লিখেছেন : সুদীপ্ত তরফদার
দশমাস দশদিন গর্ভধারণ করে সন্তানের জন্ম দিলেন৷ পরে রক্ত পরীক্ষায় প্রমাণ মিলল আপনি নাকি তার মা (বায়োলজিক্যাল মাদার ) নন ! শুনে গল্পকথা মনে হলেও বাস্তবে এ ধরনের বিভ্রাটের শিকার হতে পারি আমি -আপনি যে কেউই৷ তাই ডিএনএ পরীক্ষা করে পিতৃত্ব অথবা মাতৃত্বের দাবি খারিজ বা বহাল করার আগে দু’বার ভাবার সময় কিন্ত্ত এসে গিয়েছে৷ ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রেও তাই রয়ে যাচ্ছে প্রমাণের ফোকর গলে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ৷ খুব বেশি দিন নয় , এই বছর চারেক আগেকার কথা৷ রাজ্যেরই এক আদালতের কাঠগড়ায় ছিলেন প্রতিষ্ঠিত এক ব্যবসায়ী৷ অভিযোগকারিণী মহিলা কল্পনাদেবী (নাম পরিবর্তিত) দাবি করেছিলেন , ১৩ বছর সুখী সাংসারিক জীবন কাটানোর পর পরনারীতে আসক্ত হয়ে তাঁকে ও তাঁর দুই সন্তানকে স্ত্রী -পুত্রের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে অস্বীকার করছেন তাঁর স্বামী৷ তাঁর না হয় বিয়ের কাগজপত্র নেই৷ তা বলে তাঁদের দুই সন্তান তো রয়েছে৷ আদালত যেন তাঁদের প্রাপ্য সুবিচার দেয়৷
বায়োলজি সম্পর্কে কিঞ্চিত্ জ্ঞান রাখা থেকে হাল আমলের সিরিয়াল ‘সিআইডি ’ বা ‘আদালত ’ দেখা বাচ্চাও এখন বলে দেবে পরবর্তী চিত্রনাট্য কোন পথে এগোবে৷ আদালত মা , বাবা ও সন্তানদের ডিএনএ পরীক্ষার নির্দেশ দেবে এবং দুধ কা দুধ , পানি কা পানি হয়ে যাবে৷ হ্যাঁ, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল৷ আর যে রায় এসেছিল তা চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো৷ দেখা গিয়েছিল , ওই দুই সন্তানের রক্তের সঙ্গে তাদের মায়ের রক্তের ডিএনএ গঠনের মিল নেই , সোজা কথায় তিনি ওদের জন্মদাত্রী মা -ই নন৷ আদালতে রিপোর্ট পেশ হওয়ার চার দিনের মাথায় আত্মহত্যা করে সব জ্বালা জুড়িয়ে ছিলেন ওই ‘মা ’৷ হ্যাঁ মা৷ কারণ , পরে পুলিশের জেরার মুখে সব স্বীকার করে নেন ওই ব্যবসায়ী৷
কেনও এমন হল ? ডিএনএ পরীক্ষাও কি তবে ভুল রিপোর্ট দিয়েছিল ? নাকি অন্য কোনও রহস্য ! পরীক্ষার ভুল নয়৷ এটি হল ‘কাইমেরিজম ’ নামে মানব -জিনোমের (সকল জিনের সমষ্টি ) এক বিরলতম বৈশিষ্ট্য যার দরুণ প্রাথমিক ভাবে ধরা পড়েনি মা -ছেলের নাড়ির টান৷ যা হতে পারত বাবার ক্ষেত্রেও৷
কাইমেরার অস্তিত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেও বিশদ গবেষণা এখনও শৈশব স্তরেই রয়েছে বলে ‘এই সময় ’কে ইমেলে জানিয়েছেন আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির জেনেটিক্স বিভাগের গবেষক ডঃ আলেকজান্ডার আরবান৷ কাইমেরা পাঠ্য বইয়ে থাকলেও যে ভাবে বিশ্বের নানা প্রান্তে এর রোগীর সন্ধান মিলছে , তাতে একে নিয়ে অবিলম্বে বিস্তারিত গবেষণা ও জনসচেতনতা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছেন ডক্টর আরবান৷ সম্প্রতি সায়েন্স পত্রিকায় এ সংক্রান্ত তাঁর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে৷
কল্পনাদেবীর পরিণতিটা যতটা মর্মান্তিক হয়েছিল , ততটা অবশ্য হয়নি ওয়াশিংটনের লিডিয়া ফেয়ারচাইল্ডের ক্ষেত্রে৷ তৃতীয় সন্তানের জন্মের সময় প্রশ্ন ওঠে তাঁর মাতৃত্বের ‘সত্যতা ’ নিয়ে৷ আদালতের নির্দেশে প্রসবের সময় লেবার রুমে উপস্থিত থেকে সেখানেই সন্তান ও মায়ের রক্ত নেওয়া হয়৷ সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে দেখা যায় , সেই সন্তানের রক্তের সঙ্গেও তাঁর রক্তের ডিএনএর কোনও মিল নেই৷ পরবর্তীকালে অবশ্য আরও বিশদ পরীক্ষা -নিরীক্ষার পর চিকিত্সকেরা তাঁকে ‘মানব -কাইমেরা ’ ঘোষণা করেন৷ ১৬ মাস পর ফের মায়ের মর্যাদা ফিরে পান ফেয়ারচাইল্ড৷ হিউম্যান কাইমেরার এ রকম আরও একাধিক চাঞ্চল্যকর উদাহরণ খুঁজে পাবেন ইন্টারনেটে৷ যেমন , ৫২ বছরের তিন সন্তানের মা জেন কিডনি ট্র্যান্সপ্ল্যান্টের সময়ে পরিবারের মধ্যে ‘দাতা ’ খুঁজতে গিয়ে রক্তপরীক্ষা করানোর পর জানতে পেরেছিলেন তিনি তাঁর দুই সন্তানের মা নন৷ পরে অবশ্য হিউম্যান কাইমেরা হওয়ায় ফেয়ারচাইল্ডের মতোই মাতৃত্ব ফিরে পান তিনি৷ কিংবা বস্টনের ২৫ বছর বয়সি মিসেস ম্যাক , একই সঙ্গে শরীরে ‘O’ এবং ‘A’ গ্রুপের রক্ত নিয়ে জন্মেছিলেন যিনি৷
গত শতকেও বিজ্ঞানী , চিকিত্সকদের সাধারণ ধারণা ছিল , প্রাণী দেহের যে কোনও একটি কোষ থেকে পাওয়া জিনোমেই লুকিয়ে থাকে তার বংশগতির ঠিকুজি -কুষ্ঠি৷ বাকি কোষে ছানবিন করার দরকারই নেই৷ আর জিনের অনেক রহস্য এখনও অধরা৷ জিনের সে রকমই বিরল এক বৈশিষ্ট্যে কখনও সন্তানের শরীরে মিলছে না মায়ের চিহ্ন৷ লিখছেন সুদীন্ত তরফদার৷ সেটা যে সঠিক নয় , কাইমেরিজমই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ কলকাতায় জিন চরিত্র বিশ্লেষণের অন্যতম কেন্দ্র বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেসের (ভিআইএমএস ) জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপিকা ডঃ অজন্তা হালদার জানালেন , শহরে ডিএনএ পরীক্ষার খুব বেশি সুবিধা নেই৷ শুধু কাইমেরাই নয় , টার্নার সিন্ড্রোম , মোসেইকসিজ্ম -এর মতো একাধিক জিনঘটিত রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে তাঁদের কাছে৷ লিউকোসাইট কালচার করে যাঁদের কেরিওটাইপিং করতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে জিনের জাদুকরী গঠনের অচেনা সব ছবি৷
তাঁর কাছেই জানা গেল , কাইমেরা সৃষ্টির ইতিবৃত্তের কথা৷ মাতৃগর্ভে সাধারণত একটি ডিম্বাণুই (X ক্রোমোজোম ) নিষিক্ত হয় পিতার শুক্রাণু (X বা Y ক্রোমোজোম ) দ্বারা৷ তৈরি হয় জাইগোট বা ভ্রুণানু৷ তবে কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে মায়ের গর্ভে থেকে যাওয়া দ্বিতীয় একটি ডিম্বাণুও একই ভাবে নিষিক্ত হয়ে দ্বিতীয় একটি জাইগোট গঠন করতে পারে৷ সে ক্ষেত্রে দু’টি সম্ভাবনা থাকে৷ প্রথমত , দু’টি সন্তানেরই জন্ম হওয়া (নন -আইডেন্টিক্যাল টুইন )৷ দ্বিতীয়ত , দু’টি জাইগোট (ধরা যাক Z1, Z2) প্রোগ্রেসিভ এমব্রায়োজেনেসিস পদ্ধতির কোনও ধাপে (জাইগোট --২সেল -৪সেল -মাল্টি সেল -মরুলা --ব্লাস্টুলা -গ্যাস্ট্রূলা ) জুড়ে গিয়ে একটিই সন্তানের জন্ম হওয়া৷ ধরা যাক সেই সন্তান হল মেয়ে (D)৷ সে ক্ষেত্রে তার সঙ্গে স্বাভাবিক পুরুষের (ক্রোমোজোম XY) মিলনে জন্মানো সন্তানের সঙ্গে মায়ের মিল অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যাবে না৷
মায়ের (D) শরীরের যে যে অঙ্গ Z1 জাইগোটের অংশ থেকে সৃষ্ট হবে , তার সঙ্গে Z2 জাইগোটের থেকে সৃষ্ট অঙ্গের জিনোমের কোনও মিলই খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ ধরে নেওয়া যাক , মায়ের (D) রক্ত তৈরি হয়েছে Z2 জাইগোটের থেকে আর স্ত্রী -জননতন্ত্র গঠিত হয়েছে Z1 জাইগোটের থেকে৷ সে ক্ষেত্রে মা ও সন্তানের রক্তের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করা যাবে না যে সে তার মায়েরই গর্ভজাত সন্তান৷ দু’টি জাইগোট জুড়ে গিয়ে হওয়া ওই মা হলেন হিউম্যান কাইমেরা৷
বিজ্ঞানীর বলছেন , শরীরের কোনাকাঞ্চিতে লুকিয়ে থাকতে পারে অল্প অল্প কাইমেরিজম৷ তাই জেনে রাখা ভাল , বলা যায় না কবে প্রশ্ন উঠে গেল আপনার বংশগতি নিয়ে৷ তাই , সাধু সাবধান ! ৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন