বুধবার, অক্টোবর ২৩, ২০১৩

আপন হতেও আপনজন


                          
               গল্পটি লিখেছেন : অরবিন্দ দত্ত    
অনিন্দ্য আর সুনন্দা হাত ধরাধরি করে কালিঝোড়ায় তিস্তার পাড়ে পাথরটার উপর এসে বসল। সুনন্দা কিছু ছোট ছোট পাথর  হাতে নিয়ে তিস্তার জলে ছুঁড়ছিল আর গান গাইছিল –“ভালোবেসে সখি নিভৃত যতনে আমার নামটি...”। আর অনিন্দ্য পাশে বসে সুনন্দার গান  শুনছিল। সুনন্দা নিয়মিত গান চর্চা করে। গানটা শেষ হতেই অনিন্দ্য বলল – জানতো সু, সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বিরহে, রবীন্দ্রনাথ অপরিহার্য। সুনন্দা বলল – ঠিক তাই। আর উনি যদি না জন্মাতেন, তাহলে আমাদের মতো প্রেমী-যুগলদের কি হত বলতো। সুনন্দার কথায় অনিন্দ্য হেসে বলল - কেন হাতে তো জীবনানন্দ দাস মহাশয় ছিলেনই। সেই যে, “চুল তার কবেকার, বিদিশার নিশা...”।  সুনন্দা বলল – “নাটোরের বনলতা সেন”। 
 অনিন্দ্য আর সুনন্দা,  এদের একের অপরের প্রতি ভালবাসাটা এতোটাই গভীর ছিলো যে, কোন ঘাত-প্রতিঘাত ওদের ভালবাসায় এতটুকু চির ধরাতে পারেনি। কলেজে  পড়ার সময় থেকে ওদের পরিচয়। কলেজের পাঠ চুকতেই  অনিন্দ্য একটা নামী কোম্পানিতে চাকুরী পেয়ে গিয়েছিল। তাই সে আর য়ুনিভারসিটির দিকে পা  বাড়ায় নি। সুনন্দা  কিন্তু ইংলিশে অনার্স নিয়ে য়ুনিভারসিটিতে ভর্তি হয়েছিল। দু’জনের রাস্তা আলাদা হয়ে গেলেও ওদের মধ্যে যোগাযোগটা ছিল। অনিন্দ্য ছুটির দিনে সুনন্দাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে নিয়ে সেভোকের বাঘপুল নয়তো  ওদের প্রিয়  জায়গা - কালীঝোড়ায় চলে যেত।  সেই কলেজ জীবন থেকে ওরা একে অপরকে ‘সু’ আর ‘অনি’ বলে সম্বোধন করে আসছে।

সেদিন, য়ুনিভারসিটির কনভোকেশন হল থেকে বেড়িয়ে সুনন্দা সোজা  গেটের কাছে এসে দাঁড়াল। মিনিট দশেকের মধ্যে অনিন্দ্য বাইক নিয়ে ওর কাছে দাঁড়াতেই সুনন্দা বাইকের পেছনে উঠে বসল। অনিন্দ্য বাইক চালাতে শুরু করা মাত্র সুনন্দা বলল - একি কোন দিকে যাচ্ছি আমরা অনি?   
অনিন্দ্য বলল কেন, আমরা ঘুরতে যাচ্ছি কালিঝোড়ায়।
এখন কালিঝোড়ায়! বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে যাবে যে। একটু চেঁচিয়ে সুনন্দা বলল।    
দেরী হবে না ম্যাডাম, সময়মত বাড়ী পৌঁছে দেব। যতটা চেঁচিয়ে সুনন্দা বলছিল, ঠিক ততটা চেঁচিয়ে অনিন্দ্য উত্তর দিল।

অনিন্দ্য আর সুনন্দা কালিঝোড়ায় এসে উপস্তিত হল। এই জায়গাটা ওদের কাছে খুব প্রিয়। মাঝেমধ্যেই ওরা এই কালিঝোড়ায় এসে কিছুটা সময় কাটিয়ে যায়। প্রথম যেদিন অনিন্দ সুনন্দাকে নিয়ে কালিঝোড়ায় এসেছিল, সেদিন তিস্তার পাড়ে পাথরের  উপরে বসে সুনন্দা বলেছিল অনি, কালিঝোড়ার  নামটা আমি শুনেছি। কিন্তু এর যে এতো সুন্দর রূপ, এখানে না এলে আমি জানতাম না। তোমাকে ধন্যবাদ। আমরা কিন্তু মাঝেমাঝেই এখানে  আসবো। সেদিন অনিন্দ্য, সুনন্দার যে শিশুসুলভ উচ্ছাস ওর চোখে দেখেছিল, তা আজও অনিন্দ্যর মনে আছে। তাই অনিন্দ্য ঠিকিই করে রেখেছিল, সুনন্দা যেদিন মাস্টার ডিক্রিটা হাতে পাবে, সেদিন ওকে নিয়ে কালিঝোড়ায় আসবে।  
অনিন্দ্য বাইকটা রাস্তার পাশে লক করে রেখে সুনন্দার একটা হাত ধরে পাশের ঢালু রাস্তা দিয়ে নেমে সোজা তিস্তার পাড়ে আসতেই সুনন্দা দৌড়ে গিয়ে সেই  পাথরটার উপর বসে পড়ল। সামনে খরস্রতা তিস্তা নদী পাথরের সমস্ত বাধা টোপকে বিশাল গর্জনে স্বমহিমায় এগিয়ে চলছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন, তিস্তার সমস্ত রাগ গিয়ে আছড়ে পরছে পাথরগুলোর ওপর। তবে, কালিঝড়ার  প্রাকৃতিক  সৌন্দর্যটা আজ অনেকটাই কমে গিয়েছে। তার কারন হল, এখানে একটা নতুন এন.এইচ.পি.সির জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে উঠছে। সেই কারনে তিস্তার অভিমুখকে ঘুড়িয়ে দিতে হয়েছে। আর এই প্রকল্প এই জায়গার নির্জনতাটাকে পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে। আধুনিকতার মাশুল গুনতে হচ্ছে প্রকৃতিকে।
কিছুক্ষণ হাত ধরাধরি করে চুপচাপ বসে থাকার পর, নীরবতা ভেঙে সুনন্দা বলল - জান অনি, এখানে যতবার আসি প্রত্যেকবারই এই জায়গাটাকে  আমার নতুন বলে মনে হয়। 
অনিন্দ্য বলে,  আমারও সেটাই মনে হয়।   
আর কি মনে হয় জান অনি? এই যে পাথরটা, এখানে এলে যেটার উপর আমারা বসি, সেটা প্রকৃতি শুধুমাত্র আমাদের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।
অনিন্দ্য বলে,  শুধু আমাদের জন্য কি করে বলছ? এখানে আমাদের মতো আরও কেউ তো এসে বসতে পারে।
সুনন্দা  দৃঢ়তার সাথে বলল – না, মশাই। এটা  শুধু আমাদের জন্যই তৈরী হয়েছে।  যতদিন আমরা এই পৃথিবীতে থাকবো ততদিন এটা আমাদের। শুধু আমাদের
অনিন্দ্য বলল -  ঠিকই বলেছ সু। আমারও তাই মনে হয়।  
মনে হয়? এইবলে সুনন্দা কটমট করে অনিন্দ্য দিকে  তাকাল। তারপর  দু’জনেই একসাথে হেঁসে উঠল
হাঁসি থামতেই অনিন্দ্য বলল, সু তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।
কি কথা? সুনন্দা বলল।
দেখ, তোমার  পড়াশোনাটা তো শেষ হয়েছে। তাই না।
সুনন্দা মুখ দিয়ে ছোট্ট একটা শব্দ করল, হুম।
তাই বলছিলাম যে, এবার আমাদের বিয়েটা করে ফেললে হয় না।  কোনমতে আমতা আমতা করে অনিন্দ্য কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।     
ওর এই কথা বলার ধরন দেখে সুনন্দা হেসে উঠে বলল - কেন, এতো তাড়া কিসের? আগে আমি একটা চাকুরী জোগাড় করি তারপর বিয়ের কথা ভাববো।      
তুমি চাকুরি করবে সু? আবাক চোখে সুনন্দার দিকে তাকিয়ে অনিন্দ্য প্রশ্ন করল।   
কেন? তোমার আপত্তি আছে নাকি? পাল্টা প্রশ্ন করলো সুনন্দা।   
না, মানে আমিতো চাকুরী করছি। যদিও প্রাইভেট কোম্পানির চাকুরী, তবুও যা বেতন পাই  তাতে আমাদের চলে যাবে। অনিন্দ্যর কথাটা শেষ না হতেই সুনন্দা বলে উঠল, তার মানে তুমি চাওনা যে তোমার স্ত্রী চাকুরী করুক। তাই না? বলেই সুনন্দা অনিন্দ্যর দিক থেকে মুখটা অন্য দিকে ঘুড়িয়ে হাসতে লাগল। মুখটা না ঘুড়িয়ে সুনন্দা আবার বলল, তুমি কিন্তু স্ত্রীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছো। বলেই অনিন্দ্যর রি-একশনটা একবার দেখার জন্য সুনন্দা ওর মুখের দিকে তাকাল।
একদিন কথায়-কথায় সুনন্দা অনিন্দ্যকে জিজ্ঞেস করেছিল, অনি তোমার স্ত্রী চাকুরী করুক সেটা কি তুমি চাও না ? উত্তরে অনিন্দ্য বলেছিল, আমি যা ইনকাম করি তাতে আশাকরি সংসারটা ভালভাবেই চালাতে পারবো।  তবে আমার স্ত্রী যদি চাকুরি করতে চায়, তা সে করতে পারে। তাতে আমি বাধা দেব না। আমি  মনে করি প্রত্যেক স্ত্রীর ব্যাক্তি স্বাধীনতা আছে। আর তাতে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।  
তা সত্ত্বেও সুনন্দা একটু মজা করবে বলে, অনির উত্তরের আশায় ওর দিকে তাকিয়ে থাকল।
এটা যে সুনন্দা নিছক মজা করার জন্য বলেছে, তা অনিন্দ্য বেশ বুঝতে পারে। তাই কিছু না বলে অনিন্দ্যও সুনন্দার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বলে -   ইয়ার্কি হচ্ছে। কথাটা শুনে সুনন্দা হো হো করে হেসে উঠল।     
হঠাৎ সুনন্দা তার হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল - এ্যাই অনি, অনেকক্ষণ হল, এবার বাড়ী যেতে হবে।
অনিন্দ্য বলল। আর  কিছুক্ষণ বসো না সু।  
না আর বসা যাবে না। এবার ওঠো অনি। বলে একপ্রকার অনিন্দ্যর হাতধরে টেনে উঠিয়ে দিল সুনন্দা।
কিচ্ছুক্ষণ পর ওরা বাইকের কাছে এল। বাইক স্টার্ট দিতে দিতে অনিন্দ্য বলল, কিন্তু আমাদের বিয়েটা ?
ওটা অন্য দিন ভাবা যাবে। এখন চল।  দেরী হয়ে যাচ্ছে, বলে সুনন্দা বাইকে উঠে বসল। বাইক ছুটল শিলিগুড়ির দিকে।  
সূর্য ততক্ষণে পাহাড়ের কোলে আশ্রয় নিয়েছে। দিনের আলো ক্রমশঃ কমতে শুরু করেছে।

(২)

ইতিমধ্যে বেশ কয়েক মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু যতবার অনিন্দ্য, সুনন্দাকে বিয়ের ব্যাপারে বলতে  গেছে, ততবারই সুনন্দার  ওই এক কথা - একটা চাকুরী যোগাড় করি তারপর বিয়ে। এই বলে সে এড়িয়ে  গেছে। এমনকি  অনিন্দ্য এও বলেছে যে, বিয়ে পরেও তো তুমি চাকুরী যোগাড় করতে পারবে।   এমনতো নয় যে, আমি তোমার চাকুরী করার বিরুদ্ধে। কিন্তু সুনন্দা, অনিন্দ্যর সব কথাকে হেসে এড়িয়ে গেছে। অনিন্দ্য জানে সুনন্দা জেদি মেয়ে। যেটা একবার বলবে, সেটাই ও করবে। ও যখন বলেছে, চাকুরী পাবার পর বিয়ে করবে, তখন সু তাই করবে। তাই বিয়ের ব্যাপারে অনিন্দ্য সুনন্দাকে পরে আর কিছু বলেনি।    
অনিন্দ্য এখন কলকাতায়। কোম্পানির একটা সেমিনার এ্যাটেন্ড করতে এসেছে। সেমিনারের আজ শেষ দিন। আগামীকাল সে শিলিগুড়ি ফিরবে। যদিও তার ফেরার কথা আগামী পরশু। কিন্তু সেমিনার চলাকালীন হঠাৎ কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর অসুস্থ হয়ে পরায়, একদিন আগেই সেমিনার শেষ হচ্ছে। আর সেটা জানানোর জন্যই সেমিনার শেষে হল থেকে বেড়িয়ে অনিন্দ্য তার সেল ফোনটা অন করে সুনন্দাকে ফোন করে। কিন্তু যতবার ফোন করার চেষ্টা করে ততবারই ওপাশ থেকে “সুইচ অফ” শুনতে পায়।
অনিন্দ্য কিছুটা চিন্তায় পড়ে। সুনন্দা কখনো তার সেল ফোন অফ করে না। আবার ভাবে হয়তো চার্জ দিতে ভুলে গেছে। সে চিন্তিত মনে হোটেলে ফিরে আসে।  
রাত ন’টা নাগাদ অনিন্দ্যর সেল ফোন বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি সে ফোনটা হাতে তুলে দেখে, স্কিনে “সু কলিং” ভেসে উঠেছে। ফোনটা অন করতেই ওপাশ থেকে সুনন্দার উত্তেজিত গলা ভেসে এল - অনি, তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।    
আমি আগামীকালই ফিরছি। আজ সারাদিন তোমার সেল ফোনের সুইচ...কথাটা অনিন্দ্যকে শেষ করতে না দিয়েই সুনন্দা বলল - আমি ফোন রাখছি।  বলেই ফোনের লাইন ডিসকানেক্ট করে দিল।  
তারপর অনিন্দ্য যতবার সুনন্দাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করে, ততবারই সে ওপাশ থেকে “সুইচ অফ” শুনতে পায়। একপ্রকার হাল ছেড়ে দিয়ে অনিন্দ্য ভাবতে থাকে, মাত্র চার দিন হল সে শিলিগুড়ির বাইরেএরমধ্যে কি এমন ঘটলো যে, সু এভাবে কথা বলছে। এই প্রথম  সুনন্দার এই ধরনের ব্যবহারের সাথে সে পরিচিত হল। এর আগে তাকে এরকম উত্তেজিত  হতে অনিন্দ্য দেখেনি।      
পরেরদিন সকাল  ৮.১৫ মিনিটে  দার্জিলিং মেলে এন.জে.পি. তে নেমে একটা অটো নিয়ে বাড়িতে এসেই অনিন্দ্য সুনন্দাকে ফোন করল। ফোনের সুইচ অফ। স্নান সেড়ে নিজেই এক কাপ চা করে  খেয়ে সকাল সাড়ে ন’টার মধ্যে সে আফিসে পৌঁছে যায়।   
বাড়িটা অনিন্দ্যর পৈত্রিক সম্পত্তি।  গত বছর জানুয়ারি মাসে মা মারা যাবার পর  অনিন্দ্য একাই এই বাড়িতে থাকে। বাবা অনেকদিন আগেই  গত হয়েছেন। এক বোন।  মা  বেঁচে  থাকতে তারও বিয়ে দিয়ে গেছেন। সেই বোন এখন কোচবিহারে থাকে। বেশিরভাগ সময় অনিন্দ্য নিজেই রান্না করে খায়। কোন কোন দিন রান্না করতে ইচ্ছে না করলে, হোটেলেই খেয়ে নেয়।    
আফিসে পৌঁছানোর মিনিট কুড়ির মধ্যে অনিন্দ্য সুনন্দার ফোন পেল। ফোন পাওয়া মাত্র সুনন্দাকে বলল, আমি এখনি তোমার সাথে  দেখা করতে চাই।
এখন নয়। আমি ঠিক দুটোর সময় তোমার আফিসের সামনে ওয়েট করবো। বলে সুনন্দা ফোনটা কেটে দিল।
অনিন্দ্যর মনটা আশান্ত হয়ে উঠল। যতক্ষণ সে সুনন্দার সাথে দেখা করে সব কথা জানতে না পারছে, ততক্ষণ ওর এই ছটফটানিটা কমবেনা। কাজকর্ম সব মাথায় উঠেছে। নিজের চেম্বারের এ মাথা থেকে ও মাথা সমানে পায়চারি করছে। আর ঘন ঘন হাতঘড়ি দেখছে কখন দুটো বাজবে। 
ঠিক দুটো বাজতে পাঁচ মিনিট আগে অনিন্দ্য আফিস থেকে বেড়িয়ে উল্টো দিকের ফুটপাথে আসতেই সে সুনন্দাকে দেখতে পেল। সুনন্দা একই ফুটপাথ ধরে ওর আফিসের দিকে আসছে। প্রায় দৌড়ে সুনন্দার কাছে পৌছাল অনিন্দ্য।   
কি ব্যাপার সু? কি হয়েছে? ব্যাকুল হয়ে অনিন্দ্য সুনন্দাকে জিজ্ঞেস করল।
সুনন্দা শুধু বলল, এখানে বলা যাবে না। অনিন্দ্য দেখল, সুনন্দার মুখটা বেশ গম্ভীর। সে বলল, তাহলে এই রোদ্দুরে কোথায় যাবে? সামনের মোড়টাতে একজনের আসার কথা আছে। ওখানে কিছুক্ষণ ওয়েট করতে হবে। বলেই সুনন্দা এগোতে শুরু করলো। অনিন্দ্য উপায় না দেখে ওর পথ অনুসরণ করল।
কার আসার কথা আছে সু? অনিন্দ্যর প্রশ্নের উত্তরে সুনন্দা গম্ভীর স্বরে বলল, এলেই দেখতে পাবে। আজকের সুনন্দার সাথে বিগোত দিনের সুনন্দাকে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না অনিন্দ্য।
অনিন্দ্য ভাবছিল, কি এমন ঘটলো যে, সু ওর সাথে এতো গম্ভীর হয়ে কথা বলছে। যা আগে কখন করে নি। যাইহোক অনিন্দ্য বুঝতে পারল যে, এখন আর সুনন্দাকে কনো প্রশ্ন করে লাভ নেই। সঠিকভাবে কোন প্রশ্নেরই উত্তর সে দেবে না। তার উপর এখনে কার আসার কথা আছে সেটাও বলল না। এদিকে মিনিট দশেক হয়ে গেল, যার আশায় ওরা দাড়িয়ে আছে, তারও দেখা নেই।  অনিন্দ্য ভেতরে ভেতরে অধৈর্য হয়ে উঠল।  
হ্যালো সুনন্দা, দেরী হওয়ার জন্য দুঃখিত। কথাটা কানে যেতেই অনিন্দ্য মুখ ঘুরিয়ে দেখে, এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক সুনন্দার সামনে  দাঁড়িয়ে আছে। না, খুব একটা দেরী হয় নি। মাত্র দশ-বার মিনিট। বলেই সুনন্দা হেসে উঠলো। অনিন্দ্য মনে মনে ভাবল যাক, সুনন্দা হেসেছে।  সেই কলকাতায় যাওয়ার দিন বিকেলে সুনন্দা অনিন্দ্যর বাড়িতে এসেছিল। খুব প্রয়োজন না হলে সাধারণতঃ সুনন্দা অনিন্দ্যর বাড়িতে যায় না।  আজ কয়েকদিনের জন্য অনিন্দ্য কলকাতায় যাচ্ছে, তাই দেখা করতে এসেছিল। কোম্পানির গাড়ি এসেছিল অনিন্দ্যকে এন.জে.পি. স্টেশানে পৌঁছে দিতে। একপ্রকার সুনন্দার জেদাজেদিতে অনিন্দ্য ওকে স্টেশানে নিয়ে  গিয়েছিল।
ট্রেনের নির্দিষ্ট  কোচের সামনে এসে ওড়া দাঁড়াল। অনিন্দ্য লক্ষ করছিল, গাড়িতে ওঠার পর  থেকে স্টেশানে আসা পর্যন্ত সুনন্দা একটিও কথা বলেনি। গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।  অনিন্দ্যরও ইচ্ছে করছিলনা সুনান্দাকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু উপায় নেই, তাই যেতে হচ্ছে। অনিন্দ বলল - সু আমাকে এবার ট্রেনে উঠতে হবে। ড্রাইভারকে বলা আছে। সে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। সুনন্দা কোন কথা না বলে মুখ নীচু  করে দাঁড়িয়ে থাকে।
অনিন্দ্য বলল - কী হল সু, কোন কথা বলবে না?  সুনন্দার চোখে জল
অনিন্দ্য বলল, তুমি কাঁদছ সু?
সুনন্দা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। সে অনিন্দ্যকে জড়িয়ে ধরে  কাঁদতে থাকে। সুনন্দার চোখের জলে অনিন্দ্যর শার্টের ওপরের কিছুটা  অংশ ভিজে গেল।
সুনন্দা কাঁদতে কাঁদতেই বলল -  অনি তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন। আমার যে তোমাকে অনেক কথা বলার আছে।
সুনন্দার  কান্না দেখে অনিন্দ্য নিজেও খানিকটা বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। সে বুঝতে পারছিল না, এই মুহূর্তে তার ঠিক কি করা উচিত। আসলে এই ধরনের সিচুয়েশনের জন্য অনিন্দ্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না।  তাই এই আবেগ ঘন মুহূর্তটাকে সহজ করার জন্য অনিন্দ্য বলল - ঠিক আছে আমি যাওয়া ক্যান্সেল করছি। বস কে বলে দেব হঠাৎ একটা কঠিন অসুখ হওয়াতে আমি যেতে পারিনি। কথাটা শোনামাত্র সুনন্দা অনিন্দ্যর মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল, প্লীজ, একথা বলো না। আমার ভীষণ ভয় করে। তুমি যাও। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। তারপর চোখ মুছে হেসে বলল, সাবধানে যেওসে দিন অনিন্দ্য সুনন্দাকে হাসতে দেখেছে, আর আজ এতক্ষনে ওর মুখে হাসি দেখল।                    
অনি, ইনি রজত দাসগুপ্ত।  আর রজতদা, এ হচ্ছে অনি মানে অনিন্দ্য সরকার। সুনন্দা  অনিন্দ্যর সাথে রজত দাসগুপ্তের পরিচয় করিয়ে দিল। অনিন্দ্য ভাবছিল, সু নিশ্চয়ই রজতবাবুকে অনেকদিন থেকে চেনে এবং সু ওনার বিশেষ পরিচিতা। তা না’হলে ওনাকে রজতদা বলে সম্বধন করত না। কিন্তু সু তো এই রজতবাবুর কথা তাকে কোনদিন বলেনি।  
চলুন অনিন্দ্য বাবু, সামনের একটা ভাল রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে গিয়ে বসি তারপর কথা হবে। রজতের কথাতে অনিন্দ্যর ভাবনা সূত্রটা  কেটে গেল। সে বলল - হ্যাঁ চলুন।
কিছুটা  হেঁটে ওরা সামনে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকল। একটা চার সিটের টেবিল বেছে নিয়ে সুনন্দা আর  অনিন্দ্য পাশাপাশি বসল এবং রজত ওদের বিপরীত দিকে একটা চেয়ারে বসলেন। রজতবাবু বসেই বললেন, সুনন্দা তোমারা খবারের অর্ডার দাও। আমি  একটু আসছি, বলে চলে গেলেন। ওয়েটার এসে দাঁড়াতেই সুনন্দা তিনটে অমলেট, টোস্ট আর কফির অর্ডার দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দ্য বলল তিনটে নয়, দুটো। আমার জন্য শুধু এক কাপ চা।   
সুনন্দা বলল – কেন? তোমারতো কিছু খাওয়া হয়নি, অনি। কলকাতা থেকে বাড়ী আর বাড়ী থেকে সোজা আফিস। ক্ষীদে তো নিশ্চই পেয়েছে। সুনন্দা জোড়করে অনিন্দ্যর জন্যও অর্ডার দিল। অনিন্দ্য শুধু একবার ঘাড় ঘুরিয়ে সুনন্দাকে দেখল। সুনন্দার ব্যবহারে  এমনিতেই  তার মন বিগড়ে ছিল। তাই সুনন্দার সাথে  কোন কথা না বলে চুপ করে ছিল। ইতিমধ্যে রজতও চলে এলেন। তিনি চেয়ারে বসেই বললেন, খাবারের অর্ডার দিয়েছো সুনন্দা? হ্যাঁ, দিয়েছি। সুনন্দা বলল।      
অনিন্দ্য বাবু, আমি কি সুনন্দার পাশে বসতে পারি? অনিন্দ্যকে উদ্দেশ্যকরে রজত বললেন।  কথাটা শুনে অনিন্দ্য চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, অবশ্যই। বলে উঠে দাঁড়াল। তারপর দুজনে জায়গা পরিবর্তন করে বসল। এবার সুনন্দা আর অনিন্দ্য মুখোমুখি বসল।   ইতিমধ্যে ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেল। সুনন্দা আর রজত যার যার প্লেট টেনে  নিল। অনিন্দ্য শুধু চায়ের কাপটা টেনে নিল। তাতে সুগারপট থেকে প্রয়োজনমতো চিনি নিয়ে  চামচে দিয়ে ধীরে ধীরে নাড়তে লাগল। সুনন্দা মাঝে মাঝে অনিন্দ্যকে আড়চোখে দেখছিল।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। একসময় রজত বললেন - দেখুন অনিন্দ্যবাবু, সুনন্দা শুধু আমার নামের সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ওর সাথে, মানে সুনন্দার সাথে আমার একটা সম্পর্ক আছে। সেটা ও আপনাকে বলেনি। আর সেটা নিয়েই আপনি এই মুহূর্তে বেশী চিন্তিত।  অবশ্য চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই না।   
না রজতবাবু, এটা আপনার সম্পূর্ণ ভুল ধারনা। সু, আইমিন সুনন্দা কে আমি যতটুকু চিনেছি, তাতে ও অন্য কারোর সাথে এমন কোন সম্পর্কে জড়াবে না, যেটা আমার কাছে চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়াবে। ওর উপর আমার এইটুকু বিশ্বাস আছে। কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে  অনিন্দ্য থামল।  তারপর বলল - আমি চিন্তত ঠিকিই, তবে তার কারনটা সম্পূর্ণ আলাদা। আর  আমার এই চিন্তাটা একমাত্র সুনন্দাই দূর করতে পারে, বলে অনিন্দ্য সুনন্দার দিকে তাকাল।  দেখল সুনন্দাও ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সুনন্দাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পাশ থেকে রজতবাবু বলে উঠলেন -  শুনুন অনিন্দ্যবাবু, সুনন্দা আমার  একমাত্র বোন। কোন তুত নয়, একেবারে আপন বোন। এইটুকু এখন জানুন। বাকিটা আমার ফ্ল্যাটে গিয়ে জানবেন।
অনিন্দ্য  সুনন্দার মুখেই শুনেছিল, ওরা এক ভাই বোন। কিন্তু সুনন্দা যে এভাবে ওর  দাদার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে, সেটা অনিন্দ্য ভাবতে পারেনি। 
অনিন্দ্য বলল -  তার মানে?
রজত বললেন, তার মানে আপনি ও সুনন্দা এখন আমার সাথে আমার ফ্ল্যাটে যাবেন। আপনাকে যে অনেক কথা বলার আছে। রজত ওয়েটারকে ডেকে বিল আনতে বলল। ওয়েটার বিল আনলে, অনিন্দ্য পার্স থেকে টাকা বের করে দিতে যাচ্ছিল। তাকে বাধা দিয়ে রজতবাবু বললেন, আজ নয়। অন্যদিন দেবেন। আজ আপনি  আমার গেস্ট।  বিল মিটিয়ে দিয়ে রজত বললেন, চলুন যাওয়া যাক। ওরা তিনজনেই রেস্ট্রুরেন্ট থেকে বেরিয়ে সামনের ফুটপাথে এসে দাঁড়াল।  
অনিন্দ্য বলল, রজতবাবু আপনারা যান আমার যেতে কিছুটা দেরী হবে। আফিসের কিছু জরুরী কাজ আছে।
রজত বললেন, ঠিক আছে, এই নিন আমার কার্ড। এতে আমার ফ্ল্যাটের ঠিকানা ও কন্ট্রাক্ট নাম্বার আছে। অসুবিধে হলে আমাকে একটা রিং করবেন। অনিন্দ্য, রজতের  হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সুনন্দার সাথে কোনরকম কথা না বলেই আফিসের দিকে পা বাড়াল। সুনন্দা বুঝল, অনির রাগ এখন কমেনি। সুনন্দা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে অনিন্দ্যর একটা  হাত ধরল। অনিন্দ্য দাড়িয়ে গেল। সুনন্দা বলল - অনি, প্লীজ এসো কিন্তু।  আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।    
অনিন্দ্য বলল - ভেবনা সু, আমি অবশ্যই যাব। আমারতো অনেক কিছু জানার আছে। তুমি যাও। তোমার দাদা ওয়েট করছেন। বলে অনিন্দ্য নিজের হাতটা আলতো করে ছাড়িয়ে নিয়ে আফিসের দিকে হাঁটতে শুরু করল। সুনন্দা কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে অনিন্দ্যর  চলে যাওয়াটা দেখল।    

(৩)

মিনিট দশেক হল অনিন্দ্য রজতবাবুর ফ্ল্যাটে এসে উপস্থিত হয়েছে। ইতিমধ্যে রজত তাঁর স্ত্রী মাধবীর  সাথে অনিন্দ্যর পরিচয় করিয়ে  দিয়েছেন।  এই মুহূর্তে ড্রয়িং রুমে রজত, অনিন্দ্য, সুনন্দা আর মাধবী  এই চার জন বসে আছে । কিছুক্ষণ আগে চায়ের পর্ব মিটে গেছে। ড্রয়িং রুমের নীরবতা ভেঙে রজত বলতে শুরু করলেন – অনিন্দ্যবাবু, আপনার কলকাতায় যাবার পর থেকে আমার ফ্ল্যাটে আসা পর্যন্ত আপনার সাথে সুনন্দা যা যা করেছে তার একটা বিশেষ কারন আছে।  হয়তো কারণটা আপনার কাছে গৌণ মনে হতে পারে।  
মাঝখানে অনিন্দ্য বাধাদিয়ে  বলে উঠল, প্লীজ রজতবাবু আমাকে আপনি নয়, তুমি বলবেন। আর আনিন্দ্যবাবু নয়, শুধু অনিন্দ্য বললে আমার ভাল লাগবে । বেশ, তবে তুমিও আমাকে রজতবাবু নয়, রজতদা বলবে। রিঙ্কি মানে সুনন্দা আমাকে শুধু দাদা বলে ডাকে। চাইলে তুমিও তাই ডাকতে পারো।  আমরা সুনন্দাকে ওর ডাকনাম রিঙ্কি বলেই ডাকি।                          
রজত বলতে থাকেন -  আপনাকে আমি আগেই বলেছি যে, রিঙ্কি মানে সুনন্দা আমার একমাত্র বোন। আমরা এক ভাই-বোন। বাবা, মা আছেন।যদিও আমি  তাদের সাথে এক বাড়ীতে থাকি না। আমি আলাদা থাকি। রিঙ্কি বাবা মায়ের সাথে এস.এফ. রোডের আমাদের নিজেস্বঃ বাড়িতে থাকে। আমাদের পরিবারটা একটা রক্ষণশীল পরিবার। আমাদের বাবা, শ্রী সুধিন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত তাঁর  বংশ-মর্যাদা এবং বংশ কৌলীন্য রক্ষা করার জন্য  সর্বক্ষণ সচেষ্ট থাকেন। এমনিতে তিনি খুব রাশভারী লোক।  আমরা ভাইবোনের কেউই বাবার মতের বিরুদ্ধে যাবার সাহস পাই না। এমনকি আমাদের মাও সচরাচর বাবার মতের বিরুদ্ধে যেতে চান না।  মা আবার একটু অন্য প্রকৃতির মানুষ। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চান। মাঝেমধ্যে মা, বাবার কিছু কিছু কাজের প্রতিবাদ করলেও তাতে খুব একটা কাজ হত না।  
আমরা, মানে আমি আর মাধবী ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। মাধবী লেখা-পড়া জানা এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। ছোটবেলাতে ও বাবা, মাকে হারিয়েছিল। দাদা-বোউদির সংসারে মানুষ। আমি জানতাম, বাবা কোনদিনই মাধবীকে ছেলের বউ হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন না। কারন, মাধবীর বংশ পরিচয়টা বাবার পক্ষে মেনে নেওয়াটা সম্ভব ছিল না। তাই আমরা কালীবাড়িতে বিয়ে করেছিলাম।  রিঙ্কিও আমাদের বিষয়টা জানতে পেরেছিল, যখন  আমাদের বিয়ের খবরটা মাকে ফোনে জানিয়েছিলাম।  মায়ের মন তো । খবরটা শুনে মা বলেছিলেন, বউকে নিয়ে বাড়িতে চলে আয়। মায়ের কথামত মাধবীকে নিয়ে আমি বাড়িতে বাবার সামনে উপস্থিত হতেই বাবা বললেন -  নিজের ইচ্ছেতে যখন বিয়েটা করেই ফেলেছ তখন আমার আশীর্বাদ পাবার যোগ্যতাটাও যে তুমি হারিয়ে ফেলেছ, সেটা নিশ্চয়ই আমাকে আর বলে দিতে হবে না।  মা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হাতের ইশারায় বাবা মাকে থামিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। বুঝলাম, এই বাড়ির পাট আমার চুকে গিয়েছে।  তারপর আমি আর মাধবী মাকে প্রণাম করে শেষবারের মত বাড়ি থকে  বেরিয়ে এসেছিলাম। এখন ছেলে বা দাদা হিসাবে দায়িত্বটা টেলিফোনের মাধ্যমে  খবরাখবর নিয়েই পালন করে চলেছি।
রজত কিছুক্ষণ থামলেন। অনিন্দ্য দেখল, মাধবী বৌদি মুখ নিচু করে বসে আছেন। কিন্তু সুনন্দা যে কখন ওর পাশ থেকে  উঠে  চলে গেছে, অনিন্দ্য তা বুঝতে পারে নি। সে ঘরের মধ্যে কোথাও সুনন্দাকে দেখতে পেল না।    
রজত মাধবীকে আরেক প্রস্থ চা দিতে বললেন। তারপর অনিন্দ্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন তুমিও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো যে,  বাবা তোমার আর রিঙ্কির সম্পর্কটাকে কিছুতেই মেনে নেবেন না। এর মধ্যে মাধবী চা নিয়ে এল। চা খেতে খেতে রজতের একটা ফোন এল। ফোন এ্যাটেন্ড করার পর  রজত বললেন, অনিন্দ্য আমাকে এখুনি একটু বেড়তে হবে।  একটা  জরুরী কাজ আছে। বাকি কথা তোমাকে মাধবী বলবে। আর হ্যাঁ, আমি না আসা আবধি তুমি কিন্তু যাবে না। এই বলে রজত চলে গেলেন।    
এখন শুধু ঘরে অনিন্দ্য আর মাধবী।  অনিন্দ্য এদিক ওদিক তাকিয়ে শুধু সুনন্দাকে খুজতে লাগল।  অনিন্দ্য দেখল, মাধবী চুপ করে বসে আছে।  অনিন্দ্য ডাকল, বৌদি। অনিন্দ্যর ডাকে মাধবী একটু চমকে উঠল। পরক্ষনেই মাধবী নিজেকে সামলে নিয়ে একটু  হেসে বলল - আমি কোথা থেকে শুরু করবো সেটাই এতক্ষণ ভাবছিলাম। যাইহোক, রিঙ্কি মানে সুনন্দা কিন্তু আমাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। তোমার  কথাটা রিঙ্কি  প্রথমে আমাকে বলেছিল। পরে আমি ওর দাদাকে বলি।
তারপর মাধবী যা বলল, তা হল –  রজত জানার পর একদিন বোনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন -  রিঙ্কি, তুই কি অনিন্দ্যকে বিয়ে  করতে চাস?    
 উত্তরে  রিঙ্কি  শুধু  বলল, হ্যাঁ।     
তাহলে তুই এটা জেনে রাখ, তোর পরিণতিটা কিন্তু আমার মতোই হবে। বিষয়টা অনিন্দ্যকে জানিয়েছিস?
সুনন্দা বলল -  এখন জানাইনি।  তবে  সময়-সুযোগ পেলে অবশ্যই জানাবো।
সুনন্দা সুযোগ খুঁজছিল, কীভাবে অনিন্দ্যর সামনে ও সব কথা খুলে বলবে। তারপর ভাবল, মাস্টার ডিক্রীটা হাতে পাওয়ার পরই না হয় অনিন্দ্যকে সব বলবে। তাই সেদিন  ডিক্রিটা হাতে পেয়ে কনভোকেশন হল থেকে বেরিয়ে সুনন্দা ঠিক করেছিল, আজ অনিকে সব কথা বলবে। একটা সুযোগ সে পেয়েছিল কালীঝোড়ায়। যখন অনি ওকে বিয়ের কথা বলেছিল। তা সত্ত্বেও সুনন্দা সেদিন অনিন্দ্যকে কিছুই বলতে পারেনি।   ভাবছিল, অনিকে ও কি করে বলবে যে, তাদের এই সম্পর্কটাকে বাবা কিছুতেই মেনে নেবেন না। প্রয়োজনে বাবা দাদার মতো তার সঙ্গেও সমস্ত রকম সম্পর্ক ছিন্ন করে দেবে। এতে অনি যদি কিছু মনে করে। তাই সেদিন অনিন্দ্যর সামনে সে বিয়ের প্রসঙ্গটাকে চাকুরীর অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে অনিন্দ্য যতবার বিয়ের প্রসঙ্গ তুলেছে, ততবারই সুনন্দা ওই একই অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে গেছে।
সেদিন সকালে সুধিন্দ্রনাথ বাবু মেয়েকে ডেকে পাঠালেন। বাবা আমায় ডেকেছেন? সুনন্দা বলল।
সুধিন্দ্রনাথ বাবু মেয়েকে বললেন – তোমার পড়াশোনাতো শেষ হয়েছে। তাই না।
হ্যাঁ, বাবা। সুনন্দা আস্তে করে বলল।
 শোন, আজ বিকেলে তোমাকে কয়েকজন দেখতে আসবেন। বাড়ীতে থাকবে।
 “দেখতে  আসবে” কথাটা শোনামাত্র সুনন্দার হাত-পা কাঁপতে লাগল।  সবকিছু  কেমন  যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। ওর সব চেতনা লোপ পেতে লাগল।  বাবাকে বোকার মতো প্রশ্ন করে বসল - কারা  দেখতে আসবেন বাবা? কেন দেখতে আসবেন?    
সুধিন্দ্রনাথ বাবু মেয়েকে বললেন -  যারা তোমায় দেখতে আসছেন তাদেরকে তুমি চিনবে না। আর কেন ওরা তোমাকে দেখতে আসছেন, সেটা বোঝার মতো বয়স তোমার হয়েছে। এখন যাও। আর শোন, তোমার মাকে  বলো আমি ডাকছি।
সুনন্দার শুধু কান্না পাচ্ছিল।  তার মনে হচ্ছিল, কে যেন তার পা দুটো মাটির সাথে আটকে দিয়েছে। সে কিছুতেই সেখান থেকে নড়তে পারছিল না। সে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল।
কি হল? এখনো যাওনি। কিছু বলবে? সুধিন্দ্র নাথ বাবুর কথায় সুনন্দার হুঁশ ফিরলো। সে হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। আস্তে আস্তে ভেতরে গিয়ে মাকে বলল, মা তোমাকে বাবা ডাকছেন।  বলে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
ঘরে বসে সুনন্দা ভেবে পাচ্ছিল না সে কি করবে। অনিও এখন শিলিগুড়িতে নেই। সে গতকালই কলকাতায় গেছে। হঠাৎ তার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। সুনন্দা ভাবল, মাকে যদি অনির ব্যাপারে সবকথা খুলে বলি, তাহলে হয়তো মা বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারে....কিন্তু তাতে সমস্যা আরও বাড়বে বৈ কমবে না। কারন আজ বিকেলেই যারা তাকে দেখতে আসছেন, তাদেরকে বাবা যদি না করে দেন, তাহলে বাবা আরও বেশি অপমানিত বোধ করবেন। তাতে বিষয়টা আরও জটিল হয়ে যাবে। অবশেষে অনেক ভেবেচিন্তে সুনন্দা ঠিক করল, আজ যারা তাকে দেখতে আসছেন তারা দেখে যেবার পর সে মাকে সব বলবে। যথারিতি সেদিন রাত্রেই সুনন্দা মাকে অনিন্দ্যর ব্যাপারে সব বলে  দিয়েছিল। সুনন্দা এটাও জানে, এর পর  হয়তো তাকে আবার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে একটা ঝড়ের মুখোমুখি হতে হবে।  তাই সে নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করে নিল। কারন কোন অবস্থাতেই সে, অনিন্দ্যকে হারাতে পারবে না।    
ওকে আজ দেখতে আসবে এটা  জানার পর থেকেই সুনন্দা নিজেকে কিছুতেই ঠিক রাখতে পারছিল না। এর মধ্যে মা একবার এসে তাকে ডেকে গেছে। কিন্তু সে যায়নি। সে কিছুক্ষণ একা থাকতে চায়। পাছে ফোনে কেউ ডিস্টার্ব করে,  তাই সে তার সেল ফোনটা অফ করে রেখেছিল। এমনকি অনিন্দ্যও যে তাকে ফোন করতে পারে, সেটাও সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। সুনন্দার এই মুহূর্তে সবচাইতে বেশি প্রয়োজন অনিন্দ্যকে। সুনন্দা সেল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ফোনের সুইচ অফ হয়ে আছে। সারাদিনের টেনশনের জন্য সে সেল ফোনটা অন করতে ভুলে গেছে। ফোনটা অন করে রিং করতেই ওপাশ থেকে অনিন্দ্যর স্বর শুনতে পেয়েই সুনন্দা বলল - অনি তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন। তাড়াতাড়ি ফিরে এস। বলেই সে অনিন্দ্য উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনের লাইন কেটে দিল।   
পরেরদিন সকালে সুধিন্দ্রনাথ বাবু, স্ত্রী সরলাময়ীর কাছ থেকে সবকিছু শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। কিছুক্ষণ ঘরময় পায়চারি করলেন। তারপর স্ত্রীকে বললেন, জান সরলা ভেবেছিলাম মেয়েটা অন্ততঃ আমার আশা-ভরসার  মর্যাদাটা দেবে। বংশ মর্যাদাটার কথা মাথায় রাখবে। কিন্তু সেও শেষ পর্যন্ত দাদার পথ অনুসরণ করল।   
সরলাময়ী কাছেই ছিলেন। তিনি বললেন, শুনেছি অনিন্দ্য ছেলেটি ভাল। এক বড় কোম্পানিতে চাকুরী করে। ছেলেটির বাবা-মা নেই, এক বোন তারও বিয়ে হয়ে গেছে। এখন সে একাই থাকেকথাগুলো বলে সরলাময়ী স্বামীর দিকে তাকালেন।
সুধিন্দ্রনাথ বাবু  বললেন, আমার কাছে ছেলে-মেয়ের পছন্দ-অপছন্দের চাইতে আমার বংশের কৌলীন্য ও মর্যাদা রক্ষা করাটা অনেক  বেশী  গুরুত্বপূর্ণ। পিতা হিসাবে ওদের আমি অভিশাপ দিতে পারি না। তাই আশীর্বাদ করছি, ওরা ওদেরমতো করে ভাল থাকুক, সুখে থাকুক। এখনতো আমি যতদিন বেঁচে থকবো ততদিন আমাকেই আমার বংশের মান- মর্যাদা রক্ষা করে যেতে হবে।  তাই তুমি মেয়েকে বলে দেবে, ছেলের কাছেতো অনেকদিন আগেই আমি মৃত। আজ থেকে তার  কাছেও আমি  মৃত।
দীর্ঘ এতোগুলো বছর যে মানুষটার সাথে সংসার করেছেন, তাকে কোনদিন এভাবে  ভেঙে পরতে দেখেননি সরলাময়ী। তাঁর আদর্শ, তাঁর সংস্কার তাকে কখনই কোথাও হারতে দেয়নি। সরলাময়ীর আজ মনে হচ্ছে, পিতা হিসাবে সন্তানের প্রতি ভালবাসা, তাঁর মায়া-মমতা,  তাঁকে তাঁর  আদর্শ, সংস্কারের কাছে পরাজিত করেছে। স্বামীকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে বাধা দিয়ে সুধিন্দ্রনাথ বাবু বললেন,  তুমি চাইলে ছেলেমেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে পার। তাতে আমি কোন আপত্তি করবো না। কারন তুমিতো ওদের মা। এই বলে সুধিন্দ্রনাথ বাবু নিজের ঘরে চলে গেলেন। সরলাময়ীর দু’চোঁখে জল। তিনি চোঁখ মুছে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখেন দরজার কাছে সুনন্দা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বুঝতে পারলেন তাদের সমস্ত কথাবার্তাই মেয়ে শুনেছে।  
মেয়ের কাছে এসে বললেন, তুইতো তোর বাবার সব কথাই শুনেছিস। এখন তোর যা করনীয় তুই করতে পারিস। মা  হিসেবে আমি তোকে আশীর্বাদ করছি, অনিন্দ্যকে  বিয়ে করে তুই সুখে থাক। সুনন্দা দেখল মার দু’চোঁখে জল। সে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। সে বলল, আমাকে তুমি ক্ষমা কোর মা। আমি যে অনিন্দ্যকে খুবই ভালবেসে ফেলেছি। আমারতো আর ফিরে আসার কোন উপায় নেই। বাবাকে  বোল তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করেন। তাঁর উপর আমার কোন রাগ বা আভিমান নেই।     
সরলাময়ী সস্নেহে মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললেন, তোর বাবাকে তো জানিস। ওসব নিয়ে তুই কিছু ভাবিস না।
আচ্ছা, অনিন্দ্যর কথাটা তোর দাদা জানে? দাদাকে বলেছিস? সরলাময়ী মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ জানে। দাদাকে আমি আগেই সব বলেছি। তারপর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে সুনন্দা বলল -  আজকের রাতটা আমার কাছে থাকবে মা?  সরলাময়ী কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে  কিছু ভাবলেন, তারপর মেয়ের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বললেন ঠিক আছে থাকব ।
সুনন্দা ঘরে এসে ভাবতে লাগল, আগামীকাল অনি কলকাতা থেকে ফিরবে। কিন্তু তাকে  কি করে সে বাড়ির এই সমস্যার কথা বলবে।  কিন্তু অনিকে তো জানাতেই হবে।  তারপর দাদার কথা মনে হতেই সে, রজতকে ফোনে  তার সমস্যার কথা জানাল। রজত  বোনকে অভয় দিয়ে  বলল,  ভাবিস না অনিন্দ্যকে জানানোর দায়িত্বটা আমি নিচ্ছি। কাল  সকালেই তো অনিন্দ্য কলকাতা থেকে ফিরছে। তুই শুধু অনিন্দ্যর সাথে আমার  পরিচয়টা  করিয়ে দিস।  
মাধবী তার কথা শেষ করে অনিন্দ্যর  দিকে তাকিয়ে বলে -  এরপর যা হয়েছে তাতো তুমি সবটাই জান অনিন্দ্য। ইনফ্যাক্ট, বাড়ির ঘটনাটা নিয়ে রিঙ্কি  মেন্টালি ডিস্টার্ব ছিল। বিষয়টা নিয়ে ও কিভাবে তোমার মুখোমুখি হবে,  সেটাই  ছিল সমস্যা। তাই আমাদের হস্তক্ষেপ করতে  হয়েছে। আশাকরি এতে তুমি কিছু মনে করনি।  
অনিন্দ্য বলল -  আমি কিছুই মনে  করিনি বৌদি। আমি  সুনন্দার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি। আমিতো  শুধু সুনন্দাকে ভালবেসেছি, ওর মনটাকে ভালবেসেছি।   
মাধবী হেসে বলল,  তোমাকে অনেক  ধন্যবাদ অনিন্দ্য। এখন মনে হচ্ছে রিঙ্কি কোন ভূল করেনি।
অনিন্দ্য বলল - এরমধ্যে ধন্যবাদ দেবার কিছুই  নেই বৌদি। সুনন্দা কোথায় বৌদি? অনেকক্ষণ হল ওকে দেখছি না।
মাধবী বলল, বুঝেছি। এই  মুহূর্তে  রিঙ্কি  কে  তোমার  সবচেয়ে বেশী  প্রয়োজন । ও ব্যালকোনিতে  দাড়িয়ে আছে।

(৪)

রজত যখন  অনিন্দ্যকে কথাগুলো বলছিল তখন সুনন্দা ভেতরে  ভেতরে  একটা অস্বস্তি বোধ করছিল। তাই সে অনেকক্ষণ আগেই ব্যালকোনিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
আজ সন্ধ্যের  আকাশটা বেশ পরিস্কার। চাঁদ উঠেছে। তারাগুলো সব জ্বলজ্বল করছে।  রজতের ফ্ল্যাটটা থার্ড ফ্লোরে হওয়ার সুবাদে রাতের বেলায় এখান থেকে  পাহাড়ের  কারসিয়াং  শহরের আলোগুলো  দেখতে  বেশ ভালোই  লাগে। যেন  মনে হয় অসংখ্য জোনাকি জ্বলছে।  সুনন্দাও ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে তাই দেখছিল আর  অনিন্দ্যর কথা  ভাবছিল।  অনিন্দ্য ব্যালকোনিতে এল। আস্তে করে গিয়ে  ব্যালকোনির রেলিং এর উপর রাখা সুনন্দার একটা হাতের উপর  সে হাত রাখল। সুনন্দা চমকে উঠে ঘুরে তাকিয়ে দেখে অনিন্দ্য দাঁড়িয়ে আছে।     অনি, তুমি! বলে সুনন্দা  মুখটা  ঘুড়িয়ে নিল।  অনিন্দ্য সুনন্দাকে  দু’হাত দিয়ে ধরে কাছে টেনে নিল। সুনন্দা মাথা নিচু করে  থাকল।  
অনিন্দ্য বলল -  আমার দিকে তাকিয়ে দেখ সু।  দেখ, তোমার  সেই  অনি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কোন বদলায়নি।  আর আমিতো শুধু তোমাকে ভালবেসেছি। তোমার মনটাকে ভালবেসেছি। যে কথাগুলো  আজ তোমার দাদা-বউদির  মুখ থেকে শুনলাম,এই  সহজ সত্যটা যদি তুমিই আমাকে বলতে পারতে, তাতে তোমার প্রতি আমার ভালবাসা বাড়ত বৈ কমতো না।  এতটুকু ভরসা তোমার আমার প্রতি রাখা উচিত ছিল সু।  
সুনন্দা বলল, আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না  কি’করে  তোমাকে বলবো যে, তোমার-আমার সম্পর্কটাকে বাবা কোনদিন মেনে নেবেন না।  অনি  আমাকে তুমি  ক্ষমা কোর। আমি যে তোমাকে  হারাতে চাই না।
আমাকে হারাবার প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে সু?  একমাত্র আমার মৃত্যু হলে,  তবেই তুমি আমাকে হারাতে পার। অনিন্দ্য বলল।  
সুনন্দা বলল, তুমি কি নিষ্ঠুর অনি। ভীষণ স্বার্থপর। বলে অনিন্দ্যকে  জড়িয়ে  ধরে। অনিন্দ্যও সুনন্দাকে জড়িয়ে ধরে।রাতের হিমেল হাওয়া ওদের দু’জনকে ছুঁয়ে গেল।  চাঁদের  আলো ব্যালকোনিতে এসে পড়েছে, সেই  আলোয় ওরা  নিজেদেরকে নতুন করে খুঁজে পেল।
মাধবীর ডাকে ওদের হুশ ফিরল।  মাধবীকে দেখে দু’জনেই লজ্জা পেল। বসার  ঘরে এসে অনিন্দ্য আর সুনন্দা দেখে রজতও এসে গিয়েছে। অনিন্দ্য আর সুনন্দাকে একসাথে ঢুকতে দেখে রজত বলল, তোমাদের  মুখ দেখে মনে হচ্ছে,  মেঘ এখন  কেটে গিয়েছে।  রজতের কথা শুনে ওরা দু’জনেই হাসল।    


 
(৫)

একটা সুন্দর সংসার। যেখানে থাকেবে সুখ-দুঃখ, মান-অভিমানের সবস্থান। আর সর্বক্ষণের জন্য একে-অপরের প্রিয়তম মানুষটাকে কাছে পাওয়া। এইটুকু পাথেয় করে সেই সংসার সাগরে তরণী বেয়ে ভেসে চলা – এক সুন্দর নতুন জীবনের খোঁজে। অনিন্দ্য আর সুনন্দা  সেই জীবনে খোঁজে  তরণী বেয়ে সংসার সাগরে ভেসে পড়ল। রজত আর মাধবী ওদের চার হাত এক করে দিল।  বোনের বিয়ের সমস্ত ব্যাবস্থাই রজত তার নিজের ফ্ল্যাটে করেছিল।     
বিয়ের আগের দিন সুনন্দা  রজতের ফ্ল্যাটে চলে এসেছিল। সুনন্দা  বাড়ি থেকে বিদায় নেবার আগে প্রথমে  সুধিন্দ্রনাথ বাবুকে প্রনাম করল।  তিনি খবরের কাগজ পড়ছিলেন।  সুনন্দা ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করতেই মুখতুলে তিনি মেয়েকে দেখলেন। মেয়ের সাথে কোন কথা না বলে, আবার খবরের কাগজের পাতায়  মন দিলেন।  এরপর সুনন্দা সরলাময়ীকে প্রনাম করল। সরলাময়ী মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।   মা-মেয়ে  দু’ জনেরই চোখে জল।  সুনন্দা মাকে বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য বলল।  সরলাময়ী তাতে রাজি হননি। মেয়েকে বললেন -  তোর বাবা যেখানে যাবেন না, সেখানে আমি যাই কি করে।
মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে সরলাময়ী বললেন -  আগামীকাল  তোর বিয়ে। কিন্তু আজই তো  আমি তোকে  বিদায় দিচ্ছি। সব মেয়েই বিয়ে করে এই ভাবে চোখের জলে বিদায় নেয়। আর একজন মা অনেক কষ্টে তার নিজের চোখের জল চেপে রেখে, মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে দেয়। মায়েদের চোখে জল থাকলেও মনে যে কত আনন্দ, কতো  গর্ব  অনুভব হয়, তা একমাত্র মেয়ের মা - ই  বুঝতে পারে।
আজ থেকে মেয়ে পর হয়ে গেল, এটা ভেবে  যেমন মায়ের চোখে জল আসে। তেমনি, মা হিসেবে মেয়ের প্রতি শেষ দায়িত্বটা পালন করতে পেরেছি, এটা ভেবেও  গর্ব  অনুভব হয়। ভূমিষ্ঠ  সন্তানের প্রথম মুখ দেখে একজন মা যেমন তার কিছুক্ষণ আগের প্রসব যন্ত্রণার  কথা ভুলে গিয়ে আনন্দিত হয়। গর্বিত হয়। তেমনি বিয়ের পর মেয়ের বিদায়কালে মা একই রকম ভাবে  আনন্দিত হয়। গর্বিত হয়।  
আমি  আশীর্বাদ  করছি, তোরা  সুখী হবি। এই বলে সরলাময়ী মেয়েকে  বিদায় দিলেন     
(৬)

অনিন্দ্য আর সুনন্দার বিয়ের প্রায়  চার মাস অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে।  ইতিমধ্যে ওরা হনিমুন সেরে ফিরে এসেছে। সুনন্দা একটা  ইংলিশ স্কুলে  চাকুরী যোগার করে নিয়েছে। প্রথম প্রথম অনিন্দ্য সুনন্দার চাকুরীর ব্যাপারে  আপত্তি করেছিল। বলেছিল, এতো তাড়াতাড়ি কিসের সু? চাকুরী তো তুমি  পরেও করতে পারবে।  উত্তরে সুনন্দা বলেছিল,  তুমি  সেই সকাল ন’টায় আফিস যাও, আর ফেরো রাত আঁটটায়। এই সময়টা আমার কিছুতেই কাটতে চায় না। ভীষণ একা একা লাগে। প্লীজ তুমি না কোর না অনি। অনিন্দ্য, সুনন্দার বাস্তব সমস্যাটা বুঝতে  পেরেছিল। তাই সে আর সুনন্দার চাকুরী করার বিষয়ে আপত্তি  করেনি।     
প্রতিদিনের মতো এক কাপ গরম চা নিয়ে এসে সুনন্দা খাটের পাশে টেবিলটার উপর রাখল। অনিন্দ্য তখনও  ঘুমোচ্ছে।   সুনন্দা আলতো করে  ওর কপালে হাত  রাখতেই অনিন্দ্যর ঘুম ভেঙে গেল।  তাকিয়ে দেখে সুনন্দা  ওর সামনে বসে আছে আর  মিটি মিটি করে হাসছে।  সুনন্দার চুল থেকে  কয়েকফোঁটা জল অনিন্দ্যর গায়ে  পড়ল। অনিন্দ্য বুঝতে পারে সুনন্দা সদ্য স্নান সেরে এসেছে। ওর  গা থকে অনিন্দ্য  বেশ একটা চমৎকার গন্ধ পাচ্ছে। সে জানে সুনন্দা প্রতিদিন খুব সকালে উঠে আগে স্নানটা সেরে নেয়। তারপর এককাপ গরম চা  নিয়ে এসে ওর ঘুম ভাঙায়।
আজ সুনন্দাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে।  কপালের ছোট্ট লাল টিপটা ওকে  আরও  মোহময়ী করে তুলেছে।  অনিন্দ্য একদৃষ্টে সুনন্দার দিকে তাকিয়ে থাকে।    
এমন করে কি দেখছ অনি? সুনন্দা  জিজ্ঞেস করে।
তোমাকে। অনিন্দ্য ছোট্ট করে উত্তর দেয়।
ইয়ার্কি  হচ্ছে। আমাকে আজ প্রথম দেখলে বুঝি।  
না। তোমার এই রূপটাকে আজই প্রথম দেখছি। অনিন্দ্য বলল।  জান সু, তোমার এই রূপের  দিকে তাকিয়ে থেকে আমি  ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারি। অনিন্দ্যর  কথায় সুনন্দা লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, তাহলে তো  সর্বনাশ!  
কেন? সর্বনাশ কেন? অনিন্দ্য  অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
হাসতে হাসতে সুনন্দা বলল, এই ভাবে তুমি যদি আমাকে দেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দাও, তাহলে  তুমি আফিসে যাবে কখন। তোমার চাকুরিটাই তো চলে যাবে। তাহলে আমরা খাব কি?
সুনন্দার কথাতে অনিন্দ্য হেঁসে উঠল।
সুনন্দা, অনিন্দ্যর  একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল -  অনি আজ তোমাকে একটা সু-খবর দেবার আছে। 
অনিন্দ্য এবার শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসল। সুনন্দার  সু-খবরটা  শোনার জন্য  উদগ্রীব হয়ে রইল।
সুনন্দা একহাত দিয়ে অনিন্দ্যর  গলা গড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে সুনন্দা বলল - তুমি বাবা হতে চলেছ। বলেই সুনন্দা মুখটা নীচু করে নিল।  
অনিন্দ্য, কথাটা শোনা মাত্র সুনন্দাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, আজ আমার সত্যি খুব আনন্দ হচ্ছে সু। আমি বাবা হতে চলেছি, আর তুমি মা। নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে।    
সুনন্দা বলল, আমারও খুব আনন্দ হচ্ছে অনি।  একজন নারীর বহু আখাঙ্কিত হল মাতৃত্বের স্বাদ। তোমার ভালবাসায়  সেই স্বাদ আমি পেতে চলেছি। তারপরেই সুনন্দা, অনিন্দ্যকে আফিসের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলে, তোমার কিন্তু আফিস যেতে দেরী হয়ে যাচ্ছে। 
আজ কোন আফিস নয়। আজকের দিনটা আমরা সেলিব্রেট করবো। অনিন্দ্য বলল।  
সুনন্দা বলল, কিন্তু আমার তো স্কুল আছে।
যেতে হবে না। অনিন্দ্য বলল।
মুখে বললেও আজ সুনন্দারও স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছিল না। সেও মনে মনে চাইছিল আজ সারাটাদিন অনির সাথে একান্তে কাটাতে।
জান অনি, আজ আমার খুব কালিঝোড়ায় যেতে ইচ্ছে করছে।  সুনন্দা বলল। 
গুড আইডিয়া। সেখানেই যাব। তার আগেএই ফাইলগুলো  বুঝিয়ে দেবার জন্য আমাকে একটু আফিসে যেতে হবে। আর  আজকের ছুটির কথাটাও ম্যানেজারকে বলতে হবে। বলে অনিন্দ্য বাথরুমে ঢুকে গেল।


(৭)

               সুনন্দা রেডি হয়ে অনিন্দ্যর জন্য ওয়েট করতে লাগল।  কিন্তু দুই ঘণ্টার ওপরে হয়ে গেল।  এখনো অনিন্দ্যর দেখা নেই। এরমধ্যে দু - দু’বার  অনিন্দ্যকে ফোনে   ধরার চেষ্টা করেছিল সুনন্দা। শুধু ফোনের রিং হয়ে যাচ্ছে। সুনন্দা  চিন্তায় পরে গেল। এমটাতো হবার কথা নয়। এক অজানা  আশঙ্কায় সুনন্দা অস্থির হয়ে উঠল। সে কেবলই ভাবছে, কেন যে সে অনিকে কালীঝোড়ার কথা বলতে গেল। সুনন্দা কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না।  একবার ভাবে দাদাকে ফোন করে জানাবে কি না। আবার ভাবে, অনি হয়তো আফিসের কোন কাজে আটকে গেছে।  কিন্তু অনি ফোন ধরছে না কেন।  সুনন্দা দেরি না করে  দাদাকে ফোনে খবর দেয়। ওপাশ থেকে রজত বোনকে আশ্বস্থ করে বলে, চিন্তা করিস না। আমি এখনি আসছি।   রজতও সঙ্গে সঙ্গে  অনিন্দ্যকে ফোনে ধরার চেষ্টা করে।  রিং হতেই  ওপাশ থেকে  কেউ ভারী  গলায় বলল - হ্যালো  কে বলছেন? অনিন্দ্যর সেল ফোন অন্যের হাতে। এটা ভেবে রজত একটু অবাক হল। সে  পাল্টা প্রশ্ন করল, আপনি কে বলছেন?   
আমি থানা থেকে  ডিউটি আফিসার বলছি।  থানা থেকে মানে ? অনিন্দ্য কোথায়? ওর কি কোন  অঘটন...... 
রজতের কথা শেষ হবার আগেই থানার ডিউটি আফিসার বললেন, আপনি কে বলছেন?  অনিন্দ্য সরকার আপনার কে হন?
আমি রজত দাসগুপ্ত বলছি।  অনিন্দ্য সরকার আমার ভগ্নিপতি।
আই সী মি. দাসগুপ্ত। একটা  খারাপ খবর আছে। আপনার ভগ্নিপতি মি. অনিন্দ্য সরকারের  মারাত্মক এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।  আবস্থা সিরিয়াস।
আমরা ওনাকে মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়ে দিয়েছি। আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানে চলে যান।
অনিন্দ্যর এ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে রজত চিৎকার করে  মাধবীকে ডেকে সোফার উপর বসে পড়ল।  মাধবী তাড়াতাড়ি এসে দেখে রজত একদৃষ্টে হাতে ধরা সেল ফোন্টার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।  মাধবী ডেকে  সাড়া না পেয়ে, রজতের কাঁধ ধরে ঝাকাতেই  রজত মুখ তুলে মাধবীকে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে  মাধবী।  অনিন্দ্য এ্যাক্সিডেন্ট করেছে।  মেডিক্যাল কলেজে আছে।  আমাদের এখুনি  রিঙ্কির কাছে যেতে হবে। তারপর  ওকে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ যেতে হবে।    
মাধবী বলল, রিঙ্কি  জানে? 
সম্ভবত না। জানলে ওই আমাকে ফোন করতো।
রজত আর মাধবী নিজেদের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল, এমন সময়  রজত বলল দাঁড়াও মাধবী। ছেলে হিসাবে আর একটা  কর্তব্য সেড়ে ফেলি, বলে মা  সরলাময়ীকে ফোনে অনিন্দ্যর এ্যাক্সিডেন্টের খবরটা দিল।  
রজতদের গাড়ী বাড়ির সামনে আসতেই, সুনন্দা প্রায় দৌড়ে গেট খুলে বেড়িয়ে এল। দেখে দাদা বৌদি একসাথে গাড়ি থেকে নামছে।  সে  বলল, এখনও অনির কোন খবর পাইনি দাদা।  
আমরা পেয়েছি। রজত বলল।
তোরা খবর  পেয়েছিস। বল না অনি কোথায়? সে কেন এখনো আসছে না।  সুনন্দা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে  রজতের জামা আকড়ে ধরল।   
রজত  বুঝতে পারছিল না , কি করে  অনিন্দ্যর এ্যাক্সিডেন্টের খবরটা  ও বোনকে জানাবে। কিন্তু   বলতে তো হবেই।  রজত চোখের ইশারায় মাধিবীকে ডেকে সুনন্দাকে ধরতে বলল।  তারপর সুনন্দার দিকে তাকিয়ে  বলল, আমাদের এখুনি মেডিক্যাল কলেজ যেতে হবে। অনিন্দ্য একটা এ্যাসিডেন্ট করেছে।  সে এখন   মেডিক্যাল কলেজে  ভর্তি আছে।
অনিন্দ্যর এ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে  সুনন্দা নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। সে মাধবীর অপর এলিয়ে পড়ল। মাধবী কোনমতে ওকে গাড়ীর  ভেতর বসিয়ে দিল। রজত দৌড়ে গিয়ে  ঘরের দরজা আর গেট বন্ধ করে গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল।
মেডিক্যাল কলেজে  খোঁজাখুঁজি করে ওরা নির্দিষ্ট রুমে গিয়ে পৌছাল। যেখানে অনিন্দ্যকে রাখা হয়েছে।   কিন্তু সেখানে অনিন্দ্যকে দেখতে না পেয়ে  রজত  সিস্টারকে জিজ্ঞেস করে  জানতে পারে যে,  প্রায়  এক ঘণ্টা আগে পুলিশ  এসে অনিন্দ্যকে এখানে ভর্তি করে  দিয়ে গেছে।  এখন  অনিন্দ্যকে ও. টিতে  নিয়ে যাওয়া হয়েছে।  আফিসিয়াল ফর্মালিটিগুলো শেষ করে রজত মাধবীদের কাছে এসে বলে  অনিন্দ্যকে  ও. টিতে নিয়ে গেছে। এখন ওর অপারেশান চলছে।  সুনন্দা  সমানে কেঁদে চলছে।  ওরা এসে ও. টির সামনে  রাখা বেঞ্চে বসল।  কিছুক্ষণ পর  ও. টির  দড়জা খুলে গেল। ডাক্তার বেড়িয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, পেশেন্টের বাড়ীর  লোক কে আছেন?  সুনন্দা তাড়াতাড়ি  ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলল,  আমি  এসেছি  ডাক্তারবাবু। আমি ওনার স্ত্রী।  ডাক্তারবাবু সুনন্দার মানসিক অবস্থা আঁচ করতে পেরে   বললেন,  আর কে কে এসেছেন আপনার সাথে? 
সুনন্দা,  রজত আর মাধবীকে  দেখিয়ে বলে, আমার দাদা  আর বৌদি এসেছেন।
ঠিক আছে। আপনারা আমার সাথে আমার চেম্বারে আসুন। বলে ডাক্তারবাবু এগিয়ে গেলেন। ওরাও ডাক্তারবাবুকে অনুসরণ করে তার চেম্বারে এসে উপস্থিত হল। ডাক্তারবাবু সুনন্দার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখুন এই মুহূর্তে আপনার  স্বামীর অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। লোয়ার পরশান পুরোপুরি ড্যামেজ  হয়ে গিয়েছে।  কিছু কিছু নার্ভ মারাত্মক ভাবে ড্যামেজ হয়েছে। মাথাতেও গুরুতর চোট পেয়েছেন।  মিনিমাম বাহাত্তর  ঘণ্টা না গেলে কিছুই বলা যাবে না।  সুনন্দা  বলল, ওকে একটু দেখতে পারি ডাক্তারবাবু?
ডাক্তারবাবু সুনন্দার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে  বললেন, দেখতে পারেন তবে দড়জার বাইরে থেকে। ভেতরে যাওয়া  নিষেধ।
সুনন্দা যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল।  ডাক্তারবাবু সুনন্দাকে দাড়াতে বলে  বেলটা বাজাতেই  একজন লোক এসে হাজির হল।  ডাক্তারবাবু সুনন্দাকে দেখিয়ে লোকটিকে  বললেন,  এনাকে  আই. সি. ইউ -৬  এ  নিয়ে যাও। রজত মাধবীকে বলল, তুমিও রিঙ্কির সাথে যাও। ওরা অনিন্দ্যকে দেখতে চলে যাবার কিছুক্ষণ পরে, রজত ডাক্তারবাবুর সাথে আরও কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে  চেম্বার  থেকে  বেড়িয়ে এল। বাইরে  বেড়িয়ে এসে রজত দেখে,  সুনন্দা আর মাধবী একটা বেঞ্চে বসে আছে। কাছে আসতেই মাধবী বলল,  দ্যাখো  অনিন্দ্যকে ওই অবস্থায় দেখার পর থেকে রিঙ্কি যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। কোন কথা বলছে না।  কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু মাথা নেড়ে উত্তর দিচ্ছে।  রজত দেখল, সত্যি তাই।  সুনন্দার চোখে  জল নেই। শুধু বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
দু’দিনপরে কিছুক্ষণের জন্য অনিন্দ্যর জ্ঞান ফিরেছিল। কথাটা ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে শোনার পর, সুনন্দা ডাক্তারবাবুর অনুমতি নিয়ে অনিন্দ্যর কেবিনে গেল।  অনিন্দ্যর হাত পা পুরোটাই ব্যান্ডেজে বাঁধা। মুখে অক্সিজেন মাক্স লাগানো।  সুনন্দা ধীরে ধীরে ওর কাছে গেল। দেখল, অনিন্দ্যর দু’চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।  সুনন্দা হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিল।
অনিন্দ্যর  টেনশানে সুনন্দা গত তিন চার দিন ঠিক মতো ঘুমোতে পারে নি। সেও খুব টায়ার্ড হয়ে পরেছে।  অনিন্দ্যর বেডের সামনে চেয়ারে বসে  থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ল।
সুনন্দা  স্বপ্ন দেখল – সুনন্দা কালীঝোড়ার ওদের  সেই প্রিয় পাথরটার উপর বসে  কেঁদে চলছে।  আপাদ মস্তক সাদা কাপড়ে ঢাকা  একটা অদ্ভুত  পোশাক পরে অনিন্দ্য তার সামনে এসে দাঁড়াল।  মুখে  সেই  দুস্টুমি  মাখা হাঁসি। সুনন্দার একটা হাত ধরে  বলল -  তুমি  কেঁদো না  সু, আমি তো তোমার সাথেই  আছি।  আমাদের যে সন্তান তোমার গর্ভে এসেছে, তাকে তোমার মতো করে মানুষ কোর সু। সুনন্দা  বলতে যাচ্ছিল – একি অনি, তুমি এরকম পোশাক পরেছ কেন? তোমার হাত এত ঠাণ্ডা কেন?
মাধবীর হাতের স্পর্শে সুনন্দার ঘুম ভেঙে যায়। মাধবীর চোখে জল দেখে সুনন্দা জিজ্ঞেস করল -  কি হয়েছে বৌদি?  
নিজেকে ঠিক রেখে কোনমতে মাধবী বলল - তোমার অনি তোমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে রিঙ্কি। 
সুনন্দা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে বেডের দিকে  তাকিয়ে দেখল  অনিন্দ্যর মুখ থেকে অক্সিজেন মাক্স ও  দেহে লাগান অন্যান্য যন্ত্রগুলো খুলে নেওয়া হয়েছে। সুনন্দা এমন ঘুমিয়ে পড়েছিল যে, সে কিছু টের পায়নি। সে স্থির হয়ে চেয়ারে বসে রইল। সে আজ আর কাঁদতে পারছে না। চোখের সব জল শুকিয়ে  গেছে। সে  আস্তে আস্তে অনিন্দ্যর ব্যান্ডেজ বাঁধা মাথার ওপর হাত বোলাতে লাগল।   এর মধ্যে  রজত নার্সিং হোমের সমস্ত  ফরমালিটিস শেষ করে কাবিনে এল।  সে  সুনন্দার মাথায় হাত দিয়ে বলল, রিঙ্কি  এবার আমাদের যেতে হবে।  রজতকে দেখে সুনন্দা বলে উঠল – অনিন্দ্য চলে গেল দাদা। আমি তাকে ফেরাতে পারলাম না....।



(৮)

আজ  এক সপ্তাহ হল সুনন্দা  আবার  স্কুলে যাচ্ছে। এর মধ্যে একদিন  সরলাময়ী সুনন্দা কে ফোন করে বলেছিল, যদি তোর একা থাকতে অসুবিধে হয়, তাহলে এখানে চলে  আয়।  সুনন্দা বলেছিল, না মা এখানে আমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না। এখানে আমি একা নই মা। অনির সন্তান আমার সাথে আছে। ও যে একটু একটু করে আমার গর্ভে বড় হচ্ছে। অনিন্দ্য হারিয়ে যায়নি মা। ও আমার সাথেই আছে। তুমি  ভেবোনা,  আমি ভালো আছি। সরলাময়ী মেয়ের কথার অর্থ বুঝতে পেরে, এর পরে তাকে আর কোন দিন বাড়িতে আসার জন্য বলেনি। 
   গত কয়েকদিন হল অনবরত বৃষ্টি পড়ে চলেছে। তবুও  কিছুটা গুমোট ভাব আছে। এই বর্ষায় স্কুলে ছাত্রীরাও আজ কম এসেছে।  তাই সুনন্দা তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে স্কুল থেকে বেড়িয়ে পড়লো। সুনন্দার আজ স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলনা। ও চেয়েছিল আজ সারাটাদিন অনিন্দ্যকে নিয়ে কাটাবে।  কিন্তু স্কুলে একটা জরুরী টিচার্স মিটিং থাকায় তাকে বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছিল।       
সুনন্দা স্কুল থেকে বেড়িয়ে সোজা  ফুলের দোকানে এল, দোকানটা সুনন্দার স্কুলের কাছে বলে দোকানের ছেলেটি সুনন্দাকে চিনতো। অনিন্দ্য রজনীগন্ধার ফুল ভালবাসতো বলে, ও প্রায়ই এখান থেকে বাড়ীর জন্য ফুল নিয়ে যেত। দোকানের সামনে দাঁড়াতেই, সুনন্দাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে,  ছেলেটি  গোটা দশেক রজনীগন্ধার স্টিক কাগজে পেঁচিয়ে সুনন্দার হাতে দিয়ে বলল, এই নিন দিদিমণিসুনন্দা হেসে  বলল, আজ শুধু ফুল দিলে হবে না। সাথে একটা রজনীগন্ধার মালা দাও। ছেলেটি একটু অবাক হয়ে বলল, আজকে  কি বাড়িতে কোন  পুজো আছে, দিদিমণি? সুনন্দা একটু হাসল। ছেলেটি  আর কোন কথা না বলে একটা ভালো রজনীগন্ধার মালা কাগজে প্যাক করে সুনন্দার হাতে দিল। পার্স খুলে একটা একশ টাকার নোট ছেলেটির হাতে দিয়ে বাড়তি টাকা ফেরত নিয়ে সে বাড়ী ফিরল। তালা খুলে ঘড়ে ঢুকে প্রথমেই সুনন্দা বন্ধ জানালা দুটি খুলে দিল। রজনীগন্ধার স্টিকগুলো  দুটো  ফ্লাওয়ারভাসে জল দিয়ে রেখে, সেগুলো হাতে নিয়ে অনিন্দ্যর ঘড়ে  ঢুকল। ফ্লাওয়ারভাস দুটো  টেবিলের উপর রাখা অনিন্দ্যর  ফটোর দু’দিকে রেখে রজনীগন্ধার মালাটা অনিন্দ্যর  ফটোতে পড়িয়ে দিল। সুনন্দার দু’ চোখ জলে ভরে এল। তার মনে হল, অনিন্দ্য বলছে ‘সু’ তুমি  কাঁদছ? সুনন্দা তাড়াতাড়ি চোখ মুছল।  না, আজ সে চোখের জল ফেলবে না। আজ যে ওদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী।
সুনন্দা অনিন্দ্যর প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতটা  “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে.......” সিডিতে চালিয়ে দিল।  
সুনন্দার মনে পড়ে – এই গানটার জন্য সে অনিন্দ্যর সাথে  ঝগড়া পর্যন্ত করেছিল। সে গানটা শুনতে চাইতো না। একদিন সুনন্দা, অনিন্দ্যকে বলেছিল প্লীজ অনি, এই গানটা তুমি বাজিও না। এটা শুনলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়।  অনিন্দ্য হেঁসে বলেছিল, এটা আমার খুব প্রিয় গান। মনে হয় বারবার শুনি। আমারতো মন খারাপ হয় না। সুনন্দা, অনিন্দ্যর কথা শুনে রেগে গিয়ে বলেছিল, তোমার মন নেই, তাই শুনতে ভাল লাগে।  সুনন্দাকে  আরও রাগাবার জন্য অনিন্দ্য বলেছিল, যেদিন আমি  তোমার কাছে  থাকবো না, সেই দিন তোমারও এই গানটা শুনতে ভালো লাগবে, বারবার শুনতে ইছে করবে। এই গানটা শুনলেই আমাকে তোমার মনে পড়বে।   সুনন্দা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলেছিল, একদম বাজে কথা  বলবে না। তোমাকে মনে করার জন্য, আমার এই গান শোনার প্রয়োজন হবে না।  সুনন্দা বিষয়টাকে সিরিয়াস নিয়েছে বুঝতে পেরে অনিন্দ্য, তাকে কাছে টেনে  নিয়ে বলেছিল – সরি,  আমি কথা দিচ্ছি  সু, এই গান  আর শুনবো না। বলে নিজের হাতে অনিন্দ্য সেদিন সিডিটা অফ করে দিয়েছিল।  
 না, আজও সুনন্দার এই গানটা শুনতে ভালো লাগছে না। গানের প্রতিটি কথা যেন ওর বুকটাকে  ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, অনিন্দ্যও  যেন তাকে বলছে, “প্লীজ সু, গানটা বন্ধ করে দাও। তোমার কষ্ট হচ্ছে”।
সুনন্দা, অনিন্দ্যর ফটোর সামনে এসে দাঁড়াল। শত চেষ্টা করেও আজ সুনন্দা তার চোখে জল  আটকাতে  পারছে না। তার চোখের জল আজ কোন বাধাই মানছে না। ধীরে ধীরে সে অনিন্দ্যর ফটোটা দু’ হাতে তুলে নিল। সুনন্দার চোখের জল টপ টপ করে অনিদ্যর ফটোর উপরে পড়তে লাগল সে  অনিন্দ্যর ফটোটা ঝাপসা দেখছে, বার বার নিজের চোখ মুছে অনিন্দ্যকে দেখার চেষ্টা করছে।  বাইরে তখন  অঝোরে বৃষ্টি পড়ে চলছে।  বৃষ্টির শব্দ অনিন্দ্যর কণ্ঠস্বর হয়ে যেন সুনন্দাকে বলছে - “সু, তুমি তো আমার আপন হতেও আপন জন”।      


শেষ

---------------------------------------------------------------------------------- --------------------------------

কোন মন্তব্য নেই: