লিখেছেন : শুদ্ধ
কৃষ্ণ আসলে গ্রিকদেবতাই
আলেক্সান্ডার তক্ষশীলা দখল করলেন। পুরুকে হারালেন। শুনলেন বন্দী পুরুর উত্তর। রাজার কাছে রাজার মত ব্যবহার চায় সে। শুনেটুনে তাকে বন্ধু করলেন তার সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে। এবারে পরিকল্পনা করছেন বাকী দেশটাও জয় করতে হবে। এর আগে অব্দি তাঁদের কাছে হিন্দুদের দেশ ছিল সিন্ধুর অববাহিকা অঞ্চল অব্দিই। এবাব্রে এসে তিনি দেখছেন দেশটা অনেক অনেক বড়। সিন্ধু ছাড়াও আরেকটা বিরাট নদী আছে, যার কাছে সিন্ধুও শিশু মাত্র, সে নদী হল গঙ্গা। তার পাশ দিয়ে গড়ে উঠেছে অজস্র জনপদ। সমৃদ্ধি তাদের কল্পনাতীত। যা বিবরণ শুনছেন তাতে মনে হচ্ছে গোটা পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদই রয়েছে সেখানে। এ জয় করা না হলে বৃথা যাবে তাঁর বিশ্ববিজয়ের পরিকল্পনা। তিনিই পৃথিবীর প্রথম সম্রাট যিনি বিশ্ববিজয় করবেন বলেই বেরিয়েছেন। শুধু নিজের প্রান্তসীমা বাড়ানো না, তার চেয়েও বড় উদ্দেশ্য তাঁর আছে। তিনি মহাপন্ডিত অ্যারিস্টটলের ছাত্র। তিনি চান এই পৃথিবীর শেষ দেখতে। জীবন তাঁর কাছে একটা চরম রোমাঞ্চকর বিষয়। কাজেই গঙ্গাতীরের রাজ্যগুলোকে অপরাজিত রেখে তিনি ফিরে যেতে পারেন না। তাঁর আর বাকী দুনিয়া জয়ের মধ্যে পথের কাঁটা শুধু মাত্র মগধ। এই পরিকল্পনা করার সময়েই তিনি জানতে পারলেন তিনিই প্রথম গ্রীক বিজেতা নন যিনি এই ভূখন্ডে এসেছেন। তিনি স্তম্ভিত।
এই অব্দি পড়ার পরে মনে হবে এ বুঝি কোনো কল্পকাহিনীর গল্প! এখান থেকে একটা অপ্রত্যাশিত মোড় চলে আসবে। আলেক্সান্ডারেরও আগে গ্রীক বিজেতা? ইস্কুল বা কলেজ পাঠ্য ইতিহাসে কোনো উল্লেখ নেই। এ কি করে সম্ভব? যাঁদের ইতিহাস একটু পছন্দের বিষয় তাঁরা ঘাঁটতে বসবেন চেনাজানা কিছু সূত্র। কই? কোত্থাও নেই তো! না থাকাটাই স্বাভাবিক। এই খবর মোটেও আমাদের চেনা ইতিহাস্র মোড়কে নেই। তাহলে কি আছে কল্পকাহিনীতেই। আবার ধোঁয়াশা? একদমই না। কেন নয় বলার আগে কয়েকটি অভিযোগের হালকা চালে দ্রুত মীমাংসা করে নিই।
কৃষ্ণ আসলে গ্রিকদেবতাই
আলেক্সান্ডার তক্ষশীলা দখল করলেন। পুরুকে হারালেন। শুনলেন বন্দী পুরুর উত্তর। রাজার কাছে রাজার মত ব্যবহার চায় সে। শুনেটুনে তাকে বন্ধু করলেন তার সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে। এবারে পরিকল্পনা করছেন বাকী দেশটাও জয় করতে হবে। এর আগে অব্দি তাঁদের কাছে হিন্দুদের দেশ ছিল সিন্ধুর অববাহিকা অঞ্চল অব্দিই। এবাব্রে এসে তিনি দেখছেন দেশটা অনেক অনেক বড়। সিন্ধু ছাড়াও আরেকটা বিরাট নদী আছে, যার কাছে সিন্ধুও শিশু মাত্র, সে নদী হল গঙ্গা। তার পাশ দিয়ে গড়ে উঠেছে অজস্র জনপদ। সমৃদ্ধি তাদের কল্পনাতীত। যা বিবরণ শুনছেন তাতে মনে হচ্ছে গোটা পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদই রয়েছে সেখানে। এ জয় করা না হলে বৃথা যাবে তাঁর বিশ্ববিজয়ের পরিকল্পনা। তিনিই পৃথিবীর প্রথম সম্রাট যিনি বিশ্ববিজয় করবেন বলেই বেরিয়েছেন। শুধু নিজের প্রান্তসীমা বাড়ানো না, তার চেয়েও বড় উদ্দেশ্য তাঁর আছে। তিনি মহাপন্ডিত অ্যারিস্টটলের ছাত্র। তিনি চান এই পৃথিবীর শেষ দেখতে। জীবন তাঁর কাছে একটা চরম রোমাঞ্চকর বিষয়। কাজেই গঙ্গাতীরের রাজ্যগুলোকে অপরাজিত রেখে তিনি ফিরে যেতে পারেন না। তাঁর আর বাকী দুনিয়া জয়ের মধ্যে পথের কাঁটা শুধু মাত্র মগধ। এই পরিকল্পনা করার সময়েই তিনি জানতে পারলেন তিনিই প্রথম গ্রীক বিজেতা নন যিনি এই ভূখন্ডে এসেছেন। তিনি স্তম্ভিত।
এই অব্দি পড়ার পরে মনে হবে এ বুঝি কোনো কল্পকাহিনীর গল্প! এখান থেকে একটা অপ্রত্যাশিত মোড় চলে আসবে। আলেক্সান্ডারেরও আগে গ্রীক বিজেতা? ইস্কুল বা কলেজ পাঠ্য ইতিহাসে কোনো উল্লেখ নেই। এ কি করে সম্ভব? যাঁদের ইতিহাস একটু পছন্দের বিষয় তাঁরা ঘাঁটতে বসবেন চেনাজানা কিছু সূত্র। কই? কোত্থাও নেই তো! না থাকাটাই স্বাভাবিক। এই খবর মোটেও আমাদের চেনা ইতিহাস্র মোড়কে নেই। তাহলে কি আছে কল্পকাহিনীতেই। আবার ধোঁয়াশা? একদমই না। কেন নয় বলার আগে কয়েকটি অভিযোগের হালকা চালে দ্রুত মীমাংসা করে নিই।
পাশ্চাত্য পন্ডিতদের মতে আমাদের ইতিহাস নেই, আছে পুরাণ। আমাদের প্রাচীন পন্ডিতদের মতে আমাদের আছে ইতিহাস পুরাণ। এইরূপ হয়েছিল বলে শোনা গিয়েছে- এটাই যার ভিত্তি। অর্থাৎ লোকগল্পের ধারা। ইতিহাস তো নির্মাণের বিষয়। প্রতি মুহুর্তে সে নির্মিত হয়। কখনো ব্যাক্তির দ্বারা, কখনো সমষ্টি আবার কখনো রাষ্ট্রের দ্বারা। গত তিনশো বছরে আমরা এই ইতিহাসের নির্মাণ ও ধ্বংস নিয়ে যা যা দেখে ফেললাম এবং এখনো যা যা দেখে চলেছি আমাদের এই উপমহাদেশে তা প্রতিদিন প্রতিমুহুর্তে আমাদের মনে পড়িয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট যে এ সকলই নির্মাণ মাত্র। রামের জন্মভূমি কি বাবরি মসজিদ যেটাই হোক না কেন সেখানে ইতিহাসের চেয়ে নির্মাণের চর্চা বেশী হয়ে পড়ে। তার ফল যে বিষময়তা তা আমরা সর্বাঙ্গে বেশ অনুভব করতে পারি, শুধু রোগের উৎসটির ব্যবস্থা করে উঠতে পারিনা। অস্যার্থ, ইতিহাসকে সামলে উঠতে পারিনা। কিন্তু এতো আজকের রোগ নয়, আর শুধু আমাদের রোগও নয়। এ রোগের মূলে যা আছে তা হল অপরিচিতের বা আপাত অপরিচিতের পরিচয় পদ্ধতির গোলোযোগ। সেই গোলোযোগ মানুষকে এতদূর অব্দিও বিক্ষুব্ধ করতে পারে যে বার্নার্ড শ-র মত মানুষও বলে বসেন, “Hegel was right when he said that we learn from history that man can never learn anything from history.” অথবা মার্ক টোয়েনের কথাই শুনুন। “The very ink with which history is written is merely fluid prejudice.”
তাহলে দোষ শুধু ভারতের নয়। দোষ শুধু আমাদের নয়। এ দোষ সর্বত্রই ছিল এবং আছে। আছের কথা আগে বলে নিই। জার্মানরা একদা যে নিজেদের আর্য এবং শ্রেষ্ঠ জাতি বলে ভেবেছিল সে দোষ ইতিহাসের ব্যাখ্যার। তেমনই আবার ইজরায়েলের অস্তিত্ব নিয়ে বিক্ষুব্ধ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু ইসলামিক ইতিহাসবিদ এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট যে বলে থাকেন, জার্মানির মারণক্যাম্পগুলোতে ইহুদি নিধনের জেনোসাইড আসলে গল্পকথা সেও একই রকম ইতিহাসবিকৃতির ফসল। আর প্রাচীন দোষ বলতে গ্রীসের বা রোমের ইতিহাসচর্চা। সে কেমন তা এই আলেক্সান্ডারের কাহিনী সূত্রেই বোঝা যাবে।
আমরা ছোটবেলা থেকেই পড়ে এসেছি ভারত ইতিহাসের অন্যতম বৈদেশিক সূত্রগুলোর মধ্যে মেগাস্থেনিসের ‘ইন্ডিকা’ উল্লেখযোগ্য। সেই ‘ইন্ডিকা’ নামের আরো অনেক বিবরণ আছে আরো অনেকের লেখা তা জানতে গেলে ঘাঁটতে হবে ইতিহাস। সে যাই হোক, ‘ইন্ডিকা’-র মধ্যেই পাওয়া যায় এই চমকপ্রদ বৃত্তান্তটি, যে আলেক্সান্ডারের আগে ভারত আক্রমণে এসেছিলেন আরো লোকজন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ডাওনিসাস এবং হেরাক্লেস। ডাওনিসাস এবং হেরাক্লেস যথাক্রমে গ্রীক পুরাণের অন্যতম দুই নায়ক এবং অর্ধ দেবতা। দুজনেই গ্রীক দেবরাজ জিউসের অবৈধ সন্তান। দুজনের ক্ষেত্রেই জিউস-পত্নী হেরা অন্যতম শত্রুর ভূমিকা পালন করেছেন। শুধু এখানেই যদি আমাদের বিষ্ময় শেষ হয়ে যেত তাহলে কথাই ছিল না। আমরা একে শুধুমাত্র পৌরাণিক গল্প বলে ধরে নিয়ে পড়ে ক্ষান্ত হতে পারতাম এবং আমোদ পেতাম। কিন্তু এ আখ্যান এখানেই থামেনি। এ গল্প শুরু করি হেরাক্লেস-এর কথা দিয়ে।
‘This Heracles, according to Megathenes, ‘was especially worshipped by the Suraseni, an Indian people (the Śūrasenas), where there are two great cities, Methora (Mathurā, Muttra) and Clisbora (Krishnapura), and a navigable river, the Jobanes (Jumnā), flows through their country. The garb worn by this Heracles was the same as that of the Theban Heracles, as the Indians themselves narrate; a great number of male children were born to him in India (for this Heracles also married many women) and one only daughter. Her name was Pandaea, and the country where she was born and which Heracles gave her to rule is called Pandaea after her [the Pāndya kingdom in South India] She had by her father’s gift five hundred elephants, four thousand horsemen, and 130,000 foot-soldiers….and the Indians tell a story that when Heracles knew his end was near, and had no one worthy to whom he might give his daughter in marriage, he wedded her himself, though she was only seven years old, so that a line of Indian kings might be left of their issue. Heracles then bestowed on her miraculous maturity, and from this act it comes that all the race over whom Pandaea ruled, has this characteristic by grace of Heracles.’
- [E.R. Bevan, “India in Early Greek and Latin Literature”, in E.J. Rapson, ed., Ancient India (Cambridge: Cambridge University Press, 1922) p. 423.]
সটান চলে এল কৃষ্ণের সঙ্গে তুলনা। সেই তুলনা শুধু যে কৃষ্ণেই থেমে থাকলো এমন না। সে তুলনা জড়ালো বলরামকেও। বলরামের হাতেই ছিল লাঙল অস্ত্র হিসেবেও। আরো যাকে জড়ালো তার কথায় আসবো পরে। তার আগে দেখে নিই এ তুলনার কোনো বীজ এখনো আছে কি না!
গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী দেব হেরাক্লেস, রোমানরা যাঁকে হারকিউলিস হিসেবে চিহ্নিত করায় আমরা ব্রিটিশ কলোনিতে সেই নামেই বেশী চিনেছি সে দেবরাজ জিউসের অবৈধ সন্তান। আলকমেনে এত সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী যে কবি হেসিয়ডের কথা অনুযায়ী মৃত্যুশীল মানব গর্ভে এমন আর কেউ জন্মাতেই পারে না। থিবস শহরে যখন সে পৌঁছয় এবং তার বিয়ের কথা হয় অ্যাম্ফিট্রিয়নের সঙ্গে তখন সে বেঁকে বসে। আগে তার ভাইদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে, তবে সে বিয়ে করবে। চললো অ্যাম্ফিট্রিয়ন টাফিয়ানস ও টেলেবোনসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তখন। সেই সুযোগ নিলেন দেবরাজ জিউস। তিনি যুদ্ধ থেকে ফেরা অ্যাম্ফিট্রিয়ন সেজে এলেন। আলকমেনের সঙ্গে সহবাস করলেন। এবং কান্ডটা আরো গোলমেলে, কেন না আলকমেন আসলে জিউসেরই পুত্র পারসিউসের সন্তান ইলেকট্রিয়নের কন্যা। জিউস সহবাসের জন্য অ্যাম্ফিট্রিয়নের বিজয় কাহিনী শুনিয়েছিলেন আলকমেনেকে। আর সেদিনই রাত্রে ফিরে আসে আসল অ্যাম্ফিট্রিয়ন। তখন আলকমেনে অবাক হয়ে বলে সে তো একটু আগেই এসেছিল। এবারে জানা যায় জিউসের কান্ড। এবং এর পরে আলকমেনের সঙ্গে সহবাস করে অ্যাম্ফিট্রিয়ন। ফলে সেই রাতেই দুবার গর্ভবতী হয় আলকমেনে।
জিউস অলিম্পাস পর্বতে ফিরে গিয়ে যেদিন জন্ম হবে ওই দুই যমজের সেদিন জানান যে তাঁর ঔরসে এমন এক সন্তান আসছে যে পৃথিবী শাসন করবে ভবিষ্যতে। হেরা তখন খোঁজ নিয়ে সব কান্ড জানতে পারেন এবং জিউসকে দিয়ে শপথ করান যে পারসিউসের বংশধর কোনো সন্তানই একমাত্র পৃথিবীর শাসক হতে পারবে। জিউসের জানা ছিল যে আলকমেনে পারসিউসের বংশধারা। কাজেই তার আপত্তি হয়নি। আলকমেনার গর্ভে যথাসময়ে দুই সন্তানের বীজ জমাট বাঁধলো।একই গর্ভাধান চক্রের সময়কালের এই দুই পৃথক ঔরসের দ্বারা দুই সন্তানের বীজের সম্ভাবনা বা জন্মপ্রক্রিয়ার একটি নাম আছে। তাকে বলে হেটেরোপ্যাটারন্যাল সুপারফেকানডেশন।
জন্মের আগে হেরার খেলা শুরু হল। তিনি অলিম্পাস থেকে নেমে চললেন আর্গোস-এ। সেখানে ইউরিস্থিউসের জন্মের ব্যবস্থা করলেন পারসিউসেরই আরেক পুত্র স্থেনেলাসের স্ত্রী-র গর্ভে।গর্ভধারণের সাতমাসের মধ্যেই হয়ে গেল সেই প্রসব। আর প্রজননের দেবী ইল্লিথিয়াকে দিয়ে আটকালেন হেরক্লেস এবং তার যমজ ভাই ইফিক্লেস-এর জন্ম। ইল্লিথিয়া আড়াআড়ি পা করে বসে রইলেন বলে আলকমেনে জন্ম দিতে পারলেন না হেরাক্লেস-এর। হেরা চেয়েছিলেন এদের জন্মই না হোক। সে প্রচেষ্টা ব্যার্থ করে দিল আলকমেনের দাসী গ্যালান্থেসের বুদ্ধি। গ্যালান্থেস গিয়ে দেবী ইল্লিথিয়াকে বললো যে আলকমেনের সন্তানের জন্ম হয়ে গিয়েছে। শুনে লাফিয়ে উঠলেন ইল্লিথিয়া। ব্যাস- আলকমেনের গর্ভের থেকে হেরাক্লেসদের বেরোনোর রাস্তা গেল খুলে। সেই অপরাধে শাস্তিও হল গ্যালান্থেস-এর। তাকে উইজেল নামের এক ছোট্ট শিকারী স্তন্যপায়ী প্রাণী করে দেওয়া হল। কিন্তু জন্মালো হেরাক্লেস এবং তার সৎ ভাই ইফিক্লেস। পরে এই ইফিক্লেস-এর পুত্রই হবে হেরাক্লেস-এর সারথী।
সে যা হোক সন্তানটির জন্মের সময় থেকেই দেবী হেরা এর ক্ষতি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তিনি হেরাক্লেস-এর মা-র গর্ভে থাকাকালীন যে ক্ষতির শুরুয়াদ করেছিলেন তা জন্মের পরেও অব্যাহত থেকে যায়। যেমন ধরুণ শিশু হেরাক্লেস-এর বিছানায় সাপ পাঠানোর কাহিনীটি। সাপ পাঠানো হয়েছিল। ইফিক্লেস যখন ভয়ে কাঁদছে তখন শিশু হেরালেস অবলীলায় সাপটিকে নিধন করলো হাতের মুঠোয় চেপে। ঐ একই সাপের দমন কৃষ্ণের কালিয়দমন। শুধু সেটা কৃষ্ণের বাল্যলীলার অংশ। এবং সেখানে কৃষ্ণ সাপের মাথায় চড়ে নেচেছিল যমুনা নদীর হ্রদে। আবার হেরাক্লেসের জন্মের পরেই দেবী এথেনা, যিনি হেরার বোন এবং নায়কদের সহায়িকা তিনি তাকে নিয়ে চলে গেলেন হেরার কাছে। হেরার শিশুটিকে দেখে মাতৃস্নেহ প্রবল হল এবং তাকে স্তন্যপান করাতে গেলেন। শক্তিশালী শিশু এমন জোরে স্তন্যপান করলো যে হেরার লাগলো বিষম ব্যাথা। তিনি শিশুটিকে ছাড়িয়ে দিতেই তার মুখ থেকে ছিটকে বেরোলো দুধ। সেই দুধ থেকে জন্মালো মিল্কি ওয়ে নামের ছায়াপথ। এই দুধের কাহিনীই অন্য আকারে আছে পুতনা রাক্ষসীর আখ্যানে। বিষ মাখানো স্তনপান করিয়ে মথুরার অত্যাচারী রাজা কংসের আদেশে কৃষ্ণকে হত্যা করতে এসেছিল পুতনা। কিন্তু শিশু কৃষ্ণ সেই স্তনপানের মাধ্যমেই হত্যা করে পুতনাকে। আবার বলরামের সঙ্গে হেরাক্লেসের মিল শক্তিমতায় এবং হাতের অস্ত্রে। বলরামের ক্ষেত্রে ‘হল’ বা ‘লাঙল’, আর হেরাক্লেসের ক্ষেত্রে সে জায়গায় থাকছে ‘ক্লাব’- একপ্রকার শক্ত ডান্ডা। দুজনেই অমিতবিক্রম। শত্রুর শত্রু এবং মিত্রের প্রাণ। ব্যাস্, এইটুকুই তুলনা করার মতন আছে। এর উপরে ভিত্তি করেই হেরাক্লেসের ভারতীয় জন্ম এবং দেবতা হিসেবে পূজিত হবার গল্প চলে এল মেগাস্থেনিসের ‘ইন্ডিকা’-তে।
এবারে ইন্দ্রের পালা
এখানেই শেষ না। এই কৃষ্ণ-বলরামের গল্পের চেয়ে এক ইঞ্চিও কম বিষ্ময়কর নয় হেরাক্লেসকে দেবরাজ ইন্দ্র বানাবার চেষ্টা। যদিও বজ্রাধিপতি ইন্দ্রর সঙ্গে জিউসের তুলনাটা অনেক সহজ ছিল তবুও হেরাক্লেসকে বেছে নেওয়াটার অন্যতম কারণ হল মেগাস্থেনিসের বিবরণ। জিউসের বজ্র, চরিত্রদোষ, সব সময়ে কেউ তার চেয়ে বড় হয়ে উঠবে এই সব আশঙ্কার অনেকাংশে মিল দেখা যায় ইন্দ্রের সঙ্গে। হেরাক্লেস বারেবারেই বিয়ে করেন এবং স্ত্রীদের হেরার ষড়যন্ত্রে উন্মাদ হয়ে হত্যা করার মতন কান্ড থাকে তা ইন্দ্রের একদমই নেই। অথচ হেরাক্লেসকেই আনা হল তুলনায়। সহজ কারণ হল ভারতের সঙ্গে হেরাক্লেসের সম্পর্ক তৈরী হয়েছে মেগাস্থেনিসের মাধ্যমে, সেখানে জিউসের সঙ্গে এমন কোনো যোগ নেই। শুধু এই হেরাক্লেসই যে ইন্দ্র তা প্রমাণ করার জন্য কতদূর অব্দি গিয়েছেন অ্যালান ডাহ্লাকুইস্ট সেটাই দেখার।
ya anayat paravata suniti turvasam yadum
Indra sa no yuva sakha||
রিগ্বেদের (VI.45.1) এই সুক্তটির এর অনুবাদে তিনি বলছেন যে প্রচলিত অনুবাদটি সঠিক নয়। এখানে হবে তার উলটো মানে। অর্থাৎ যদু ও তুর্বসু ইন্দ্রকে নিয়ে এসেছে হবে, ইন্দ্র এদের নিয়ে এসেছে এই অনুবাদ হবে না। কারণ, এখানে ‘punar’ ও ‘astam’- যার অর্থ ‘আবার’ ও ‘ঘর’ এই শব্দদুটি নেই। সুতরাং ইন্দ্র বিদেশাগত। এই লেখার প্রসঙ্গে ডাহলাকুইস্ট জানিয়েছেন যে তাঁর সুইডিশ পান্ডুলিপি থেকে ইংরেজী অনুবাদের সময়ে তিনি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন এটা বোঝাতে যে তিনি মেগাস্থেনিসের সমর্থন করছেন না, বা বিরোধও করছেন না। তিনি অন্যদের মত কোনো পূর্বধারণা এবং পক্ষপাতের বশবর্তী হয়ে এ কাজ করছেন না। তিনি শুধু অনুসন্ধান করছেন মাত্র। এখানেও তিনি অধ্যাপক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী কৃত অনুবাদের কথা ধারাই নিয়েছেন। রায়চৌধুরী তাঁর লেখায় বলেছিলেন ভারতীয়রা তাদের প্রাচীন বাসস্থানের স্মৃতি মনে রেখেছিল। রিগ্বেদের অন্য একটি সুক্তে I.30.9 তে একজন তাঁর পিতা কথিত ইন্দ্রের কথা বলছেন, যে ইন্দ্র তাঁদের প্রাচীন বাসস্থানের দেব। একটু আগে দেওয়া বৈদিক সুক্তটির কথা উল্লেখ করে তিনি বলছেন যে যদু ও তুর্বসুদের ইন্দ্র নিয়ে এসেছিলেন এ দেশে। আরেকটি সুক্তে ডাহ্লাকুইস্ট দেখাচ্ছেন,
Thus indeed he crossed with them now the Indus|
Thus indeed he fought with them now the veda||
[Rigveda, VII.33.33]
নিজেই এর পরে প্রশ্ন তুলেছেন যে ইন্দ্রের এই আগমন (যদিও এখানে ইন্দ্রের কথা স্পষ্ট করে নেই) কি একবারই হয়েছিল? নাকি অনেকবারের মধ্যে একবারের কথা হচ্ছে? এটা কি অন্য স্থান ছেড়ে চলে আসার যাত্রায় পার হওয়া? এমন নানান প্রশ্নের উত্তর এখানে নেই। কিন্তু অন্য কোথাও যদি খোঁজা হয় তাহলে? সে কথার উত্তরে ওনার উল্লিখিত আরেকটি সুক্তের কথা বলেই আমরা চলে আসবো আমাদের কথায়।
The bull has begotten a bull to fight; he the man, is born of a woman. He who as a General leads the men is a mighty warrior, desirous of combat, courageous.
[Rigveda, VII.20.5]
ডাহ্লাকুইস্ট বলছেন এখানে ইন্দ্রের কথা স্পষ্ট বলা আছে সেনানায়ক হিসেবে। না, কারো নাম নেই। সিন্ধু পার হওয়ার কথা আছে। বেশ আছে। তাতে কি? তাতে মেগাস্থেনিসের হেরাক্লেস আসে কোথা থেকে? যারা বেদের মধ্যে এত কিছু লিখে রাখলো তারা হেরাক্লেস নামটাকে রাখলো না? কেন? উত্তর নেই তার। কিন্তু যা আছে তার রাস্তাটা সোজা। ইন্দ্র এনেছেন যদু ও তুর্বসুদের। যদুরা ইন্দ্রপূজো করে। সে আমরা পুরাণে কৃষ্ণের গিরি-গোবর্ধন তুলে ইন্দ্রের বিরোধ করার কাহিনীতেই জানি। আবার মেগাস্থেনিস বলছেন সৌরশেনীয়রা হেরাক্লেসের পুজো করে। সৌরশেনীয়রা যদুর বংশ। সুতরাং এখানে ইন্দ্র হয়েছে হেরাক্লেস। এভাবেই চলেছে। এরপরে ডাহ্লাকুইস্ট নিয়ে এসেছেন ইন্দ্রের রাজা হবার প্রসঙ্গ এবং শচীর সুক্তটি।শচীর সুক্তে এসেছে ইন্দ্রের কন্যার কাহিনী। শচী তাঁর নিজের কথা বলতে গিয়ে বলছেন এক কন্যার কথা যিনি রাণী হয়েছেন। এর সঙ্গে মেলানো হয়েছে হেরাক্লেসের আপন কন্যা গমনের মেগাস্থেনিস কথিত কাহিনী। আরেক সুক্ত উদ্ধৃত করে ডাহ্লাকুইস্ট দেখাচ্ছেন যে ইন্দ্রও কন্যাগমন করেছেন [x 61.5-10]। শুধু তাই না, সেই কন্যা এর পরে পালিয়ে যায় দক্ষিণাত্যে। কথাটা হল যে সুক্তটি ধরে তিনি এটা দেখালেন সেখানে তিনি নিজেও বলছেন যে কোনো নামের উল্লেখ নেই। তাহলে ইন্দ্র কি করে বোঝা গেল?
বোঝা যায় না। ব্রহ্মার সঙ্গে তাঁর কন্যা স্বরস্বতীর যৌন সম্পর্কের কথাও আছে বেদ-এ। এই সুক্তটি সেই অনুসঙ্গেও হতেই পারে। বেদ সম্পর্কে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা জানেন যে বেদের আখ্যানগুলি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। শুধু তাই নয়, যেহেতু মুখে মুখে তৈরী তাই অনেক সময়েই সেকালের শ্রোতা যে গল্প বা ঘটনা জানেন তার স্বল্প ছোঁয়াতেই সুক্তগুলো শেষ হয়ে যায়। তাই একালে কাহিনীগুলো বোঝা খুব সমস্যার। তার সঙ্গে আছে ভাষার দুর্বোধ্যতা। আছে বহুবার বেদ বিন্যস্ত হবার আখ্যান। বেদ কোনো একজনের লেখাও না। যে কারণে ডুমেজিল বলছেন,
“The authors of the poems who give praise to Indra sometimes make multiple
references to the most diverse parts of this tradition, sometimes exalt one particular point, but they do not trouble themselves to present an episode in full, or to establish, between their allusions to several episodes, a logical or chronological nexus; they do not even confine themselves to one variant…or balk at contradictions in the same hymn: what does it matter, when all the versions of these grand events work together for the glory, the ‘increasing,’ of the god?”
ইন্দ্র রাজা দেবতাদের। হারকিউলিস বা হেরাক্লেস রাজা ছিলেন না। ছিলেন জিউস। আবার হেরাক্লেস-এর মতই ইন্দ্র এক যুদ্ধ দেবতা। কিন্তু জিউস সেই অর্থে কোনো যুদ্ধ দেবতা ছিলেন না। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাচীন মিথোলজির ক্ষেত্রে দেখা যায় যুদ্ধ দেবতাদের ছাঁচটা অনেকটা একই রকম। শত্রুদমন, পররাজ্য দখল, সুরাসক্তি এবং নারী আসক্তিতে ভরপুর তাদের আখ্যান। হেরাক্লেস-এর সঙ্গে গিলগামেশের-ও মিল আছে ইন্দ্রের মতন। ফলে গ্রীক ইতিহাস বলে কথিত এই সব পুরাণ ও ইতিহাস নির্ভর আখ্যানমালায় হেরাক্লেস ইরানও জয় করেছিলেন একই রকমভাবে। কাজেই মেগাস্তেনিসের এই বৃত্তান্ত আমাদের আজকের দিনে আমোদ দতে পারে, ইতিহাসের সন্ধান না। কিন্তু কেন এমন বৃত্তান্ত তৈরী হয়ে থাকে? এ প্রশ্নের উত্তর জানার আগে অলে যাব অন্য এক গ্রীক দেবতার আলোচনায়। সে দেবতার নাম ডাওনিসাস।
আলেক্সান্ডার নয়, প্রথম গ্রীক অভিযান ডাওনিসাসের নেতৃত্বে
প্লিনি, সোলানিয়াস, আরিয়ান এই সব গ্রীকোরোমান ইতিহাসবিদরা বলছেন এমন আক্রমণ আলেক্সান্ডারের আগে ঘটেছে এবং সেটার নেতা ছিলেন ডাওনিসাস স্বয়ং।
কে ডাওনিসাস? ইনি গ্রীক পুরাণের এক দেবতা যাঁর জন্ম গ্রীসের বাইরে এবং যিনি সুরা প্রস্তুত করার রহস্য শিখিয়েছিলেন গ্রীকদের। আরো আছে, ইনিই গ্রীসের প্রখ্যাত নাট্যচর্চার প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এনার উৎসব উপলক্ষেই হত গ্রীসের নাট্যচর্চা। মুখোশ পড়ে এনার মূর্তি বা প্রতীককে সামনে রেখে এক দীর্ঘ্য শোভাযাত্রা হত গ্রীসে, যা যেত থিয়েটার এরিনা অব্দি যে শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ ছিল ওই এরিনাতে নাচ, গান এবং কোরাসের প্রতিযোগিতা। সেই কোরাসের প্রতিযোগিতার প্রথম বিজয়ী যার নাম জানা যাচ্ছে তিনি হলেন থেসপিস। তাঁরই হাতে প্রথম অনুষ্ঠিত হল দেবতা ডায়োনিসাসের বা অঞ্চলগত উচ্চারণ ভেদে ডায়োনুসাসের উদ্দেশ্যে রচিত ট্র্যাজেডি। সেই ট্র্যাজেডির আগেই অবশ্য তিনি সেরার পুরস্কার পেয়েছিলেন একটি ছাগল। গ্রীক এই দেবতার একটি প্রচলিত রূপ হল ছাগল এবং ট্র্যাজেডি শব্দটার মানে ‘ছাগলের গান’।
এই গোটা অনুষ্ঠানটির নাম ছিল ডায়োনিসিয়া। গ্রামাঞ্চলে একরকম হত, আর শহরে আরেকরকম। অবশ্য গ্রামাঞ্চলেরটাই গ্রীসের সবচাইতে পুরোনো ধারা। শহরেরটা তুলনায় নবীন ও ফলে সংস্কৃত। দেবতাটির সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলা খুব জরুরী আমাদের এই আলোচনায় যাওয়ার জন্য। মাইসিনিয়া থেকে শুরু করে গ্রীসের নানাবিধ অঞ্চলে নানাবিধ মত আছে এই দেবতার আগমন সম্পর্কে, কেন না ইনি বহিরাগত। পন্ডিতদের মধ্যেও মতের ছড়াছড়ি। কেউ মনে করেন ইনি এশিয়ার সুদূর পূর্ব থেকে আগত এক দেবতা। আবার কেউ মনে করেন ইনি ফ্রিজিয়া থেকে এসেছেন গ্রীকদের দেবতাসারিতে। কেউ কেউ খুব পুরোনো মিনোয়ান গ্রীকদের মধ্যেও এঁর সদৃশ দেবতার কথা বলেন।
গ্রীক পুরাণের মতে ডাওনিসাস দেবরাজ জিউসের মানবী গর্ভের সন্তান।দেবরাজ জিউসের সঙ্গে মানবী সেমেলে-র সম্পর্কের কথা এক বৃদ্ধা বা ধাত্রীর ছদ্মবেশে জেনে যান দেবরাজ্ঞী হেরা। তিনি সেমেলেকে ওস্কালেন জিউস স্বয়ং এই গর্ভস্থ সন্তানের পিতা কি না তা জানার জন্য। সেমেলে মানবের ছদ্মবেশী জিউসকে যখন বলেন যে এ কথা জানতেই হবে তাকে তখন জিউস বাধ্য হয়ে স্বরূপ ধারণ করেন। সে রূপ বজ্র-বিদ্যুৎ সমন্বিত এক ভয়াবহ রূপ। কোনো মানুষের পক্ষে তা দেখার পরেও আর বাঁচা সম্ভব ছিল না। এবং সেমেলে মারা যান। জিউস তখন গর্ভস্থ ডাওনিসাসকে বের করে নিয়ে নিজের থাই-এর মধ্যে সেলাই করে নিয়েছিলেন। কিছুকাল পরে যখন জন্মের সময় হয় তখন এইজিয়ান সাগরের আইকারিয়া দ্বীপে তাকে নিয়ে যান। সেখানে জন্ম হল ডাওনিসাসের। এবারে গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের কথায় শুনুন বাকীটা।
As it is, the Greek story has it that no sooner was Dionysus born than Zeus sewed him up in his thigh and carried him away to Nysa in Ethiopia beyond Egypt; and as for Pan, the Greeks do not know what became of him after his birth. It is therefore plain to me that the Greeks learned the names of these two gods later than the names of all the others, and trace the birth of both to the time when they gained the knowledge.
—Herodotus, Histories 2.146
এবারে এখানে সমস্যা আছে কয়েকটা। ফ্রিজিয়া বা দূর প্রাচ্যের মতনই স্থান নিয়ে বেশ বিরোধ আছে। আবার কখনো দেখা যায় যে সেমেলে না, পাতালের দেবী পার্সিফোনির গর্ভে জন্ম ডাওনিসাসের এবং রাণী হেরা এ খবর পেয়ে টাইটানদের পাঠায় তাকে হত্যা করতে। টাইটানরা তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে হত্যা করে, তার হৃদয় ছাড়া সব কিছুই খেয়ে নেয়। দেবী আথেনা, রিয়া এবং ডিমিটার তাকে রক্ষা করেন পর্যায়ক্রমে। দেবরাজ জিউস তার হৃদয়টিকে নিজের থাই-এর মধ্যে নিয়ে তাকে আবার জন্ম দ্যান নতুন করে। কোনো কোনো গল্পে জিউস তাকে দিয়ে দ্যান সেমেলের গর্ভে এবং সেখানে আবার জন্ম হয় ডাওনিসাসের।
এই পূর্বোক্ত অংশটুকুর মধ্যেই দেখা যাচ্ছে ভারতীয় পুরাণের নানা অংশের সঙ্গে দেবতাদের কার্যকারীতার অসম্ভব মিল। থাই-এর থেকে সন্তানের জন্ম দেওয়ার এমন আখ্যান ভারতীয় পুরাণেও আছে। তার মধ্যে একটি বিখ্যাত আখ্যান হল নারদের আখ্যান। নারদকে ব্রহ্মা জন্ম দিয়েছিলেন থাই থেকে। আবার দেখা যাচ্ছে মাতৃগর্ভের বাইরে জন্মের অনেক আখ্যানের মধ্যে দুটি বিখ্যাত আখ্যান হল বলরাম এবং দ্রোণের আখ্যান। দ্রোণের ক্ষেত্রে তাঁর পিতা ভরদ্বাজ তাঁর জন্ম দিয়েছিলেন একটি দ্রোণ বা পাত্রের মধ্যে নিজের বীর্য্য ধারণ করে। সে বীর্য্য অপ্সরা ঘৃতাচিকে দেখে তাঁর উত্তেজনার ফল। আবার বলরামের ক্ষেত্রে জন্ম তাঁর মাতৃগর্ভের বাইরে। দেবকীর সন্তান বলরাম বাসুদেবের আরেক স্ত্রী রোহিণীর গর্ভে স্থানান্তরিত হন। এবারে দেখি ডাওনিসাসের দ্বি-জন্মের কাহিনীর মিল ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে কোথায় আছে! প্রথমটি হল জরাসন্ধ। রাজা বৃহদ্রথের দুই পত্নীর গর্ভে ঋষিপ্রদত্ত ফলের দ্বারা জন্ম একটি শিশুর দুটি টুকরোর। সেই টুকরো দুটিকে ফেলে আসা হয়েছিল। তখন জরা রাক্ষসী তাদেরকে জোড়া লাগিয়ে দেওয়ায় জন্মায় একটি শিশু। তার জন্ম জরার দ্বারা এই সন্ধিতে হওয়ায় নাম তার জরাসন্ধ। এমন ভাবেই গান্ধারী যখন কুন্তী প্রথম পান্ডব সন্তানের জন্ম দিয়ে ফেলেছেন এই সংবাদ শোনেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের যে আশা ছিল তার পুত্র প্রথম জন্মে কৌরবদের রাজসিংহাসনে বসবে সেই আশা পূর্ণ করতে না পারায় গর্ভের মধ্যে থাকা পিন্ডের পাত ঘটান, তখন ঋষি বেদব্যাস সেই পিন্ডকে ঘিয়ের মধ্যে রেখে আলাদা আলাদা করে জন্ম দ্যান শত সন্তানের। এখানেই বলে রাখা ভাল যে মহাভারতে কুন্তী না গান্ধারী কে আগে জন্ম দেবে সন্তানের এই প্রতিযোগীটার মিল আছে হেরাক্লেস-এর জন্মের আখ্যানের সঙ্গে। আবার একটি আগ্রহোদ্দীপক মিল হল ডাওনিসাসের দ্বি জন্মের সঙ্গে ব্রাহ্মণের দ্বিজত্বের প্রথায়। ব্রাহ্মণ যিনি হন, তিনি যখন উপবীত ধারণ করেন প্রথম সেইটি তাঁর দ্বিতীয় জন্ম।
এমন নানা মিলের মধ্যে শেষ মিলের কথা বলে চলে যাব আরো বড় প্রসঙ্গে। সেই মিলটি হল ডাওনিসাসের জন্মের পরে একটি কাহিনী অনুসারে দেবরাজ জিউস তাকে দিয়ে আসেন ন্যাসা পর্বতে বৃষ্টির দেবী এক নিম্ফের কাছে। সেইখানে নিম্ফেরা তাঁকে প্রতিপালন করেন। এই নিম্ফ হোলো গ্রীক পুরাণের সেই সব যুবতী কন্যারা যাঁরা অপূর্ব সুন্দরী, যাঁদের সামাজিক অর্থে কখনো বিয়ে হয় না, যে কারোর সঙ্গে তাঁদের ইচ্ছেতেন তাঁরা যৌন সংসর্গে লিপ্ত হতে পারেন। সাধারণ ভাবে এঁদের মৃত্যু নেই, তবে এঁরা অমর এমনও না। গীত, বাদ্যাদিতে এঁরা অসম্ভব দক্ষ। খুব সহজেই এঁদের সঙ্গে মেলানো যায় ভারতীয় পুরাণের অপ্সরাদের। এবং সেই মিল দেখলেই দেখা যায় বাঙালির শারদীয় উৎসবে ও একক ভাবেও পূজিত এক দেবতার সঙ্গে ডাওনিসাসের জন্মের পরের মিল। সেই দেবতাটি হলেন কার্তিক, যাঁকে ছয় কৃত্তিকা অপ্সরারা প্রতিপালন করেছিলেন জন্মের পরে। এখানেই বলে রাখি পৃথিবীর উপরে থাকা আকাশের ধারক দন্ড হিসেবে ন্যাসা পর্বতের মতন ভারতীয় পুরাণের কৈলাস পর্বতেরও বেশ খ্যাতি আছে কিন্তু। ল্যাটিনে এই ধারণ করে রাখার ধারণাটির নাম Axis Mundai।
ফিরে আসি কার্তিকের কাহিনীতে। কাহিনীটি সাধারণভাবে হল শিব সতীর দক্ষযজ্ঞে মৃত্যুর পরে দুনিয়া পরিভ্রমণ করে বেড়াচ্ছিলেন। এমন সময় তারকাসুর ব্রহ্মার কাছে বর লাভ করে যে শিবের সন্তান ছাড়া কেউ তাকে বধ করতে পারবে না। সেই সুযোগে মর্ত্য থেকে দেবলোক সব অধিকার করে ফ্যালে। তখন ব্রহ্মার কাছে দেবতারা যান এবং ব্রহ্মা-বিষ্ণুর পরামর্শে কামরাজ মদনকে পাঠানো হয় শিবের সঙ্গে শিবের সাধিকা পার্বতীর মিলন ঘটানোর জন্য। কিন্তু মদন শিবের সাধনাভঙ্গ করায় শিবের তৃতীয় নেত্রদ্বারা ভষ্মীভূত হয়। তখন দেবতারা সকলে এসে অনুরোধ করায় শিব পার্বতীকে বিয়ে করেন। কিন্তু শিবের বীর্য্য ধারণে পার্বতী একা অক্ষম হওয়ায় তাকে দেব অগ্নির কাছে দেওয়া হয়। অগ্নিও পারেন না। তখন দেবনদী গঙ্গার কাছে সে বীর্য্যকে রাখা হয়। সেই বীর্য্য থেকে ছটি সন্তান জন্মায় কালে কালে, যাঁদেরকে পালন করেন কৃত্তিকারা। এবারে পার্বতী সেই ছটি সন্তানকে জুড়ে একটি সন্তানে পরিণত করেন। তিনি দেব কার্তিক। এখানেও আরেকটি খুব কৌতুহলজনক মিল হল এই কৃত্তিকারা গ্রীক পুরাণের প্লেইয়াডেস নামের সাত নিম্ফের মতন যারা আবার ডাওনিসাসের শিক্ষাদাত্রী। এদের প্রসঙ্গ এবারের মত শেষ করে আপাতত ডাওনিসাসের কথাটা হয়ে যাক।
ডাওনিসাসকে যে শিক্ষাই দেওয়া হয়ে থাকুক না কেন তিনি আদতে এক বুনো দেবতা। শোভাযাত্রায় তাঁর রথ টানতো সিংহ জাতীয় কোন হিংস্র পশু। শোভাযাত্রার সামনের সারিতে থাকতো মেইনেডরা, যাঁরা নারী এবং মদিরাপানে উন্মত্তপ্রায়, আর ভাবাবেশে নেচে চলেছেন রাস্তা জুড়ে। তারপরেই থাকতো স্যাটিররা, যাঁদের গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী উর্দ্ধাঙ্গ মানুষ, অধোভাগ ছাগলের মতন দেখতে। সেই সাজে সাজতো একদল ভক্ত। অন্যদল নানা বাদ্যযন্ত্র কিম্বা থিয়ারসাস জাতীয় অস্ত্র হাতে অংশ নিত সেই শোভাযাত্রায়। তাই এই ডাওনিসিয়ান রাইটের আরেকটি নাম ছিল থিয়াসাস। এবং সেই থিয়াসাস কালে কালে প্রভাবিত করেছিল রোমান জেনারেলদের বিজয়ের পরে রোমে অনুষ্ঠিত শোভাযাত্রাকেও। সেই প্রভাবের সূত্রে আমরা পেয়ে যাই রোমান কবি নোন্নাসের ‘ডাওনিসিয়াকা’ নামের এক বিপুল কাব্যগ্রন্থকে। এই ‘ডাওনিসিয়াকা’-তে থিয়াসাস-এর চরম উদাহরণ হল দেব ডাওনিসাসের ভারত বিজয়ের পরে গ্রীসে ফেরার শোভাযাত্রা। সেই শোভাযাত্রার বর্ণণা এমনকি প্রভাবিত করেছিল রোমান জেনারেলদের বৈদেশিক বা বড় কোনো বিজয়ের পরে রোমের ফেরার শোভাযাত্রার পদ্ধতিকে। কিন্তু যে দেশের বিজয় অভিযান থেকে ফেরার পরের এমন শোভাযাত্রা সে দেশের সঙ্গে এই দেবতাটির সম্পর্ক ঠিক কেমন তা এবারে জানা দরকার।
প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসে ডাওনিসাস ও ভারত সম্পর্ক- যুক্তি, তক্ক আর গপ্পো
গল্পটা মোটামুটি একই রকমের। আলেক্সান্ডারের ভারত আক্রমণের প্রায় ৬৪৫১ বছর ৩ মাস আগে ডাওনিসাস এসেছিলেন ভারত আক্রমণ করতে। আলেক্সান্ডার আসা অব্দি সময়ের মধ্যে এখানে রাজত্ব করেছেন প্রায় ১৫৩ থেকে ১৫৪ জন রাজা- যাদের মধ্যে ডিওনিসাস নামের তিন রাজাও ছিলেন। একথা আমাদের জানাচ্ছেন ডিওডোরাস সিকুলাস (৬০-৩০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) নামের এক সেকালের গ্রীক ঐতিহাসিক। এই তিন রাজার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ডাওনিসাস-ই হলেন আমাদের আলোচ্য দেবতা। তিনি ৫২ বছর রাজত্ব করেছিলেন এবং শেষে বৃদ্ধ বয়সে মারা যান স্বাভাবিক ভাবে। আরেকজন প্রাচীন গ্রীক ঐতিহাসিক মেগাস্থেনিসের বই-এর অংশ তুলে দিচ্ছেন এই আলোচনায়। নীচে সেই অংশটি দেওয়া হল।
“Dionysus founded cities and gave laws to those cities and introduced the use of wine among the Indians as he had done among the Greeks, and taught them to sow land, himself supplying the seeds…”
- Arrian, Indica
কিন্তু ডাওনিসাসের মৃত্যুর বিষয়টি এখানে কিছু জটিলতার সৃষ্টি করছে। সে জটিলতা কাটাতে আছে ডিওডোরাস সিকুলাসের ভাষ্য।
“Then he made a campaign into India, whence he returned to Boeotia in the third year bringing with him a notable quantity of booty, and he was the first man ever to celebrate a triumph seated on an Indian elephant..And the Boeotian and other Greeks and the Thracians, in memory of the campaign in India, have established sacrifices every other year to Dionysus.”
-Diodorous Siculus
কাজে কাজেই গ্রীক সূত্রানুসারে আলেকক্সান্ডারেরও আগে ছিল গ্রীক বিজয়ীরা। চাই কি এভাবেও বলা যেতে পারে যে গ্রীকরাই ভারতে সভ্যতা বলতে যা বোঝায় তার সূত্রপাত করেছিল। মজা হল এই যে এ কথার কোনো মানেই নেই ইতিহাসগত ভাবে। কেন নেই সেটা বোঝার জন্য আমরা প্রথমে ধরি দেবরাজ ইন্দ্রের কাহিনীটি। তাহলেই বেশ কিছুটা সমস্যা পরিস্কার হয়ে যাবে।
কিছু আগে কথা প্রসঙ্গে লিখেছিলাম ইন্দ্রের সঙ্গে ইরাকি নায়ক গিলগামেশেরও যথেষ্ট মিল। আক্কাডিয়ান কিউনিফর্ম অনুযায়ী যিনি গিলগামেশ তিনিই সুমেরিয়ান টেক্সট অনুযায়ী বিলগামেশ। আবার বহুকাল পরে আরবীতে তিনি এক দানব জিলজামিশ। তাঁর প্রসঙ্গে ররাজা অভিধাটি বারেবারে ঘুরে আসে। তিনি উরুক নগরের ধারের এক শক্ত প্রাকার তৈরী করেন যা তাদের রক্ষা করতো বহিঃশত্রুর হাত থেকে। ইন্দ্র-ও এমনি বৃত্রাসুরকে বধ করে তাঁর প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন তাঁর গোষ্ঠীর জন্য সূর্য ও জলকে মুক্ত করে। গিলগামেশ এক ঐতিহাসিক চরিত্র বলেই মনে করা হয়। ইন্দ্র পৌরাণিক চরিত্র হলেও এভাবে ভাবাই সম্ভব যে তিনি কোনো প্রাচীন বীরের স্মৃতিতে গঠিত এক দেবতা। যেমন গিলগামেশ এককালে দেবতায় পরিণত হয়েছিলেন।
আবার ইন্দ্রের সঙ্গে অসম্ভব মিল আরেক ইরানীয়ান বীরের। আবেস্তা অনুযায়ী যাঁর নামের সঙ্গে উপাধি হল ‘ভিরিথ্রাঘ্ণ’ (Veretraghna)। তিনি অজি দহকা নামের অসুরকে দমন করেছিলেন। আবার বৃত্রাসুরকে দমন করার পরের থেকে ইন্দ্রের উপাধি ‘বৃত্রাহন’ হয়। এই ইরানীয়ান নায়কের নাম থ্রায়েটোনা। আরো অনেক মিল আছে এনার সঙ্গে। ‘অহি’ (শত্রু) যা বৃত্রের অন্য পরিচয় সেই পরিচয়ের সঙ্গে মিল আছে ‘অজি’-র। দুজনের অস্ত্রের নামও কাছাকাছি। ইন্দ্রের অস্ত্র ‘বজ্র’, থ্রায়েটোনার ক্ষেত্রে ‘ভজ্র’ নাম সে অস্ত্রের। আবার ‘ভজ্র’ বা ‘বজ্র’ অনেকটাই হেরাক্লেস-এর ‘ক্লাব’ জাতীয় অস্ত্রের সঙ্গে মিলে যায়।
এখানে একটা ইরানীয়ান পৌরাণিক কাহিনী জানালে ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা বোঝানো সহজ হবে। থ্রায়েটোনা তাঁর তিন সন্তান সালম, তোজ আর এর্জি-র মধ্যে পৃথিবী ভাগ করতে বসলেন। প্রথম সন্তান চাইলো সম্পদ, তাই তিনি তাকে দিলেন পশ্চিম অংশ। দ্বিতীয় সন্তান চাইলো বীরত্ব। তিনি তাকে দিলেন পূর্বদিক। আর ছোট ছেলে চাইলো আইন ও শৃঙ্খলা। তাই তিনি তাকে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট অঞ্চল দুটি দিলেন। সেই অঞ্চল দুটি হল ইরান ও ভারত। ইন্দ্র যেমন সোমরসিক, জন্মের কিছু পরেই ইন্দ্র সোমরস পান করতে শুরু করেন এবং বিপুল চেহারা ধারণ করেন সোম পান করলেই, এই থ্রায়েটোনাও পৃথিবীর প্রথম চারজনের মধ্যে একজন যিনি ‘গাওকেনেরা’ গাছের থেকে ‘হাওমা’ তৈরী করেন, যা স্বর্গীয় পানীয়। আবার এই পানীয় সূত্রেই এঁর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ফেলা যায় ডাওনিসাসের।ডাওনিসাস হলেন মদিরার গ্রীক দেবতা। তিনিও দেবতা ও মানবের সংমিশ্রণ। সুতরাং এ পরিচয়গুলো দিয়ে আসলে কিছুই প্রমাণ করা যায় না। তবু এই জাতীয় প্রমাণেড় প্রচেষ্টা বারেবারেই উঠে আসে। তার কারণগুলোকে কিছুটা বোঝার মাধ্যমেই আমরা এই লেখা সমাপনের দিকে যাব।
সভ্যতা, সাম্রাজ্য ও গৌরবগাথা
আলেক্সান্ডার এমন একটা দেশে পৌঁছোলেন যেখানে চাষ হয়, যেখানে সম্পদ সঞ্চিত হয়েছে। যেখানে মানুষ গ্রাম, নগর সব মিলিয়ে এক সভ্যতা গড়ে তুলেছে যা খুব দুর্বল নয়। বহুলাংশে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর নিজের রাজ্য ম্যাসিডোনিয়া তাঁর পিতা ফিলিপের আগে অব্দিও গ্রীক বলেই স্বীকৃতি পেত না বাকী নগর-রাষ্ট্রগুলোর কাছে। এথেনস বা স্পার্টা বা থেবস মনে করতো ম্যাসিডোনিয়ানরা বর্বর। তাদের গণতন্ত্রহীনতা, বংশপরম্পরায় রাজশাসন, রাজার বহুবিবাহ তাদের কৃষিসভ্যতা সমস্ত কিছুই তাদের অ-গ্রীক করে রেখেছিল। কিন্তু ফিলিপস এবং তাঁর নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এক সময়ে তাঁকে সমস্ত গ্রীসের ‘হেজিমন’ বা একচ্ছত্র অধিপতি করে তুলেছিল।
কিন্তু রাস্তাটা ছিল রক্তাক্ত। পিতা ফিলিপসের প্রবল ভালবাসা থেকে যে যাত্রা শুরু সে যাত্রাপথে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, মায়ের প্ররোচনায় পিতার অন্য স্ত্রী-র গর্ভের সন্তানের হাতে যাতে ক্ষমতা চলে না যায় তার দিকে সতর্ক থাকা, নিজস্ব সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা সবই ছিল। এমনকি হয়তো বা পিতাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করাও আসলে তাঁরই কাজ ছিল শেষত। তাঁর মা ওলিম্পিয়া ছিলেন অতি উচ্চাভিলাষীণি। এতটাই যে, নিজের স্বামীর নিজের দেহরক্ষীদের সর্দারের হাতে গুপ্তহত্যার পরে পরেই স্বামীর অন্য প্রিয়তমা পত্নীকে তার কন্যা সমেত জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলতেও দ্বিধা হয়নি তাঁর। সবটাই, সমস্তটাই ক্ষমতার লোভে।
সে ক্ষমতা হাতে পেলেও এশিয়া অভিযানের আগে অব্দি আলেক্সান্ডার কখনো তার পরিপূর্ণ স্বাদ পাননি। ম্যাসিডোনিয়া রাজাশাসিত রাজ্য হলেও সেখানে রাজা কিন্তু দরবারের সদস্যদের ধরা ছোঁয়ার বাইরের কিছু ছিল না। রাজাকে যে কোনো কাজই করতে হত অভিজাতদের পরামর্শ নিয়ে, যারা জমি জমা এবং দাসেদের মালিক ছিল। এশিয়াতে একের পরে এক রাজ্য জয় করতে করতে দেখলেন এখানে এক রাজতন্ত্র চলে বিভিন্ন জায়গায়, যে রাজতন্ত্রের মূল শক্তির উৎস হল দৈবী ক্ষমতা। রাজারা দেবতার বংশধর। মিশরে বা তখনকার ইজিপ্টে প্রথম এমন এক দৈবী ক্ষমতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটলো বিজিত মিশরের পুরোহিতদের তাঁর প্রতি উপাধি বর্ষণের কল্যাণে। এরপরে জেরুসালেম কিম্বা পারস্যেও একই অভিজ্ঞতা হল তাঁর। পারস্যের রাজধানীতে যে আলেক্সান্ডার এসে পৌঁছেছিলেন সেই আলক্সান্ডার শুধুমাত্র আর গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের ছাত্র নন, সামরিক শক্তি ও বুদ্ধিমত্তায় অতি কৌশলী যোদ্ধা-সেনাপতিই নন, তিনি নিজে এক রাজদর্শনের সূচনা করছেন তখন। পারস্যর রাজাদের মত আলখাল্লা পরা থেকে শাহেনশাহ উপাধি ধারণ, কিম্বা দরবারের হস্ত চুম্বন বা সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতের প্রথা তখন তাঁর মাথায় ঢুকে গিয়েছে। নিজেকে ঈশ্বর ভাবছেন তিনি। এই ভাবনা তাঁর বিরুদ্ধে তাঁরই ম্যাসিডোনিয়ান সেনাবাহিনী এবং সঙ্গীদের মধ্যে বারেবারে বিক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে।
তার সঙ্গে রয়েছে নতুন নতুন সাম্রজ্যের বিজিত অংশের পুরানো সেবকদের সঙ্গে তাঁর সঙ্গীদের ক্ষমতার বাঁটোয়ারা নিয়ে স্বার্থের লাগাতার দ্বন্দ্ব। নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভব ঘটাতে চেষ্টা করছেন সেই সব দ্বন্দ্ব সমাধান করতে। তাঁর করা সমাধানের থেকে সূত্র নিয়েই একদিন ভারতের বিজয়ী মুঘল বাদশাহ আকবর ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে বিয়ে থেকে শুরু করে, অধীকৃত অঞ্চলের রাজকর্মচারী এবং সেনানায়কদের সাম্রাজ্যের সঙ্গে স্বার্থের সূত্রে বেঁধে ফেলার পদ্ধতি নেবেন নিজের সাম্রাজ্য বাড়াতে ও রক্ষা করতে। আলেক্সান্ডার তো সেকেন্দর শাহ-ও বটে। আকবর তাঁর কাহিনী জানবেন না তা হয় না। অর্থাৎ একদিকে নিজের ভূমিতে পরিচয়ের এবং যথাযথ স্বীকৃতির অভাব, ব্যাক্তিগত দক্ষতার পরিপূর্ণ সম্মাননাপ্রাপ্তির অমিত ইচ্ছে, অন্যদিকে অন্যতর ভূখন্ডের থেকে প্রত্যাশার অধিক প্রাপ্তি- এই দুই-এর সংমিশ্রণ হল আলেক্সান্ডারের রাজনৈতিক দর্শন।
এই দর্শনে ভারতের ঠাঁই-ও হয়েছে। গ্রীকরা ভারতের কথা জেনেছে এশিয়া মাইনরের সূত্রে। জেনেছে পারসিক সাম্রাজ্যের সূত্রে। পারসিকরা যখন গ্রীস জয় করে তখন থেকেই তাদের নানা ভাষা, নানা ধর্মীয় কর্মচারীদের মধ্যে একাংশ গ্রীকও বটে। এছাড়াও ছিল বাণিজ্য সূত্রে জানাও। আক্লেক্সান্ডারও জেনেছিলেন। এই পারসিক আকামেনাইড সাম্রাজ্যের ভারতীয় যোদ্ধারাও সূত্র ছিল যারা গ্রীস আক্রমণেও গেছিলো ৪৮০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ-তে। আবার পারসিক বাহিনীর অন্তর্গত ভারতীয়দের সঙ্গে আলেক্সান্ডারের গ্রীক বাহিনীর যুদ্ধও হয়েছিল ৩৩১ খীঃপূর্বাব্দে। আলেক্সান্ডারের আগের গ্রীক সূত্রগুলো যেমন হেকাটাইওস, হেরোডোটাস কিম্বা পারসিক সম্রাট আর্টেক্সেরেস মেমন-এর ব্যাক্তিগত গ্রীক চিকিৎসক কটেসিয়াস এভবেই জেনেছেন ভারত সম্পর্কে। সে ভারত এক অদ্ভূত দেশ। সে দেশে নানা অদ্ভূত ব্যাপার-স্যাপার ঘটে। আজিব তার জীব-জন্তু-মানুষ। তাদের শক্তি প্রচুর, কিন্ত তারা পররাজ্য দখলে ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে যায় না। এমন ভাবে নানা গল্প-গাথার মাধ্যমে তাদের লেখায় তথ্য সংগৃহীত হয়েছে বলে তাদের ব্যাখ্যান বা বয়ান হয়েছে বিচিত্র। যেমন হেরোডোটাস পারসিক ও বৈদিক ভারতীয়রা উভয়েই পূজো করেন এমন দেবতার কথা বলতে গিয়ে বলছেন মিত্র-র কথা। মিত্র অর্থাৎ সূর্যদেব। কিন্তু হেরোডোটাস তাঁকে দেবী করেছেন, তিনি হয়ে গিয়েছেন মিত্রা। এমন নানা সূত্র থেকে আলেক্সসান্ডারও জেনেছিলেন গ্রীক দেবতা ডাওনিসাসের ভারত আক্রমণের কথা অবশ্যই। সেখান থেকেই তাঁর রাজদর্শনের সূত্রে নতুন অবতার হিসেবে তাঁর আগমনের স্বপ্নও মনের কোণে ঠাঁই নিতে পারতো। সেই স্বপ্ন প্রভাবিত করতে পারতো তাঁর সঙ্গী মেগাস্থেনিসের বিবরণকেও।
কেন এ কথা তার জন্য একটি সুত্র উদ্ধৃত করি এখানে। ই আর বিভান তাঁর ‘ইন্ডিয়া ইন আর্লি গ্রীক অ্যান্ড রোমান লিটারেচার’ লিখছেন,
“One member of Alexander’s suite, his chief usher (είσαγγελεύs), Chares of Mytilene, is quoted as saying the Indians worshipped a god Soaroadeios, whose name being interpreted meant ‘maker of wine’. It is recognized that the Indian name which Chares must have heard was Sūryadeva, ‘Sun-god.’ Some ill-educated interpreter must have been mislead by the resemblance of sūrya ‘sun’ to surā ‘wine.’Even Megasthenes depended, of course, mainly upon his Indian informants for knowledge of the peoples on the borders of the Indian world, and he therefore repeated the fables as to the monstrous races with one leg, with ears reaching to their feet and so on, which had long been current in India and had already been communicated to the Greeks by Scylax and Hacataeus and Ctesias.”
তা সূর্য যদি সুরা হয়ে ওঠে আলেক্সান্ডারের নিজের লোকের কাছে তাহলে ডিওনিসাসের বা হেরাক্লেস-এর পূজো কৃষ্ণ-বলরাম বা শিবের হয়ে উঠতে অসুবিধে কি? বরং আলেক্সান্ডার এবং তাঁর পরবর্তী এশিয়ান হেলেনিয়ান শাসকদের কথা ধরলে তাঁরা নিজেদের দেবতার অংশ বা বংশধর হিসেবেই দেখাতে চাইতেন যখন, তখন এ তো সুবিধেই দেবে। এই সৌরশেনীরা মথুরায় হেরাক্লেস পূজো করে এই কাহিনীটা আরো আরো অনেক জোর পেয়ে যেত যদি আলেক্সান্ডার সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের শাসক হয়ে উঠতে পারতেন। ব্রিটিশ বা ইউরোপিয়ানরা এই উপমহাদেশ দখল করার পর থেকে আর্যরা এসে ভারত সভ্যতার সব উৎকৃষ্ট ফসল ফলিয়েছে এবং তার আগে কিছুই ছিল না, বা এখানকার আগের অধিবাসীদের এতে প্রায় কোনো অংশভাগ নেই জাতীয় যে আখ্যান সিন্ধু সভ্যতায় বেশ কিছুটা মার খায়, তেমনই অল্প-বিস্তর মার খেত- কিন্তু মোটের উপর এটাই বেশ শক্ত মত হয়ে জাঁকিয়ে বসতে পারতো ইন্ডোলজির বাজারে। সাম্রাজ্যের গৌরব, বিজয়ীর গর্বিত বংশধারার প্রতিষ্ঠা এতে সুবিধাজনক হয়। খেয়াল করে দেখলে দেখা যাবে আলেক্সান্ডারের মতনই দীর্ঘ্য ঐতিহাসিক সভ্যতার স্বীকৃতির অভাব ব্রিটিশদেরও ছিল, সেই জন্যেই পালে হাওয়া পেয়েছিল ইন্ডোলজির এরিয়ান তত্ত্ব। আলেক্সান্ডারের দুর্ভাগ্য যে তিনি এই উপমহাদেশ জয় করতে পারেননি। নইলে ওই মার্ক টোয়েনের মতামত ধরেই বলা যায় এই জাতীয় ইতিহাসের ‘প্রেজুডিস’-এর কালিতে ভারতীয় সভ্যতাটার জন্মই হয়তো হয়ে দাঁড়াতো গ্রীক সভ্যতার ছত্রছায়ায়। আলেক্সান্ডার হয়ে দাঁড়াতেন ডাওনিসাসের বংশধর যিনি দেবাদেশে ভারত জয় অরতে এসেছিলেন ভারতীয়দের অধোগতি থেকে রক্ষা করতে।
1 টি মন্তব্য:
অসামান্য তথ্য পরিবেশন করলেন। ধন্যবাদ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন