লিখেছেন : ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য
হিন্দু
শাস্ত্রমতে, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। আর তাই তিনি ইচ্ছে করলেই যেকোনো সময়
যেকোনো কাজ সম্পাদন করতে পারেন এবং ইচ্ছে
করলেই যেকোনো সময় যেকোনো রূপও ধারণ করতে পারেন। তাঁর নিরাকার রূপের নাম ব্রহ্ম; আর সাকার রূপের নাম দেবতা। ঈশ্বরের নিরাকার রূপটি নির্দিষ্ট হলেও সাকার রূপ
অনির্দিষ্ট। মানুষের জ্ঞাত-অজ্ঞাত যেকোনো রূপ ধারণ করার ক্ষমতা তাঁর আছে বলেই এ রূপটি নির্দিষ্ট
নয়। অবশ্য সব সময় যে তাঁর রূপ নিজের ইচ্ছার ওপরই নির্ভরশীল এমন
নয়। ভক্তের ইচ্ছার ওপরও অনেক সময় এই রূপ
নির্ভর করে। অর্থাৎ
কোনো মানুষ যদি ভক্তির সঙ্গে
যেকোনো বাস্তব, অবাস্তব ও কাল্পনিক কিংবা অন্য কোনো রূপে
তাঁকে আরাধনা করে; তবে সেই রূপেও তিনি তাঁকে কৃপা করতে পারেন। ঈশ্বরের রূপ
তাই মুখ্য নয়; ভক্ত কোন আকৃতিতে তাঁকে আরাধনা করল এটা কোনো বিষয় নয়; তাঁর ভক্তি, শ্রদ্ধা ও উদ্দেশ্যই সর্বাপেক্ষা
গুরুত্বপূর্ণ।
ঈশ্বরের সঙ্গে হিন্দুদের মূলত প্রেমের
সম্পর্ক বিদ্যমান। এই প্রেমের একটি সখ্য প্রেম; অন্যটি বাৎস প্রেম। অর্থাৎ
হিন্দুরা প্রধানত দুটি রূপে তাঁকে আরাধনা করে। এর একটি প্রেমিক রূপ; অন্যটি মাতৃরূপ। নিজেদের শ্রীরাধিকা তথা প্রেমিকা ভাবে ভাবিত করে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমে বিভোর হওয়া এক
ধরনের সাধনা। আবার নিজেদের
সন্তানরূপে সজ্জিত করে ঈশ্বরকে মায়ের আসনে স্থান দেওয়া অন্য আরেক ধরনের উপাসনা। দুই স্থলেই গভীর প্রেম ঈশ্বর ও মানুষের
মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে। কোন
প্রেমের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি, তা অবশ্য বলা
দুষ্কর। কখনো মনে হতে পারে
প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেম, আবার কখনো মা-সন্তানের প্রেম। তবে যে প্রেমই বড় হোক না কেন; বাঙালি এখন দুই ভাবেই তাঁকে ভজনা করে। অবশ্য
নিজেকে দাস হিসেবে কল্পনা করে; কৃষ্ণকে প্রভু হিসেবে আরাধনা করার চিত্রও
বাংলায় দুর্লক্ষ্য নয়।ঈশ্বরের মাতৃরূপের নাম দুর্গা। তিনি দুর্গতি নাশ করেন বলে দুর্গা; আবার দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছেন বলেও দুর্গা। অবশ্য তিনি মহিষাসুরকে সংহার করেছেন বলে মহিষাসুর মদিনী এবং জগতের সব শক্তি ও মায়ার আধার বলে মহামায়া-মহাশক্তি। বিভিন্ন গুণ ও রূপের ওপর ভিত্তি করে অবশ্য তাঁকে চণ্ডী, কালী, তারা, কাত্যায়নী, উমা প্রভৃতি নামেও সম্বোধন করা হয়। তবে রূপ তাঁর যতই বৈচিত্র্যময় হোক না কেন; দুর্গার মূল পরিচয় শক্তি দেবী হিসেবে। তিনি ঈশ্বরের শক্তির প্রতীক। বিশ্বের সব শক্তির উৎস হিসেবে তাঁকে কল্পনা করা হয়। আর তাই ত্রেতা যুগে অবতার রামচন্দ্র রাবণ বধের আগে এই দেবীর পূজা সম্পাদনা করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়; দ্বাপর যুগে অবতার কৃষ্ণও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অব্যবহিত আগে অর্জুনকে দুর্গার আরাধনা করার জন্য দিয়েছিলেন পরামর্শ (দ্র. মহাভারত-ভীষ্মপর্ব)।
পুরাকালে দশ দিক থেকে শক্তি সংগ্রহ করে মহিষাসুর নামক এক মহাপরাক্রমশালী দৈত্যকে দেবী দুর্গা পরাস্ত করেন। উল্লেখ্য, মহিষাসুর ঈশ্বরের একসময়কার পরম ভক্ত। কঠোর তপস্যা দ্বারা তিনি কোনো একসময় স্রষ্টাকে সন্তুষ্ট করেছিলেন। তবে আনন্দিত স্রষ্টা যখন তাঁকে প্রসন্ন চিত্তে কিছু বর দিতে আগ্রহী হলেন; তখন মহিষাসুর কেবল অমরত্বের বর চাইলেন। অন্য বর কামনার জন্য বারবার অনুরোধ করার পরও মহিষাসুর যখন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল রইলেন; তখন সৃষ্টিকর্তা তাঁকে সেই বর দিয়ে দিলেন। কিন্তু এই বরপ্রাপ্তির পরই মহিষাসুরের চেহারা পাল্টে গেল। তিনি ত্রিভুবনের অধীশ্বর হয়ে সর্বসুখ ও ভোগের মালিক হওয়ার জন্য শুরু করে দিলেন ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা। তাঁর এই নিষ্ঠুরতা এমন একটা পর্যায়ে গেল, দেবতারাও হলেন স্বর্গচ্যুত।
স্বর্গচ্যুত দেবতারা এতে ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন এবং তাঁদের ক্রোধরাশি থেকে তৈরি হতে থাকল তেজদীপ্ত মহাশক্তি। এই মহাশক্তি আর কিছুই নয়; এই শক্তিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত শক্তি; সব দেবতার সম্মিলিত শক্তি; নারীরূপধারিণী মাতৃস্বরূপা দেবী দুর্গা। জগতের সব শক্তি একত্রভাবে সঞ্চিত হয়েই দেবী দুর্গারূপে আসেন মহিষাসুর দমনে।
কিন্তু মহিষাসুর তো অমর; অজেয়। তাঁকে কিভাবে সংহার করা যায়? দেবতারা স্রষ্টা (ব্রহ্মা) প্রদত্ত বরকে খানিক নিরীক্ষা করলেন এবং এরই ফাঁকে নির্ণয় করে দুর্গার হাতে তুলে দিলেন অস্ত্র। দেবী দুর্গা অস্ত্র হাতে পেয়ে হুংকার দিয়ে উঠলেন; ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুর ওপর। কিন্তু অশুভশক্তি বহুরূপী। বারবার সে রূপ পাল্টায়। তাকে চিহ্নিত করাই একসময় দুর্গার জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তার পরও তিনি মহাশক্তি; বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হলেও একসময় ঠিকই তিনি শত্রুকে চিহ্নিত করতে পারেন এবং পদানত করে তার বক্ষে বসিয়ে দেন শূল।
তবে দেবতার (ব্রহ্মা) বর একেবারে বিফলেও গেল না। আসুরিক শক্তি সব সময়ই রয়ে গেল জগতে। ভালোর সঙ্গে মন্দ কাজও চলতে থাকল তার নির্দিষ্ট গতিতেই। অবশ্য শূলবিদ্ধ অসুরের পক্ষে যেমন যুদ্ধ জয় করা অসম্ভব; তেমনি শুভশক্তির পদানত অবস্থায় অশুভশক্তির চূড়ান্ত বিজয় লাভ করাও দুষ্কর। আসুরিক শক্তি তাই শূলবিদ্ধ অবস্থায়ই দুর্গার পদতলে রয়ে গেল চিরকাল।
পৌরাণিক কাহিনী বরাবরই প্রতীকনির্ভর। এসব কাহিনীর সত্যতা-অসত্যতায় কিছু আসে যায় না। কাহিনীর সত্যতার চেয়ে এর অভ্যন্তরীণ তাৎপর্য বা ব্যঞ্জনাই মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ থেকেই মানুষ নিজেকে তৈরি করতে শেখে এবং তার কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারে। এতদ্ব্যতীত ঈশ্বর যেহেতু উপনিষদে ভক্তকে যেকোনো রূপে তাঁকে উপাসনা করার অনুমতি দিয়েছেন; তাই ১০ হাত ও ত্রিনয়নারূপী এই দেবীকে ঈশ্বর হিসেবেই ভক্তরা উপাসনা করতে পারেন এবং করেন।
বস্তুত মায়ের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক অচ্ছেদ্য; সব প্রিয় বস্তুকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করা তার চিরন্তন স্বভাব। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির মতো ঈশ্বরকেও বহু আগ থেকেই একদল মানুষ তাই মায়ের চোখে প্রত্যক্ষ করে আসছে। এ যুগেও ঘটেনি এর ব্যত্যয়। জগন্মাতা দেবী দুর্গা আজও বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় আশ্রয়। মহাশক্তি দেবী দুর্গার পূজা আজ অবধি তাই বাঙালি হিন্দুর সর্বাপেক্ষা বড় উৎসব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন