমাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করেন?চলো,তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দি'।হয় তাঁর স্থান হোক জেলে,নতুবা তসলিমা নাসরিনের মতন রাজ্যের বাইরে।বুঝলে গুরু--এ দেশে ন্যূনতম বাকস্বাধীনতা নেই,তা শ্রীজাত,
তসলিমা এবং তাঁদের মতন বাকী সবারও বুঝতে হবে।তোমাদের বুঝতে হবে আমরা সম্মিলিতভাবে কোন দিকে এগুচ্ছি?
    কবিকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,'এটা আমার কাছে দুর্ভাগ্যজনক।কারণ, আমরা আসলে আস্তে আস্তে গণতান্ত্রিক একটা দেশ হিসেবেও এত বড় অসহিষ্ণুতার একটা আবহাওয়ায় ঢুকে যাচ্ছি,যেখানে মানুষের বাক-স্বাধীনতা খুব সংকীর্ণ একটা জায়গায় আবদ্ধ হয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে।একটা কোনো কিছুর বিরোধিতা করলে সঙ্গে সঙ্গে ফতোয়া জারি করা হচ্ছে।যেটা আগে আমাদের দেশে ছিল না।সেটা যে কোনো ধর্মের দিক থেকেই হোক না কেন।সেটা হিন্দুদের দিক থেকে হোক,ইসলামিকদের দিক থেকে হোক,
কিংবা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীদের দিক থেকে হোক।কিন্তু তাদের অসহিষ্ণুতা দিনকে দিন এত বাড়ছে।কারণ আমি কখনই ভাবি নি যে এই কবিতাটা এরকম একটা জায়গায় যাবে যে, যার জন্যে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করা হবে।সেটা দেখে আমি খুবই হতাশ।যেমন খুবই হাস্যকর জিনিসটা।কিন্তু হাস্যকরের চেয়েও বড় যে, তার আড়ালে লুকিয়ে আছে একটা হতাশা যে আমরা কোন দিকে যেতে চলেছি।...'
     ভাবা যায় না, একজন কবি কবিতা লিখেছেন বলে,কবিতার মাধ্যমে নিজের মত প্রকাশ করেছেন বলে প্রথমে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হল।এর একদিন পর তাঁর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করল পুলিশ।তিনি নাকি বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে কোনো এক ধর্মকে আঘাত করেছেন,তাই তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ দণ্ডবিধির ২৯৫(ক) ধারায় মামলা করা হল।
     বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং মুক্তমনারা এর প্রতিবাদ করলেও বিজেপি সরকার কিন্তু এই মামলার স্বপক্ষেই যুক্তি দেখাচ্ছে।পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির রাজ্য সম্পাদক রথীন্দ্র বসু মামলাকারীর বাড়িতে গিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান।শুধুমাত্র অভিনন্দন জানিয়ে তিনি থেমে থাকেন নি।তিনি মামলাকারীর হয়ে গলাও ফাটান।কারণ মামলাকারীর বক্তব্য তাঁর খুব ভালো লেগেছে।মামলাকারী বলছে,'হিন্দু ধর্মের সহিষ্ণুতাকে বাংলার কিছু বুদ্ধিজীবী দুর্বলতা বলে মনে করেন।তাই এমন একটা প্রতিবাদ জানানো উচিত মনে করছি।এর জন্য সমস্ত রকমের বিরোধিতার মুখে দাঁড়াতে আমি রাজি।'
    মনে পড়ছে গত শতকের শেষের দশকের কথা।ওপার বাংলায় তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে এরকম মামলা দায়ের করা হয়।তিনি নাকি এ দেশের জনপ্রিয় কাগজ দ্য স্টেটসম্যান-এ দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে কোরান সংশোধনের কথা বলেছেন।তসলিমা নাসরিন একজন বিতর্কিত লেখিকা।এই লেখিকা দীর্ঘদিন ধরে ইসলাম ধর্ম,আইন,ভারত বিভাগ এবং আরও অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিতর্কিত লেখালেখি করে আসছেন।লজ্জা উপন্যাস লিখেও তিনি ভারতের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ নিয়েছেন।তাই তাঁকে গ্রেপ্তার করতে হবে,নতুবা তাঁকে দেশ ছাড়তে হবে।এবং শেষমেশ তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়।তাঁর বিরুদ্ধে ঠিক এরকম ঘটনা আরেকবার ঘটে
কলকাতায়।সেখান থেকেও তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।আজ যদিও কবি শ্রীজাতর বিরুদ্ধে মামলা করায় অনেকে এর প্রতিবাদ করছেন।কিন্তু তসলিমা নাসরিনের হয়ে কিন্তু কেউ গলা ফাটাননি।আর তাই সে-দিন তিনি তাঁর ফেসবুক পেজে লিখলেন,' যার বাড়ি ঘর তুমুল ঝড় তুফানে ভেসে গেছে, যার জীবন টর্নেডোয় তছনছ হয়ে গেছে, যে মানুষ সুনামির শিকার, সে কিন্তু কারো মাথায় দু ফোঁটা বৃষ্টি পড়লে পাশে ছাতা হাতে দাঁড়ায়। সে আমি। আমি শ্রীজাত'র বিরুদ্ধে যে এফ আর আই হয়েছে, তার প্রতিবাদ করছি। আমার পাশে ওরা কেউ ছিলো না কোনওদিন। আমাকে হাঙ্গরের মুখে যখন ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছিল, ওরা দেখেছে, কিন্তু কিছু বলেনি। তারপরও আমি শ্রীজাতকে অহেতুক ভিজতে দেবো না। একটি বৃষ্টির ফোঁটাও ওর মাথায় আমি পড়তে দেবো না। দুষ্ট বৃষ্টি থেকে বাঁচাবো আমি তাকে। ঝড় তুফানের সামান্য কোনও চিহ্নও যেন তার আকাশের কোনও কোণে উঁকি না দেয়, তার জন্য যতটা চিৎকার করা যায়, করবো।আমি তো দেশহীন, রাজ্যহীন, ঘরবাড়িহীন নিঃস্ব মানুষ। আমার চিৎকারে কারো কিছু আসবে যাবে না। তারপরও চিৎকার করবো। আর কিছু না থাক আমার , নীতি তো আছে। সব রকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার বড় একটা, বিশাল একটা মন আছে। আমি ডানের খাই না, বামের খাই না, উপোস থাকি, তবু আদর্শ বিসর্জন দিই না।'
      তাঁর এই স্টেটাসের কমেন্টে একজন লিখলেন,'হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে যে কেউ লিখতে পারেন, এতে কিন্তুু খুব সাহসের দরকার নেই, তবে ইসলামী মৌলবাদের​ বিরুদ্ধে আপনি ছাড়া আর তেমন কেউ লেখার সাহস রাখেন না।'
     কমেন্টকারী যে একশ' শতাংশ ভুল,তার প্রমাণ আমি দিচ্ছি।--১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স-ডে।মাস খানেক আগে সেই নির্দিষ্ট দিনে ফেসবুকে আমি একটা লেখা লিখলাম--'ভ্যালেন্টাইন্স ডে-ফে এসবের কোনও প্রয়োজন নেই।আমি পেরেম কত্তে চাই,কে আমায় আটকাবে?আমার জীবন,আমার পেমিকা,যা খুশি করবো,যে-দিন মন চায় সে-দিন করবো,যে-খানে মন চায় সে-খানে করবো,গাছের ছায়ায় করবো,খোলা আকাশের নীচে রোদ্দুর গায়ে মেখে মেখে করবো,বৃষ্টি ভেজা গায়ে নিজেকে উজাড় করে দেবো,অন্ধকার ঘরে করবো,আলো জ্বালিয়ে করবো,না-কি জলের তলায়(?)---সেটা আমার ইচ্ছে।....'
      লেখাটা লিখেছিলাম একটা প্রতিবাদী মনোভাব থেকে।কারণ এবারের ভ্যালেন্টাইন্স-ডে তে প্রেমিক-প্রেমিকাদের বিরুদ্ধে কড়া ফতোয়া জারি করেছিল বজরং দল।তাই তাদের বিরুদ্ধেও লিখলাম আমি।আর সাথে সাথেই আমাকে হুমকি।একদল উগ্র ধর্মান্ধ লোক তো বলেই দিলেন যে তারা নাকি আমার বিরুদ্ধে আদালতে যাচ্ছেন।আমার প্রতিটা ফেসবুক আপডেটের দিকে নাকি তাদের নজর আছে।আর যখনই কোনো সংঘটন বা কোনো community এর বিরুদ্ধে কিছু লিখবো,সাথে সাথেই আমার বিরুদ্ধে criminal case দায়ের করা হবে, তখন কিন্তু আমাকে জেলে যেতে হবে।
    ভেবে দেখুন,আমরা কতটুকু অসহিষ্ণু হলে একজন লেখকের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করতে পারি,তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশে মামলা করতে পারি।এটা অবশ্য ঠিক,একজন লেখকের যতটুকু বাকস্বাধীনতা চাই,একজন আম জনতা,তারও ততটুকু বাকস্বাধীনতা চাই।একজন লেখককে যতটুকু মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া উচিত,একজন আম জনতাকেও ঠিক ততটুকু স্বাধীনতা দেওয়া উচিত।একজন লেখক যে কোনো কিছু লিখতে পারেন,একজন পাঠকের তা পছন্দ হতে পারে,আবার নাও হতে পারে।অপছন্দ হলে তিনি তার প্রতিবাদ করতে পারেন।কিন্তু তার জন্য অবশ্যই সুস্থ পরিবেশে থাকা চাই।প্রতিবাদ হতে পারে লেখনীর মাধ্যমে কিংবা আলোচনার মাধ্যমে।কিন্তু কখনই তাকে উগ্র আকার দেওয়া উচিত নয়।তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে,প্রত্যেকের এই ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে।তা না হলে ভারতীয় গণতন্ত্র কিন্তু একদিন মরেই যাবে।

কোন মন্তব্য নেই: