শুক্রবার, নভেম্বর ১৫, ২০১৩

জীবন মঞ্চের দু-একটি কথা (পর্ব-৩)

                                  লিখেছেন : মনোবর
ফুলকলি রে ফুলকলি বল তো এটা কোন গলি? টিভি তে একটা ঢ্যাঙ্গা লোক সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে নাচছে। লম্বা বলেই হয়ত তার চলন, ঘূর্ণন বেশ লাগছে দেখতে। এখনকার মত সামারসল্ট নাচ নয় অবশ্য। তা হোক দেখতে বেশ লাগছে। ‘কি দ্যাখস টিভিতে? তুই না দোকানে যাবি বললি? যাবি কখন?’ মা পূর্ব বাংলার মায়া এখনো কাটাতে পারেনি। হয়ে গেল নাচ! আগে তুই খেয়ে পরে বাঁচ! বাবার প্রেসার বেড়েছে। বড়দি এলেই বাবার প্রেসার হাই হয়। মেজদি আর সেজদির চেয়ে ও কতই না বঞ্চিত হয়েছে। সে দুঃখ এলেই উজাড় করে দেয়। ওর বর হাইস্কুল টীচার। কি বা এমন মাইনে পায়। বড় মেয়ে বলেই ও বড় দাবী করতে পারে। ভুল যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন বাবা কেন ওকে ব্যাকিং করবে না? বাবা কি আর করে! আদরের বড় মেয়ে। বাবা মেয়েদের খুব ভালবাসে। শুনেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাসত। আর বাবা তো সাধারণ এক ব্যবসায়ী। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে সমপরিমাণ ভালবাসা আমার পাবার কথা। সেই ফিল্ডে এখন জামাইদের সঙ্গে আমাকে জোর লড়াই করতে হচ্ছে। অপোনেন্ট ক্রমেই স্ট্রং হচ্ছে। মেয়ে প্লাস জামাই প্লাস নাতি নাতনী। আমার অবস্থা অভিমন্যুর মত। বীর বলে খ্যাতি হয়ত পাবো কিন্তু বিজয়ী হতে পারবো না।
দোকান ব্যাপারটা আমার ঠিক স্যুট করেনা। দোকানটা চলে ভালো। কিন্তু কর্মচারীটি আমাকে ঠিক বস বলে মানতে চায় না। ফলে আমার একটা অস্বস্তি হয়। বিশ্বস্ত কর্মচারী আর বাউন্ডুলে পুত্র দুয়ের মধ্যে কাকে প্রাধান্য দেবেন বাবাও ঠিক বুঝতে পারে না। আমার স্বভাব কুন্তীপুত্র কর্ণের মত। তুমি যদি আমার মূল্য বুঝতে না পারো হে পিতঃ, আমি তবে দুর্যোধনের পক্ষেই না হয় চলে যাবো। অর্জুনের বারটা বাজিয়ে দেবো। আপাততঃ আমি বিদ্রোহী হব এবং দোকানে যাবো না। বড়দি এসেছে। ও যদি ওপেন ফিল্ড পেয়ে যায় যুদ্ধ আরো ক্রুশীয়্যাল টার্ন নেবে। ‘ আমার আজ শরীর খারাপ। এখন আমি দোকানে যেতে পারবো না।’´বলে আমি উপবেশিত অবস্থান বদলে ধুপ করে শায়িত অবস্থায় চলে যাই। ‘এই গলিতে যদি কেউ একবারই আসে, সেই তো ফাঁসে! তুই এখানে হায়রে নিজের দোষেই তো বন্দী হলি!’ গানটা যা জমেছে! ‘তোর যা খুশী তাই কর!’ এই বলে মাতৃদেবীর প্রস্থান হয়।

অনতিবিলম্বে বড়দির প্রবেশ ঘটে। সঙ্গে আবার ভাগনা সুনয়ন। এর মধ্যেই করতে হয়েছে চশমা ধারণ। বাঁচাও প্রভু গিরি গোবর্ধন! ‘দেখা, তোর মামাকে রেজাল্টটা দেখা।’ বলে দিদি সুনয়ন কে এগিয়ে দেয় অতএব ফুলকলি এপিসোড জট পাকিয়ে যায়। ‘জানিস মনু! ইংরাজীতে কি কান্ড করেছে? চল্লিশের মধ্যে ঊনচল্লিশ। ওর টীচার পর্যন্ত অবাক হয়ে গেছে। আসবার সময় আবার বায়না ধরেছে মামাকে বলবে আমায় যেন একটা স্যান্ডুইচ মোবাইল কিনে দেয়। জানিনা! আমি ওসব বলতেও পারব না। তুই বোঝ আর তোর মামা বুঝুক!’ এই বলে দিদি ঝড়ের মত প্রস্থান করে। পরের ক্ষেপনাস্ত্রটা কোথায় ঝাড়বে ভগবান জানে! ‘তুই তো প্রায় সাহেবদের মত ইংলিশ শিখে ফেলেছিস!’ গর্বের বাঁধ খুলে দিই আমি। সুনয়নের চোখ টিভির দিকে। ‘এম টিভি টা দাওনা।’ বলে ও আমার দিকে তাকায়। ‘স্যান্ডুইচ মোবাইল কি রে?’ আমি জিজ্ঞাসা করি। ও মাথা নাড়িয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করে। তুই আমার কাছে মোবাইল চাইবি বলেছিলি? ও আবার মাথা নাড়ায়। তবে যে তোর মা বলল? আমার তদন্ত অভাবনীয় সাফল্যের দিকে এগোচ্ছে। ‘বাবা মাকে শিখিয়ে দিয়েছে বলার জন্য।’ বলে ভাগনা টিভিতেই মগ্ন হয়ে যায়। জানালা দিয়ে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। আকাশ দেখেই আমার মলির কথা মনে পড়ে। জানালার ওপাশে ওর মুখ দেখতে পাই। সুনীল উন্মুক্ত আকাশের ব্যাপক পটভুমিকায় আমার নীলকন্ঠ পাখী মুচকি হেসে আমার দিকে তাকায়। আমার তখন আকাশ হতে ইচ্ছা হয়!

কোন মন্তব্য নেই: