লিখেছেন :মনোবর
রঙ্গমঞ্চে একটা লাশের মত এলিয়ে আছি। চারদিক ঘেরা এই
মঞ্চে খাটের উপর থেকে লাশটাকে তুলে এইবার হাঁটাতে হবে কারণ আজ একটা সাক্ষাৎকার
আছে। কিন্তু একটা কল করে নেওয়া দরকার। ঠিক আছে স্টেশনে গিয়েই না হয় করা যাবে।
এই জামাকাপড় পরার ব্যাপারটা বিরক্তিকর। একসেট পোষাক তুলে রাখা আছে কিন্তু এখন
বারকরা যাবে না। তাহলে জেরার মুখে পড়তে হবে। এই পোষাকে যাওয়াটাও খেলো দেখাবে।
তাহলে? হয়েছে! ওঘরে কেউ নেই। যা আছে কপালে!
পরবর্তী দৃশ্যে আমি রাস্তায়। দ্বিতীয় চরিত্র রুনার
বাবা। ডাইরেক্টরের ষড়যন্ত্র। ‘বলছিলাম গতমাসে তো বেশ কয়েকটা কামাই আছে এই
শনিবার রবিবারটা পড়িয়ে দিলে হতনা?’ আজ তো হবেনা। বড়দির
বাড়ী যাচ্ছি বড়দাদাবাবু হঠাৎ শুয়ে পড়েছে। বলে আমি এগুতে এগুতে দেখি রুনার
বাবার চোখে অবিশ্বাস ঝুলে রয়েছে।
মারো গুলি। ভুগিয়ে ভুগিয়ে টাকা দেয়। আবার শনি রবি
পড়াতে বলে। বেকার জানে কিনা বায়নার আর অন্ত নেই। ‘কোথায় চললি রে?’ পান চিবুতে চিবুতে হারুদার উদয়। বড়দির বাড়ী যাচ্ছি। আমার নির্বিকার
উত্তর। ‘তোর বড়দি তো লক্ষীকান্তপুরে থাকে। এখন তো
আপট্রেন আসবার সময়!’ হারুদা অবাকহয়ে জিজ্ঞাসা করে।
শালাদের কি আমার ঠিকুজি মুখস্থ থাকে! বড়দি আছে মেজদির বাড়ী। জামাইবাবু
হাসপাতালে ভর্তি তো তাই। ‘আমিও তো পিজি তে যাচ্ছি ভায়রাভাই কে দেখতে’।
ভাগ্যিস হাসপাতালের নাম বলিনি। ‘চল ভালই হল গল্পে গল্পে
যাওয়া যাবে’। হারুদার খুশী আর ধরছে না। এখন কলটা কিভাবে
করা যায়! ‘চা খাবি?’ হারুদা
প্রস্তাব দেয়। এই সুযোগ।
হারুদা, তুমি চা খেয়ে নাও আমি
একটু আসছি। বলে আমি হন হন করে হাঁটা মারি।
‘হ্যালো, মানব বলছি’।
‘সে তো বুঝতেই পারছি’।
‘তুমি আসছো তো?’
‘না এলে কি ভাল হয়?’
‘
কার? তোমার না আমার?’
‘জানিনা তো!’
‘শোন, আমি স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা করছি। ঠিক
সময়েই পৌঁছে যাবো’ ‘বুঝেছি’।
হারুদা বোধহয় বুঝতে পেরেছে আমি ওকে এড়িয়ে যাবার
চেষ্টা করছি। এবার চোখে চোখ পড়তেও না দেখার ভান করল। যাকগে! পরে ম্যানেজ করতে
হবে। ট্রেনে চাপার অভিজ্ঞতা বিচিত্র। সিটের জন্য লড়াই করার সময় সভ্যতাকে ভুলে
যাবার এক অপূর্ব সুযোগ এসে উপস্থিত হয়। যেমন আজ হল। একটি রো তে চতুর্থ সিটটি
ফাঁকা দেখে তার সামনে যেই না দাঁড়িয়েছি অমনি এক যুবতী কোমরের ধাক্কায় আমায়
সরিয়ে সেই সিটে বসবার দাবীদার হয়ে দাঁড়াল। ব্যাপার টা লক্ষ্য করে আর এক যুবক
হেসেই ফেলল। যুবতী কিন্তু গম্ভীর। যার সঙ্গে সাক্ষাৎকার তার কথা মনে পড়ল। নত
মস্তকে আর একটু ভেতরে ঢুকে গেলাম। এই সময় জানালার পাশের সীটের একজন উঠে দাঁড়াল
তারপর আমাকে সিট ছেড়ে দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সুতরাং নিজেকে বললাম পুরো
প্রোডাকশান না দেখে ডিরেক্টরের সমালোচনা করনা বৎস।
পরের দৃশ্য রোম্যান্টিক। শহর, গ্রাম তার
সব বৈভব নিয়েও আমাকে ধরে রাখতে পারছে না। ওরা অবাক হয়ে আমার এই উদাসীন চলে
যাওয়া লক্ষ্য করছে। এদিকে আমার পাশে কল কাকলী চলছে। লড়াকু যুবতী কানের মধ্যে
হেডফোন গুঁজে কিছু শুনছে। তার পাশে আরও দুজন বড় বেশী মুখর হয়ে কত কি যে বলে
যাচ্ছে। মানবের কি আর ঐসবে মন আছে? নেই। ‘আর কিছু বলবে?’ এই কথাটা দিগন্ত থেকে
ঘন্টাধ্বনির মত বার বার অনুরণিত কেন হচ্ছে কে জানে!
আমার এবার কিছু বলা উচিত। বলা উচিত যে আমরা এবার জীবন
আমাদের মত করে শুরু করতে পারি। বলা উচিত যে তোমাকে নিজের ভবিষ্যত নিয়ে আর ভাবতে
হবে না। এখন আমাদের হবে একটাই ভবিষ্যৎ। আর এইসব বলার জন্য আমার একটি নিশ্চিত
রোজগারের প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন কর্ম দরকার। ও এই রকম কিছুই ভীষণ ভাবে শুনতে চায়।
আর এই সব কিছুই মলির প্রাপ্য। ও এই সবকিছুর যোগ্য। ও সহিষ্ণু, শান্ত, নিয়মানুগ, সুন্দরী। আর কি চাই? এই রকম একজন কি একটি শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ, ভালোবাসার রোদ ছায়ার ভরা সম্পূর্ণ এক
জীবননাট্যের জন্য মঞ্চ অধিকার করতে পারে না? অবশ্যই পারে
যদি ডিরেক্টর বায়াসড না হয়, যদি সে অনুভূতিহীন একটা
জড়পদার্থ না হয়, যদি যখন তার জেগে থাকার কথা তখন সে ঘুমিয়ে
না পড়ে অথবা স্রেফ, স্রেফ একটু বেশী হাততালির লোভে একটা
সৃষ্টিছাড়া পারম্পর্যহীন নাটক নামিয়ে নাট্যশিল্পের বারটা সে না বাজাতে চায়।
কিন্তু কার এতবড় বুকের পাটা যে কোন এককেই যাকে মাপা যায়না অতবড় একজন ডিরেক্টর
কে অযোগ্য বলবে!
এইসব কি আমি ভয় থেকে বলছি? আমি কি আসলে
এক অবোধ্য, অদৃশ্য, অথচ নিত্য
ক্রিয়াশীল অমোঘ সত্তাকে বোকার মত প্রশংসা করে ভাগ্য যা জ্ঞানীদের মতে আসলে কোথাও
নেই তাকে নিজের অনুকুলে নিয়ে আসতে চাইছি! যদি তাই হয় তাহলে আমি হয়ত বিজ্ঞান
ভ্রষ্ট হচ্ছি কিন্তু প্রেমের জয় হচ্ছে। সবাই কি চায়না যে অন্তে প্রেমই বিজয়ী
হোক? তাহলে তাই হোক প্রেমেরই জয় হোক। ট্রেনটা এইবার
শিয়ালদহে ঢুকে পড়ছে। মলি বুকস্টলের কাছে অপেক্ষা করছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন