লিখেছেন : মনোবর
‘তুমি কে?’
‘তুমি কে?’
‘কেন?’
‘তুমি কি কখনও এই ঘরে থাকতে?’
‘থাকতাম তো।’
‘তারপর কি হয়েছিল?’
‘মরণ! তোমরা তো তাই বল।’
‘কিভাবে?’
‘তুমি জেনে কি করবে?’
‘না। থেমোনা। বল, বল কিভাবে?’
‘মেরে ফেলেছিল। আজ আমি যাই। জানালা বন্ধ
করবে না।’
তারপর জলতরঙ্গের শব্দ। পাশের ঘরে টিভি
চলছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। নির্বাক দৃষ্টিতে খাতার দিকে চেয়ে আছি। আমার হাতে কলম
ছিল। এসব কি অন্যমনষ্কভাবে আমিই লিখলাম! কিন্তু উত্তরগুলোর লেখার ঢং আলাদা।
প্রশ্নগুলো আমার ঢঙ্গে লেখা। বাইরে লোক চলাচল শুরু হয়েছে। জীবন একটু একটু করে আবার
কোলাহল মুখর হয়ে উঠছে। আমার খুব শীত করছিল। কম্বলটা টেনে গায়ে দেবার পরে একটু
স্বস্তি পেলাম। মাথা ভারী, ক্ষিদে বলে কিছু টেরই পেলাম না। তারপর এক সময় ঘুমিয়ে
পড়লাম।
বাইরে থেকে দরজা ধাক্কার শব্দে ঘুম ভাঙল।
বুড়ীমা। ‘একটা বাজে। তুমি স্নান করবে না?’
‘না। আমার বোধহয় জ্বর হয়েছে।’
‘অ্যাঁ! সেকি!’ বুড়ীমা আতংকিত হয়ে পড়ে।
‘তাহলে কি খাবে? ভাত না খাওয়াই ভাল।’
‘এখন কিছুই খাবোনা। বিকেলে যদি ইচ্ছা হয়
মুড়ি টুড়ি খাব।’
‘দেখো দেখি আবার জ্বর বাঁধিয়ে বসলে! কিছু
দরকার টরকার হলে ডেকো।’
বুড়ীমা বিদায় নিতে আমি গুটি সুটি মেরে
কম্বলের তলায় ঢুকে যাই।
* * * * * * * * * * * *
কেমন
যেন হয়ে যাচ্ছি। বাইরে ঘোরাঘুরির চেয়ে ঘরে থাকলেই স্বস্তি পাচ্ছি। অনেকদিন বাড়ীতেও
যাওয়া হয়নি। খাতাতে ক্রমশঃ লেখা জড় হচ্ছে। খুব গোপন এই খাতাটা। এখন আমার স্নায়ু,
ইন্দ্রিয় অনেক বেশী সজাগ। চোখ বন্ধ থাকলেও বুঝতে পারি ও আছে না নেই। কাজকর্মে খুব
ভুলভাল কেন যে হচ্ছে! সবসময় নাকি আমি অন্যমনষ্ক থাকি। যারা বলে ওরা সব ছাপোষা লোক।
কতক্ষণ তাল দেওয়া যায় ওদের সঙ্গে!
কেউ কেউ আবার বলাবলি করছে আমার নাকি
মানসিক অবসাদ হয়েছে। ওরা ঠিক করেছে আমাকে এক সাইক্রিয়াটিষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করাবে। ভুলটা
আমারই। আমি ওদের কাছে ওর কথাটা বলেছিলাম।
লোকটার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। একটা
আরামদায়ক চেয়ারে আমাকে বসাল। ঘরটায় আলো ছিল কিন্তু তীব্র নয়। ‘আমিও জানি এই জগতের
আড়ালে অন্য একজগত আছে।’ এই কথা বলে লোকটা কি সব খুট খাট শুরু করল।
‘আপনার সঙ্গে এক অশরীরি আত্মার কথা হয়।
হতেই পারে। বলুনতো কি কি কথা হয়।’ এই বলে লোকটা জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে
রইল। আর তখনই এই প্রথম আমি ওর কন্ঠস্বর শুনলাম। ফিসফিস করে বলল, ‘ওকে কিছুই বলবে না।’ দুনিয়ার কারো কথা তো আর
ওর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। অতএব লোকটার সব কারিকুরি বিফলে গেল। আমার এক জামাইবাবু
আর মা ঠিক করেছে এখান থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করবে। আমি সে
প্রস্তাবে জল ঢেলে দিয়েছি। পৃথিবীর অন্য কোথাও আমি থাকতে চাইনা। এমন কি স্বর্গেও
নয়।
আমি
এখন গল্পটা জানি। ও ঐ বুড়ীমা’র ছোট মেয়ে। বুড়ীমার স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর বুড়ীমা
চাকরী পায়। তারপর কর্মক্ষেত্রে একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। সেই লোকটা
এখানে যাতায়াত করত। মেয়ে লোকটাকে পছন্দ করত না। অপমান করত যা-তা বলত। একদিন ওর
চোখে একটা আপত্তিকর ব্যাপার পড়ে যাবার পর অশান্তি তুমুল হয়ে ওঠে। বুড়ীমা তখন
মধ্যস্থতার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তারপর সেই রাত এল। বুড়ীমা বাড়ীতে ছিলনা।
ওর মাসী এসে থাকবার কথা ছিল কিন্তু মেসো হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় মাসী এলোনা। লোকটা সেই
রাতে পথের কাঁটা সরাবার জন্য কোন এক কৌশলে ঘরে ঢুকে পড়ে। ও চেঁচাতে পর্যন্ত
পারেনি। তার আগেই লোকটা সবলে ওর গলাটিপে ধরে। ঐ পর্যন্তই ওর মনে আছে। পরে ওর মা
নাকি খুব কেঁদেছিল। কিন্তু পাছে নিজে জড়িয়ে পড়ে সেই ভয়ে খুনের কথাটা আত্মহত্যা বলে
চালান হয়। ওর মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে লোকটা থানা, পুলিশ সব ম্যানেজ করে ফেলে।
প্রতিবেশীরাও কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। বুড়ীমা এরপর লোকটার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে আর
লোকটা এক বীভৎস পথদুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। এতে ওর হাত ছিল কিনা সে প্রশ্নের উত্তর ও
দেয়নি। ও বলেছে যে এখন ওর কোন কষ্ট নেই। ও বলেছে যে ওর মা জানে যে ও এখানে যাতায়াত
করে।
ও
আরো কিছু কথা বলেছে কিন্তু তা কাউকে বলতে বারণ। কি এমন আকর্ষনীয় এই ভুলেভরা
নিষ্ঠুর জগৎ। ও বলেছে আমি ওর জগতে যেতে চাই কিনা তা ঠিক করতে। কতগুলো মুর্খই আমাকে
মানসিক রোগী ভাবে। কতগুলো মুর্খই ভাবে যে ও গলায় শাড়ী জড়িয়ে আত্মহত্যা করেছিল।
তারা তো জানেনা প্রথম প্রথম ও কত নিঃসঙ্গ ছিল। ও তখন হিংস্র ছিল। এখন ও খুব শান্ত
আর মিষ্টি। যে কোন মানুষের চেয়ে ও ভাল। শুধু আগের শরীরটাই যা নেই।
ও আছে। যেমন সবাই আছে সেভাবেই ও আছে। এরা
বিশ্বাস করেনা। এদেরই একজন তো ওকে মেরেছিল। আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি। আমি
বলেছি, ‘আমি তোমার জগতে যাবো। তোমার সঙ্গে থাকব আমি।’
তারপর অনেকক্ষন ও নিরুত্তর ছিল। আমি জানি
ও অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল।
অনেক পরে ও বলল, ‘বেশ তাই হবে।’
সমাপ্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন