লিখেছেন : গৌতম গুপ্ত
ধর্ম মানুষের জীবনকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করে, সে কথা হয়তো সঠিক বুঝতে পারি
না নিজে কোনও ধর্মাচরণে বিশ্বাস করি না বলে৷ যখন সুপ্রিম কোর্টে মামলায় বলা
হল, রমজান পালনের জন্য রমজানের পুরো মাসটা ধরে পঞ্চায়েত নির্বাচন
করা চলবে না, আমার মনে হয়েছিল, সে আবার কি? আবার রায়ে যখন বলা হল, মানুষের ধর্মীয় আবেগ ও
দুর্বলতার চেয়েও বড় দেশের সংবিধানের বিধান, মনে হল, এখনও সব আশা শেষ হয়ে যায়নি৷তারপর যখম জানলাম, অতীতে বিনা আপত্তিতেই ভারতেই রমজানের সময় বিভিন্ন নির্বাচন হয়ে গেছে, মনে প্রশ্ন এল, মুসলমানেরা কি ক্রমশ বেশি করে ধর্মাচরণে বিশ্বাসী হয়ে উঠছেন? আরও জানা গেল, শতকরা ১০০ ভাগ মুসলমান দেশ কুয়েতে এই রমজান মাসের মধ্যেই নির্বাচন হতে চলেছে, তখন মনে হল, আমাদের রাজ্যে আপত্তিটা কতটা বাস্তবসম্মত ?
একটা কথা মনে রাখা ভাল, পৃথিবীর সব ধর্মেরই শুরু প্রাচীন বা মধ্য যুগে৷ সে সময়কার মানুষের জ্ঞান, বিশ্বাস ও জীবনযাপনের ধারা ছিল অন্য রকম৷ সেই বিশ্বাস ও অভ্যাস আজও হুবহু অনুসরণ করে যেতে চাইলে আধুনিক জীবনের সঙ্গে তা মেলানো মুশকিল৷ বেশি আগে যাওয়ার দরকার নেই, গত শতকের প্রথম দিকেও তো খৃষ্টানেরা প্রতি রবিবার গীর্জায় যেতেন প্রার্থনা করতে৷ অবশ্য প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক মেলামেশা আর বিয়ের জন্য মেয়ে-দেখা ও ছেলে-দেখার কাজও সম্পন্ন হত৷ আজকাল ক’জন খৃস্টান প্রতি রবিবার গীর্জায়
যান? তাতে কি আসে-যাচ্ছে? শহরাঞ্চলে ক’টি হিন্দু বাড়িতে আজও সন্ধেবেলায় শাঁখ বাজে? ক’টি বাড়িতে তুলসীতলা রয়েছে? কিংবা, পৈতে হওয়ার পর ক’জন ব্রাহ্মণ সন্তান রোজ আহ্ণিক করে গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করেন?
মুসলমানেরা যে দিনে পাঁচবার নমাজ পড়েন, তাতেও আমি বিলক্ষণ অবাক হই৷ মনে হয়, মানুষের আর কি কাজকর্ম নেই? কিংবা, রমজানের সময় সারা দিন উপোস ও অন্যান্য নিয়মকানুন পালনে তাঁদের অনেকেরই নিষ্ঠা দেখে আশ্চর্য হই৷ আধুনিক জীবনের সঙ্গে এ সবের সামঞ্জস্য কতটুকু? ব্যাপারটা এমন নয় তো, নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রচার করার একটা তাগিদ থেকেই এ সব নিয়ে নতুন করে বাড়াবাড়ি শুরু হয়েছে?
পশ্চিমী দেশগুলিতে বসবাস করেন যে সব মুসলমান তাঁরা কি সেখানকার নির্বাচনের সময় রমজান পড়লে বিচলিত হন? দিন বদলের জন্য পথে নামেন? এই যে আজ কলকাতার রাজপধে মিছিলের ব্যানারে লেখা হচ্ছে, রমজান মাসে নির্বাচন মানে মুসলমানদের ভোট প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে রাখা, তার মানে কি? এ কি ঘুরিয়ে নির্বাচন বয়কটের ডাক দেওয়া?
নানা মানুষের নানান ধর্ম৷ নিজের ধর্মকে সেরা ধর্ম বলে বিশ্বাসটাই বড় বিপদের কারণ৷ ওই অন্ধ বিশ্বাস থেকেই অন্য ধর্মকে আঘাত করা আর প্রাচীন জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়ার ঝোঁক তৈরি হয়ে যায়৷ প্রাচীনপন্থীরা পুরনো বিশ্বাস মেনে জীবন কাটাতে চান৷ পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞানের ও চিকিত্সাবিদ্যার সুফলগুলি কিন্তু এঁরা নির্দ্বিধায় উপভোগ করেন৷ তখন মনে হয় না, কই এ সব তো ধর্মের আদি যুগে ছিল না?
পশ্চিমী দুনিয়ায় ধর্মবিশ্বাসহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলছে৷ অর্থাত্ বিজ্ঞান ও
যুক্তিবাদের যতই প্রসার ঘটবে, ততই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ধর্মবিশ্বাস৷
আরও কত বছর লেগে যাবে বাকি পৃথিবীতেও এই ধর্মহীনতার ধর্ম ছড়িয়ে পড়তে, তা জানি
না৷ কিন্তু যে ধর্মাচরণ মানুষে মানুষে কেবল বিভেদ ঘটায়, তা মানুষের
সমাজে থাকবে কেন? ধর্মাচরণের যে দায় মেয়েদের ঘরে বন্ধ করে রাখতে চায়, যে বিশ্বাস
অবিশ্বাসীর প্রাণদণ্ড চায়, সে ধর্ম থাকা মানেই তো মানুষের
অকল্যাণ৷ যে ধর্মবিশ্বাস সংস্কৃতি চর্চাকে পাপ মনে করে, তা তো মানুষের
সেরা কীর্তিগুলিকেই অস্বীকার করতে চায়৷ যে মানুষ অবিশ্বাসীর ওপর আক্রমণ
শানায়, সে তো বিশ্বাস করে না বহুত্ববাদে৷ সে তো স্বাধীন চিন্তার শত্রু৷
আজ দুর্গাপুজোই হোক, কিংবা ক্রীসমাস, তা ধর্মাচারণের চেয়েও সর্বজনীন উত্সবের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে৷ রমজানে ধর্মাচরণ যেন ক্রমশ নিয়মের নিগড়ে বন্দী হয়ে পড়ছে৷ কি হয় এক মাস উপোস না করলে, এ প্রশ্ন কি করা চলে না? পুরনো প্রথা আজও মেনে চলবার সার্থকতা ও যৌক্তিকতা তো সব ধর্মের মানুষেরই ভেবে দেখে দরকার৷ বাকি জীবন এগিয়ে চলবে, পারিপার্শ্বিক বদলে যাবে, কিন্তু ধর্মাচরণ ও ধর্মবিশ্বাসের ধরণ প্রাচীনত্বের নিগড়ে বন্দী থাকবে, এটা কেমন কথা?
আজ দুর্গাপুজোই হোক, কিংবা ক্রীসমাস, তা ধর্মাচারণের চেয়েও সর্বজনীন উত্সবের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে৷ রমজানে ধর্মাচরণ যেন ক্রমশ নিয়মের নিগড়ে বন্দী হয়ে পড়ছে৷ কি হয় এক মাস উপোস না করলে, এ প্রশ্ন কি করা চলে না? পুরনো প্রথা আজও মেনে চলবার সার্থকতা ও যৌক্তিকতা তো সব ধর্মের মানুষেরই ভেবে দেখে দরকার৷ বাকি জীবন এগিয়ে চলবে, পারিপার্শ্বিক বদলে যাবে, কিন্তু ধর্মাচরণ ও ধর্মবিশ্বাসের ধরণ প্রাচীনত্বের নিগড়ে বন্দী থাকবে, এটা কেমন কথা?
কৃতজ্ঞতা : এই সময়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন