মঙ্গলবার, নভেম্বর ১২, ২০১৩

সেই রাতে যা ঘটেছিল

            লিখেছেন :  মনোবর
আমার হেডফোনটা গেল খারাপ হয়ে পাঁচ গজ তার সমেত ফিলিপসের হেডফোনটা শো টাকা দিয়ে কিনেছিলুম তা বছরখানেক পর তার কোথায় একটা কি যেন লিক হয়ে গেল অফিসে নিয়ম কানুন এমন কড়া করেছে যে খানিক আগে বেরুব তার উপায় নেই রেজিষ্টারের কাছে গেলে তিনি দেখান এস কে, এস আবার দেখান ডি এস কে ডি এস আবার বলেন, ‘সেক্রেটারিকে বলে যান ব্যাপারে আমি কিছু করতে পারব না সেক্রেটারির ঘরে ভিড় লেগেই থাকে ওই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এই শো টাকার প্রব্লেম কে প্রায়োরি টি খাওয়ান অসম্ভব যাক্গে বাবা অফিস ছুটির পরেই না হয় চাঁদনি চকে যাব ওখানে টুলে বসে কাজ করে বিশাল সব মেকানিক হেডফোন, হটফোন, চাঁদে যাবার রকেট সব ওরা সারাতে পারে বলে শুনেছি

যেতে যেতে সন্ধ্যে হল,ওপরের দিকে আবার গুড় গুড় করে মেঘমামা ডাকতে শুরু করল ওমা! খানিক পরেই অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম শুরু হয়ে গেল টুলে বসা মেকানিকরা টুল নিয়ে দৌড়বে কখন আর আমার হেডফোন একজামিন করবেকখন! আটটা নাগাদ বৃষ্টির ব্রেকডাউন হলে আমি একে ওকে হেডফোনের ব্যাধির ব্যাপারটা বোঝাবার মওকা পেয়ে গেলুম বড় মিস্ত্রীরা কি আর সহজে এইসব তুচ্ছম্বিষয়েন মস্তক ঘর্মাৎ করতে চায় সব ব্যাটার খালি গন্ডার মারার ধান্দা
তা এক কোনে দেখি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে একজন হাই তুলছে আবার ফাঁকে ফোঁকরেপদযুগল কে আন্দোলিত করছে বাক্যবাণে ঐটেকে বধ করে দিলুম বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সে তার পালটে মালটাকে দাঁড় করিয়ে দিল আবার তাতে একটা গানও শুনিয়ে দিল শবনমী, পহেলে নেহিথী চাঁদনী গৌরব, গৌরব! এসব হীরের টুকরো এইট ফেলরা এশিয়ার গৌরব

এর পর সাফল্যের আনন্দ আর ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে মাখামাখি হয়ে যখন শিয়ালদহ পৌঁছলুম তখন বাজে রাত দশটা শেষ ট্রেন সাড়ে দশটায় স্টেশনের জায়ান্ট ফ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে আদ্র পোষাক শুকোতে গিয়ে কাঁপুনি এসে গেল শীতের দাওয়াই হচ্চে ক্যালরি চিপ ক্যালরি হচ্চে গিয়ে পাঁচ টাকার কেক আর মোষের ক্ষীরের চা একটা কেক হচ্চেনা দেখে দুটো মেরে দিলুম পয়সা তো কেউ সংগে করে নিয়ে যেতে পারবেনা ভাই! অনাবশ্যক কৃপণতার কিবা প্রয়োজন!ডিনারটা সেরে নেবার পর পরই রাতের ট্রেনটা ঘোৎ ঘোৎ করতে করতে শেষ ঠিকানায় এসে লম্বা শ্বাস ছাড়ল 


ট্রেন ছাড়ার বাঁশী বাজল আরোহীর সংখ্যা নগণ্য যাদের হেডফোন অটুট আছে তারা এতক্ষণ---যাকগে যার যেমন কপাল বৃষ্টির কারণে হাওয়ার উল্টোদিকে তিন নাম্বার সিটে বসলুম তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম তা তো আর বুঝতে পারিনি লাট খেয়ে পড়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল সে পতন থেকে নিজেকে হ্যাচ্কা মেরে ুলে নিতে গিয়ে ঘুম ছুটে গেল ততক্ষনে মেঘের ফাঁকে পূর্ণ জ্যোতি নিয়ে চাঁদের উদয় হয়েছে সেই চাঁদ জানালা বরাবর ট্রেনের সংগে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে আমি যেদিকে চাঁদ ছিল তার উল্টোদিকে আর ওই জানালায় ঘোমটা মাথায় এক নারীমূর্তি চাঁদের দিকে একভাবে চেয়ে কি যেন ভেবেচলেছে বাঁদিকে হেলে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে চেয়ে দেখি একেবারে পেছনদিকে হাঁটুমুড়ে বসে আছে জনাদুই মধ্যবয়সী তারাও ঢুলছিল এইদিকে কেবল একটা টিউব জ্বলছিল আমার চতুর্দিক নিরীক্ষণের মধ্যেই সেটাও আবার দুলকি মারতে শুরু করল তারপর হতচ্ছাড়া ভোগেই গেল
পরিবেশটা কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হল এত রাতে একাকী মেয়ে যাচ্ছেটা কোথায়! এই সময় ট্রেনের ঘট ঘটাং ভেদ করে একটা ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পেলাম একটু পরেই বোঝাগেল মেয়েটি কাঁদছে কি যে অস্বস্তি হতে লাগল! কিন্তু অজানা অচেনা একটি মেয়েকে হঠাৎ তো আর জেরা করা যায়না কান্নার শব্দ ক্রমশঃ জোরাল হয়ে উঠছিল প্রায় মনস্থির করে ফেলেছি যে ওর কাছে গিয়ে ব্যাপারটা জানতে চাইব ঠিক তখনই আমায় কোন অবকাশ না দিয়ে মেয়েটি উঠে দাঁড়াল আর তীব্র গতিতে যেন সে ভেসে গেল হাওয়ায় প্রায় আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে দরজার দিকে, জোরাল বিদ্যুৎ চমকাল একবার -পরিষ্কার দেখতে পেলাম তার কান্নাভেজা মুখ,এলোমেলো চুল আর ঘষটে যাওয়া সিঁদুরের টিপ! অথচ কি মর্ম্মান্তিক ভাবেই সে ঝাঁপ দিল সবেগে নীচেনাবলে তীব্র চীৎকার হারিয়ে গেল দুরন্ত গতির শব্দে আর আমিই রইলাম একমাত্র এই ভয়ংকর ঘটনার প্রায় বোবা হয়ে যাওয়া সাক্ষী! কিছু বোঝবার আগেই সব ঘটে গেল দৌড়ে ওপাশের লোক গুলোর কাছে গেলাম দেখলাম তারা বেদম মাতাল শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে আমাকে একবার দেখেই তারা চোখ বুঁজল আর বিড় বিড় করে কি সব বলতে লাগল কিচ্ছু করার নেই, ওর বেঁচে থাকা অসম্ভব ব্যাপার
গন্তব্যে এসে প্রায় মাতালের মত টলমল করে ট্রেন থেকে নামলাম স্টেশন মাস্টারকে বলেও কোন লাভ হবেনা এত বিষাদ জীবনে কখনও অনুভব করিনি আমি অবাক হয়ে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটাকে যেন বার বার দেখতে পাচ্ছিলাম রাতের ট্রেনের তীব্র বাঁশিতে সম্বিৎ ফিরল ট্রেনটা যখন নির্বিকার ভাবে তার চিরকালীন ভংগীতে আমাকে অতিক্রম করছিল তখন যে কামরা থেকে একটু আগেই আমি নেমেছি যেখানে মাতাল দুটো তখনও বসে সেদিকে চেয়ে মনে হল আমি হয়ত এবার অজ্ঞান হয়ে যাব হ্যাঁ, একটুও ভুল দেখিনি আমি সেই জানালায় সেই মেয়েটি তখনও বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিল আর শুন্যের মধ্যে আমি হাতড়ে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে আমার ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছিলাম কিন্তু পারিনি পড়ে যাবার মুহূর্তে আমার আনন্দ হচ্ছিল, খুব আনন্দ! ওকে যে আমি বেঁচে থাকতে দেখে গেলাম!

কোন মন্তব্য নেই: