লিখেছেন ৹ গৌতম গুপ্ত
যত দূর মনে পড়ে বছর সাতেক বয়স থেকে একা একাই বাজারে যাওয়ার অভ্যাস
শুরু হয়েছিল৷ সে অবশ্য এক অজ পাড়াগাঁয়ে৷ সেখানেই বাজারের ফর্দ তরি-তরকারির
দোকানে হাতে ফেলে দিয়ে আমি চলে আসতাম পাঁঠার মাংসের দোকানে৷ ঠিক দোকানও
নয়৷ একেবারেই খোলা আকাশের নিচে গুটিকতক পাঁঠা, পাশে বাঁশে টাঙানো কাটা পাঁঠার মাংস ও
দাঁড়িপাল্লা নিয়ে সেই দোকান৷
আমার আকর্ষণ ছিল পাঁঠা কাটা দেখা৷ নানান রকম ভাবে পাঁঠার মুণ্ডু কাটা হত৷ একটা লোক
কাটত, আরেকটা লোক পাঁঠাটাকে চেপে ধরে থাকত৷ এক দিন চেপে ধরার লোকটি
অনুপস্থিত ছিল৷ কাজেই মাংসঅলা একাই পাঁঠা কাটার কায়দা ভেবে ফেলল৷ পাঁঠাটির
পেছনের দুই পা বেঁধে টাঙিয়ে দিল বাঁশে৷ তারপর হেঁট-মুণ্ড পাঁঠার মুণ্ডচ্ছেদ
তেমন শক্ত কাজ নয়৷
প্রায়ই গ্রামের লোক বাড়িতে পোষা পাঁঠা মাংসওয়ালার কাছে বিক্রির জন্য দিয়ে যেত৷
এক দিনের কথা মনে আছে৷ একটি অল্পবয়সী ছেলে বাড়ির ছেলেমানুষ পাঁঠাটির
গলায় দড়ি বেঁধে মাংসওয়ালার কাছে এনে হাজির করল৷ টাকাপয়সার লেনদেন
হয়ে যেতেই ছেলেটি পা চালিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল - যেন
বাড়ির পোষা পাঁঠাটিকে মাংস হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া দেখতে না
হয়৷ ছেলেটি একবার ফিরে তাকিয়েছিল৷ তাকিয়ে দেখে, পাঁঠাটি এক
দৃষ্টিতে অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছে৷ সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না তার খেলার সাথী
ছেলেটি কেন তাকে ফেলে চলে গেল৷ এমন তো আর কোনও দিন ঘটে নি৷
ছেলেমানুষ পাঁঠাটিকে বেশিক্ষণ সংশয়ে থাকতে হয়নি৷ মাংসওয়ালার সঙ্গী কয়েক
মিনিটের মধ্যেই পাঁঠাটিকে চেপে ধরল৷ ব্যাপারটা কি হচ্ছে, বুঝতে না বুঝতেই তার
মুণ্ডু কাটা গেল৷
আর কোনও দিন পাঁঠা কাটা দেখতে ইচ্ছে করেনি৷
আর কোনও দিন পাঁঠা কাটা দেখতে ইচ্ছে করেনি৷
সে দিন বাজারে মুরগী কিনতে গিয়েছিলাম৷ সাধারণত আস্ত মুরগী ওজন করিয়ে কেটেকুটে
দিতে বলি৷ তাকিয়ে দেখি না৷ সে দিন কি মনে হল, তাকিয়ে দেখলাম পুরো
প্রক্রিয়াটা৷ মুরগী তো চট করে একার চেষ্টাতেই কাটা যায়৷ কিন্তু মাথাটা
কেটে দেওয়ার পর মুরগীর ধড় যে কয়েক মিনিট ধরে ঝটপট করে, ওটাই বড্ড অস্বস্তিকর
দৃশ্য৷ মুরগীঅলা ধড়টা চেপে ধরে রাখল৷ নইলে নাকি মুণ্ডহীন মুরগীর
কাঠা ধড় এ দিক সে দিক ছুটে বেড়াবে প্রায় একটা ভৌতিক দৃশ্যের অবতারণা
করে৷ তা ছাড়া চারি দিকে রক্ত-টক্ত ছিটিয়ে সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড হবে৷
বিকেলে একটু হাঁটতে বেরোই৷ অফিস থেকে কাছের গলি দিয়ে হেঁটে পার্ক স্ট্রিটে
পৌঁছনো যায়৷ গলিতে কাটা গরু ঝোলে৷ সে দিন দেখলাম, ঝুলন্ত গরুর পাশে বসে
একটি লোক গরুর গায়ের চরবিতে যত্ন করে হাত বোলাচ্ছে৷ ঠিক জানি না, ওই চর্বি
দিয়ে কেমন বড়া ভাজা হবে, সে কথা ভেবে লোকটি অমন মমতায় ঝুলন্ত চর্বিতে
হাত বোলানো কি না৷
ও পাড়ায় নতুন নতুন রাস্তা চেনার চেষ্টায় ওই গলি থেকে আরেক গলিতে ঢুকলাম৷
সেখানেও কাটা গরু ঝুলছে৷ নতুন অভিজ্ঞতা হল, সরু গলিতে মাংসের দোকানের
একেবারে উল্টো দিকে বেশ ফুল ও আলো দিয়ে সাজানো শিব মন্দির৷ মাইকে ভক্তিগীতি
বেজে চলেছে৷ হিন্দু-মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান৷ বাঃ!
এই সব দেখে-টেখে আজকাল মাংস খেতে আর ভাল লাগে না৷ মনে হয়, মানুষ বড় নৃশংস
প্রকৃতির৷ জিভের সুখের টানে অনায়াসে কত প্রাণীহত্যা করে মানুষ৷ গরু-বাছুর-শুয়োর-হরিণ-মুরগী-কে
মানুষ বোধহয় প্রাণী হিসেবে দেখে না৷ নেহাত্ ‘মাংস’ হিসেবেই
দেখে৷ কেমন করে শূয়োর বধ করা হয়, জানেন তো? প্রাণীহত্যার বীভত্সতা অনেকেরই খারাপ লাগে৷ তাই মল-এ
গিয়ে প্যাক-করা মাংস কিনলে প্রাণীটির কথা মন থেকে সরিয়ে রাখা যায়৷ তবে
স্বাস্থ্যের বিবেচনায় ‘রেড মিট’ খাওয়ার রেওয়াজ কমেছে বলে মানুষের হাতে ইদানীং মুরগী সম্প্রদায়
বেশি বিপন্ন৷
এই আমিই তো ছেলেবেলায় পাঁঠা কাটা দেখেছি মন দিয়ে৷ যেন অ্যাকাডেমিক চোখ নিয়ে৷
গলায় কোপ পড়বার আগে পাঁঠাটি ক’বার ‘ব্যা’ ডাকল, তা-ও গুণতাম৷ এখন সে মন আর
নেই৷ এখন মাংসের দোকানের সামনে দিয়ে গেলে নজরে পড়ে কাটা পাঁঠার মুণ্ডু সার
সার রাখা আছে বোধহয় খদ্দেরকে নিশ্চিন্ত করতে, যা ঝুলছে, তা কুকুর-টুকুর নয়, পাঁঠাই৷ কাটা মণ্ডিুর প্রতিটিরই চোখ কিন্তু পুরো খোলা৷
এর ব্যাখ্যা
ভেবে পাইনি৷ পাঁঠাদের কি তবে চোখের পাতা নেই? না কি ওরা মৃত্যুর মুহূর্ত
পর্যন্ত বোঝবার চেষ্টা করে, কি ঘটছে৷ পাঁঠারা মৃত্যু ভয়েও চোখ বোজেনা, এ ভারি
আশ্চর্য কিন্তু৷
ছোটরা নাকি নিষ্ঠুর হয়৷ পরিণত বয়সে পৌঁছে আমি হয়তো ‘মানবিক’ হয়েছি৷ যদিও ঠিক জানি না, মানবিকতার সংজ্ঞাটা ঠিক কি৷
ছোটরা নাকি নিষ্ঠুর হয়৷ পরিণত বয়সে পৌঁছে আমি হয়তো ‘মানবিক’ হয়েছি৷ যদিও ঠিক জানি না, মানবিকতার সংজ্ঞাটা ঠিক কি৷
কৃতজ্ঞতা : এই সময়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন