লিখেছেন : অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
সুচিত্রা সেন মানেই যেন এক জমকালো সেলুলয়েড সেনসেশন! সুচিত্রা সেন (এপ্রিল
৬, ১৯২৯/মতান্তরে এপ্রিল ৬, ১৯৩১) ভারতের অন্যতম বিখ্যাত অভিনেত্রী । লাখো
বাঙালির হৃদয়ের রানি। বাংলা চলচিত্র ইতিহাসের জীবন্ত কিংবদন্তী।
১৯৭৮ সালে 'প্রণয়পাশা' ছবি মুক্তি পায়। সেই শেষ। তারপর থেকে আর লোকচক্ষুর
সামনে আসেননি বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় মিথ সুচিত্রা সেন। তার নো-ম্যানস
ল্যান্ডে কারও প্রবেশাধিকার ছিল না। আজও সুচিত্রা-রহস্য ভেদ করা সম্ভব
হয়নি কারও। তার সেই বাঁকা চাহনি যা আজও বহু তরুণের ঘুম কেড়ে নেয়।
উত্তম-সুচিত্রা জুটি আজও বাংলা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ জুটি হিসাবে পরিগণিত।
শুধু পশ্চিমবাংলায় নয়, শুধু ভারতে নয়—সুচিত্রা সেনের জনপ্রিয়তা
পাশের
প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশেও তুঙ্গে। দেশ ভাগ হয়েছে কবেই, সুচিত্রা সেনকে
ভাগ করা যায়নি আজও।শেষ কয়েকটা বছর তিনি নিভৃত জীবনযাপন করছিলেন। তিনিই
প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার
পান (শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কার – “সাত পাকে বাঁধা” ১৯৬৩ ছবির জন্য, মস্কো
চলচ্চিত্র উৎসব)।১৯৫২ সালে “শেষ কোথায়” ছবির মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়, কিন্তু ছবিটি মুক্তি পায়নি। পরবর্তী বছরে উত্তমকুমারের বিপরীতে “সাড়ে চুয়াত্তর” ছবিতে তিনি অভিনয় করেন। ছবিটি বক্স-অফিসে সাফল্য লাভ করে এবং উত্তম-সুচিত্রা জুটি উপহারের কারণে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। বাংলা ছবির এই অবিসংবাদিত জুটি পরবর্তী ২০ বছরে ছিলেন আইকন স্বরূপ। ১৯৫৫ সালের “দেবদাস” ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেন, যা ছিল তার প্রথম হিন্দি ছবি। উত্তমকুমারের সঙ্গে বাংলা ছবিতে রোমান্টিকতা সৃষ্টি করার জন্য তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বিখ্যাত অভিনেত্রী। ১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকে তার অভিনীত ছবি মুক্তি পেয়েছে। অন্য আর-একটি হিন্দি ছবি হল “আঁধি”, এই চলচ্চিত্রে তিনি একজন নেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। বলা হয় যে, চরিত্রটির প্রেরণা এসেছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জীবনচর্যা থেকে। এই ছবির জন্য তিনি “ফিল্ম ফেয়ার” শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন এবং তার স্বামীর চরিত্রে সঞ্জীবকুমার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান।
১৯৭৮ সালে সুদীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয়ের পর তিনি চলচ্চিত্র থেকে অবসরগ্রহণ করেন। এর পর তিনি লোকচক্ষু থেকে আত্মগোপন করেন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হন। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য সুচিত্রা সেন মনোনীত হন, কিন্তু ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে সশরীরে পুরস্কার নিতে দিল্লি যাওয়ায় আপত্তি জানানোর কারণে তাঁকে শেষপর্যন্ত পুরস্কার দেয়া হয়নি। তার মেয়ে অভিনেত্রী মুনমুন সেন এবং মুনমুনের দুই মেয়ে নাতনি রিয়া সেন ও রাইমা সেনও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বহুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর মেয়ে মুনমুন সেন বলেছিলেন, "উত্তম কুমারকে বিয়ে করা উচিত ছিল তোমার। উনি কোনো উত্তর দেননি। স্রেফ হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।"
এই মুহূর্তে তাঁর অভিনীত যে চলচ্চিলগুলি মনে পড়ছে -- সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩),ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪),অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪),শাপমোচন (১৯৫৫),সবার উপরে (১৯৫৫),সাগরিকা (১৯৫৬),পথে হল দেরি (১৯৫৭),হারানো সুর (১৯৫৭),দীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৯),সপ্তপদী (১৯৬১),বিপাশা(১৯৬২),চাওয়া-পাওয়া (১৯৫৯), সাত-পাকে বাঁধা (১৯৬৩),হসপিটাল (১৯৬০), শিল্পী (১৯৬৫),ইন্দ্রাণী (১৯৫৮),রাজলক্ষী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮),সূর্য তোরণ (১৯৫৮),উত্তর ফাল্গুনি (১৯৬৩,হিন্দিতে পুনঃনির্মিত হয়েছে “মমতা” নামে),গৃহদাহ (১৯৬৭),ফরিয়াদ, দেবী চৌধুরানী (১৯৭৪),দত্তা (১৯৭৬),প্রণয় পাশা(১৯৭৮), প্রিয় বান্ধবী, আঁধি (১৯৭৫),শ্রাবণসন্ধ্যা (১৯৭৪),হার মানা হার (১৯৭২), আলো আমার আলো (১৯৭১), ফরিয়াদ (১৯৭১), কমললতা (১৯৬৯), গৃহদাহ (১৯৬৭),বোম্বাই কা বাবু (১৯৬০)।
সুচিত্রা সেন শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাঁকে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে সর্দি, জ্বর, কাশি আর শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন তিনি।বেলভিউ হাসপাতালে ডা. সুব্রত মৈত্রের তত্ত্বাবধানে আছেন সুচিত্রা সেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন