শনিবার, জানুয়ারী ২৫, ২০১৪

সেই সাদা বাড়িটা (পর্ব ৪)

              লিখেছেন : মনোবর 
সুনীল মামার মা তার ছেলের হবু বৌ দেখবার জন্য একদিন এখানে চলে এল। মধ্যম উচ্চতার অতীব ফর্সা এক সুশ্রী বৃদ্ধা। প্রথাগত ভাবে পাত্রী না দেখে তিনি অন্যভাবে পাত্রীকে দেখে সবশেষে আমার মতামত চাইলেন। হঠাৎ তিনি ঘোষণা করলেন মনু যা বলবে তাই হবে। সেই বয়সে কেন জানিনা লোকে আমাকে পছন্দ করে ফেলত। আমি গভীর ভাবনায় পড়ে গেলাম। মিতালী মাসির যে একটা প্রেম ছিল তা আমি জানলেও মামা জানত না। সুনীল মামা আমার প্রায় আবদার রক্ষা করত। সুতরাং তার ভালর কথা আমাকেও ভাবতে হবে। মামা তার দুই দুস্থ বোনকে নানা ভাবে সাহায্য করত। নিজে বাসায় রান্না করে খেত। আর নানা রকম দায় দায়িত্ব সত্বেও আমার আবদার রক্ষা করত। আর খুব কম লোকই মামার মত গল্প বলতে পারত। মামার সঙ্গে অনেক বার ভূতের সাক্ষাৎ হয়েছিল। শোবার আগে মামা গম্ভীর মুখে সেইসব অদ্ভূত অভিজ্ঞতার বর্ণনা আমার কাছে দিত। সবশেষে আমায় প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিত এইসব গোপন কথা আমি যেন কারও কাছে প্রকাশ না করি।
সুপুরুষ সুনীল মামা ছিল আমার অতিপ্রিয় এক চরিত্র। অতএব মামী হিসেবে একজন স্বার্থপর অন্তঃসারশূন্য একজন ভান সর্বস্ব নারীকে আমি পছন্দ করায় সায় দিলাম না। মামা আমায় অনেক ঘুষঘাষ দিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। আমি সুস্পষ্ট ভাবে মত দিলাম বিয়ের বিরুদ্ধে। ব্যাস! আমার মতই গ্রাহ্য হল। বিয়ে নাকচ হয়ে গেল। আর তারপর মিতালী মাসি কেন জানিনা আমার শ্ত্রু হয়ে গেল।

এই শত্রুতার কারণে আমার ও বাড়ীতে যাতায়াত কমে গেল কিন্তু সমবয়েসী হিসাবে মনোজের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বজায় থাকল। এইসময় মনোজের কাকা যিনি এয়ার ফোর্সে চাকরি করতেন আর যার ব্যায়ামপুষ্ট চেহারা ছিল দেখবার মত তিনি তিন মাসের ছুটি নিয়ে মনোজদের বাড়ীতে বেড়াতে এলেন। রাস্তায় একদিন আলাপ করে তিনি আমায় পছন্দ করে ফেললেন আর প্রায়ই আমাকে ও বাড়ীতে ডেকে পাঠাতেন। এই সূত্রে আবার ও বাড়ীতে আমার যাতায়াত শুরু হল। মামা ততদিনে বদলী হয়ে বারুইপুর ঘরভাড়া নিয়ে সেখানে চলে গেলেন। পরীক্ষার পর একবার সেখান থেকেও ঘুরে এলাম। মামা আমাকে একটা জিনসের প্যান্ট আর শার্ট উপহার দিলেন।

আমাদের তখন বয়ঃসন্ধিকাল। আর আমাদের মধ্যে মনোজই প্রথম নিষিদ্ধ জগতের অভিজ্ঞতা লাভ করল। অকে সহায়তা করল পাশের বাড়ীর এক যুবতী। তার বর এক গেঞ্জীর কারখানায় কাজ করত। সেই কারখানা লক আউট হয়ে যাবার পর সে বেকার বসে থাকত আর তার বৌ মনোজদের বাড়ীতে দৈনন্দিন কাজের জন্য নিযুক্ত হল। এই যুবতীর কৃষ্ণবর্ণ তনুখানি ছিল চোখে পড়বার মত। পরবর্তী কালে সে পুর্বতন স্বামী ত্যাগ করে এক বিবাহিত স্কুলমাষ্টারের পাণিগ্রহণ করে এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে জীবন অতিবাহিত করছে বলে শোনা গেছে। কিন্তু ঐ সিদ্ধান্ত নেবার আগে আর্থিক সুবিধার উদ্দেশ্যে সে এই এলাকায় অনেক কীর্তিস্থাপন করে। তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল মনোজের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া।

স্বগর্বে মনোজ ঘোষণা করত যে তার মত এমন সাফল্য এত কম বয়সে আর কেউ দেখাতে পারেনি আর পারবেও না। এরপর সবিস্তারে সে অজানা সব ব্যাপার এবং জীবনের প্রকৃত আনন্দ যে কাজের মধ্যে নিহিত সেই সম্মন্ধে আমাদের জ্ঞান সমৃদ্ধ করত। ওর অবস্থা হল আদমের মত। নিষিদ্ধ ফল হুড়মুড় করে ভক্ষণে ব্যস্ত মনোজের পড়াশুনার পরিণাম হল শোচনীয়।

এইরকম এক সময় দাদুর স্ট্রোক হয়ে গেল। কিছুদিন শয্যাশায়ী থাকার পর তিনি দেহ রাখলেন। অতএব তার চালু ডাক্তারি ব্যবসা ধরে রাখবার জন্য এবং কাছে থেকে একমাত্র পুত্রের দেখাশুনার জন্য স্ত্রী এবং দুই কন্যা সমেত হাসপাতালের চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে বিহার থেকে মনোজের বাবা মা পাকাপাকিভাবে এখানে চলে এল।
সাদা বাড়িতে নতুন যুগের সূচনা হল। মনোজের মা অতি দ্রুত প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা সঙ্গতিসম্পন্ন তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুললেন। অপেক্ষাকৃত গরীব্দের ও বাড়ীতে যাতায়াত নিষিদ্ধ হল কিন্তু পাড়ার ঊঠতি বয়সের ছেলেদের প্রতি কোন কঠোর আইন প্রয়োগ করা হলনা কারণ তারা নানারকম বিষয়ে দরকারী সাহায্য যোগাত। দুজন উঠতি বয়সের সুন্দরী বালিকা যুবতী যে বাড়ীতে থাকে কোন এক অজানা কারণে প্রায় উঠতি বয়সের সব ছেলেরা সেই বাড়ীর আশপাশে ঘুর ঘুর করে আর তাদের কোন কাজে লাগলে নিজেদের ধন্য মনে করে।

এই নতুন যুগেও আমি টিঁকে গেলাম কারণ মামীমার ধারণা ছিল আমার সান্নিধ্য মনোজের উপকারই করবে। পাস করা ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করা ফেল করা ছেলেদের পক্ষে সবসময়ে ভাল বলে তিনি মনে করতেন।
মনোজের দুই বোনের মধ্যে কায়দা কানুনে আধুনিকতা এবং কলকাতার ঢঙ্গে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলার কারণে ফর্সা সুন্দরী মিলি অচিরেই সারা পাড়ার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াল। মিতালী মাসির প্রভুত্বের যুগ অস্ত গিয়ে মামীমার অসম্ভব কূটনৈতিক তত্বাবধানে মিলিযুগের উদয় হল। এবং এই নতুন যুগে মিতালী, চৈতালী, ঠাকুরমা এমন কি মণোজ পর্যন্ত কোনঠাসা হয়ে দ্বিতীয় এক শিবির গড়ে উঠল যার সদস্য হিসেবে ওরা আমাকে ওদের দলে চাইল। আমি সেই চাওয়ার অমর্য্যাদা করিনি কারণ দাদু এবং মিতালী, চৈতালী মাসীরা আমার জীবনে একটা স্থায়ী ছবির মত বিরাজ করত। ভালমন্দ সব মিলিয়ে যে জীবনটা পেছনে পড়ে রইল, যে জীবন কখনই বদলানো সম্ভব নয় ওরা তার অন্যতম চরিত্র হয়ে আমার স্মৃতির রূপকথা হয়ে গিয়েছিল পরবর্তী চটকের এমন ক্ষমতা ছিলনা যে ওদের এই আসন টলিয়ে দেবে। ফলে পরবর্তী কালের সংঘাতে আমার ভূমিকা ছিল মোহনলালের মীরজাফরের নয়।

                             ( ক্রমশঃ)

কোন মন্তব্য নেই: